1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

কাশীর মাহাত্ম্য

ছবি : ইন্টারনেট 

কাশীর মাহাত্ম্য 

সবিতা বিশ্বাস 


ভারতবর্ষের প্রাচীনতম একটি তীর্থের নাম শ্রী শ্রী কাশীধাম | কিন্তু এর প্রাচীনতা বা পত্তন সম্পর্কে বিভিন্নব্যক্তি বিভিন্ন মন্তব্য করে থাকেন | ঐতিহাসিকদের মত অনুসারে আকবরের নবরত্ন সভার অন্যতম রাজা টোডরমল এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন |  প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পরে আওরঙ্গজেব তা ধ্বংস করে দেন | যদিও এই তথ্য অনেকে মানতে চান না | 

তারা বলেন স্কন্দ পুরাণের কাশী খন্ডে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায় | ১১৯৪ সালে মুসলিম যোদ্ধা মহম্মদ ঘোরী বারাণসীর অন্য সকল মন্দিরের সাথে এই মন্দিরটি ধ্বংস করেন | এরপর মন্দিরটি পুনরায় নির্মিত হলে মুসলিম শাসক কুতুবুদ্দিন আইবক মন্দিরটি ধ্বংস করেন | আইবকের মৃত্যুর পর মন্দিরটি আবার নির্মিত হয় | ১৩৫১ সালে ফিরোজ শাহ তুঘলক আবার মন্দিরটি ধ্বংস করেন | 

১৬৬৯ সালে আওরঙ্গজেব মন্দিরটি ধ্বংস করে ওখানে জ্ঞানবাপী মসজিদ তৈরি করেন | মন্দিরের পাশে মসজিদটি এখনো আছে | শ্রী শ্রী কাশীধামে শ্রী বিশ্বনাথ যে মন্দিরে অবস্থান করছেন সেটি ১৭৮০ সালে ইন্দোরের মহারানী অহল্যাবাঈ হোলকার পুননির্মাণ করেন | অহল্যাবাঈ ছিলেন খুবই ভক্তিমতী ও পরম শিবভক্ত | তাঁর গুরু ছিলেন অম্বাদাস পৌরাণিক নামে এক সদাচারী শৈব ব্রাহ্মণ | 

অহল্যাবাঈ একদিন ভোরের দিকে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলেন | দেখলেন তাঁর আরাধ্য দেবতা পিনাকপাণি যেন তাঁর সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন | মহাদেবের প্রশান্ত চেহারা, বরাভয় মূর্তি | তিনি অহল্যাকে বলছেন,  “তুই আমার পরম ভক্ত, তোকে আমি একটা জরুরী কাজের দায়িত্ব দিতে চাই”| অহল্যাবাঈ করজোড়ে জানতে চান- কি সেই কাজ? মহাদেব বললেন, উত্তরবাহিনী পুণ্যসলিলা গঙ্গার তীরে সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থক্ষেত্র বারাণসী ধামে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের এক লিঙ্গ হিসেবে আমি সতত বিরাজমান | সব থেকে পবিত্র শিবলিঙ্গ এটি | জ্ঞানবাপী মন্দিরেই আমার অধিষ্ঠান ছিল | কিন্তু হঠকারী কিছু মানুষের আক্রমণে আমার সেই সাধের মন্দির আজ চূর্ণবিচুর্ণ | তুই আবার নতুন করে বারাণসী ধামে আমার মন্দির প্রতিষ্ঠা কর | এতে আমার ভক্তরা আনন্দলাভ করবে | 

মহাদেব আরো বললেন, নর্মদা নদীতে স্নানের পর  কষ্টিপাথরের একটা শিবলিঙ্গ তুই খুঁজে পাবি | বারাণসীর নতুন মন্দিরে এই শিবলিঙ্গই যেন প্রতিষ্ঠা করা হয়,  এতেই আমি আবির্ভূত হব | এই শিবলিঙ্গ চিরদিন কাশী বিশ্বনাথ হিসেবে পূজিত হবে | এবং এটা দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের সেরা লিঙ্গ হিসেবে মর্যাদা পাবে | এর পরেই ঘুম ভেঙ্গে যায় অহল্যাবাঈয়ের | এর পরে রানী এই মন্দির তৈরী করেন |

শিবপুরাণ অনুসারে একবার সৃষ্টিকর্তা  ব্রহ্মা ও রক্ষাকর্তা বিষ্ণু তাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তাই নিয়ে বিবাদে রত হন | তাদের পরীক্ষা করবার জন্য শিব ত্রিভুবনকে ভেদ করে জ্যোতির্লিঙ্গ নামে এক বিশাল অন্তহীন আলোকস্তম্ভ রূপে আবির্ভূত হন | বিষ্ণু ও ব্রহ্মা এই লিঙ্গের উত্স অনুসন্ধান করতে যান | ব্রহ্মা যান উপর দিকে এবং বিষ্ণু যান নীচের দিকে, কিন্তু কেউই এই লিঙ্গের উত্স খুঁজে পান না | ব্রহ্মা মিথ্যে বলেন, তিনি জ্যোতির্লিঙ্গ খুঁজে পেয়েছেন | বিষ্ণু তার পরাজয় স্বীকার করে নেন | শিব তখন দ্বিতীয় জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে আবির্ভূত হয়ে মিথ্যে কথা বলার জন্য ব্রহ্মাকে অভিশাপ দেন | শিব বলেন, মিথ্যে কথা বলার জন্য কোনো অনুষ্ঠানে তার স্থান হবেনা | অন্যদিকে সত্য কথা বলার জন্য  বিষ্ণুকে আশীর্বাদ করে বলেন, সৃষ্টির অন্তিমকাল  পর্যন্ত তিনি পূজিত হবেন | 

জ্যোতির্লিঙ্গ হল সেই অখন্ড সর্বোচ্চ সত্যের প্রতীক, যার অংশ শিব নিজে | হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরগুলিতে স্বয়ং অগ্নিময় আলোকস্তম্ভ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন | প্রত্যেক জ্যোতির্লিঙ্গের নির্দিষ্ট নাম আছে, এগুলি শিবের এক এক রূপ | বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির হল  গুজরাটের সোমনাথ, অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রী শৈলমের মল্লিকার্জুন, মধ্যপ্রদেশের উজ্জ্বয়িনীর মহাকালেশ্বর, মধ্যপ্রদেশের ওঙ্কারেশ্বর, হিমালয়ের কেদারনাথ, মহারাষ্ট্রের ভীমশংকর, উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর বিশ্বনাথ, মহারাষ্ট্রের ত্রম্ব্যকেশ্বর, ঝাড়খন্ডের দেওঘরের বৈদ্যনাথ, গুজরাটের দ্বারকায় নাগেশ্বর, তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমের রামেশ্বর এবং মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গাবাদের ঘৃষ্ণেরশ্বর | 

সর্বাপেক্ষা প্রাচীন গ্রন্থ বেদ | সেই প্রাচীন গ্রন্থে কাশীর উল্লেখ আছে | বেদ থেকে বেদান্ত, উপনিষদাদি শাস্ত্রে কাশীর উত্পত্তি ও প্রকাশ সম্বন্ধে বিশদ বর্ণনা আছে | মহাপ্রলয়ের সময় সকল পদার্থ লুপ্ত হয়ে যায়; সূর্য, চন্দ্র প্রভৃতি গ্রহ কিছুই থাকেনা | প্রকৃতি ব্যক্ত ভাব থেকে অব্যক্ত প্রকৃতিতে পরিণত হয় | ঘন অন্ধকারে সব কিছু ঢেকে যায় |

অবিচ্ছিন্ন অন্ধকার সব কিছু ঢেকে দিলে পরমব্রহ্মের দ্বিতীয় ইচ্ছাশক্তি উত্পন্ন হল; সনাতন ব্রহ্ম নিজলীলা প্রভাবে নিজের একটি দ্বিতীয় মূর্তি কল্পনা করলেন এবং শুদ্ধস্বরূপা  ঈশ্বরের মূর্তি সৃষ্টি করে সর্বগত অব্যয় পরমব্রহ্ম অন্তর্ধান করলেন | পরমব্রহ্মের দ্বিতীয় ঈশ্বরী মূর্তি – মহেশ্বর, নবীন ও প্রাচীন ব্রহ্ম | অদ্বিতীয় মহেশ্বর নিজের শরীর থেকে সৃষ্টি করলেন প্রকৃতিকে | সেই প্রকৃতিকে প্রধান, মায়া, পরা গুণবতী নামে ডাকা হয় | এই প্রকৃতি পুরুষ যখন তপস্যার স্থান খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন নির্গুণ শিব সেই জলরাশি বেষ্টিত পঞ্চক্রোশ ব্যাপী কাশীকে ত্রিশূলাগ্রে ধারণ করেছিলেন | মহাদেব এই ক্ষেত্র নির্মাণ করেছিলেন, এই ক্ষেত্র আনন্দময়ী বলে পুরাকালে একে ‘আনন্দকানন’ বলা হত | 

মহেশ্বর কাশী থেকে কুশদ্বীপে মন্দার পর্বতে যাবার সময় ক্ষেত্রকে রক্ষা করার জন্য সাধকদের সিদ্ধিপ্রদ ও মৃত জীবগণের মুক্তিপ্রদ নিজ মূর্তিময় এক শিবলিঙ সকলের অজ্ঞাতসরে প্রতিষ্ঠা করে যান | মহেশ্বর মন্দার পর্বতে গেলেও কাশীক্ষেত্রে লিঙ্গরূপে অবস্থান করে নিজের সংসর্গ থেকে বিমুক্ত করেননি | তাই এই ক্ষেত্রের নাম অবিমুক্ত ক্ষেত্র | প্রকৃতি ও আদিপুরুষ পরম আনন্দস্বরূপ কাশীক্ষেত্রে নিজ লীলায় বিচরণ করেন | পঞ্চক্রোশ পরিমিত কাশীক্ষেত্র প্রকৃতি পুরুষের পদতল থেকে নির্মিত, প্রলয়কালেও এই ক্ষেত্রকে তাঁরা ত্যাগ করেন না, এই কারণেই কাশী অবিমুক্ত ক্ষেত্র | 

কাশী শিবের রাজ্য | অখিল ব্রহ্মাণ্ডপতি বিশ্বনাথ কাশীর রাজা | এই রাজ্যে কাশী বিশ্বনাথের একাধিপত্য, এখানে যমরাজেরও প্রবেশাধিকার নেই | এই রাজ্যের রাজধানী পঞ্চক্রোশী কাশী | ভগবান মহেশ্বর ও ভগবতী মহামায়া সৃষ্টির অভিলাষী হলে মহেশ্বর নিজের বাম অঙ্গের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সেই অঙ্গ থেকে মনোরম সুন্দর আকৃতির শান্ত পুরুষ উত্পন্ন হল | মহাদেব তাঁকে বললেন তুমি মহাবিষ্ণু, চারিবেদ তোমার নিঃশ্বাস থেকে উত্পন্ন হবে | তুমি বেদ থেকে সমস্ত বিষয় জানতে পারবে ও সেই পথেই সব কিছুর সমাধান করবে |

বিষ্ণুকে এই কথা বলার পর মহেশ্বর ও মহেশ্বরী আনন্দ্কাননে প্রবেশ করলেন | মহাবিষ্ণু চক্রের দ্বারা এক পুষ্করিণী খনন করে নিজের শরীরের ঘাম দিয়ে তা পূর্ণ করেন | তারপর তিনি পুষ্করিণী তীরে বসে কঠোর তপস্যা শুরু করেন | বিষ্ণুর তপস্যায় মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে মহামায়াকে নিয়ে বিষ্ণুর কাছে আসেন এবং বলেন, তুমি বেদোক্ত প্রকারে জগতের সৃষ্টি করো, ধর্ম্ম অনুসারে সর্বভূতের পালন করো | ধর্মবিদ্বেষীদের বিনাশ করবে, যারা ধর্ম্মপথে যাবে তাদের নিজ কর্মফলেই মৃত্যু হবে; তুমি সংহারের নিমিত্ত মাত্র হবে | এই পুষ্করিণী মঙ্গলপদ চক্রতীর্থ পুষ্করিণী নাম খ্যাত হবে | আমার কর্ণের কুন্তল মনিকর্ণিকা এই পুষ্করিণীতে পড়ার কারণে মনিকর্ণিকা নামে খ্যাত হল | 

মহেশ্বর নিখিল জগতকে বিষ্ণুর অধীন করে নিজে ইচ্ছামত লীলা করছেন | বিষ্ণু এই অখিল চরাচরকে মহাদেবের অধীন করে রেখেছেন | তাই যিনি বিষ্ণু তিনিই শিব, শিব আর বিষ্ণুতে তিলমাত্র প্রভেদ নেই | পঞ্চক্রোশ পরিমিত আনন্দকানন মহাদেবের ক্ষেত্র, এখানে অন্য কারো কথা চলেনা | কাশীতে জীবগণ জীবিতাবস্থায় রুদ্রদেহ ধারণ করে অনন্তকালে মহাদেবের কৃপায় মহাদেবের সাযুজ্যলক্ষণ লাভ করতে সমর্থ হয়, কাশীতে জীবগণ রুদ্ররূপে বাস করে | তারা অন্য জায়গার রুদ্রদের থেকে শ্রেষ্ঠ | এজন্য আনন্দকানন রুদ্রবাস বলে খ্যাত | মহাপ্রলয়ের সময় মহাভূতগণ শবরূপে এই কাশীতে শয়ান করেন তাই কাশীর অপর নাম মহাশ্মশান | 

হিন্দুধর্মে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী কাশীতে এলে মানুষের সব পাপ মুছে যায় | আত্মা শুদ্ধ হয়, জীবনের গোপন সত্যি জানতে পারেন | সেই কারণে শুধু দেশ নয়, বিদেশ থেকেও লক্ষ লক্ষ মানুষ কাশীতে বাবা বিশেশ্বরের দর্শনে আসেন | কাশী শব্দটি এসেছে কাশ থেকে যার প্রকৃত অর্থ জ্বলজ্বল করা | এই মন্দিরের চূড়াটি ১৫.৫ মিটার উঁচু | ১৮৩৫ সালে শিখ সম্রাট রঞ্জিত সিংহ মন্দিরের চূড়াটি ১০০০ কিলোগ্রাম সোনা দিয়ে মুড়ে দেন | যার জন্য এই মন্দিরকে  অনেকেই স্বর্ণমন্দির বলে থাকেন | ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ ভারতের এক বেনামী দাতা মন্দিরে ৬০ কেজি সোনা দান করার পরে মন্দিরের গর্ভগৃহে সোনার প্রলেপ  দেওয়া হয়েছে | মন্দিরে ৯০ সেন্টিমিটার পরিধির এবং ৬০ সেন্টিমিটার উঁচু একটি শিবের লিঙ্গ রয়েছে |

অতীতে অসংখ্যবার মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ও পুনর্নির্মিত হয়েছে | একাদশ শতাব্দীতে হরিচন্দ্র মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেছিলেন | মন্দিরের সাথেই একটি মসজিদ আছে | অনেকের ধারণা মসজিদের জায়গায় আদি মন্দির ছিল | হিন্দুদের স্কন্দপুরাণে এই মন্দিরের উল্লেখ আছে | শৈব সাহিত্য থেকে জানা যায়, সতীদেবীর দেহত্যাগের পর শিব মনিকর্ণিকা ঘাট দিয়ে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে এসেছিলেন | এই ঘাটটি শাক্তদের পবিত্র তীর্থস্থান |

অখিল ব্রহ্মান্ডপতি বিশ্বেশ্বর কাশীর রাজা | রাজবাড়ি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, দক্ষিণ দিকের প্রাচীরে প্রবেশের দরজা | দরজার সামনে বাড়ির প্রাঙ্গন | বাড়ির দক্ষিণে নহবত | পশ্চিমদিকে আশাপুরী দেবী ও লক্ষ্মীনারায়ণ | পশ্চিমদিকে প্রাচীরে যে দরজা আছে সেখানে আছেন ভৈরবনাথ | উত্তরদিকে পশ্চিমধারে পার্বতী, পূর্বধারে অন্নপুর্ণা | দক্ষিণদিকে পূর্বধারে অবিমুক্তেশ্বর ও একাদশ রুদ্র অবস্থিত | প্রাঙ্গনের মধ্যে মন্দির, মন্দিরের চারটি দ্বার, পশ্চিমদ্বারের সম্মুখে নাটমন্দির, নাটমন্দিরের মাঝখানে মহারাজা হরিশ্চন্দ্র স্থাপিত শিব-বৈকুন্ঠেশ্বর | পশ্চিমে দন্ডপাণীশ্বর, মন্দিরের ভিতরে চক্রবেদীর মধ্যস্থলে  কাশীনাথ বিশ্বেশ্বর | তিনটি অংশে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের কাঠামো গঠিত | প্রথমটি মন্দিরের উপরে একটি স্পায়ার আপস করে, দ্বিতীয়টি হল সোনার গম্বুজ আর তৃতীয়টি হল একটা পতাকা ও একটা ত্রিশূল বহনকারী গর্ভগৃহের উপর সোনার চূড়া | 

কাশীর মাহাত্ম্য হল রাজমন্দিরের অবারিত দ্বার | দলে দলে ইতর, ভদ্র সকল শ্রেণীর বালক বালিকা যুবতী বৃদ্ধা সব বয়সের স্ত্রী পুরুষ ফুল গঙ্গাজল বেলপাতা নিয়ে রাজাকে দর্শন করে, রাজাকে স্পর্শ করে সন্তোষলাভ করে | এই যাতায়াতের বিরাম নেই | অল্প পরিসরের প্রবেশ দরজায় সকলে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ালেও কেউ কিছু মনে করেনা | সকলের প্রাণেই এক অপার্থিব আনন্দ বিরাজ করে |

কাশীর মন্দিরে দুপুরে ভোগ আরতি, বিশ্বনাথ চন্দন, পুষ্পমালায় সজ্জিত হন | ধূপ, কর্পূর, অগুরু গন্ধে মন্দির আমোদিত হয়, ডম্বরু, শঙ্খ, কাঁসর-ঘন্টা বাজতে থাকে | একজন ব্রাহ্মণ ব্যদন করেন, নয়জন ব্রাহ্মণ বেদ্গান করেন এবং আরতির প্রদীপ নিয়ে আরতি করেন | ভোগের সময় মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে |

সন্ধ্যাবেলা প্রথমে হয় দুগ্ধ অভিষেক, একটা ঘটিতে অতি সূক্ষ্ম ছিদ্র আছে | বিশ্বেশ্বরের মাথায় সেই ঘটি থেকে দুধের ধারা পড়ে | এরপরে গঙ্গাজলে অভিষেক করা হয় | বাবার শরীরে ঘি ও চন্দন মাখানো হয়, তারপরে চন্দন লেপে সারা শরীর সর্পাকৃতি করা হয় | মাথায় রক্তচন্দন, আতপচাল ও দূর্বা ও বেলপাতা দিয়ে আরতি করা হয় | শিঙ্গা, ডম্বরু বাজে, পাঁচজন ব্রাহ্মণ শম্ভ, শম্ভ, শম্ভু শব্দে আরতি করেন এবং পরে স্তুতিপাঠ করেন | 

প্রায় সকল সিদ্ধপুরুষ, সাধু ও পন্ডিতগণ কাশীকে অবলম্বন করে জীবন অতিবাহিত  করেছেন | এবং অনেকেই কাশী বাস করেছেন | পরম বৈষ্ণবভক্ত তুলসীদাস ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে কাশীতে বাস করেন- তিনি সংকটমোচন মন্দিরে রামায়ণ এবং গোয়ালদাস মহল্লার গোপাল মন্দিরের একটা ছোট ঘরে “বিনয় পত্রিকা” প্রভৃতি রচনা করেন | কুলুকভট্ট বঙ্গদেশ থেকে এসে কাশীবাস করেন এবং মনুসংহিতার টিকা রচনা করেন | রাজশাহীর নিসিন্দাবাসী উদয়নাচার্য্য মিথিলায় ন্যায়শাস্ত্র অধ্য়য়ন করে নৈয়ায়িক হয়েছিলেন , এরপরে কাশীতে এসে বৌদ্ধাচার্য্য জিক্ষ্মনিকে পরাস্ত করেন | এঁরা ১৪০০ শতকে কাশীতে ছিলেন | পূর্ববঙ্গের কোটালীপাড়া নিবাসী পুরন্দর আচার্য্যের পুত্র মধুসূদন  সরস্বতী কাশীতে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন | চৌষট্টিযোগিনী মন্দিরের সামনে তাঁর আশ্রম ও মঠ ছিল | সাধককবি রামপ্রসাদের পুত্র রামগতি কাশীবাসী হয়েছিলেন | তাঁর কন্যা আনন্দময়ী কাশীতে টোল খুলে সভায় ন্যায়শাস্ত্র বিচার করতেন | তিনি “হটী বিদ্যালঙ্কার” বলে খ্যাত | 

প্রেম ভক্তির অবতার শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব নীলাচল থেকে বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন | বৃন্দাবন থেকে গৌড়ে ফেরার সময় ১৫১১/১২ খ্রিষ্টাব্দে কাশীতে আসেন, সেখানে সনাতনকে দীক্ষিত করে বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দেন | তাঁর শিষ্য ভট্টমারী নিবাসী গোপাল ভট্ট তখন কাশীতে দাক্ষিণাত্য পন্ডিত প্রকাশানন্দ সরস্বতীর আশ্রমে ছিলেন | প্রকাশানন্দ ব্রহ্মচারী বৈদিক জ্ঞানমার্গ অবলম্বী ছিলেন | শ্রীচৈতন্যদেবের সাথে অনেক বাক বিতর্ক করে পরাজিত হন | তখন তিনি শ্রীচৈতন্যদেবের পান্ডিত্যে ও ভক্তিতে মুগ্ধ হয়ে “চৈতন্যচন্দ্রামৃত” গ্রন্থ রচনা করেন | এইভাবে নব নব ধর্মের প্রচারকগণ কাশীতে এসে জ্ঞান কর্ম ও ভক্তিযোগে কাশীকে সমৃদ্ধ করেছেন |

বারাণসী যুগে যুগে শিক্ষার একটি মহান কেন্দ্র | বারাণসী অধ্যাত্মবাদ, রহস্যবাদ, সংস্কৃতি, যোগ, জ্ঞান দর্শন ভক্তি, ভারতীয় শিল্প, কারুশিল্পের বিকাশ কেন্দ্র | ইংরেজ লেখক ও সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন যিনি বেনারসের পবিত্রতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, তিনি লিখেছেন “বেনারস ইতিহাসের চেয়ে পুরনো, ঐতিহ্যের চেয়ে পুরনো, কিংবদন্তির চেয়েও পুরনো এবং তাদের সকলকে একত্রিত করার জন্য দ্বিগুণ পুরোনো দেখায়”|

মহাভারত রচয়িতা কাশীরাম দাস, রাজা রামমোহন রায়, কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কাশীতে বসবাস করেছিলেন | কানপুরের কনৌজ ব্রাহ্মণ সন্তান বংশীধর কাশীতে শাস্ত্র অধ্য়য়ন করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন | তিনি বিশুদ্ধানন্দ স্বামী নামে খ্যাত | রামানন্দ, পরমহংস শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব, সোহংস্বামী (শ্যামাকান্ত বন্দোপাধ্যায়), সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ, জয়্পুররাজ দ্বিতীয় জয়সিংহের সভাপন্ডিত দিগ্বিজয়ী কৃষ্ণদেব ভট্ট, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, এছাড়াও প্রচুর সাধু-সন্ত জ্ঞানী ব্যক্তিগণ কাশীতে বসবাস করেছেন | কথিত আছে পুণ্যসলিলা গঙ্গায় ডুব দিয়ে জগন্নাথ মন্দিরের ছত্রি দর্শন করলেন সর্বপাপ ক্ষয় হয়, মানুষ মুক্তিলাভ করে | বারাণসীর গঙ্গার সমস্ত পাপ ধুয়ে ফেলার ক্ষমতা রয়েছে | যুগ যুগ ধরে হিন্দুদের জন্য চূড়ান্ত তীর্থস্থান কাশী |


কাশীর মাহাত্ম্য শুধু মন্দির নয়, বারাণসীর ঘাটে ও | যে কোনো একটা ঘটে গিয়ে মিনিট দশ দাঁড়ালেই মনে হবে এটা অন্য কোনো দেশ | গেরুয়া বসন পরা সাধু, মন্ত্রের উচ্চারণ, গনত্কারের মেলা, জল ছিটিয়ে স্নানের শব্দ, সন্ধ্যেবেলার আরতি, সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক মাদকতা | 

মনিকর্ণিকা ঘাট বারাণসীর সবচেয়ে পবিত্র ঘাট | কারণ এখান থেকেই পাওয়া যায় মোক্ষ, পাওয়া যায় মুক্তি | এখানে বেশিরভাগই মৃত্যুপথযাত্রী বয়স্ক মানুষদের ভীড় দেখা যায় | তারা বিশ্বাস করেন এখানে মারা গেলে কর্ম থেকে মুক্তি পাওয়া যায় | এই ঘাটের চিতার আগুন কখনো নেভে না | সার সার মৃতদেহ সাজানো আছে, একের পর এক ডোমেরা সেগুলো নিয়ে যাচ্ছে | 

গঙ্গা নদী যেখানে অসি নদীর সাথে মিশেছে সেটাই হল অসি ঘাট | কথিত আছে দেবী দূর্গা শুম্ভ আর নিশুম্ভ নামক দুই দৈত্যকে হত্যা করবার পরে তাঁর অসি বা তরবারী এইঘাটে নিক্ষেপ করেছিলেন | সেই থেকেই এই ঘাটের নাম অসি ঘাট | এখানে মস্ত পিপল গাছের নীচে রয়েছে অতিকায় শিবলিঙ্গ | 

চেত সিং ঘাটের সাথে জড়িয়ে আছে নানা ইতিহাস | ১৭৮১ সালে এখানে ওয়ারেন হেস্টিংস আর চেত সিংহের লড়াই হয়েছিল | চেত সিং এখানে একটা কেল্লা তৈরী করেছিলেন সুরক্ষার জন্য | কিন্তু যুদ্ধে হেরে যাবার পর কেল্লাটি ইংরেজদের হাতে চলে যায় | নদীর চারটি তীর এই ঘাটের সঙ্গে যুক্ত | চেত সিং, নিরঞ্জনি, নির্বাণি ও শিভালা | আগে এই ঘাটের নাম ছিল খিড়কি ঘাট | ১৮ শতকের পুরনো এই ঘাটে তিনটি শিবমন্দির আছে | 

দ্বারভাঙ্গা ঘাট তৈরি করেন নাগপুরের অর্থমন্ত্রী শ্রীধর নারায়ণ মুন্সি | তাই এই ঘাটের অপর নাম মুন্সিঘাট | এখানে একটি ১৯০০ শতকের দুর্গ আছে, যার মালিক হল বিহারের একটি পরিবার | দুর্গ নির্মিত হয়েছে বেলেপাথর দিয়ে |

পুরাণ অনুসারে সিন্ধিয়া ঘাটে জন্মেছেন দেবতা অগ্নি | এই ঘাটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল অর্ধেক জলমগ্ন শিবমন্দির | এই ঘাটকে অনেকেই সিদ্ধ্ক্ষেত্র বলেন | এখানে আছে ১৮ শতকের দুর্গামন্দির | বারাণসীর সবচেয়ে আনন্দময় ঘাট এটি | 

দশাশ্বমেধ ঘাটের আরতি খুব আকর্ষণীয় | পুরাণ বলে প্রজাপতি ব্রহ্মা যজ্ঞ করার সময় দশটি ঘোড়াকে বলিদান করেন | তা থেকে এই নামকরণ হয়েছে | এখানে মূলত অগ্নিদেবতার পুজো করা হয় | এছাড়া সূর্য দেবতা, শিব ও গঙ্গা নদীর অরাধনাও করা হয় | এখানে আছে মহারাজ জয় সিংহ নির্মিত মান মন্দির | কলামন্দির ও দেখার মত | 

জয়পুরের মহারাজা মান সিংহ ১৬ শতকের মাঝামাঝি রাজপুত স্থাপত্যের মানমন্দির ঘাট নির্মাণ করেন | ১৭৩০ সালে সোয়াই জয় সিংহ দ্বিতীয় এখানে একটা অবজারভেটরি নির্মাণ করেন | এখানে রাখা জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত যন্ত্রপাতি এখনো ভালো অবস্থায় আছে | 

কাশী বিশ্বনাথের মন্দির মহাদেবের অত্যন্ত প্রিয় | কাশীতে মৃত্যু হলে জন্ম-মৃত্যুর এই বৃত্তাকার চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া যায় | এখানে যার মৃত্যু হয় স্বয়ং মহাদেব তাঁর কানে তারকমন্ত্র দেন বলে ভক্তদের বিশ্বাস | 

দেবাদিদেব মহাদেবের মন্দির ছাড়াও আরো দেবতাদের মন্দির, স্থাপত্য, গুণীজনের পদধুলি ধন্য কাশী সব কিছু নিয়েই বিরাজমান | কাশীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা সাধ্যাতীত | 

বিশ্বনাথ মহল্লার পশ্চিম ফটকের উপর মা অন্নপূর্ণার মন্দির | মা ভবানী অন্নদাত্রী, উপবাসী ব্যাস্দেবকে অন্নদানে তৃপ্ত করেছিলেন | কাশীবাসীর মৃত্যুশয্যায় মরণক্লেশ দূর করবার জন্য নিজের বস্ত্রাঞ্চল দিয়ে হওয়া করে ক্লেশ নিবারণ করেছিলেন | কাশীরাজ ভগবান মহেশ্বর এখানে নিজের ইচ্ছামত লীলা করছেন | সৃষ্টির প্রক্রিয়া অবিরাম অপ্রতিহতভাবে চলছে | মানবজাতি যখন মোহআবরণের আড়ালে থেকে নিজের গন্তব্য ও মোক্ষ দ্বারকে ভুলে যায়, তখন মহেশ্বর কৃপাবশে তাদের সামনে উপস্থিত হন | কাশীর বাবা বিশ্বনাথের মাহাত্ম্য এখানেই | 


তথ্যসূত্র—১) কাশী মাহাত্ম্য ও কাশী তীর্থের কথা --- ভারত সেবাশ্রম সংঘ 

২) কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ----- উইকিপিডিয়া

৩) কাশী মাহাত্ম্য পর্ব ২ ও ৩ ---বিশ্বনাথ বাড়ি ও ভবানী অন্নপূর্ণার      বাড়ি ও কাশীবাসী মনীষীগণের বক্তব্য---১৩০ বৈঠকখানা রোড, নীলমণি সেনের বাড়িতে মা অভ্যা দুর্গার পূজা |

৪) বেনারসের এই আশ্চর্য ঘাটগুলোর প্রতি পরতে অপেক্ষা করছে অপার বিস্ময় --- দোয়েল ব্যানার্জী 

৫) মসজিদকে পাশে নিয়ে হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির – সনাতন পন্ডিত 

৬) কাশী বিশ্বনাথ মন্দির সম্পর্কে এই অজানা তথ্য জানা আছে কি?—এই সময় 

৭) কাশী বিশ্বনাথ সম্পর্কে অজানা তথ্য – ইন্টারনেট 

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment