![]() | |
|
হুঁটুদাসের ডুগডুগি
শ্রীকান্ত অধিকারী
বাড়িতে কেউ নেই,সবাই একা।
প্রত্যেকদিনের মত আজও ঘুম থেকে উঠে বাঁ হাত দিয়ে চোখ কচলালো পুটু। বিছানায় বসে বসে অভ্যাস বসে বিরাট হাই তুলতে তুলতে শব্দ করল। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল কারও ডাকের জন্য। যদিও সে জানে কেউ ডাকবে না। আসলে ডাকার কারও গরজ নেই। যদি কখনও পুটু বলে বসে,-মা আমায় ডাকলে না।
মা বলবে, পুটু আমার বড় হয়ে গেছে। ও তো নিজেই নিজেই উঠতে পারে। বাথরুম করতে পারে, মুখ পরিষ্কার করে ব্রেকফাস্ট করতে পারে। পুটু আমার বিলো ফাইভ তো নয়। ও সব করতে পারে।
করতে পারে তো। তাই ওর তাড়াতাড়ি ওঠার তাগিদও নেই। সে একবার সিলিঙের কোণার দিকে তাকিয়ে ভেবে নেয় কি বার? –ফ্রাইডে! আজ ছুটি। ইংলিশ ম্যাডাম আসবে না। এবার সে মাথাটা বালিশে গুঁজে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। আর কান খাড়া করে থাকে কারও ডাকের জন্য। যদি কেউ ডাকে।
কিন্তু কেউ ডাকে না। তখন বিড়বিড় করে, আছে কিন্তু কেউ নেই--সবাই একা। মা এখন ফোনে ব্যস্ত থাকবে। বাবা ল্যাপটপে নিউজপেপার ডুবিয়ে ব্রেকফাস্টে মগ্ন। দাদু দূরদর্শনে এক দাড়িওলার বক্ষোদর কম্পনে হিল্লোলিত। শ্বাস চেপে গাল ফুলিয়ে বুঃ -বুঃ করেই যাবে। পাশ দিয়ে বাঘ পেরিয়ে গেলেও শুনতে পাবে না। আর ঠাম্মা!–আহঃ আহঃ করতে করতে হাঁটু ধরে ধরে কোমর বেঁকিয়ে দোতলার বারান্দায় এ পাশ ও পাশ করে মর্নিংওয়াকে বিজি থাকবে। আর খবর রাখবে দুধ এলো কি না। এই বুঝি কাজের মাসি রান্নার পিসি কলিং বেলে চাপ দিল।
বাড়িতে সবাই ব্যস্ত। এমনকি ফাইটার ফিস দুটোও। ওদের সবেতেই ফাইট। একসঙ্গে থাকলেই ফাইট। তাই ওদের জন্য দুটো আলাদা জার। আবার একা থাকলে এ ওর মুখের দিকে ঠাই পাতাহীন চোখে চেয়ে চেয়ে লেজ নাড়ে।
ফাইটার ফিসের কথা মনে পড়তেই খেয়াল হয় ওদের এখন একটা করে মশা প্রয়োজন। ব্রেকফাস্টে ওরা গোটা গোটা মশা খায়। মশার জন্য ওকে বাগানে যেতে হবে। মশা গাছের রস খায়। কিন্তু ঘরে ঢুকলে মানুষের রক্ত। মানুষের রক্ত ওদের দারুণ পছন্দ। ঘরে দিনরাত অলআউট চলে। ভীতু মশা তাই ভয়ে ঘরে ঢোকে না।
বাগানে গিয়ে দাঁড়াতেই বেশ ক’টা খাবুটে মশা ওর কচি ফর্সা পায়ের রস নিতে শুঁড় বের করলেই দে থাপড়া। দক্ষ হাতের আঘাতে লটকে পড়ে মাটিতে। আধমরা দুটো মশাকে কুড়িয়ে হাতের তালুতে আলতো করে রাখতে যাবে অমনি বেজে ওঠে--ডুগ ডুগ ডুগ ডুগ –ডুরুম! ডুরুম!
সে ছুট্টে যায় গ্রিল দরজার কাছে।
ওর সামনে লোকটা দাঁড়ায়। হাতের দড়ি দিয়ে বাঁধা সঙ্গে দুটো বাঁদর। রঙ বেরঙের কাপড় পরানো। ওকে দেখেই এক গাল হাসি মেখে বলে–বরবউয়ের খেলা দেখবে নাকি ছোটবাবু? দেখবে আমার বাবুমশাই টোপর মাথায় লাঠি কাঁধে বিয়ে করতে যাবে?
লোকটা কী বলছে সেদিকে কোনও ধ্যান নেই,ওর তখন ঐ বাদ্যযন্ত্রটার প্রতি নজর। কি কৌতূহল ওর চোখেমুখে!--আজব এক জিনিস! অতি উৎসাহে বলে, আঙ্কেল ওটা কি?
--হুঁটুদাসের ডুগডুগি। দেখবে এই ডুগডুগি বাজাব আর ওরা কেমন খুশিতে নাচতে শুরু করবে। ডুগ ডুগ ডুগ ডুগ–ডুড়ুম ডুড়ুম–চাঁদ বদনী ধনি নাচ তো দেখি।
কি আশ্চর্য! সত্যি সত্যি ওই দুটো বাঁদর কেমন লাফিয়ে লাফিয়ে নাচতে শুরু করে। কখনও একবার ছোটটা তো একবার বড়োটা। সে কি লাফালাফি।
--কী বললে হুঁটুদাসের ডুগডুগি? পুটু ফিক করে হেসে ফেলে।--ওটা বাজালেই ওরা নাচবে?
--হ্যাঁ। যার সামনে বাজাবে সেই নাচবে।
--বাজালেই নাচবে?
--হুঁ নাচবে তো। এই দ্যাখ। বলেই সেই লোকটা আরও জোরে জোরে ওর সেই ডুগডুগি বাজাতে শুরু করে। অমনি বাঁদরগুলো তিড়িং বিড়িং করে নাচতে লাগে।
আর থাকতে না পেরে পুটু চেয়েই ফেলে,--ওটা আমায় দেবে?
--আমি তো এমনি এমনি দিই না। কিছু তো লাগবে।
পুটু চুপ করে যায়। তারপর বলে, আমার টিফিন বক্সে পাঁচশ টাকা আছে। দেবে?
মাদারি বলে, টাকা পয়সা আমার চাই না।
-তবে?
-কথা দিতে হবে।
-কী কথা?
-দাঁড়াও ওদের শুধোয়। বলেই মাদারি দুই বাঁদরের মুখের কাছে কান নিয়ে যায়। তারপর ওরা তিনজনে কি যেন ফুসুর ফুসুর করে আর ঘাড় নাড়ে।
পুটু হাঁ করে ওদের দিকে চেয়ে থাকে।
মাদারি তখন এক গাল হেসে বলে, ওরা বলছে ওদের নাকি মানুষেরা খুব জ্বালায়। ঢিল ছোঁড়ে। তাড়া করে। চকলেট বোম ফাটায়। কত কি করে ভয় দেখিয়ে তাড়ায়। বল তো ওরা তাহলে কোথায় যায়?
পুটু মাথা নাড়ে।
-তুমি যেন কখ নো কোনো জন্তু জানোয়ারকে ভয় দেখাবে না, কথা দিতে হবে। তবেই তোমাকে এই মজার ডুগডুগিটা ওরা দেবে। কি বল?
পুটু সজোরে মাথা হেলিয়ে ওদের কথা মেনে নেয়।
তারপর সে কি আনন্দ! পুটু নাচতে নাচতে অনভ্যস্ত হাতে ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে ডাইনিঙে আসতেই দেখে ফাইটারফিসগুলো নেচে নেচে উঠছে। কাচের জারের ভেতরেই কেমন ঘুরে ঘুরে কোমরে মোচর দিয়ে পাখনাগুলো তির তির করে কাঁপাচ্ছে। মশা খাবার সময় নেই।
অবাক ! অবাক করার মত ঘটনা। ফাইটারফিস নাচছে!
একছুটে মায়ের কাছে গিয়ে ডুগডুগি বাজিয়ে বলে, মা দেখবে এসো, ফাইটারফিসগুলো কেমন নাচছে।
পুটুর হাতে এক অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্র দেখে পুটুর মা’র দম আটকে যাবার জোগাড়।--এ কি রে! কী এটা? বাজাতো আরেকবার।
--হুঁটুদাসের ডুগডুগি। পুটু খিল খিল করে ওঠে।
পুটুর বাজানো ডুগডুগির ডুগ ডুগ ডুড়ুম ডুড়ুম শব্দ শুনতেই পুটুর মা পুটুকে কোলে তুলে দুলিয়ে দুলিয়ে গান করে,--‘পু -টু আমার ছুটুছেলে কাপড় পরতে জানে না।’
মা পুটুকে কোলে করে নাচতে নাচতে নিয়ে যায় ওর বাবার কাছে,--চল বাবাকে দেখাবি। ওর বাবা তখন ল্যপটপ খুলে ঘাড় গুঁজে কি সব দেখছে। পুটুর ডুগ ডুগ ডুড়ুম ডুড়ুম বাজনা শুনে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে অদ্ভুতভাবে ওর দিকে চেয়ে বলে, কোথায় পেলি রে? দে আমায় দে।
সঙ্গে সঙ্গে পুটু বলে, আগে কথা দাও কোনো জন্তু জানোয়ারকে ভয় দেখাবে না। তবেই দেব।
-কে বলেছে?
-ওই লোকটা, যে আমাকে এই ডুগডুগিটা দিয়েছে।
-বেশ কথা দিলাম। কোনো জানোয়ারকে ভয় দেখাব না। এবার তো দে।
ডুগডুগি হাতে নিয়েই ওর বাবা এক পা অন্য পায়ের হাঁটুর ওপর তুলে লাফাতে লাফাতে বলে, এই ভাবে নেচে নেচে বাজাতে হয় ডমরু, বুঝলি হাঁদা। পুটু অবাক হয়ে দেখে ওর বাবা অদ্ভুত কৌশলে এক পায়ে নাচছে। ওর বাবা যে এমন সুন্দর নাচতে পারে আগে কখনও দেখে নি।ওর মা খুশিতে হাততালি দিয়ে ওঠে।
পুটু কাউকে কিছু না বলে সোজা দোতলায় চুপি চুপি গিয়ে দাদুর কানে বাজিয়ে দেয়–ডুগ ডুগ ডুগ–ডুড়ুম ডুড়ুম।
অমনি দাদু পুটুকে পেয়ে যেন বাঁচল এমন ভাব দেখিয়ে বলে, দেখ দেখ কেমন তুলেছি। বলেই পেটটাকে একবার ভেতরে একবার বাইরে এনে দোলাতে থাকে। আর ফোকলা দাঁত বের করে বলে, অ্যাদ্দিন কেন এটা করতে পারছিলাম না বলতো! বাজা বাজা। বাজাতো আবার। দাদু পেটে ঢেউ খেলায় আর নাতি ডুগডুগি বাজায়।
দাদু নাতির সৃষ্টিছাড়াকাণ্ড দেখে ঠাম্মা হতভম্ভ। প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে নাতির হাত থেকে বাদ্যযন্ত্রটা কেড়ে নিয়ে বোল শুরু করে–
ডুগ ডুগ ডুড়ুম ডুড়ুম…
অমনি পুটু ঠাম্মাকে বলে, বাজাবার আগে কথা দাও কোনো জন্তু জানোয়ারকে ভয় দেখাবে না।
ঠাম্মা ফোকলা দাঁত বের করে হাসে। বলে, ঠিক আছে ঠিক আছে।
ঠাম্মা ডুগডুগি বাজায়…
-ডুগ ডুগ ডুড়ুম ডুড়ুম
বল শিব বলরে ব্যোম।
বম বম বম শিবম
নেত্য করে খা আলুরদম।
হাততালি দেয় আর ধেইধেই করে ঠাম্মার সামনে ওই বাঁদরগুলোর মত নাচতে থাকে। মাঝে মাঝে ফোরং কাটে, বউ শ্বশুরঘর যাবে?
ঠাম্মাও হাঁটুর ব্যথা ভুলে পুটুর সঙ্গে বরবউ খেলে। হঠাৎ ছোটবেলার একটা মিষ্টি দুপুর এসে দাঁড়ায় ঠাম্মার বারান্দায়!--একটা মাদারি এমনি করে দুটো বাঁদর নিয়ে ওদের পাড়াতে খেলা দেখিয়ে যেত। আর ওরা সব পাড়ার ছেলেমেয়েরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে মাদারির খেলা দেখত। হাতে থাকত সেই ডুগডুগি। ডুগ ডুগ ডুগ করে যেন এখনও বাজে,---ডুগ ডুগ ডুগ ডুড়ুম ডুড়ুম
নেত্য করে খা আলুরদম।
মায়ের সেলোফোন পড়ে রইল কোথায়, বাবার ল্যাপটপ খোলা থাকতে থাকতে এক সময় নিজেই কখন বন্ধ হয়ে যায়। টিভিতে কে এলো কে গেল কে তার খবর রাখে। ঠাম্মার কানেই গেল না দুধওলার ডাক। শেষে দুধের প্যকেট দরজায় রেখে চলে যায়। কাজের মাসি রান্নার পিসি ডেকে ডেকে হাপিত্যেস করে ফিরে যেতে উদ্যত হল ঠিক তখনই ওদের বুকের মাঝে কে যেন ডুগ ডুগ ডুগ ডুড়ুম ডুড়ুম করে বাজাতে লাগে। খেয়ালই হল না কখন বাজনার তালে তালে ওদেরও কোমর দুলে উঠে।
পুটুদের বাড়িতে এখন মাঝে মাঝেই ডুগডুগি বাজে। পুটুর বাবা রাস্তার ধারে পাঁচিলে বড় করে লিখে দিয়েছে,- জন্তু জানোয়ারকে ভয় দেখাবে না। ওরা আমাদের ভালবাসে।
পুটুদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে পেরোলে পথচারীরা ডুগডুগি বাজার শব্দ শুনতে পায় এবং ওদেরও কোমর দোলে। বুকের মাঝে বেজে ওঠে ডুগ ডুগ ডুগ ডুড়ুম ডুড়ুম।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment