1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

তু লাল পাহাড়ীর দেশে যা

ছবি : ইন্টারনেট 

 তু লাল পাহাড়ীর দেশে যা

রাজশ্রী দে 

দত্ত বাড়িতে প্যান্ডেল বাঁধা হচ্ছে , দুদিন পরে তাদের বড় মেয়ের মিষ্টির বিয়ে  |দত্তদের  অবস্থা বর্তমানে সাধারণ| তবে এককালে ছিল বিশাল  , তবে  খারাপ হয়ে গেলেও বনেদিয়ানার  কিছু  লেশ এখনও  আছে | তা প্রকাশ  পায়  বিশেষত বাড়ির  কর্তাদের কথাবার্তায়  ,আচার আচরণে |মিষ্টি অবশ্য   বাড়ির সব প্রথা ভেঙে তার ক্লাসমেট  নীলকে  বিয়ে করছে বাড়ির অমতে |নীল একটা প্রাইভেট  কোম্পানিতে জব করে  , এখানেই বাড়ির সকলের অমত | তাঁরা চায় মেয়ের  অন্য কোথাও ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার , প্রফেসর  অথবা   কোনো মাল্টিন্যাশনাল  কোম্পানির  চাকুরীরত কারো   সঙ্গে  বিয়ে হোক | কিন্তু মিষ্টির জেদের কাছে হার মেনেছে সবাই| যাইহোক এবার বিয়ে বাড়ির অন্দর মহলে ঢুকে পরি ........

 মিষ্টি দত্ত বাড়ির বড় ছেলে সুধীর দত্তের একমাত্র মেয়ে , মেজো ও সেজো ভাইয়ের দুটি করে ছেলে l

এক  এক করে সব দূরের আত্মীয়রা চলে  এসেছে | মিষ্টির মামাবাড়ি জলপাইগুড়িতে, সেখান থেকে এসেছে দুই মামার পরিবার | তারপর   মাসি পিসিরাও এসে পরেছে প্রথম বাড়ির মেয়ের বিয়েতে |  মিষ্টি ওরফে রঞ্জাবতী  পড়াশোনায় দারুন ভালো , ও ফিজিক্স নিয়ে MSC  করেছে | এখন  ইচ্ছে  WBCS পরীক্ষা  দেওয়ার | নীল  কথা দিয়েছে বিয়ের পরে মিষ্টির যতদূর ইচ্ছে  পড়তে পারে ,  যা  ইচ্ছে  করতে পারে | এইজন্যই নীলকে  আরও বেশি করে ভালোবাসে মিষ্টি ...........

 আশীর্বাদ , গায়ে হলুদ  একে একে সব হয়ে গেল , অবশেষে বিয়ে | প্রচুর আত্মীয় , বন্ধু , অফিস কলিগরা এসেছে বরযাত্রী | নীল খুব মিশুকে তাই খুব মজা করেই বিয়ে হল| তাদের শুভ দৃষ্টি , মালাবদলের সময় এত মজা হল যে সকলে উপভোগ করল বিয়েটা | 

তারপরে  বাসর ঘরে নীল একাই জমিয়ে রাখল একটার পর একটা গান গেয়ে | মিষ্টি  শ্রোতা  সে অত কথা বলতে পারে না তবে শুনতে ভালোবাসে| বন্ধুরা ভাবে কেমন করে   মিষ্টির মত মেধাবী শান্ত মেয়ে নীলের মত অতি সাধারণ , প্রাণবন্ত ছেলেকে    ভালোবাসল ,  অবশ্য সবই ভালোবাসার ম্যাজিক ........

বিয়ের পরে  শ্বশুরবাড়ির ছোট্ট পরিসরে মানিয়ে নিয়েছে মিষ্টি | ছোট্ট  ফ্ল্যাটের দেড় তলায় পেয়েছে একটা  পড়ার ঘর  যা তার একান্ত আপন  |  শাশুড়ি  আর নীলকে নিয়ে সংসার , একমাত্র ননদ থাকে মুম্বাইয়ে | বিয়ের সময়  ননদের পরিবার সহ আত্মীয় স্বজন এসেছিল  কিন্তু চলে যাওয়ার পরে আজ বাড়ি ফাঁকা| নীল অফিস  গেল অনেক দিন পরে , বই নিয়ে  পড়তে  বসে গেছে মিষ্টি| কিছুক্ষন পরে  শাশুড়িমা রান্নাঘরে গেলে তাকেও যেতে হবে,  এর নামই সংসার , অদ্ভুত .........

 ফ্ল্যাটের লোন , বিয়ের খরচ সামলে নীল  আর মিষ্টির   হনিমুনে  যাওয়া হল না | অবশ্য সেজন্য মিষ্টির মন খারাপ  নেই | বিয়েতে যে সব টাকা গিফট হিসেবে পেয়েছিল তা দিয়ে কলেজ স্ট্রিট থেকে  প্রচুর বই কিনে নিয়ে এসেছে মিষ্টি  | এসব দেখে মিষ্টির শাশুড়ি বললেন ....... "এত টাকা খরচ করে  এসব বই কেনার কি খুব দরকার ছিল |  বুঝতেই তো পারছো নীলের  একার রোজগারে সংসার  চালানো , তুমি তো আর ছোট্ট অবুজ মেয়ে নও " |মিষ্টি নিরুত্তর , এন্ট্রান্স পরীক্ষার  বই কেনার জন্য  যে কথা শুনতে হবে মিষ্টি স্বপ্নেও ভাবে নি| কারণ   তাদের বাড়িতে আজও রয়েছে বিশাল লাইব্রেরি , বহু পুরোনো বইয়ের সংগ্রহ এখনও| প্রতিটি বইয়ের যত্ন নেন মিষ্টির বাবা আর নতুন কাকা | নতুন কাকা হলেন মিষ্টির বাবার খুড়তোতো ভাই , তিনি অসাধারণ  পান্ডিত্যের অধিকারী | কলকাতার এক নামকরা কলেজের  পলিটিকালসায়েন্সের   প্রফেসর |  যে পরিবারে বইয়ের মূল্য নেই সেখানে কেমন করে মিষ্টি এসে পরল , অবাক কান্ড | এখানে কেউ নতুন বইয়ের গন্ধ শোঁকে না .......

বিয়ের পর আর বিয়ের আগের মধ্যে প্রচুর পার্থক্য|   অফিস  থেকে ক্লান্ত নীল বাড়ি  আসে ,  তখন গভীর মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করে মিষ্টি তার দেড় তলার  ঘরে  | ডিনার টেবিলে দুজনের দেখা হয় তখন কিছুটা গল্প  |আর  প্রিন্সেপ ঘাট , নিউ মার্কেট , রবীন্দ্র সদনের প্রোগ্রাম , নন্দনে বাংলা সিনেমা দেখতে যাওয়ার  কথা  বলে না নীল |ছুটির দিনগুলো বাড়িতেই কেটে যায় | নীল  মায়ের সঙ্গে ছুটি কাটাতে ভালোবাসে  ,সন্ধ্যের দিকে বেরিয়ে যায় পাড়ার ক্লাবে ,  রাত করে আসে | আকাশ দেখতে   পায় না মিষ্টি  বহুদিন  | এ বাড়িতে কোনো বারান্দা নেই , একতলা ফ্ল্যাটবাড়ি  ,   দম  আটকানো পরিবেশ |  নীলের সব আনন্দ বাড়ির বাইরে, বাড়িতে মায়ের মতোই  গম্ভীর |এই নীল বড়ই   অচেনা , এক মুখোশধারী .........

 পরীক্ষার দিন বাবার সঙ্গে গেল মিষ্টি , নীলের অফিসে খুব কাজের চাপ  |তাছাড়া নীলের  মা চান না শুধু শুধু  ছেলে অফিস কামাই করুক | মিষ্টি  শ্বশুর বাড়িতে বলে গেছে পরীক্ষা দিয়ে  ওবাড়িতে চলে যাবে , থাকবে কিছুদিন  সেখানে |   কতদিন মায়ের কাছে যাওয়া হয় নি l বাড়িতে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল |ভাইরা একসঙ্গে ঘিরে ধরলো দিদিকে |মা কাকিমারা  হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল মিষ্টিকে গল্প করার  জন্য|   মায়ের কাছে রাতে শুয়েছে মিষ্টি , বাবা এতক্ষন ধরে গল্প করে  পাশের ঘরে গেলেন ঘুমোতে | মা মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জানতে চাইলেন .......  তোমার শাশুড়িমা ভালো ব্যবহার করেন তো ?  মা জানেন মিষ্টি নিন্দে করার মেয়ে  নয় , তবু মায়ের মন|  মিষ্টি  বলে ..... ওরা খুব ভালো মা| মা মেয়ের মুখ দেখে  বুঝতে পারেন মিষ্টি ভালো  নেই , ওর  শরীর অনেক ভেঙে গেছে ,  রাত জেগে পড়ার দরুন চোখের তলায় কালি  পরেছে |  রোজ রাতে মিষ্টি চলে যায় ছাদে , প্রাণভরে   আকাশ দেখে | আজ জোৎস্নার রাত ,চাঁদের আলো যেন  চুঁইয়ে চুঁইয়ে  পরছে  আকাশ থেকে |মনে পরে নীলের কথা,  নীল অবশ্য অফিস  থেকে  বাড়ির ল্যান্ড  ফোনে  কথা বলে মিষ্টির সঙ্গে|  

নীল এসেছে মিষ্টিকে নিতে , দিনগুলো কিভাবে আনন্দের মধ্যে ফুরিয়ে গেল |নীল  এসেছে   কিন্তু কোনো ভালো লাগার অনুভূতি লাগছে না কেন মিষ্টির মনে , ভারাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে কেন মন|  সকলকে প্রণাম করে হলুদ ট্যাক্সিতে  উঠে পরল মিষ্টি নীল |মা চোখে জল  নিয়ে কপালে দু হাত ঠেকিয়ে বললেন ........ দূর্গা , দূর্গা ,  মন জেনে গেল   তাঁর মেয়ে  ভালো নেই ..........

অবশেষে  একেক ধাপ পেরিয়ে WBCS  পাস  করল মিষ্টি , বিশাল ভালো রেজাল্ট করে হল এক্সিকিউটিভ  অফিসার  | নীল অভিনন্দন জানালো তার  ছোটবেলার  সহপাঠীকে |  বাড়ির সকলে খুব খুশি কিন্তু নীলের মায়ের  এক কথা ....

...... আমার বাবু  ইচ্ছে করলেই ভালো রেজাল্ট করতে পারত ,  এই মেয়ের সঙ্গে  ঘুরতে গিয়ে পড়াশোনা করল না | মিষ্টির  আনন্দে কেউ যেন শুকনো বিবর্ণ পাতা ছড়িয়ে দিল |সে তো অনেক চেষ্টা করেছিল নীলের  জন্য কিন্তু  অধ্যাবসায় ছিল না  , উপরন্তু কলেজে রাজনীতিতে ভয়ঙ্কর ভাবে জড়িয়ে ছিল নীল| মিষ্টির  কথা ভেবেও কোনোদিন সেভাবে প্রতিষ্ঠা পেতে  চায় নি | তবুও মিষ্টি  নীলের পাশেই ছিল,  এই হয়ত প্রকৃত ভালোবাসা , আজ তার সাফল্যে  কিছুটা হলেও বিবর্নতার ছোঁয়া লাগল..........

 প্রথম পোস্টিং পুরুলিয়াতে ,  নীল অফিসের ব্যস্ততার জন্য মিষ্টির সঙ্গে যেতে পারবে না | মিষ্টি বলল..... "বিয়ের পরে তো আমরা কোথাও বেড়াতে যাই নি, চলো মা ও যাবে আমাদের সঙ্গে "|কিন্তু নীল  জানালো ..... "আমার অফিসের প্রচন্ড কাজের  প্রেসার , তুমি  তো করবে সরকারি  চাকরি , প্রাইভেট  কোম্পানিতে জব করা কত কঠিন তুমি  বুঝবে না"| আশ্চর্য মিষ্টি ,  এই নীল বড় অচেনা তার কাছে |অবশেষে মা বাবার সঙ্গে মিষ্টি   কলকাতা ছেড়ে   রওনা দিল লাল মাটির দেশে |নীল  আর মিষ্টি একই আকাশের তলায় মনে মনে অনেকটা দূরে চলে গেল........

মিষ্টি ব্যস্ত  অফিস নিয়ে ,  একটা বিশাল রাজনৈতিক প্রেসার তো আছেই l তাছাড়া চলছে মাওবাদীদের চোখ রাঙানি  l  মা বাবা চলে গেছেন  এখন একা  মিষ্টি তবে কোয়াটারে কাজের লোক আছে দুজন lএই কয়েকদিনের মধ্যেই সে আদিবাসী মেয়েদের উন্নয়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে lওখানকার মানুষজনও  সমীহ করে চলছে  এই শান্ত  বিচক্ষণ অফিসারটিকে l মহিলারা আসছে ছুটির দিনে ,   শাড়ীর কোঁচড়ে  পলাশ ফুল নিয়ে , কেউ  আনে গুড় বারন  করা স্বত্তেও |এসবের মধ্যেই তারা  দিয়ে  যায় তাদের ভালোবাসা | নীল এসেছিল একবার দুদিনের জন্য , দুজনে হাতে হাত রেখে ঘুরেছিল পুরুলিয়া | গিয়েছিল অযোধ্যা পাহাড় ,  বড়ন্তি , গড়পঞ্চকোট , শাল পিয়ালের বন | জামাই  এসেছে বলে গ্রামবাসী সাঁওতালি ও ছৌ নাচ করল , মিষ্টির  খোঁপায় গুঁজে দিল পলাশ  | নীল আরও গম্ভীর হয়ে গেছে ,  নীলের হাসিমুখ দেখার আকুলতা  আজও  মিষ্টির মনে  |যাওয়ার আগে কথায়  কথায়  মিষ্টিকে  আঘাত দিয়ে গেল নীল,  বলল....... তুমি খুব চালাক, নিজের  ক্যারিয়ার ঠিক  গুছিয়ে নিলে , আমিই শালা বোকা থেকে গেলাম | মিষ্টি  হিংসে দেখল নীলের মধ্যে যা কোনোদিন আশা করেনি l বসন্তে যেন এক তপ্ত আগুন ছড়িয়ে দিয়ে চলে গেল নীল .........

 একবছর  কেটে গেল, আবার বসন্ত ,  প্রকৃতি  সেজে উঠেছে l এরকম এক দিনে  অফিসে বসেই  মিষ্টি   হাতে পেল একটা বড় রেজেস্ট্রি খাম,  ডিভোর্স পেপার  পাঠিয়েছে নীল  l   আকাশে অস্তমিত সূর্য ,মিষ্টি লাল পলাশ  বিছানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে  চলেছে ধীরে ধীরে ,  কাছের আদিবাসী গ্রাম থেকে ভেসে আসছে গান .......

  পিণ্ডাড়ে পলাশের বন/ পালাবে পালাবে মন

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment