শেষ থেকে শুরু
রুদ্র রায়
আগামীকাল মহালায়া। পুজো সামনে চলে এলেও লালবাজার এ একটু অন্য ব্যাস্ততা। রাত প্রায় একটা তিরিশ। পরপর দুটি গাড়ি ঢুকল লালবাজার এ । বছর চল্লিশের এক যুবককে প্রায় জামার কলার ধরে লিফটে করে তোলা হল উপরে। ইন্টারোগেশন রুমে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল ইন্সপেক্টর নিমা লাম। গোয়েন্দা বিভাগের দাপুটে অফিসার। কালিম্পং এ মূল বাড়ি। এখন যাদবপুরেই বছর চারেক হল নতুন ফ্ল্যাটে থাকে স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে। জটিল কেস এলেই গোয়েন্দা বিভাগের অন্যতম ভরসা এই নিমা। সুঠাম চেহারা। বন্দর এলাকার এক শ্যুট আউটে ডান পায়ে একবার গুলি লেগেছিল। তারপর থেকে সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটে নিমা। পাহাড়ি হলেও নজর কাড়া উচ্চতা নিমার। প্রায় ছয় ফুট এক।
আগে অনেক জটিল কেস সমাধান করেছে নিমা । এরকমই একটা কেস এর তদন্তকারী অফিসার হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে নিমাকে। আর সেই সূত্রেই সন্দেহভাজন একজনকে আজ পুরুলিয়া থেকে ধরে আনা হয়েছে। কেস টা নিয়ে নিমা সহ গোটা ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট ক্লু লেস ছিল। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে প্রথম ক্লু পেয়েই ধরে আনা হয়েছে এই ব্যক্তিকে। ধরে আনা ব্যক্তিকে নিমা যে চেয়ারে বসে আছে তার সামনে এনে দাঁড় করাল ডি.ডি র সাব ইন্সপেক্টর, অমিতাভ দাস।
ঘটনাটি মাস দুয়েক আগের। কোলকাতার নিষিদ্ধ পল্লীতে এক মহিলাকে নৃশংস ভাবে খুন করা হয়। গলা কাটা অবস্থায় নিজের ঘরে পাওয়া যায় ওই মহিলাকে। মহিলার বয়স বছর তিরিশ। নিষিদ্ধপল্লীতে বছর দুয়েক আগে এসেছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ক্যানিং থেকে। বেশ কিছুদিন কেটে গেলেও এই কেসের সমাধানে কোন ক্লু পুলিশ খুঁজে পায়নি। এমনকি ওই মহিলার গ্রামে গিয়েও পুলিশ তদন্ত করেছে। খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে এই এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ। কিন্তু কোন অগ্রগতি হয়নি কেসের। প্রথমে লোকাল থানা তদন্ত করলেও পরে লালবাজারে গোয়ান্দা বিভাগের হাতে আসে কেস টা।
ঘটনার মাস দুয়েক পরে আচমকাই একটা ক্লু পাওয়া যায়। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে এক ব্যক্তিকে সনাক্ত করা হয়। রামলাল যাদব। যার গতিবিধি খুনের সময়ে ওই নিষিদ্ধ পল্লী অঞ্চলে সন্দেহজনক মনে হয় পুলিশের। তবে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ একটা আন্দাজ পায় যে এই ব্যক্তি নিজে খুনি হতে পারে না। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। নার্ভের সমস্যা আছে। হাত, পা কাঁপে। এর পক্ষে খুন করা একটু কঠিন বলেই পুলিশের মনে হয়েছে প্রাথমিক ভাবে। তবে সন্দেহের বাইরে কাউকেই রাখা যায় না। বিশেষ করে খুনের সময়ে ওই অঞ্চলে সন্দেহজনক ভাবে ঘুরে ফিরে বেড়ানো এই রামলাল নিজে খুন না করলেও খুনে যে একেবারে যুক্ত নয় তা ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট এর কেউই মনে করছে না।
নিমা কেস টা হাতে নেওয়ার পরে এই রামলাল কে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে যে এক সময় এই নিষিদ্ধ পল্লীতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তার। যে মহিলা খুন হয়েছে তার কাছেও রামলালের যাতায়াত ছিল। কিন্তু রামলাল কে জিজ্ঞাসাবাদ করে এক যুবকের কথা উঠে আসে। যে শুধুমাত্র এই খুন হওয়া মহিলার কাছেই আসত। অন্য কারো কাছে নয়। রামলালের কথা অনুযায়ী এই যুবক খুব সম্ভবত কোলকাতার নয়৷ মাঝে মাঝে কোলকাতায় আসত। এই যুবককে বেশ কয়েকবার দেখেছে রামলাল। এবং খুনের রাতেও ওই যুবক এসেছিল বলে রামলালের দাবি।
লেক মল থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ৷ আলাপ হাইরাইজের টাওয়ার টু তে ৭৪৩ নম্বর ফ্ল্যাটে একাই থাকে বছর তিরিশের তমালিকা সেন। বেশ সুন্দরী। চোখ গুলো আলাদা করে নজর কাড়ে। কিছুদিন ধরে তমালিকা নিজেই নিজেকে ফ্ল্যাটে বন্ধ করে রেখেছে। ফোন টাও সাইলেন্ট। কয়েকদিনে বেনসন এন্ড হেজেস এর বেশ কয়েক প্যাকেট সিগারেট শেষ করেছে। ধরেনি অফিস থেকে আসা গুরুত্বপূর্ণ ফোন। একজন রান্নার লোক আসে। কিছুদিন তাকেও আসতে বারন করেছে তমালিকা। খাবার আনিয়েছে অনলাইনে।
জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে তমালিকা। হাতে আধ খাওয়া সিগারেট। কি একটা ভাবনা কয়েকদিন ধরে গ্রাস করেছে তমালিকাকে৷ এ যেন অন্য তমালিকা। স্থির চোখে খেলে বেড়াচ্ছে অনেক কিছু।
এদিকে পুরুলিয়া থেকে ধরে আনা ব্যক্তিকে নিমার সামনে হাজির করানোর পরে আট দিন কেটে গেছে।আদালতের নির্দেশে সে এখনো পি সি তেই। কিন্তু এর মধ্যে একটা অদ্ভুৎ ঘটনা ঘটে গেল, যা পুরো ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট কে অবাক করে দিল। জয়েন্ট সি পি ক্রাইম নিজের ঘরে একটা জরুরি মিটিং ডেকেছিলেন। সেখানে ডাকা হয়েছিল এই কেসের তদন্তকারী অফিসার নিমা, জোড়াবাগান থানার অফিসার ইনচার্জ সহ এই কেসের সাথে বিভিন্ন সময়ে যুক্ত মোট সাত জন অফিসার কে। একেবারে কোনার দিকে একটি চেয়ারে বসে আছে তমালিকা। তমালিকার সাথে গোয়েন্দা বিভাগের সম্পর্ক বছর পাঁচেকের। তৎকালীন ডিসি ইএসডি রাকেশ চিরিমার একবার একটা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে তমালিকাদের আর্ট কলেজে গেছিলেন।সেখানে তমালিকার এক বিশেষ প্রতিভার পরিচয় পান রাকেশ। পরবর্তী কালে তমালিকার সেই বিশেষ প্রতিভা বাইপাসের চয়নিকা হত্যা কান্ডে খুনিকে ধরতে বিশেষ সাহায্য করে পুলিশকে। এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান শুনে হুবহু খুনির ছবি এঁকে দিয়েছিল তমালিকা। সেই শুরু তারপর গত পাঁচ বছরে সাতাশ টি কেসে তমালিকার আঁকা ছবি তদন্ত কে নয়া দিশা দিয়েছে।
কিন্তু আজকে জয়েন্ট সিপির ঘরের অভিজ্ঞতা একটু অন্যরকম হল তমালিকার। গোয়ান্দা বিভাগের চোখে অন্যতম সন্দেহভাজন সেই পুরুলিয়া থেকে ধৃত যুবক।এই কয়েক দিনে নিমা নিজের মত করে জেরা করেছে সেই যুবককে।যুবকের ঘাড়ে, পিঠে সেই জিজ্ঞাদাবাদের দগদগে চিহ্ন এখনও খালি চোখে দেখা যায়। জয়েন্ট সি পি ক্রাইম জয়িতা সিনহা প্রথমে নিমার কাছে কেসের অগ্রগতি জানতে চাইলেন। পরে তিনি যেটা বললেন সেটা বাকিদের বেশ অবাক করে দিল।
জয়েন্ট সি পি জানালেন গতকাল উত্তর প্রদেশ পুলিশের তরফে লালবাজার এ যোগাযোগ করা হয়েছিল। উত্তর প্রদেশ পুলিশের এস টি এফ এর হাতে কিছু তথ্য প্রমাণ ছিল আন্তঃরাজ্য নারী পাচারকারী একটি দল কে নিয়ে। এই ব্যাপারে ধর পাকড় চলাকালীন এক ব্যক্তিকে আটক করে উত্তর প্রদেশ পুলিশ। এই ব্যক্তি কোলকাতার নিষিদ্ধ পল্লীতে উত্তর প্রদেশের বেশ কিছু নাবালিকাকে আনার ব্যপারে অভিযুক্ত ছিল। প্রথমে এর এক সাগরেদ কে পুলিশ গ্রেফতার করে। তাকে জেরা করে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় তারা। পরে ওই ব্যক্তিকে কড়া ভাবে জেরা করে পুলিশ জানতে পেরেছে নিষিদ্ধ পল্লীতে সেই রাতে খুন টা করেছিল এই ব্যক্তি। কিছুদিন পানাগড়ে গা ঢাকা দিয়ে ছিল। পরে বিহার হয়ে উত্তর প্রদেশে পালানোর সময়ে পুরানো কেসের ব্যাপারে উত্তর প্রদেশ পুলিশের এস টি এফ এর হাতে গ্রেফতার হয়। তথ্য প্রমাণ এর জন্য তাদের একটি দল আগামীকাল কোলকাতা আসছে।
এই অবধি বলে থামলেন জয়িতা সিনহা। তারপরে নিমা আর তমালিকার দিকে তাকিয়ে বললেন রামলাল যাদব এর কথা কিন্তু খুব একটা ভুল ছিল না। এই ধৃত ব্যক্তি মাঝে মাঝেই এখানে আসত। আর এসে উঠত শুধুমাত্র ওই খুন হওয়া মহিলার কাছেই। সেদিন মাদকের নেশায় বচসার মধ্যেই মহিলার গলায় ছুরি চালিয়ে দেয় সে। কোন পূর্ব পরিকল্পনা বা আলাদা কোন মোটিভ ছিল না বলেই সে জানিয়েছে।
" নিমা, যাকে আমরা খুনি বলে মনে করছিলাম পুরুলিয়ার সেই যুবক তার মানে নির্দোষ। " নিমার দিকে তাকিয়ে বললেন জয়িতা। নিমা কিছু বলার আগেই জয়িতা বললেন তাছাড়া কোন প্রমাণই এখনও এই পুরুলিয়া থেকে ধৃত যুবককে খুনি বলে প্রমাণ করার মত নয়। সি ডি আর রেকর্ড বলছে এই যুবক খুন হওয়ার সময় পুরুলিয়া তেই ছিল। আমি যদি ধরেও নি যে মোবাইল ফোন সে সাথে ক্যারি করেনি তবুও ওর আর একটা স্ট্রং এলিবাই হলো রঘুনাথপুর এর এটিএম। পোস্টমর্টেম অনুযায়ী খুনের সময় রাত্রি সাড়ে আট টা থেকে সাড়ে নটা। কিন্তু এই যুবককে রঘুনাথপুর এর একটি এ টি এম এ সন্ধ্যা সাত টা দশ এ দেখা গেছে। এই সময়ের মধ্যে রঘুনাথপুর থেকে কোলকাতায় এসে খুন করা....! জয়িতা বলে চললেন.... তবুও আমাদের ভাবাচ্ছিল রামলালের বয়ানে তমালিকার আঁকা ছবির সাথে এই যুবকের অবয়বের হুবহু মিল। এ ব্যাপারে তোমার কি মনে হয় তমালিকা? তমালিকা খুব মন দিয়ে জয়েন্ট সি পি র কথা শুনছিল। আচমকাই তাকে জিজ্ঞেস করাতে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। তারপরে বলল দেখুন ম্যাডাম এই ব্যাপারটা আমাকেও ভাবাচ্ছে। রামলাল এর বয়ানে এই ব্যক্তির ছবি উঠে এল।আমি সেই মতই স্কেচটা রেডি করলাম। রামলাল ছবিটা কনফার্ম ও করেছিল। অথচ পুরুলিয়ার ধৃত ব্যক্তি সেদিন কোলকাতাতেই ছিল না! স্ট্রেঞ্জ! আবার আপনার কথা অনুযায়ী খুনি উত্তর প্রদেশ থেকে ধরাও পড়েছে।
জয়িতা নিমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা নিমা, রামলাল কে একবার ফের জিজ্ঞাসাবাদ করো তো। নিমা বলল ম্যাডাম সে এখন আর জি করে ভর্তি আছে। নেশার ঘোরে চীৎপুর এ শ্যামলী জুয়েলার্সের সামনে পড়ে ছিল। একটা গাড়ি এসে ধাক্কা মারে। তবে আঘাত গুরুতর নয়। যত মাতালের কান্ড! মুচকি হাসলেন জয়িতা।
এই ঘটনার পাঁচ দিন পর। লা আর্টিজান রেস্তোরাঁয় একটি টেবিলের একদিকে তমালিকা আর অন্যদিকে নিমা আর অনন্যা সেনগুপ্ত। অনন্যা তমালিকার কলেজ জীবন থেকে অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। তবে আর্ট এর দিকে না গিয়ে পারিবারিক ব্যবসা সামলায় এখন। কাজের জগতের বাইরেও তমালিকা, নিমা আর অনন্যার বেশ একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। গোয়েন্দা বিভাগের হয়ে কাজ শুরুর একেবারে প্রথম থেকেই নিমার সাথে তমালিকার পরিচয়। বেশ কয়েকবার নিমাকে তদন্তে সাহায্য করেছে তমালিকা। শুধু কেসের প্রোয়োজোনে সন্দেহভাজনের স্কেচ এঁকেছে তাই নয়। বিভিন্ন সময়ে কোন জটিল কেসের সমাধানে এই লা আর্টিজান এ বসে অনেক সূত্র বাতলে দিয়েছে তমালিকা।তমালিকার এই ধারালো মস্তিষ্ক কে বরাবরই কুর্নিশ জানিয়েছে নিমা।
নিমা বলল উত্তর প্রদেশ থেকে ধৃত ব্যক্তির কাছ থেকে খুনে ব্যবহৃত অস্ত্র টি উদ্ধার হয়েছে। এটা ঠিক ছুরি নয়। উত্তর প্রদেশে স্থানীয় ভাষায় এটিকে চিক্কা বলে। সরু, ছয় ইঞ্চি লম্বা কিন্তু বেশ ধারালো। আর ফোল্ড করে দিব্বি দেশলাই বাক্সের মধ্যেও রাখা যায়। উত্তর প্রদেশ এস টি এফ এর জেরা শেষ হলে ওই ব্যক্তিকে হেফাজতে নেওয়া হবে। অনন্যা তমালিকার দিকে তাকিয়ে বলল কিন্তু ওই যে স্কেচ টা তুই ওই রামলাল না কি যেন নাম তার বয়ানে এঁকেছিলি, যার ভিত্তিতে একজন কে গ্রেফতার করা হয়েছে তার কি হল! তমালিকা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। নিমা বলল এই রামলাল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে ওকে একবার আচ্ছা করে দেব। একটা ভুল ভাল বর্ণনা দিয়েছে। আর কাকতালীয় ভাবে ওই স্কেচের সাথে এই যুবকের মুখের মিল ছিল। আমার সোর্স খবর দিল এরকম একজন পুরুলিয়া তে আছে৷ অনেকটা এই স্কেচের ব্যক্তির মত দেখতে। ছেলেটির জন্য খারাপ লাগছে বুঝলে তমালিকা। আমি একটু কড়া ভাবেই....! তমালিকা বলল এই কয়েকবছর এ নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে গোয়ান্দা বিভাগের কাজে। কিন্তু এরকমটা কখনো হয়নি। আমারো খারাপ লাগছে, হাজার হোক স্কেচ টা আমারই আঁকা। নিমা বলল আজ ওই যুবক কে কোর্টে তোলা হয়েছিল, পুলিশ জামিনের বিরোধিতা করেনি। তাই জামিন হয়ে গেছে ওর। কিছু ফরম্যালিটি মিটিয়ে কাল বেলার দিকে ওকে ছাড়া হবে। তমালিকা বলল নিমা যদি তুমি একটা ব্যবস্থা করে দাও আমি ওনার সাথে একবার দেখা করতে চাই। আমারও খুব খারাপ লাগছে ওনার জন্য। নিমা বলল ঠিক আছে। আমি বলে রাখব তুমি দেখা করে নিও।
একটা জরুরি ফোন পেয়ে নিমা উঠে গেল। কিছুক্ষন থেকে উঠে পড়ল তমালিকারাও। স্কুটিতে স্টার্ট দিল তমালিকা। পিছনে অনন্যা।
রাত ঠিক সাড়ে দশটা। লালবাজারে ঢুকল তমালিকা। নিমা সব ব্যবস্থা করেই রেখেছিল। সেই পুরুলিয়া থেকে ধৃত যুবককে যে সেলে রাখা হয়েছে তার সামনে গেল তমালিকা। এক কনস্টেবল তাকে পৌঁছে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। এটা ঠিক লক আপ বলা চলে না। একটা ছোট বক্স ধরনের বানানো। একটা খুব অল্প আলোর বাতি ঝুলছে উপর থেকে। একটা চেয়ারে বসে আছে সেই যুবক। তমালিকার উপস্থিতি হয়ত সে বুঝতে পারেনি। কিছুটা মাথা নিচু করে ঝিমাচ্ছে বলে মনে হল।
তমালিকা যুবকের কাঁধে হাত রাখল পিছন থেকে।
কেমন আছো ধ্রুব দা? বিদ্যুতের শক লাগার মত সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেল যুবকের। এই তীব্রতা সে এই কয়েকদিনের পুলিশের অত্যাচারেও অনুভব করেনি। চেয়ার ছেড়ে মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ালো তমালিকার দিকে।আলো আঁধারি জায়গায় কয়েক মিনিটের শীতল নিস্তব্ধতা। তুত্তুরি তুই এখানে? যুবকের গলা দিয়ে আরো শব্দ বেরানোর আগেই তমালিকা বলল, আমাকে ক্ষমা করে দিও ধ্রুব দা, এই কয়েকদিন তোমার সাথে পুলিশ যা করেছে তার জন্য আমি দায়ি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও! কিন্তু বিশ্বাস করো এ ছাড়া আমার কাছে আর কোন উপায় ছিল না ধ্রুব দা। আর কোন উপায় ছিল না। তোমার তুত্তুরির তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল যে!
মানে কি বলছিস তুই? তুই কিভাবে আমার এই অবস্থার জন্য দায়ি হতে যাবি! যুবকের গলায় বিস্ময়। তমালিকা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপরে বলল কলেজে তোমার প্রতি দুর্বল ছিলাম ঠিকই কিন্তু তুমি যখন আমার এক বছর আগে পাস আউট হয়ে কেরিয়ার নিয়ে না ভেবে বোহেমিয়ান জীবন কাটাতে সেটা আমার ভালো লাগত না ধ্রুব দা। তাই আর যোগাযোগ না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। জীবন নিয়ে খুব উচ্চাশা ছিল আমার। আর তারপরে আমি যখন এক বছর পরে কলেজ শেষ করলাম তোমাকে অনেক খুঁজে ছিলাম। তোমার বাড়িতেও গেছিলাম, বন্ধুবান্ধব আত্মীয় কিছুই বাদ দিই নি। কিন্তু তোমার কোন খোঁজ পাইনি। খানিকটা কাকতালীয় ভাবে আমার এই গোয়েন্দা বিভাগে যোগদান।সাথে একটা বিজনেস ও আছে। একটা ফ্ল্যাট কিনেছি।কিন্তু বিশ্বাস করো ধ্রুব দা আমি হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। আমি পাগলের মত প্রতিদিন তোমার অভাব অনুভব করেছি। একাডেমির সামনে তুমি আমাকে প্রথম চুমু খেয়েছিলে মনে আছে ধ্রুব দা! কিছুক্ষণ চুপ করে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল তমালিকা আর ধ্রুব। আমি পেশার জগতে খুব জড়িয়ে পড়েছিলাম ধ্রুব দা। কিন্তু পেশার বাইরে খুব একা, খুব অসহায় লাগত। এক দিন রাতে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। জানি এই সিদ্ধান্ত হয়ত আইনের চোখে আমাকে অপরাধী করবে। কিন্তু বিশ্বাস করো এ ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না।আমি নিজে তোমাকে অনেক খোঁজার চেষ্টা করেও পারিনি।আর তাই, রামলাল নামের এক সাক্ষীর বয়ানে আমি ইচ্ছে করেই তোমার ছবি আঁকি। আর রামলাল হল জাত মাতাল। ওকে সাইকোলজিক্যালি প্রেসার দিয়ে এই ছবিটা ওর সামনে এঁকে বলতে থাকি একেই তুমি দেখেছিলে। ভালো করে দেখো একেই তুমি দেখেছিলে। তারপরে এক সময়ে সে বলে, হ্যা ম্যাডাম মনে হচ্ছে একেই দেখেছিলাম।ব্যাস আমার কাজ সহজ হয়ে যায়৷ আমি জানি পুলিশের সোর্স তোমাকে ঠিক খুঁজে এনে দেবে ধ্রুব দা। তোমার ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয় পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে।আর তার পরেই একদিন হঠাৎ খবর আসে তোমাকে পাওয়া গেছে। তখন তুমি একটা কেসের মূল সন্দেহভাজন। আমার প্ল্যান করাই ছিল যে তোমাকে পাওয়া গেলে ওই রামলাল কে দিয়েই বলাব যে এ সে ব্যক্তি নয়। কিন্তু তার আগেই মূল অপরাধী ধরা পড়ে যায়। আমাকে ক্ষমা করে দিও। ক্ষমা করে দিও প্লিজ। এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না তোমাকে ফিরে পাবার। ইন্সপেক্টর নিমার কাছে শুনলাম তুমি পুরুলিয়ার একটা গ্রামে আছো। বাচ্ছাদের আঁকা শেখাও।
এতক্ষণ চুপ থেকে নীরবতা ভাঙল ধ্রুব। " সব সময় সব কথা তুই বলবি তুত্তুরি! সব সিধান্ত তুই নিবি? আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সিধান্ত তুই নিয়েছিলি আর আজ আবার আমাকে এই ভাবে নিয়ে এসেছিস! " নিজের ডান হাতের তর্জনী ধ্রুবর ঠোঁটে ঠেকিয়ে তমালিকা বলল না, আর কোন কথাই আমি বলব না। ধ্রুব দা তোমার তুত্তুরি তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে এসেছে আজ। আমাকে পুরুলিয়া নিয়ে যাবে ধ্রুব দা তোমার সাথে? এই শহরে আমি হাঁফিয়ে উঠেছি। নিয়ে যাবে তোমার সাথে?
না নিয়ে যাব না। ধ্রুব খুব আলতো স্বরে বলল। আগে তোর ধ্রুব দা তোর একটা ছবি আঁকবে। কে জানে যদি আবার হারিয়ে....! ধ্রুবর মুখ টা এবার হাত দিয়ে চেপে ধরল তমালিকা, চলো ধ্রুব দা তোমার পলাশ বনে আমাকে নিয়ে চলো। এবারে এক সাথে নিরুদ্দেশ হবো। লালবাজার এ একটা গোটা রাত কেটে গেল পুলিশের স্কেচখাতায় স্থান পাওয়া এক সন্দেহভাজন আর তার ছবি আঁকা আর্টিস্ট তুত্তুরির ওরফে তমালিকার গোপন আলাপচারিতায়।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment