1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

ত্রাণ শিবির

ছবি : ইন্টারনেট

                                                                                                                                                       

ত্রাণ শিবির

বন‍্যা গাঙ্গুলি

'ঝড়' শব্দটাই ভীষণ ছন্নছাড়া। একটা এলোমেলো করে দেবার ব্রত থাকে তার উপাসনায়। ঝড় আসে, ঝড় যায় পৃথিবী পৃষ্ঠে তার লীলাখেলার স্মৃতি হিসেবে ধ্বংসের পদাঙ্ক রেখে যায়। আমরা তার ভীষণকায় শক্তির কাছে অতি সামান‍্য কীটপতঙ্গের মতো ছটফটিয়ে মরি। প্রতি বছরে এইরকমই বৃহৎ আকারের ঝড়েরা এসে মানুষের জীবনগুলোকে ওলোটপালোট করে দিয়ে যায়। ঝড়ে ভালো কিছু হয় বলে তো মনে হয় না। অন্ততঃ আমরা সবাই তাই জানি। কিন্তু কোনো কোনো ঝড় শুধু প্রকৃতির নয়, মানব মানবির জীবনেও প্রবল হিল্লোল তুলে হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে পুনরুজ্জীবিত করে। সে কি!  ঝড়ের আবহে আবার প্রেমের গল্প তৈরি হয় নাকি? ও তো শুধু ধ্বংসের নির্ণায়ক। সৃষ্টিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে তছনছ করে দিতেই আসে। হ‍্যাঁ হয়! জানকি আর রঞ্জনের হারিয়ে যাওয়া প্রেমের গল্প একটা স্থায়ী মাত্রা পেয়েছিলো এইরকমই এক ঝড়ের তান্ডবলীলায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষগুলোর অস্থায়ী আস্তানায়, অর্থাৎ 'ত্রাণশিবিরে'।  গত ইয়াসের ঝড় যখন দিকদিগন্ত ব‍্যাপ্ত করে প্রচন্ড হুংকারে  সুন্দরবনের বদ্বীপগুলোতে প্রবল ধাক্কা মেরে নদীগুলোকে উত্তাল করেছিল। বুড়ো মোহনকাকার আশি বছরের অভিজ্ঞ চোখের তলার মোটা থলিতে, গালের শত সহস্র ভাঁজে, ঈশান কোনের  আকাশের  ছাই রঙ এক অশনি সংকেতের কালো ছবি এঁকেছিল। বুড়ো বড় আক্ষেপ করে বলেছিলো, "আর বুঝি রক্ষা নেই রে জানকি, সে এলো বলে। ছাগল গুলান বেঁধে ঘরে থো।"  মাধবকাকা ফুঁসে ওঠা নদীর জলের রঙ দেখে বলে দিতে পারত  এ ঝড় কতটা স্থায়ী হবে, কোনদিক দিয়ে সে বয়ে যাবে। জানকি মাধবকাকাকে হারিয়েছিল ঝড়ের রাতে  নদীর সর্বগ্রাসী উদরে। যদিও সরকার থেকে নিষেধাজ্ঞা ছিল তাv সত্বেও মৎসজীবি মাধবকাকা ভেবেছিল আজ বোধহয় জালে অনেক মাছ পরবে। বনবিবি বোধহয় তাঁর ঝাঁপি উজাড় করে দেবেন। কিন্তু তা আর হল না। 

জানকিদের পুরো গ্রাম আশ্রয় নিয়েছিল হরিমোহন বালিকা বিদ‍্যালয়ের দোতলার ঘরে। এই সময় জানকির কাজ অনেক কমে যায়। ছাগল বাঁধা, ঘর নিকানো, ঘড়া ভর্তি করে খাবার জল আনা, গড়ান, গেঁওয়া বনের আনাচ কানাচ থেকে শুকনো পাতা আনা, ভাইবোনগুলোকে পান্তা মেখে দেওয়া, সবই বন্ধ। কারণ তারা তো এখন ত্রানশিবিরে। ওই নরকের মধ্যেই পাড়ার শিবেদার বৌ টা প্রসব যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে। শাউড়ি বড় ব‍্যাস্ত হয়ে মারুফার মা কে হাঁতরে বেড়ায় ভীরের মধ‍্যে। তার হাতে নাড়ী কাটার সুনাম আছে। বৌটার তো বাচ্ছা হবে, সে সবই পারে তবে মারুফার মা ভালো নাড়ী কাটে। গ্রামীন প্রসবালয়ে  নাম লিখিয়েছিলো শিবের মা। কিন্তু এখন সব তো জলের তলায়। এদিকে সদার মায়ের বয়স হয়েছে প্রায় নব্বুই ছুঁই ছুঁই বড় অবুঝ, গরম ভাতের জন‍্য মরে যাচ্ছে। সে বুড়ি গরম ভাত খেয়েই মরবে। জানকি সকাল থেকে সেই চেষ্টাই করছে বুড়িটার জন‍্য একটু গরম ভাত জোগাড় করার জন‍্য। পাশের ইস্কুল বাড়ীটাতে ভাত দিচ্ছে। পালে পালে লোক ছুটছে সেইদিকে জানকিও ছোটে। অবশেষে ভাত জোটে, এনে ক্ষুধার্ত ঠাগমা কে ধরে দেয়। খিদেতে তার নিজের পেট জ্বলছে। কিন্তু আবার গিয়ে একশো জনের পিছনে লাইনে দাঁড়াতে হবে। পেটের জ্বালায় যেতে হয় জানকিদের ভাতের লাইনে। এ ওদের জীবনের জীবন্ত পরিস্থিতি প্রতি ঝড়ের পরে। 

ও হ‍্যাঁ প্রেমের গল্পের কি হলো? রঞ্জনের সঙ্গে জানকি গোসাবার একই ইস্কুলে পড়তো। ক্লাস এইট অবধি পড়ে জানকি পড়াশুনো ছেড়ে দেয় সংসারের চাপে। বাবা মাঝরাতে নৌকো নিয়ে বেড়িয়ে যেতো মাছ ধরতে। কতদিন জানকি মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখেছে মা  কুপি জ্বালিয়ে বাবাকে পান্তাভাত গুছিয়ে দিচ্ছে। একদিন এইরকমই ঝড়ের কবলে পড়ে তার বাবা, আর নৌকো নিয়ে ঘাটে ফিরতে পারেনি। 

গায়ের রঙ কালো হলেও ভাইবোনেদের মধ‍্যে জানকি বেশ সুশ্রী। ইস্কুলে  রঞ্জনদা পড়তো ক্লাস টেন আর ও এইটে। ওই বয়সেই রঞ্জনদা অনেকবার তাকে ছুঁয়েছে। পড়াশুনায় সাহায‍্য করেছে। নিজের রুটি তরকারি জানকিকে দিয়ে জানকির পেঁয়াজ মাখা পান্তা খেয়েছে। ইস্কুলের বাথরুমের দরজা বন্ধ করে জানকিকে চুমু খেয়েছে বারকয়েক। স্পর্শ করেছে জানকির অন্তরাত্মাকে। কিন্তু জানকিদের এর বেশি পড়াশুনা মানায় না। দারিদ্র্য চোখ রাঙায়। জানকি ইস্কুল ছেড়ে দিলে রঞ্জনদার সঙ্গে সব আলিঙ্গন শিথিল হয়ে যায়। অনেকবার পথে ঘাটে জল আনতে গিয়ে জানকির সঙ্গে রঞ্জনের দেখা হয়েছে কিন্তু জানকি আনতো মুখে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। রঞ্জন চেষ্টা করেছে তার সঙ্গে কথা বলার কিন্তু জানকিকে ভীষণ লজ্জা, ভয় চেপে ধরতো। শুধু ভাবতো ও বড়লোকের ছেলে আজ সাইকেলের সামনে চাপিয়ে নদীর ধারে নিয়ে যাবে কাল সে কি করে গেরামে মুখ দেখাবে। সবাই বলবে জানকি বড়লোকের ছেলে দেখে টোপ ফেলেছে। নিজেকে সরিয়ে রেখেছ দাঁতে দাঁত চেপে। স্বপ্ন দেখত রঞ্জনদাকে নিয়ে। তারও স্বাদ জাগত রঞ্জনদার ঘরের ঘরণী হবে সে। একটা স্বচ্ছল সংসার পাতবে সে তার স্বপ্নের পুরুষটির সঙ্গে। সদ্য যৌবনা জানকির শরীর মন আন্দোলিত হত রঞ্জনদার সুগভীর স্পর্শ মনে করে। তার মত গরীব ঘরের মেয়ের পক্ষে রঞ্জনদাকে বোধহয় এতটা ভালোবাসা বা চাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু মন যে কিছুতে মানতে চায় না। 

কেটে গেছে প্রায় কয়েক বছর। রঞ্জন এখন সরকারি ইস্কুলের শিক্ষক। তাই তার ডিউটি পরেছে ত্রানশিবিরে। বর্তমানে যেখানে তার পুর্ব প্রেমিকা জানকি আশ্রিতা। গতকাল রাতে এসে পৌঁছেছে রঞ্জনরা প্রচুর চাল, ডাল, মশলা, তেল, ওষুধ, ত্রিপল, শুকনো খাবার আরও অনেক নিত‍্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে। চারিদিক জলে ডুবে গেছে। এখানকার মর্মান্তিক  দৃশ‍্য  দেখে রঞ্জন মনে মনে ভাবে "আমিও এই গ্রামেরই একজন বাসিন্দা ছিলাম। আজ আমারও এই একই অবস্থা হতো যদি চাকড়িটা পেয়ে  শহরে  চলে না যেতাম।" দু তিনদিন কেটে গেছে ঝড় তার শক্তি ক্ষয় করে থেমে গেছে। কিন্তু নদীর ফোঁসফোঁসানি যেন থেমেও থামছে না। সকাল থেকে ব‍্যাস্ত রঞ্জন রা। অভূক্ত মানুষগুলো পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে একটু ভাতের জন‍্য। থালা বাটি হাতে মানুষের  দীর্ঘ লাইন। গোটা দশ বারো জনের পেছনে রঞ্জন একটা খুব পরিচিত মুখ দেখতে পেল। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছে না। মহামারীর বিষ থাবা থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন‍্য বেশিরভাগ মানুষই মুখে মাস্ক পড়ে আছে। তবুও রঞ্জনের চিনতে ভুল হয়নি। "জানকি তো! একি হাল হয়েছে ওর!" লম্বা লাইন এগিয়ে জানকি কাছাকাছি এলে রঞ্জন সকলের সামনে কোনো কথা বলতে পারে না জানকির সঙ্গে। জানকি রঞ্জন কে খুব ভালো করে চিনতে পেরেছে। কিন্তু আজ তার কোনো জড়তা নেই। এখন তাদের শুধু বাঁচার ও বাঁচাবার লড়াই। রঞ্জনদার স্পর্শ এখনও তার মনে শিহরন জাগায় না। সেই সব দিনের কথা ভেবে জানকির এখন কষ্ট হয়না বরং নিজের এই শরীরটার প্রতি, ভাগ‍্যের প্রতি ধিৎকার জাগে। বাপটা জলে তলিয়ে গেল, মা টা একশো দিনের কাজ করে ইঁটভাটায়। নেশাভাঙ্গ করে, বাইরে পুরষ সঙ্গীও আছে। তার কথা মা ভাবেই না। তিনটে ভাইবোন কে চারবেলা গেলানো তার যেন অলিখিত কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের লোক নানা কথা বলে জানকি আর তার মা, সে সবে কান দেয় না। জানকির মা শুধু বলে ভালো ছেলে পেলে তোর বে দিয়ে দেবো। কিন্তু ওই মুখের কথাই সার। যখন জানকি তার ভাইবোনকে নিয়ে ভাত নেবার জন‍্য থালা বাড়ায় তখন রঞ্জন কায়দা করে বাথরুম যাচ্ছি বলে সরে যায়। ভাত জানকিরা পেয়ে যায়। কিন্তু মনে মনে ভাবে জানকি "রঞ্জনদা এইরকম করলো কেন? ও আচ্ছা আজ তো আমি ত্রানশিবিরের কাঙাল, রঞ্জনদার বোধহয় সন্মানে লাগলো। ইশ্ এই ভিখারিনীকে  ছুঁয়েছিলাম!" গরম ভাতের ধোঁয়ার সঙ্গে পুরোনো স্মৃতিগুলো কিরকম উবে যেতে থাকে জানকির মন থেকে। ত্রাণশিবিরে যে ইস্কুলবাড়ীটা তে জানকীরা আশ্রয় নিয়েছিলো সেই বাড়ীর দোতলায় উঠতে শিঁড়ির নিচে একটু আড়ালে রঞ্জন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল জানকির জন‍্য। শয়ে শয়ে লোকের মধ্যে  সমস্ত দ্বিধা পেড়িয়ে ফুঁসে ওঠা মাতঙ্গীর মতো উপছে পড়া আবেগ নিয়ে রঞ্জন জানকি কে নাম ধরে ডাকে। জানকি শুনেও না শোনার ভান করে। তবুও একটা টান টানতে থাকে জানকি কে। ফিরে তাকায়। হাতে গরম ভাতের ছ‍্যাঁকা লাগে। "যাক তাহলে চিনতে পেরেছো আমাকে। কেমন আছো তুমি রঞ্জনদা? এখন কোথায় থাকো?_ কলকেতে?" এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে যায় জানকি।  "তোকে অনেক খুঁজেছি রে। গ্রামে এলেই আশেপাশের মানুষজনকে তোর কথা জিজ্ঞাসা করেছি। কেউ তোর সন্ধান দিতে পারেনি। অবশ‍্য আমি এ গ্রাম ছাড়ার পরে মাত্র দুবারই এসেছিলাম। জিনিসপত্র নিয়ে যেতে। তুই তো জানিস দিদি মারা যাওয়ার পরে  দুটো ছেলেপুলে নিয়ে জামাইবাবু আবার বিয়ে করেছে। মায়ের পক্ষে সহ‍্য করা সম্ভব হচ্ছিল না। বাবা মারা যাবার পর থেকে মা আমাদের দুই ভাইবোনের জন‍্য অনেক কষ্ট করেছে। দিদির বিয়ে দেওয়া, আমার পড়াশুনার খরচ চালানো। জামাইবাবু ক্রমশ ঘাড়ে চেপে বসতে লাগলো। ভিটেমাটি যা ছিল সব মা কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিক্রি করালো। নিজে বেশ কিছু অংশ বুঝে নিলো দিদির ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। যত দিন যেতে লাগলো তত অসহায় হতে লাগলাম মা আর আমি। আমি তখন নাবালক কিছুই বুঝি না। তাই দিদিটা আমার অকালে চলে যাবার পর জামাইবাবুর দ্বীতিয় সংসার থেকে একদিন মা আর আমি যেটুকু টাকা পয়সা ছিলো তাই সম্বল করে কলকাতায় একটা ঘর ভাড়া করে সংসার পাতি। মা বেটায় কোনোরকমে চলে যেতো। আমি উচ্চমাধ‍্যমিক পরীক্ষা দি আর সঙ্গে ছেলে পড়ানো শুরু করি। আর মা ঘরে সেলাইয়ের কাজ করত। তারপর কলেজ শেষ  করে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে থাকি। হঠাৎ করে এই চাকরিটা পেয়ে যাই। মায়ের সে কি আনন্দ তোকে বলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু মা সেই সুখ বেশিদিন নিতে পারল না। আসলে  মায়ের কপালে সুখ লেখা ছিলো না রে। গতবছর করোনার করাল থাবা মা টাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলো। শেষ দেখাটুকুও মাকে দেখতে পাই নি। কিন্তু বিশ্বাস কর জানকি তোকে আমি মনে মনে খুব খুঁজেছি। ভাবতাম হয়তো অন‍্য কারোর ঘরনি হয়ে ছেলেপুলে নিয়ে সুখে শান্তিতে ঘর করছিস। তোকে এখানে এইভাবে দেখবো এ আমি ভাবিনি।" জানকি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। টপ টপ করে চোখের জল ভাতের ওপর পরতে থাকে। কোনো উত্তর দিতে পারে না সে। শুধু বলে, "রজ্ঞনদা তুমি এবার বিয়ে করে নাও।শহরে তো অনেক শিক্ষিত মেয়ে আছে তাদের কাউকে!"

 রঞ্জন একটা সজোরে ধাক্কা খেল যেন। ওই ফুঁসে ফুঁসে ওঠা নদীর মতোই জানকি আজ অনেক তেজস্বিনী।  নিজের  চলমানতার শক্তির কাছে অনেক বেশী আত্মবিশ্বাসী। কারণ বাস্তবটা আজ তার চোখের সামনে অনেক বেশী জীবন্ত।"ও.. ও জানকি শিবের বৌ টা ছেলে বিইয়েছে রে।" এতো কষ্ঠের মধ‍্যেও  ফোগলা দাঁতে একগাল হেসে শিবের মা জানকি কে খবরটা দেয়। জানকি সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে বেশ চিৎকার করে বলে, "খুড়ি ওর নাম রাখো প্রলয়।" বুড়ির কানে কথা পৌঁছলো না। প্রচুর লোকের সহাবস্থান সেখানে তারপর আছে নদীর স্রোতের উল্টো টানের শব্দ। রঞ্জন নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অপরাধীর মতো। "রঞ্জনদা আমি যাই গো। ওদিকে বোধহয় আমাদের জায়গাটা কেউ দখল করে নিয়েছে।" রঞ্জন মনে মনে ভাবে " না জানকি কে বিয়ের প্রস্তাব দিলে বোধহয় রাজি হবে না। কিন্তু তার প্রথম প্রেম তো জানকিই। জানকির এই শক্তিরূপেন মূর্তিই তো তার কাঙ্খিত নারী মূর্তি।  এভাবে রঞ্জন জানকিকে অনেকবার বলার চেষ্টা করে। কিন্তু জানকি বুঝেও না বোঝার ভান করে। জানকি নিজের সুখের কথা আর ভাবে না। বার বার ঝড় এসে ওদের আটপৌরে জীবনগুলোকে তছনছ করে দেয়। সুখের স্বপ্ন জানকিরা আর দেখে না। হারিয়ে ফেলার ভয়ে। রঞ্জন জানকিকে ইনিয়ে বিনিয়ে তার সঙ্গে  ঘর বাঁধার  প্রস্তাব দিলে জানকি শূণ‍্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রঞ্জনের দিকে। "রঞ্জনদা আমাদের জীবনগুলো, প্রানগুলো এখন সুন্দরবনের অস্তিত্বের মতোই অনিশ্চিত। আদপে এই ব-দ্বীপ গুলো থাকবে কিনা মানচিত্রে, সেটাই অনিশ্চিত। আমি ছাড়া আমার ভাইবোনগুলো ভীষণ অসহায়। ইস্কুলের মিড ডে মিল ও এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তুমি আমার জন‍্য ভেবো না রঞ্জনদা। পঞ্চায়েতের বৈঠকে মা আমার জন‍্য গ্রামীন স্বাস্থ‍্যকর্মীর কাজে নাম লিখিয়েছে। ওরা বলেছে "তোমার মেয়ে ক্লাস এইট আবধি পড়েছে, ওর একটা বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। তাই মনে মনে ভাবি রঞ্জনদা তখন ভাগ‍্যিস বাবা ইস্কুলে ভর্তি করিয়েছিলো।" রঞ্জন অবাক হয়ে জানকিকে দেখতে থাকে। সত‍্যি ঝড় শুধু ধ্বংসই করে না সৃষ্টিও করে। নদীর জল ফুলে ওঠে দুকূল ভাসিয়ে দেয় বাঁচার ও বাঁচানোর লড়াইটাকে শেখাবার জন্যই।  "রঞ্জন চলো এখনকার মতো ত্রাশিবিরের কাজ শেষ। ত্রানসামগ্রীও মোটামুটি শেষ। আবার হয়তো পরে পাঠাবে আমাদের" বারুইদা রঞ্জনের পিঠে হাত রেখে কথাগুলো বলেন। রঞ্জন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "হ‍্যাঁ আমাকে বার বার আসতে হবে এখানে। এখন চলুন। যাওয়া যাক।" আর মনে মনে বলে এই অচেনা জানকিকেই তাকে চিনতে হবে। সে যতদিন লাগে লাগুক। জানকির সেই লড়াকু চোখদুটো চোখ বন্ধ করেও দেখতে পায় রঞ্জন। যেখানে প্রেম চির শ্বাশত, ভীষণ সত‍্যি। সে তো এইরকমই একটা জানকিকে চায় তার জীবনযুদ্ধের সেনাপতি হিসেবে। কারণ জানকি তো মা দুর্গার মত শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। 

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment