1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

ঈশ্বর প্রাপ্তি

ছবি : ইন্টারনেট 


ঈশ্বর প্রাপ্তি

মৃণাল বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

ঘড়িতে তখন  ঠিক কাটায় কাটায়  রাত এগারোটা বেয়াল্লিশ। প্রতিদিন রাত বারোটা নাগাদ সদর দরজাটা বন্ধ করা অভ‍্যাস। কিন্তু আজকে কি মনে হলো একটু আগেই দরজা বন্ধ করার কাজটায় অন্তর থেকেই একটা তাগিদ অনুভব করলাম। যা দিনকাল পড়েছে একটু অতিরিক্ত সাবধান হওয়ার প্রয়োজনও আছে বৈকি। তাছাড়া অনেকক্ষণ ধরেই পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। এবং আওয়াজটা যেন ক্রমশ এদিকেই এগিয়ে আসছে বলে মনে হলো। যদিও আমার বাড়িটা একটু গলির ভেতরে তাই পুলিশের গাড়ি কোনোভাবেই আমার বাড়ির দোড়গোড়া পযর্ন্ত আসতে পারবে না। উঠোন পেরিয়ে সদর দরজাটা একটু খুলে আশপাশটা একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নেওয়াটা আমার বহুদিনের অভ‍্যাস । আজও তার কোনরকম ব‍্যাতিক্রম হলোনা। সবে সদর দরজা খুলে বাইরে মাথা বের করে দেখতে যাবো আর ধুমকেতুর মতো একটা কেলেপানা প‍্যাকাটি মার্কা লোক আমাকে একরকম প্রায় ঠেলেই সরিয়ে দিয়ে এপাশে উঠোনের মধ‍্যে ঢুকে পড়ে পরিমরি করে দরজার ছিটকিনি আর হুড়কোটা বন্ধ করে দিয়ে আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরে বসে পড়ে কঁকিয়ে কাঁদো কাঁদো সরে বলে উঠলো, “ স‍্যার আপনার পা’য়ে পরি আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন না । আমি আপনাদের কারোর কোনো ক্ষতি করবো না, বিশ্বাস করুন। বাপ-মায়ের দিব্বি দিয়ে বলছি। শুধু কিছুক্ষণের জন‍্যে আমাকে দয়া করে আপনাদের আশ্রয়ে থাকার অনুমতি দিন। মেইন রাস্তা থেকেই পুলিশ আমাকে গাড়ি নিয়ে ধাওয়া করেছিল। কোনরকমে দুটো গলি পার হয়ে আপনার বাড়ির দরজা খোলা পেয়ে আপনাকে একপ্রকার ঠেলে সরিয়ে দিয়েই ঢুকে পড়েছি। স‍্যার আপনার সেইভাবে কোনও ব‍্যথা লাগেনি তো? আসলে ভয় হচ্ছিল, ওরা যদি আমাকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দেয়। আর গুলি যদি একবার শরীরে লাগে তাহলে তো সব শেষ। আমার সাথে সাথে আরও পাঁচটা বিভিন্ন বয়সের মানুষও না খেতে পেয়ে মরে ভূত হয়ে যাবে। আপনার পায়ে পরছি, দয়া করে আমাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবেন না স‍্যার। আমিতো মরবই সাথে সাথে আমার পরিবারের বাকি পাঁচজনও না খেতে পেয়ে ক্ষিধের জ্বালা সহ‍্য করতে না পেরে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে একে একে মরে যাবে। অবশ‍্য তার আগেই আমার আজকের এই পরিচয় জানতে পারলে এমনিতেই লজ্জা আর ঘেন্নায় মানসিকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে বাড়ির ভেতরেই হয়তো একসাথে আত্মহত‍্যা করে বসবে।“

“ তুই গুলি খেয়ে মরবি নাকি তোর বাড়ির লোক আত্মহত্যা করে একসাথে মরবে তাতে আমার কি?” একটু মনে জোড় সঞ্চয় করে শুকনো হেড়ে গলায় বলে উঠলাম। বের হ, বেরিয়ে যা বলছি। ব‍্যাটা চোর, তোর মতলব আমি বুঝতে পারছিনা ভাবছিস? পেছনে পুলিশের গাড়ি লেগে রয়েছে বলে সাধু গিরি হচ্ছে। সেয়ানা চোর। যেই দেখবি পুলিশ তোকে না পেয়ে চলে গেছে ওমনি নিজের আসল রূপ ধরে আমাদেরকে মেরে ধরে আমাদের সর্বস্ব লুটপাট করে, চম্পট দিবি । ওটি হবেনা বাছাধন, সেই গুড়ে বালি। সর, সরে যা, আমার পা ছাড় বলছি। আমি এক্ষুনি চিৎকার করে পাড়ার লোক জড় করে তোকে পুলিশের হাতে তুলে দেবো।“

“ স‍্যার, দয়া করে আমার সাথে ওরকমটি করবেন না। আমি আপনাকে আমার কথা সব খুলে বলবো। আপনি চোর বলতে যেটা জানেন বা বোঝেন আমি ঠিক সেই ধরনের চোর নই। আমি স্বভাব চোর নই বাবু, আমি অভাবে পরে দু মুঠো খাবার জোগাড় করার তাগিদে আজ রাতের অন্ধকারে চুরি করার উদ্দেশ্যে প্রথম রাস্তায় নামতে একপ্রকার বাধ‍্যই হয়েছি।“

আমি লোকটার হাত থেকে কোনরকমে প্রায় জোর করে পা ছাড়িয়ে আবারও কিছু বলতে যাবো, তার আগেই মিনুর মা স্বশরীরে আমাদের মাঝখানে এসে উপস্থিত।

“ কি হলো গো, এত হৈচৈ কিসের? দরজা বন্ধ করতে এসে তখন থেকে কাকে এতো বকাবকি করছো? মেয়েটাকে কিছুতেই ঘুম পাড়াতে পারছিনা তোমাদের চিৎকার চেঁচামেচির জ্বালায়। ও মা’গো, অন্ধকারে তোমার পা জড়িয়ে কেলে মার্কা এটা আবার কে? জন্তু না মানুষ?”

লোকটা এবার আমার পা ছেড়ে দিয়ে তরিঘরি সোজা গিয়ে মিনুর মায়ের পায়ের উপরে হুমড়ি খেয়ে পরে মিনুর মায়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরে আরও দ্বিগুন স্বরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিল। মিনুর মা’কে কোনরকম কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিজের মতো বলতে শুরু করে দিল, “গিন্নি’মা, আমাকে বাঁচান। বাবুকে কতবার করে বোঝানোর চেষ্টা করছি যে আমি চুরি করতে বেড়িয়েছি ঠিকই কিন্তু চোর বলতে যেমনটা সবাই বোঝে আমি একেবারেই সেরকমটি নই। আমার কোনো খারাপ মতলব নেই। কিন্তু বাবু কিছুতেই আমার কথা বিশ্বাসই করতে চাইছেন না। দয়া করে স‍্যারকে একটু বুঝিয়ে বলুন না গিন্নিমা আপনার কথা স‍্যার ঠিক শুনবেন।“

ব‍্যাটার কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। মিনুর মা’কে আবার গিন্নিমা!বহুত সেয়ানা চোর। বাড়িতে ঢোকার পর থেকে স্রেফ অভিনয় করে যাচ্ছে। জীবনে প্রচুর চোরের গল্প শুনেছি। মহান ও মারাত্মক সব চোরেদের গল্প সাহিত্যে পড়েছি কিন্তু এরকম আজব চোর চোখে তো দেখা দূরে থাক, কোনও গল্পেও কস্মিনকালে পাঠ করেছি বলেও মনে পরছে না। আসার পর থেকেই মরা কান্না জুড়ে দিয়েছে। ও নাকি আজকেই প্রথম চুরি করতে বেড়িয়েছে! শোনো চোরের কথা। চুরি করে করে হাত পাকিয়ে ফেলেছে, আর বলে কিনা আমি স্বভাবে চোর নই স‍্যার, আমি অভাবে চোর! এটাও এই মধ‍্যরাতে আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? নাটকের দলে থাকলে ভালো স্ক্রিপ্ট রাইটার হতে পারতো।

“ আরে আগে আমার পা ছাড়, তারপরে তো দুজনে মিলে ভাববো তোকে নিয়ে জামাই আদর করবো নাকি থানায় ফোন করে তোকে আইনের হাতে তুলে দেবো। পা ছাড়, ছাড় বলছি।“ মিনুর মা জোরে ধমকে চেঁচিয়ে উঠলো।

এই সবকিছুর মাঝে ছোট্ট মিনু যে কখন ঢুলুঢুলু চোখে গুটিগুটি পা’য়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আমাদের কথার মাঝখানে চলে এসেছে, সেটা আমাদের দুজনের কেউই টের পাইনি। মিনুর আদো আদো কথাতেই ওর দিকে তিনজনই একসাথে ফিরে তাকালাম।

“ বাবা, এই কাকুটা এখানে কি করছে? কাকুটা মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে কেন? কাকুটাকে কি মা কান মুলে দিয়ে বকেছে?”

“ আরে!! মিনুর মা, তুমি ওকে ঘুম পাড়াওনি? “

“ কি করে ঘুম পাড়াবো বলত পারো? মাঝরাতে তুমি আর এই কেলে পানা লোকটা যা শুরু করেছো তাতে করে কেউ ঘুমোতে পারে? তাও তো পিঠে থাপড়ে থাপড়ে ঘুম পাড়ানোর হাজার চেষ্টা করলাম। দেখে তো মনে হলো মেয়ে বোধ হয় ঘুমিয়ে পরেছে। কিন্তু তোমার আদরের মেয়েও যে মা’কে ঠকাতে শিখে গেছে সে তো বেশ ভালোমতোই বোঝা যাচ্ছে।“

“ তাহলে ঘুম থেকে উঠে চলে এলো কিভাবে?”

“ মিনু মা, শিগ্গির ঘরে চলো। এই লোকটাকে কাকু বলে ডেকোনা। এই লোকটা পচা। একটা দুষ্টু লোক। এতো রাত অবধি ছোট বাচ্চাদের জেগে থাকতে নেই মা। তুমি আমার ছোট্ট পুতুল না? চলো চলো, অনেক রাত হয়ে গেছে, এবার ঘুমিয়ে পরতে হবে। নাহলে কালকে তোমার শরীর খারাপ করবে। চলো চলো, আমরা দুজনেই ঘুমিয়ে পরবো।“ মিনুর মা মিনুকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে সবে পা বারাতে যাবে আর ঠিক সেই সময় লোকটা কথা ছুড়ে দিয়ে বলে উঠলো-

“আসলে গিন্নি’মা, আমার মনে হয় আমাদের চিৎকার চেঁচামেচিতেই ওর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ছোটো তো তাই ভয় পেয়ে বিছানা ছেড়ে এখানে চলে এসেছিল।“

“ একদমই তাই। ঠিকই বলেছো। আরে!! তোমার তো সাহস কম নয়। তুমি আমাদের মাঝখানে কথা বলছো যে বড়? ধন‍্য চোর বটে হে তুমি। আমরা জোড়ে কথা বলবো না আস্তে বলবো, সেটাও কি তোমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার অনুমতি নিয়ে বলতে হবে? এটা আমাদের বাড়ি, আমরা এখানে যেভাবে খুশি কথা বলবো, তাতে তোমার কি? ”

“ না বলছিলাম যে, ছোট্ট বাচ্চা তো। আমাদের চিৎকারে ওর কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে গেল, তাই।“

“ এই, তোমার মতলবটা কি বলোতো? তুমি একটা ছিচকে চোর, অথচ এমন ভাব দেখাচ্ছ যেন মায়ের থেকে মাসীর দরদ বেশি। ও আমার মেয়ে, আমি বুঝবো ও ঘুমাবে কি ঘুমাবে না। ওকে নিয়ে তোমায় বেশি ভাবতে হবেনা। বেশি চালাকি করলে না লোকাল থানায় ফোন করে পুলিশ ডেকে এনে তোমাকে সোজা পুলিশের হাতে তুলে দেবো।বুঝতে পারবে যে কত ধানে কত চাল। ভদ্র ভাবে কথা বলছি তো তাই ভাবছো এদের সাথে মিষ্টি করে ভাব জমিয়ে তারপরে ভালো মানুষির সুযোগ নিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো যা খুশি তাই করা যাবে,তাই না?“

“ না না গিন্নি’মা, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আসলে আমারও আপনার এই মিনুর বয়সিই একটি মেয়ে আছে। গত দুদিন হলো বাড়িতে উনুন ধরেনি। বাড়িতে দশটা টাকা নেই যে মেয়েটার মুখে একটু ভাত তুলে দেবে ওর মা । বাড়িতে আমি বাদে আরো মোট পাঁচ পাঁচটা পেট। আমি, আমার বউ, বৃদ্ধ অশক্ত বাবা, মা আর অবিবাহিত একটা আইবুড়ো বছর চল্লিশের পক্ষাঘাতগ্রস্ত দিদি আর আমার চার বছরের মেয়ে, বিন্নি। ধুম জ্বরে গত তিনদিন ধরে আমি বাড়ি ছেড়ে বের হতে পারিনি। বউটা কোথা থেকে এর ওর বাগান থেকে চেয়ে চিন্তে কতগুলো কচুর ডগা তুলে এনেছিল। ঐ কটাই সেদ্ধ করে নুন দিয়ে চটকে বড় পাঁচজন খেয়েছিলাম। গলার চুলকুনিতে পাঁচ জনাই যন্ত্রণায় ছটফট করেছি। ভাগ‍্যিস চার বছরের মেয়েটাকে দিইনি। ছোট্ট মেয়ে, খেয়ে নিলে হয়তো মরেই যেত।“

“ কেন বানিয়ে বানিয়ে মিথ‍্যে কথা বলে আমাদের সহানুভূতি আদায় করার চেষ্টা করছো তখন থেকে। তোমার মতলব বুঝতে আমার আর বাকি নেই। ভালো কথায় চিড়ে ভিজবে না কিন্তু হে ছোকরা, এই বলে দিলাম। তুমি বানিয়ে বানিয়ে যতই গাঁজাখুরি গল্প শোনাও না কেন ওসব ধোপে টিকবে না। পুলিশের হাতে তো তোমাকে আজ তুলে দেবই।“

“ বিশ্বাস করুন স‍্যার , মেয়ের দিব‍্যি দিয়ে বলছি। আমি একটা কথাও বানিয়ে বলছি না। খিদের যন্ত্রনায় মেয়েটা ছটফট করছে গো বাবু। বাপ হয়ে সহ‍্য করি কি করে। বউটাও তো বাচ্চাটার জন্ম দেওেয়ার পর থেকেই অপুষ্টিতে ভুগছে। কান্না করলে মেয়েটার মুখটা বুকের মধ‍্যে চেপে ধরে। কি পায় জানিনা, মেয়েটা খালি পেটেই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে।“

“ রাখতো, যত্তসব বানানো মিথ‍্যে সাজানো গল্প!! তুই কি ধরনের চোর হে, এসে অবধি তখন থেকে শুধু কেঁদেই চলেছিস? আর কি সুন্দর অনায়াসে বিনা দ্বিধায় একের পর এক মিথ‍্যা কথা বলে চলেছিস। একটুও আটকাচ্ছে না কোথাও!!”

“ আঃ, তুমি থামবে? তুমিও তো ওরই মতো একজন মেয়ের বাবা। এবং শুনছই তো ওর মেয়েও তোমার মেয়েরই বয়সি। ওর দুঃখের কথা শুনে তোমার একটু কষ্ট হচ্ছেনা? তুমি কিরকম পিতা!! আজকে তুমি যদি ওর জায়গায় থাকতে তবে তুমি কি করতে?”

“ ওঃ হোঃ, মিনুর মা। তুমি বুঝতে পারছোনা। তুমি কার সাথে কার তুলনা করছো? ও হলো একটা চোর। আইনের চোখে একজন অপরাধী। ও লোকের বাসায় চুরি করে ওর সংসার চালায়। আমি তো চোর নই। আমি কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে নিজের চেষ্টায় চাকরি পেয়ে আজ একটা সরকারি ব‍্যাঙ্কের ম‍্যানেজার। আমার হাত দিয়ে প্রত‍্যেক দিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়।। আমিও তো ইচ্ছা করলেই লোকের টাকা চুরি করে বিদেশি ব‍্যাঙ্কে টাকা রেখে আরাম ও আয়েশ করতে পারতাম। কিন্তু আমি তো আমার সততাকে বিসর্জন দিইনি। ওর মতো অশিক্ষিত হয়ে থেকে অসৎ পথে আয়ের রাস্তা বেছে নিইনি। পেটে বিদ‍্যা নেই তো কি হয়েছে,ওর যা বয়স তাতে করে ও তো একটা ছোটখাট ব‍্যবসা করে সামান্য আয় করেও সন্মানের সাথে মাথা উঁচু করে সমাজের বুকে বেঁচে থাকতে পারতো। প্রয়োজনে একটা টোটো কিনে রাস্তায় চালিয়ে টাকা রোজগার করতো। সৎ ইচ্ছা থাকলে উপায়ও প্রচুর আছে। আমার ব‍্যাঙ্কই তো কম সুদে কত লোককে লোন পাইয়ে দিচ্ছে। গরীবের ছেলে, টাকা পয়সার অভাবে লেখাপড়া শিখতে পারেনি তো কি হয়েছে, প্রয়োজনে গায়ে গতরে খেটে উপার্জন করতে পারতো। কিন্তু ও সেটা করেনি। বরং ও রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। আজকে চুরি করছে, কালকে ব‍্যাঙ্ক ডাকাতি করবে। হতেই পারে সেটা আমারই ব‍্যাঙ্কের শাখাতেই। আর আমি নিশ্চিত আজকে আমার বাড়িতে এসেছে আমাকে ভয় দেখিয়ে আমার ব‍্যাঙ্কের সম্পর্কেই খোঁজখবর নেওয়ার জন‍্যে, ভালো মানুষ সেজে।“

“ একদম সঠিক কথা বলেছেন স‍্যার। আপনি একজন হস্তরেখাবিদ হলেও ভালো উন্নতি করতে পারতেন জীবনে। আমার পেটে সত‍্যিই ছিটেফোটাও বিদ‍্যে নেই। নাহলে সরকারি কলেজ থেকে ইলেক্ট্রনিক্স-এ বি টেক কমপ্লিট করেও চাকরি জোগাড় করতে পারবোনা কেন বলুন? আমাদের দেশে এই মুহূর্তে সরকারি চাকরি কোথায় আছে একটু বলবেন স‍্যার? বাবা ছিলেন নকুল চন্দ্র কলেজের সিনিয়র ক্লার্ক। হঠাৎ করেই মুত্রথলিতে ক‍্যানসার ধরা পরলো। চাকরিটাও পুরো করতে পারলেন না।অবসরের দুবছর আগেই স্বেচ্ছা অবসর নিতে বাধ‍্য হলেন। যে কটা টাকা পেয়েছিলেন ক‍্যানসারের চিকিৎসায় সব শেষ। দিদিটার দুটো কিডনিই আচমকা অকেজো হয়ে গেল। পয়সা নেই, কার থেকে কিডনি ডোনেশন নেব? বিনা পয়সায় কে দেবে তার একটা অমূল‍্য কিডনি? কিন্তু ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছি। দিদি আমার থেকে বছর দশেকের বড়। আমার গায়ে কখনো আঁচড়টিও লাগতে দিতনা। সেই দিদিকে চোখের সামনে মরে যেতে দেখা যায়? আপনিই বলুন না স‍্যার, আমার জায়গায় আপনি থাকলে পারতেন? আমি পারিনি স‍্যার। নিজের একটা কিডনি দিয়ে দিদিকে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছি। একটা করে কিডনি নিয়ে দুজনেই আর কতদিন বাঁচবো জানিনা স‍্যার। কিন্তু তারপর থেকে আর ভারী কাজ করতে পারিনা। ঐ যে একটু আগেই বললেন না, গায়ে গতরে খেটে রোজগার করার কথা। চেষ্টা করেছিলাম স‍্যার, কিন্তু শরীর সাথ দেয়নি। ভেবেছিলাম একটা ছোটখাট ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান দেবো। জমি কিনে দোকান বানানো সম্ভব নয়। প্রচুর পুঁজির দরকার। এমনকি একটা ব‍্যস্ত জায়গায় একটা দোকানঘর ভাড়া নিয়ে একটা ইলেকট্রনিক্স গুডস-এর দোকান চালু করতে গেলেও কমকরে না হলেও প্রায় তিন থেকে চার লাখ টাকার ধাক্কা। অনেকের কাছেই ঘুরেছি। বছর খানেক আগে আপনাদের ব‍্যাঙ্কের শাখাতেও গিয়েছিলাম স‍্যার। কিন্তু তখন যিনি ম‍্যানেজার ছিলেন, বললেন যে সমাজের একজন গণ‍্যমান‍্য ভালো মানুষকে দিয়ে সুপারিশ করিয়ে আনতে হবে, নাহলে বাড়ির দলিল ব‍্যাঙ্কের কাছে বন্দক রাখতে হবে। হহ্নে হয়ে অনেক খুঁজেছি, কিন্তু ভালো মানুষ পাইনি স‍্যার, যিনি আমার হয়ে দু-টো ভালো কথা ম‍্যানেজার বাবুর কাছে গিয়ে বলবেন। বাবা, দিদির দৈনিক চিকিৎসার খরচ চালানোর জন‍্যে বহু আগেই বাড়ি মহাজনের কাছে বন্দক দিয়ে টাকা চড়া সুদে ধার করতে হয়েছিলেন। আসল শোধ করা তো দূরের কথা সুদটাই জমতে জমতে প্রায় আসলের সমান হয়ে গেছে। মহাজন শাসিয়ে রেখেছে আর মাস দুয়েকের মধ‍্যে টাকা না দিলে বাড়িটাও জোড় করে লিখিয়ে নেবে। তখন কোথায় কোন গাছ তলায় সপরিবারে দাড়াবো বলতে পারেন? সেই গাছতলায় থাকার জন‍্যেও হয়তো কোনো এলাকার ক’অক্ষর জ্ঞান শূন্য গো-মূর্খ দাদার দালালকে মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিতে হবে। সব জায়গা থেকে প্রতিহত হতে হতে দেওেয়ালে একসময় পিঠ ঠেকে গিয়েছিল স‍্যার। খিদে বরই ভীষণ বস্তু। যার অভাব আছে শুধুমাত্র সেই বোঝে তার কি ভয়ঙ্কর জ্বালা। সখ করে কেউ চোর হয়না স‍্যার। আমার ভাগ‍্য আর সরকারের স্বজন পোষন নীতিই এর জন‍্যে দায়ী। কিন্তু এসবের হাত থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ আপনার কি জানা আছে স‍্যার”

“ যা যা বললে তার সবটাই বিশ্বাস করে নিলেও একটা উওর কিন্তু এখনো খুঁজে পেতে বাকি যে, এত অভাবের মধ‍্যেও বিয়ের ইচ্ছাটাকে মনে না আনলে বাড়ির লোক সংখ‍্যাটা তো আরো দুটো বৃদ্ধি পেতোনা।“

“ একদমই যথার্থ বলেছেন স‍্যার। আসলে বেলা, মানে আমার স্ত্রী, তারও একটা কিডনি নেই। আমার একটা কিডনি যখন সরকারি হাসপাতালে দিদির শরীরে প্রতিস্থাপিত হচ্ছিল তখন পাশের বেডের এই মেয়েটিরও একটি কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়ার জন‍্যে শরীর থেকে অপারেশন করে বাদ দেওয়া হচ্ছিল। তখনই আলাপ। দুজনের জীবনেই অনেক মিল, অনেক সংগ্রাম। ওর মা,বাবা খুব ছোটবেলায় রোড অ‍্যাক্সিডেন্ট-এ মারা যান। মামার বাড়িতে বছর তেরো বয়স থেকেই বসবাস। সেখানে মামা মামির কাছে কতটা আদর যত্নে ছিল সেটা সবিস্তারে না বললেও সহজেই বোধগম‍্য। বাড়ির কাজের লোকের থেকেও দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা ছিল ওর। এছাড়া আমার বাড়িতেও বিশ্বস্ত একজন লোকের খুব দরকার ছিল যে সর্বদাই হাসিমুখে আমার মা,বাবা এবং দিদির সেবা করতে পারবে। বিয়ে করার সময় আমি তখনও চুরি করার কথা মনেও আনিনি। চন্ডীপাঠ থেকে জুতো সেলাই, সবধরনের কাজই করেছি। বেলাও হাজার কাজের মাঝখানে সময় করে আশেপাশের বৌদি, কাকিমাদের কাছ থেকে সেলাইয়ের অর্ডার নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মেয়েদের পোশাক বানিয়ে দিত। কিন্তু ধীরে ধীরে অতিরিক্ত কাজ করার ধকল আমার শরীর নিতে পারলো না। অবশ‍্য ডাক্তার বাবু আগেই বলেছিলেন, যে, কিডনিটা ডোনেট করার পর আর বেশি কায়িক পরিশ্রম করতে পারবো না। তার মধ‍্যেই বেলা মেয়ের জন্ম দিল। ফলে সংসারে অভাবটা যেন আরো প্রকট হয়ে উঠলো। সংসার আর মেয়ে সামলে বেলাও আর সেলাই-এর কাজে সময় দিতে পারতো না। সেলাইয়ের অর্ডার নিয়ে সময়মতো সেগুলো যোগান দিতে পারছিল না। যার জন‍্যে চেনা লোকজনও আমাদের খারাপ আর্থিক অবস্থার কথা জেনেও আর সেলাইয়ের অর্ডার দিতো না। ফলে বিকল্প একটা আয়ের রাস্তা খুঁজে পাওয়াটা খুবই প্রয়োজন হয়ে পরেছিল স‍্যার। নাহলে পরিবারের কাউকেই আর বাঁচাতে পারবো না। ভাবতে গিয়ে আয়ের এর থেকে সহজ আর কোন বিকল্প রাস্তা খুঁজে পেলাম না স‍্যার। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখা একটা ছেলে ভাগ‍্যের বিড়ম্বনায় চোর হওয়ার লক্ষ্যে রাতের অন্ধকারে রাস্তায় নেমে পরলাম। বাড়ির কেউ আজকে আমার এই সিদ্ধান্তের কথা জানেনা। কাউকে বলার সাহস হয়নি কারণ জানি এই প্রচেষ্টার জন‍্য বাড়ির প্রত‍্যেকেই আমাকে ধিক্কার দিত। তাই সবাই ঘুমিয়ে পরার পর নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছি।“

 এইমুহূর্তে কি বলবো তার কোন সঠিক ভাষাই খুঁজে পাচ্ছিনা।। অবিশ্বাস করতেও ইচ্ছা করছিল না। কারণ, এতো গুলো কথা হঠাৎ করে একটা সত‍্যিকারের অশিক্ষিত চোরের পক্ষে বানিয়ে বলা কোনমতেই সম্ভব নয়। 

“ আমাকে তো রীতিমতো চিন্তায় ফেলে দিলে হে তথাকথিত চোর ভাই। কারোর জীবন এতটা পরীক্ষার সম্মুখীন হতে পারে ঈশ্বরের ইচ্ছায়!! ভাবতেই তো কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগছে। ঈশ্বর কারোর উপর যে এতটা নির্দয় হতে পারেন সেটা তোমার সাথে এইরকম অদ্ভুতভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ না আসলে তো কখনও কল্পনাতেও আনতে পারতাম না। কিন্তু তিনি যখন তোমাকে এইভাবে আমার কাছে পাঠিয়েছেন তখন তার পেছনে একটা ভালো উদ্দেশ্য তো নিশ্চই আছে। আমি তোমাকে এইভাবে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেবোনা। তোমাকে মাথা তুলে ঘুরে দাড়াতে হবে। বলো, তোমার মধ‍্যেকার সেই পুরোনো স্বপ্নটাকে তুমি আবার জাগিয়ে তুলতে পারবে?আমি তোমাকে সাহায্য করবো। আমার ব‍্যাঙ্ক থেকে আমি তোমাকে বিজনেস লোন পাইয়ে দেব। তোমার স্ত্রীকে আমি সেলাই মেশিন কেনার জন‍্যেও লোন পাইয়ে দেবো। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে যে তুমি তোমার এই ক্ষণস্থায়ী পরিচয়টাকে চিরদিনের জন‍্যে মুছে ফেলে আবার আলোর জগতে ফিরে আসতে পারবে।“

-----

মাঝখানে দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। বেলা এবং ওর স্বামী রতন, মানে মিনুর সেই চোর কাকু, এখন অনেকটাই সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে ঘুরে দাড়াতে সক্ষম হচ্ছে ধীরে ধীরে নিজেদের শ্রম ও ব‍্যাঙ্ক থেকে প্রাপ্ত লোনের সঠিক প্রয়োগের মিলিত প্রচেষ্টায়। আজকে আমার ব‍্যাঙ্কের শাখায় এসেছিল ধার নেওয়া লোনের প্রথম কিস্তি শোধ করার জন‍্য। আর ও যেটা খুব ভালো পারে, ব‍্যাঙ্কের ম‍্যানেজারের মানে আমার চেম্বারের দরজা ঠেলে অনুমতি নিয়ে ঢুকে সটান সকলের সামনেই দ্বিধাহীনভাবে আমার পা জড়িয়ে ধরে মুখস্থ বলার মতো করে বলতে শুরু করলো,

“ স‍্যার, একসময় ভাবতাম যে ঈশ্বর বলে এই বিশ্ব সংসারে সত‍্যিই কিছু নেই। কিংবা যদি থেকেও থাকেন তাহলে অতি অবশ্যই তিনি একচোখা। আমরা যারা সৎপথে মোটামুটি একটু খেয়ে পড়ে নিজেদের একমাত্র অবলম্বন,আত্মসন্মানটুকু নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই, ঈশ্বর তাদের সেই সামান্য চাহিদা টুকুও কেড়ে নিতে চান। ঈশ্বরের আশীর্বাদ যেন শুধুমাত্র সমাজের ভন্ড, লোভী, আর অসৎ মানুষ গুলোর জন‍্যেই। কিন্তু বিশ্বাস করুন স‍্যার, আমার গত দেড় বছরের উপলব্ধি আমাকে এটা শিখিয়েছে যে এতদিন আমি ভুল বুঝেছিলাম। ঈশ্বর আজও আছেন এবং তিনি আমাদের মাঝখানেই আমাদের রূপেই ছড়িয়ে রয়েছেন। আমার সেই ঈশ্বরের পায়ের ধূলো কি একটু মাথায় ছোঁয়াতে পারি স‍্যার?”

আজ ভক্তের সাথে ভক্তের ঈশ্বরও কেঁদে ফেললেন।।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment