1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

সরল সমীকরণ

ছবি : ইন্টারনেট

সরল সমীকরণ

বুলা বিশ্বাস 

          'জানিস, প্রেমটা ঠিক সেভাবে হয় নি।' কথাগুলো বলতে বলতে তন্বীর চোখে মুখে একটা খুশির ঝলক দেখা গেলো যেন।

সেদিন তন্বীর পঞ্চাশ বছরের জন্মদিন পালন করতে ওর চারবন্ধু, মামন, রুনা, তোতোন আর রাই যখন ওদের বাড়িতে গিয়েছিলো, খাওয়াদাওয়া শেষে, পাঁচবন্ধু খাটের উপর বসে গল্প শুরু করতে করতেই তন্বী কেমন ইমোশন হয়ে পড়ে। খুশিতে ডগমগ তন্বী ওর প্রেমের কাহিনী বলতে শুরু করে। 

'জানিস, আমি তখন চাকরি করতাম। অয়ন, বিল্টু, তানিয়া, ঈশিকা, বাচ্চু তখনো চাকরি পায় নি। চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে, কেউ কেউ তখনো পড়াশুনা করছে। আমি আর অয়ন বাদে তখন সবাই প্রেম করছে। ওদের বেশিজনেরই  প্রেম ওই, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট আর কি! আমার আর অয়নের সেরকম কিছু হয় নি, বুঝলি। আমরা শুধুই সবাই বন্ধু। প্রতিমাসের এক তারিখে বিকেলবেলায় আমার অফিস ছুটির সময় দেখতাম, ওরা সবাই আমার অফিসের কাছাকাছি চায়ের দোকানটার কাছে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। এর মানে হলো, আমি মাইনে পেয়েছি, এবার ওদের খাওয়াতে হবে। আমি হাসতে হাসতে বেরিয়ে পড়তাম। বলতাম, চল আজকে কোথায় খাবি? ওরা একেবারে রেডি। ভেনু এবং মেনু দুটোই ঠোঁটস্থ করে চলে এসেছে। খাওয়া, আড্ডা দিয়ে যে যার সঙ্গী নিয়ে নিজেদের গন্তব্য স্থলে রওনা দিতো। আমি আর অয়ন আরো খানিকক্ষণ গল্প করে, যে যার বাড়ি চলে যেতাম। সব থেকে বড় কথা কি জানিস, আমরা কেউ কারোর প্রতি যে অবসেসড, সেটা বুঝতেই পারতাম না। এর আর একটা কারণও ছিলো, আমি বরাবরই একটু টমবয় প্রকৃতির। ইমোশন টিমোশনটা একটু কমই ছিলো। ভাবতাম, এটাই জীবন। 

এভাবে প্রায় চার বছর চললো। অয়ন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি বাকরীর চেষ্টা করছে, তখনো চাকরি পায়নি। 

এদিকে সব বন্ধুরা মোটামুটি চাকরি  পেয়ে বিয়েথা করে সেটল হয়ে গেছে।  কথাগুলো খুব সুন্দর করে যখন গল্পাকারে তন্বী ওর বন্ধুদের বলছিলো, বন্ধুরা নিঃশ্বাস চেপে ওর গল্প শুনে যাচ্ছিলো। তন্বী একটু নিঃশ্বাস  নেয়। 

সবার চোখেমুখে কৌতূহলের রেশ। 

তন্বী একটু জল খেয়ে আবার শুরু করলো। 'আসলে কি জানিস, ওই মিষ্টি মধুর দিনগুলোর কথা মনে পড়লেই আমি কেমন আত্মহারা হয়ে পড়ি রে। এরপরে কতো বছর পার করে এসেছি, কেন জানি না, ওই দিনগুলো আমাকে মজিয়ে বেড়ায়। 

যাই হোক, এবারইতো আসল কথাটা বলবো। গল্পের ট্যুইস্ট শুরু হতে চলেছে।'   সবার চোখে মুখে বিরাট বিস্ময়। বিস্ময়টা আসলে কিচ্ছু নয়। তন্বীর কথা অনুযায়ী প্রেম, কিন্তু প্রেম নয়। কিরকম একটা কাঁটা বিঁধে খচখচ করার মত অবস্থা!  

তন্বী বলে, 'তোরাতো জানিস, আমার  বরাবর পাহাড় খুব পছন্দের। থেকে থেকেই ছুটি পেলে, আমি এখনো সঙ্গে কাউকে না পেলে, একাই প্রকৃতির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ি। 

সেবার কিছু একটা উপলক্ষ্যে তিনদিনের মত আমার অফিস ছুটি ছিলো। অয়নকে বললাম, 'চল না, পুরুলিয়াটা ঘুরে আসি।' অয়ন বলে, 'আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তুই তোর বাড়িতে কী বলে বেরোবি, ভেবেছিস?'

আমি বলেছিলাম, 'আমার মা, আমাকে খুব বিশ্বাস করেন। মা'কে শুধু বলে যাবো, বন্ধুদের সাথে যাচ্ছি। ব্যস, মা নিশ্চয়ই অনুমতি দেবেন।'

যেমন ভাবা তেমন কাজ। আমরা  কোলকাতা থেকে ওখানে থাকার কটেজ বুক করে নিয়েছিলাম। পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে সোজা পুরুলিয়ায়। স্টেশনে নেমে কটেজে যাবার সময় আমরা  একজন ভদ্রলোককে দেখে ছিলাম। প্রায় ছ'ফুট ভদ্রলোকটিকে দেখে, অয়ন প্রায় জোরেই আমাকে বলেছিল, 'জানিস, ওনাকে দেখে আমার প্রবাসী বাঙালী বলে মনে হচ্ছে। দেখ, পায়ে পুরোনো, ধুলো মাখা পুমা'র জুতো পড়েছেন।' কথাটা শুনে আমি ওর দিকে বড় বড় করে চোখ পাকিয়ে ওকে ইশারায় চুপ করতে বললাম। অয়নও কেমন ঘাবড়ে গিয়ে চুপ করে গেল। 

আমাদের কটেজে পৌঁছানোর জন্য যখন বাসস্ট্যান্ডে এসে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি,  ভদ্রলোকটি নিজেই এসে আমাদের সাথে পরিচয় করেন। সামনে এসেই হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন,  'আমি স্নেহাশীষ সান্যাল। বলতে পারো, তোমাদের মতোই পর্যটক।

দু'জনেই এসেছো বুঝি? তোমরা বন্ধু?' 

আমরা স্মিত হাসি দিয়ে, ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালে, উনি বললেন, 'এবারে এখনও পর্যটক বেশ কম। তাই লাস্ট বাসটাও কিছু আগে বেড়িয়ে গেছে। যদি আপত্তি না থাকে, চলো আমি তোমাদের সাথে তোমাদের কটেজ পর্যন্ত যাচ্ছি। তবে হেঁটেতো যাওয়া যাবে না।' ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি একটু ঘাবড়িয়েই গিয়েছিলাম। কারণ, সেখানে আর কোনো যানই ছিলো না। এভাবে যখন আমরা অপেক্ষা করছি, দূর থেকে একটা বালি বোঝাই লরি আসছিলো। ভদ্রলোকটি হাত দেখিয়ে লরিটিকে থামিয়ে, ড্রাইভারকে বুঝিয়ে সব বলতে, ড্রাইভার আমাদের তিনজনকেই তার সিটের পাশে বসিয়ে নিয়েছে। অযোধ্যা পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে যখন গাড়ি চলছে, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখে, সকলেই বাক্যহারা। সারা পাহাড়টাকে লাল পলাশ যেন মুড়ে দিয়েছে। পাহাড়  আগুন রঙে রেঙেছে। ভদ্রলোক মহুয়ার নেশায় আচ্ছন্ন। তাঁর সর্বাঙ্গে মহুয়ার গন্ধ। আমরা নেশা করিনি বটে, ওই গন্ধে আমরাও কেমন বুঁদ হয়ে যাচ্ছিলাম।

মনে মনে ভাবছিলাম, এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় এমন শুভাকাঙ্খী ক'জনার ভাগ্যে জোটে। আমরাতো খুশিতে ডগমগ। যদিও বেশ রিজার্ভ ছিলাম। মাঝেমাঝে অবশ্য ভদ্রলোক নিজেই কথা বলছিলেন। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে জানান, পুরুলিয়ার জনজীবন নিয়ে উনি রিসার্চ করছেন। কাজের সূত্রে তাঁকে এখানে বহুবার আসতে হয়। তাই তিনি এখানকার মানুষজন, বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে বেশ অবহিত। সঙ্গে এটাও বললেন, 'তোমরা যে কেন বাপু এতো চুপচাপ, বুঝতে পারছি না।  তোমরাও তোমাদের কথা কিছু বলো। ও হ্যাঁ তোমরা কিন্তু আমাকে সান্যাল'দা বলেই সম্বোধন কোরো।' আমরাও মিষ্টি হাসি দিয়ে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। 

সরকারী কটেজ, সবাই চেনে। ড্রাইভার কটেজের সামনেই গাড়ি থামায়। 

আমরা তিনজনেই লরি থেকে নেমে পরি।

ভদ্রলোক আমাদের কটেজে পৌঁছিয়ে যাবার সময় বলে গেলেন, 'আজ অনেক ধকল গেছে। রেস্ট নাও। কাল সকাল সাতটার সময় আমি চলে আসবো। তোমরা রেডি থেকো।'

সেদিন ছিলো পূর্নিমার রাত। আমরা ছাড়া বাকি কটেজে কোনো মানুষজন ছিলো না। কেয়ারটেকার খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। আমরা রাতের খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে, বাইরের বারান্দায় বসে ভরা পূর্ণিমায় প্রকৃতির অপূর্ব রূপ প্রত্যক্ষ করছি। চারিদিকে অখণ্ড নির্জনতা বিরাজ করছে। আমরাও ওই নির্জনতায় ডুব দিয়েছিলাম। দু'জনার কারো মুখে কোনো কথা নেই। অনতিদূরে অযোধ্যা পাহাড় আর তার উপর দিয়ে তূর্গা জলপ্রপাত থেকে ঝর্ণার জল পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে। চাঁদের আলোয়, সে এক নৈসর্গিক রূপ প্রত্যক্ষ করছিলাম। আর ঠিক তার পরে পরেই আমাদের কেমন বিবশ অবস্থা। ততক্ষণে, কী এক অজানা আবেগে আমি ধীরে ধীরে অয়নের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করে ফেলেছিলাম। আমরা নিজেরা কতক্ষণ যে ওই জ্যোৎস্নার আলোয় মাখামাখি করে নিজেদের একাত্ম করে ফেলেছি, বুঝতেই পারিনি।

পরের দিন ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙে। স্নান সেরে, ব্রেকফাস্ট করে রেডি হয়ে গিয়েছিলাম। সান্যাল'দা যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে গিয়েছিলেন। আমরা ওনার সাথে বেরিয়ে পড়েছিলাম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করি।  ছোট বড় নুড়ি পাথর পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। গাছ পাতার সবুজের কী যে বৈচিত্র্য বলে বোঝাতে পারবো না। একরকম পাতা দেখলাম, মনে হবে টকটকে লাল রঙা ফুল। না রে, ওগুলো পাতা। ওদিকে তুর্গা ওয়াটার ফলস থেকে জল অযোধ্যা পাহাড়ের গা বেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। অপরদিকে লাল পলাশে প্রকৃতি রেঙেছে। 

হঠাৎ ভদ্রলোক বললেন, আমি কিন্তু ওই ঝর্ণার জলে স্নান করবো। কী তীব্র গতিতে জলধারা লাফিয়ে নীচে পড়ছে। আমি নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না। স্নানে মত্ত হয়ে পড়লাম। অনতিদূরে অয়ন মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হাতের ইশারায় ওকে ডাকলাম। ও ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। স্নান সেরে উঠে আসতে যতটুকু সময় লেগেছে, রোদের প্রখর তাপে, গায়ের জামাকাপড় গায়েতেই শুকিয়ে গিয়েছিল। 

অয়ন বলছিলো, 'এরকম পাগলামি করিস বলেই আমার একটুও ভালো লাগে না, বুঝলি? অসুখে পড়লে কী করবি?' 

আমি বললাম, 'হ্যাঁ রে, মনে হচ্ছে তুই কেমন যেন অ-সুখে পড়ছিস? কী দেখছিলি অমন জুলজুল করে। অয়নের চোখে মুখে দুষ্টুমি খেলে গেলো। 

ঝর্ণার জলে স্নান করে বেশ খিদেও পেয়ে গিয়েছিলো। আমরা ফিরতে শুরু করলাম।

কটেজে পৌঁছে, কেয়ারটেকারকে বললাম, রাতের জন্য একেবারে হালকা করে কিছু বানিয়ে দিতে। পরের দিন বাড়ি ফিরতে হবে। তাই জামাকাপড় সব কিছু লাগেজ বাক্সবন্দী করে ফেললাম। অয়ন বললো, 'আমার রুকস্যাকটা একটু গুছিয়ে দে তো,' বলে নিজের দাড়িগোঁফ সেভ করতে লেগে গেলো। আমি ওর সব কিছু গুছিয়ে ফেললাম। 

গোছাতে গোছাতে আমি কেমন ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। জানিস, কী জানি কেন, আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল পড়েছিলো। অয়নের দৃষ্টি তা এড়িয়ে যায় নি। বললো, 'কি রে কাঁদছিস কেনো? কিছু কি ভাবছিস?'

আমি তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে বললাম, 'মোটেও না, আমি কাঁদছি না। আর মোটেও কিছুই ভাবি নি।'

অয়ন মুচকি হেসে বললো, 'সব কিছু না হলেই ভালো।'

আমি ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। 'কী কী বললি, সবকিছু নেগেটিভ হবে না?'

অয়ন বললো, 'সেটা অবশ্য আমার থেকে তুই ভালো বলতে পারবি।'

জানিসতো, আমার তখন এতোটা লজ্জা লাগছিলো যে, কি বলবো। আমিতো আসলে ....। 

যাক, আমরা ওই রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। পরের দিন বাড়ি ফেরা। 

ভোরের ট্রেন ধরে যথারীতি যে যার বাড়ি যাচ্ছি।

হঠাৎ অয়ন আমাকে বললো, 'শোন তনু, একটা কথা বলবো রাখবি?' 

আমি বললাম, 'বাওয়া, তুমি কি মহুয়ার নেশা করেছো নাকি, চাঁদ? অত কিন্তু কিন্তু করছো কেনো, বলেই দেখো না। রাখি কিনা। 

ও বললো, 'শোন, বাড়ি ফেরার পর  থেকে টানা এক সপ্তাহ আমরা দু'জনে কেউ একে অপরের সাথে দেখা করবো না। ঠিক আছে তো?'

আমি বললাম, 'আলবাৎ ঠিক আছে। মাত্রতো এক সপ্তাহ। ওকে বস,' বলে দু'জনে যে যার গন্তব্য স্থলে রওনা দিলাম। 

পরের দিন থেকে আবার অফিস। আবার পুনর্মূষিকঃ ভব।' আমি অফিসে চলে গেলাম। ভীষণ কাজের চাপ। দম ফেলার সময় নেই। সব ঠিকঠাক। অফিস যখন ছুটি হলো, অয়নের জন্য আমার মনটা কেমন ছটপট করে উঠলো। সাথে সাথেই মুঠোফোনের বাটনে আঙুল চলে যেতেই তাড়াতাড়ি নিজেকে সংবরণ করে ফেললাম। মনে পড়ে গেলো, অয়নের কথাটা। এক সপ্তাহ আমরা একে অপরের সাথে দেখা করবো না! বাড়ি চলে এলাম। আশ্চর্য ব্যাপার কি জানিস, বাড়িতে এসেও আমি স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। মনের মধ্যে কেমন একটা অস্থিরতা কাজ করছে। আমার কাছে এক সপ্তাহ মানে, মনে হচ্ছিলো যুগ যুগান্ত ব্যাপী বিরহ যন্ত্রণা।

আবার নিজেকে চেপে সংযত করে রাখলাম। এভাবে অতি কষ্টে আরো দু'দিন অতিবাহিত করলাম। আর পারলাম না। মন তখন পাগলপারা। বড় বেশি যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছি। অয়নের উপর প্রচণ্ড রাগ হলো। বিড়বিড় করে দাঁতে দাঁত ঘষে নিজের মনে বলতে লাগলাম, কী করে ও এতো নিষ্ঠুর হতে পারলো! যেখানে একমুহূর্ত ওকে আমি চোখের আড়াল করতে পারছি না, সেখানে ও কী করে এতো নির্বিকার থাকতে পারে? কী করে একবারও আমাকে না দেখে ও স্থির থাকে? নাহ্, আর ভাবতে পারিনি।   চতুর্থ দিনে অফিস শেষে সোজা অয়নদের বাড়িতে। কলিং বেল টিপতে, ওর বোন বেরিয়ে এলো। অয়নের বাড়ির লোকেরা আমাকে চেনে। যেহেতু আমাকে দেখতে তত ভালো নয়, গৌরাঙ্গীও নই, তাই অয়নের সাথী হিসেবে আমি যে ওদের না পসন্দের তালিকায়, এটা বুঝতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি।  কারণ যখন ওর বোন দরজা খুলে বেরিয়ে, আমাকে দেখেই ভ্রু'টা কুঁচকে বলে উঠলো, 'কাকে চাই?'

আমি বললাম, 'অণু আছে?' 

ও আমতা আমতা করছে দেখে, ও কিছু বলার আগেই আমি বাড়িতে ভিতর ঢুকে পড়লাম। অয়নের মা খুব গম্ভীর ভাবে অণুর ঘরের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে  বললেন, 'অণু ঘুমোচ্ছে।' 

আমি মাসিমা, মানে অধুনা আমার শাশুড়ি মা কে প্রণাম করে, সোজা অয়নের ঘরে ঢুকে পড়লাম। দেখছি ও উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। 

তোরা জানিসইতো, আমার গলার আওয়াজটা একটু জোরেই। তার উপর বেশ উত্তেজিত ছিলাম বলে, গলার স্বর বেশ চড়াই ছিলো। তখন মনেই ছিলো না, আমি অন্য কারো বাড়িতে এসেছি, একটু সংযতভাবে কথা বলতে হবে। 

কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করে, আমি ওকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললাম, 'এই ওঠ ওঠ। কি রে মুখ দেখবি না  নাকি? তুই এমন ভাব করছিস, যেন ঘুমিয়ে আছিস। মোটেও ঘুমাস নি। ওঠ, ওঠ বলছি।'

ও তখনও সেভাবে শুয়ে আছে। বলছে, 'হ্যাঁ রে, এরকম কথাতো ছিলো না।'

আমি বললাম, 'প্লিজ, তুই ওঠ। আমার দিকে একবার দেখ। আমি যে আর পারছি না রে। তোকে না দেখে আমি যে একেবারেই একটা দিন কাটাতে পারছি না।'

ও খিকখিক করে হেসে বিছানার উপর উঠে বসলো। বললো, 'আগে বোস তো।' জলের বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বললো, 'এই নে, জল খা।'

এই বারিধারাই আমার শরীরে তখন একদিক থেকে যেমন প্লাস হচ্ছিলো, অপরদিকে অবিরত ভাবে মাইনাস হয়ে চলছিলো।' মানে একদিকে আমি ঢকঢক করে জল খাচ্ছি, অপরদিকে আমার মতন ডাকাবুকো মানুষটার দু চোখ বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে।

ও আমার এমন অবস্থা দেখে, ওর বোনকে চেঁচিয়ে বললো, 'বনু, আমার আর তনুর জন্য বেশ গাঢ় দুধের দু'কাপ কফি করে আনতো।'

ঘরের দরজাটা আধভেজা ছিলো। ক্ষণিকের ক্ষিপ্রতায় ও প্রায় আমার কাছে চলে এসেছিলো। প্রায় জড়িয়ে ধরার মুহূর্তে, ওকে বললাম, 'আরে, করছিসটা কি?' মাসীমা, নেহা আছে। পাগল হয়ে গেলি নাকি?'

তাড়াতাড়ি ও নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বলছে, 'তোর চোখে জল দেখলে আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। বিশ্বাস কর, গড প্রমিস।' 

'হুমম, তাই জন্যেই তো টানা তিনদিন আমাকে না দেখে ঘরে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিস, যেন তোর ইনটারভেল চলছে।'

'সেটা কোনোদিন হয়? আমি দেখতে চেয়েছিলাম, তোর আমার সম্পর্কটা শুধু মাত্র ইনফ্যাচ্যুয়েশন তো নয়। সত্যিই কি আমরা একে অপরকে ভালোবাসি? বিশ্বাস কর, আমি কিন্তু রোজ তোর ছুটির সময় লুকিয়ে লুকিয়ে তোকে দেখে আসতাম। তবেই শান্ত হতাম। পরক্ষণেই ভাবতাম, তনুটা বড় দস্যি মেয়েতো। বেমালুম আমাকে না দেখে খাসাই আছে! মনটা ভালো ছিলো না রে। 

এই আবার, আবার কাঁদছিস!'

আমি চোখটা মুছে নিয়ে বললাম, 'না রে অয়ন, আমরা আর একে অপরকে ছেড়ে থাকতে পারছি না। চল আমরা বিয়ে করে নেই।'

ইতিমধ্যে দু'কাপ কফি নিয়ে নেহা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, 'সামনের মাসেই চাকরীতে তোর জয়েনিংতো, দাদা। আমাকে কিন্তু কাঞ্জিভরম কিনে দিবি। উঃ! কি আনন্দ। বিয়েতে জম্পেশ করে সাজতে হবে তো, কী বলো বৌমণি!'

অয়ণ ওকে একটা তাড়া দিয়ে ওখান থেকে ভাগিয়ে দিলো। আমিতো খানিক লজ্জা যে পাইনি, তা নয়। তবে আর ওখানে বেশিক্ষণ বসে থাকলাম না। 

'কাল দেখা করবো কিন্তু। চলে আসবি। আসছি মাসীমা,' বলে বেরিয়ে পড়লাম।

আর তার পরেতো বিয়ে, বাচ্চা সংসার, ব্যস সবকিছুই চলছে। তবে সত্যি কথা বলতে কি, টাচ উড, আমাদের মধ্যে এখনো সুড়সুড় করে রোম্যান্সের ধারা কিন্তু অব্যাহত। 

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment