1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

পোস্টমর্টেম

ছবি : ইন্টারনেট

পোস্টমর্টেম

আনন্দ গোপাল গরাই

                                                  

(১)


তিনদিন পরে রোশনির সন্ধান পাওয়া গেল গভীর জঙ্গলে। প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে ছিল তার ডেডবডি। জঙ্গলে পাতা কুড়োতে গিয়ে কয়েকটা সাঁওতাল মেয়ে দেখতে পেল মৃতদেহটা।খবর গেল পুলিশে। সনাক্তকরণের জন্যে ডাকা হল রোশনির মা বাবাকে। নিখোঁজের দিনেই থানায় ডাইরি করেছিল ওরা। শোনা যায় পুলিশ নাকি সেভাবে অনুসন্ধান করেনি। মৃতদেহ তুলতে এসে গ্রামবাসীদের ক্ষোভের মুখে পড়ে পুলিশ। দোষীদের অবিলম্বে ধরার এবং শাস্তির আশ্বাস দিয়ে ওরা পোস্টমর্টেমে  নিয়ে যায় রোশনিকে।

     পোস্টমর্টেম টেবিলে রোশনিকে দেখে চমকে উঠে ডাক্তার নীলাঞ্জন সরকার। ওর মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নীলাঞ্জন। একি সত্যিই রোশনি না অন্য কেউ ? না, অন্য কেউ নয়। মেয়েটা রোশনিই--- তারই প্রেমিকা রোশনি। স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে উঠে রোশনির সঙ্গে তার পরিচয় ও প্রেমের ছবি।

(২)


সবেমাত্র ডাক্তারি পাশ করে গ্রামের একটা হাসপাতালে পোস্টিং পেয়েছে নীলাঞ্জন।একদিন প্রচণ্ড জ্বরে রোশনি  তার মায়ের সাথে এল ডাক্তার দেখাতে। নীলাঞ্জন দেখল তাকে এবং দেখল বেশ ভালোভাবেই। সাতদিনের ওষুধ দিয়ে বলল জ্বর ছেড়ে যাবে। ছেড়ে গেলেও আর একবার এসে যেন চেক আপ করিয়ে যায়। চার দিনের মাথায় জ্বর ছেড়ে গেল রোশনির। তবে শরীর খুব দুর্বল। ওষুধটা পুরো সাতদিন খেলো সে। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল রোশনি। তবু ডাক্তারের পরামর্শ মতো সাতদিন পর চেক আপ করাতে গেল রোশনি। সেদিন অবশ্য মা সঙ্গে যাননি। একাই গেল রোশনি একটা টোটো ভাড়া করে। বাবা হাই ইস্কুলের শিক্ষক। মা অঙ্গন ওয়াড়ির সুপারভাইজার। দুজনেই কাজে ব্যস্ত। বাবা চেয়েছিলেন একটা সি, এল নিয়ে মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কিন্তু রোশনি বলেছিল ছুটি নেবার কোনো দরকার নেই। একাই যেতে পারবে সে।

     হাসপাতালে যখন সে পৌঁছাল তখন সবেমাত্র দুটো পেসেন্ট লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখানো হয়ে গেলে রোশনি ঢুকল চেম্বারে। পরীক্ষা করে নীলাঞ্জন বললে  আর কোনো ওষুধের দরকার নেই। শুধুমাত্র দিন পনেরোর জন্যে একটা ভিটামিন ট্যাবলেট  লিখে দিল।

     রোশনিকে দেখে কী যেন আকর্ষণ অনুভব করল নীলাঞ্জন। জানতে ইচ্ছে করল তার সমন্ধে অনেক কথা। কিন্তু কিভাবে কথাটা তুলবে  ভেবে পাচ্ছিল না সে। নিজের মনের সঙ্গে অনেকক্ষণ যুদ্ধ করল সে।রোগিনীর রোগ সমন্ধে জিজ্ঞাসা করাই ডাক্তারের  নিয়ম। তার ব্যক্তিগত জীবন সমন্ধে নয়। তার ব্যক্তিগত জীবন সমন্ধে জানতে চাইলে রোশনি যদি কিছু ভাবে। তার সমন্ধে খারাপ ধারণা জন্মায়। তবুও বলব কি বলব না ভাবতে ভাবতেই কথাটা শুরুই করে দিল নীলাঞ্জন।।প্রেস্ক্রিপসনে নাম রোশনি রায়, বয়স একুশ বছর এসব তো জিগ্যেস করে লিখেছে সে। এবার জানতে  চাইল---‘ আপনি কোন কলেজে পাড়াশুনা করেন রোশনি?’ ‘আমাকে আপনি বলবেন না। তুমি বললেই যথেস্ট। ‘ এই কথা বলেই নিজের কলেজের নাম,কোন ইয়ারে পড়ে, বাড়ি কোথায়, মা বাবা কী করেন একে একে সব বলল নীলাঞ্জনকে। গভীর আগ্রহের সঙ্গে রোশনির সব কথা শুনতে লাগল নীলাঞ্জন। জানতে চাইল বি, এস, সি কমপ্লিট করে আর কী করার ইচ্ছে আছে তার। কথা বলতে বলতে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে দুজনের চোখে চোখ পড়ল দুজনের। ক্ষণিকের জন্যে  লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠল রোশনির মুখ। সে যেন বুঝতে পেরেছে নীলাঞ্জনের মনের কথা। সেই হল শুরু । এক কাপ চা নিয়ে দরজার কাছে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল হাস্পাতালের প্রবীনা নার্স সোমাদেবি। নীলাঞ্জন ও রোশনি তখন নিজেদের ব্যক্তিগত পরিচয় আদান প্রদানে এতটাই তন্ময় হয়ে গেছে যে দরজায় কেউ এসে দাঁড়িয়েছে তা বুঝতেই পারল না ওরা। একটু মুচকি হেসে চায়ের কাপ নিয়ে সেখান থেকে নিঃশব্দে কেটে পড়ল সে। বুঝতে বাকি রইল না যে ডাক্তার ও রোগিনী দুজনের মনেই রঙ ধরেছে।

(৩)

বাড়ি থেকে হেঁটে মিনিট চারেক গেলেই গ্রামের বাসস্ট্যান্ড। ওখান থেকে বাস ধরেই  শহরের কলেজে পড়তে যায় রোশনি। আজও বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিল বাসের অপেক্ষায়। হঠাৎ একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল তার পাশে।

   ‘ আরে রোশনি না?  কলেজ যাবে বুঝি? এস, গাড়িতে উঠে এস। আমিও শহরেই যাচ্ছি। কলেজ গেটে তোমাকে নামিয়ে দেব।‘

   লজ্জায় আরক্ত হয়ে রোশনি বললে—‘ আপনি আসুন ডাক্তারবাবু। আমি বাসেই চলে যাব। ‘

ডাক্তার কিন্তু নাছোড়বান্দা । ‘আরে এসোই না ‘—বলে একরকম জোর করেই নিজের পাশের সিটে রোশনিকে বসিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিল নীলাঞ্জন। নিজেই ড্রাইভ করছিল সে। এক  ভদ্রলোক বাস ধরার জন্যে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ফিরে এসে বেশ রসালো করেই ডাক্তার ও রোশনির প্রেমের গল্প পরিবেশন করতে লাগলেন তিনি। আর এই প্রেমের কাহিনি কানাকানি হতে হতে মা বাবার কানে পৌঁছতেও  খুব একটা সময় লাগল না।

      গাড়িতে যেতে যেতে দুজনের ব্যক্তিগত জীবন সমন্ধে আরও অনেক কথা জানল ওরা। একসময় নীলাঞ্জনের মুখ থেকে বেরিয়ে এল তার মনের কথা---‘ তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি রোশনি। ‘

     লজ্জায় মুখ নামালো রোশনি । কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল তার মনের আকাশেও প্রেমের রামধনু রঙ ছড়িয়েছে।

কলেজ গেটে রোশনিকে নামিয়ে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেল নীলাঞ্জন। দুরু দুরু বুকে কত কথা ভাবতে ভাবতে ক্লাসে গিয়ে বসল রোশনি। তার মনের ক্যনভাসে বার বার ভাসতে লাগল নীলাঞ্জনের মুখ। মনে ভিড় করে আসতে লাগল গাড়িতে বসে দুজনের কথোপকথনের কথা। সংগীতের সুরের মতো বাজতে লাগল নীলাঞ্জনের সেই কথাটা---‘ তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি রোশনি।‘

 কলেজ শেষে কলেজ গেট দিয়ে বেরিয়ে যথারীতি বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটার উপক্রম করছিল রোশনি। হঠাৎ কানে আসে নীলাঞ্জনের কথা---‘ উঠে এস রোশনি। আমি তোমার জন্যেই ওয়েট করছি।‘ রোশনির কোনো আপত্তি গ্রাহ্য না করেই গাড়ির গেট খুলে দেয় নীলাঞ্জন। আগের জায়গায় উঠে বসে রোশনি।

        রাস্তার ধারে একটা  ছোট্ট নদীর ধারে এসে গাড়িটা থামায় নীলাঞ্জন। দুজনেই নেমে এসে নদীর কিনারায় গিয়ে বসে ওরা। নদী থেকে স্নিগ্ধ হাওয়া এসে লাগে রোশনির এলো চুলে। আদর করে হাত বুলিয়ে দেয় নীলাঞ্জন। একসময় দুহাত দিয়ে রোশনির মুখটা নিজের মুখের দিকে টেনে নেয় নীলাঞ্জন। অধরে এসে মেলে অধর। দেহে জাগে শিহরণ, মনে জাগে এক অপূর্ব রোমাঞ্চ। এই প্রথম দুজনের এত কাছে আসা, এত ভালোবাসা।সকালের মতো সন্ধেবেলায় একই জায়গায় রোশনিকে নামিয়ে দিয়ে যায় নীলাঞ্জন। দুজনের মন ছুটে যায় দুজনের চলার পথে।

 (৪)

কলেজে রোশনির সঙ্গে পড়ত পাশের গ্রামের ছেলে অনন্ত। নাম যেমন, গুণও তেমনি অনন্ত। এমন কোন নেশা নাই যা সে করে না।, এমন কোনো কুকর্ম নাই যা তার মাথায় আসে না। অথচ সবই করে গোপনে। ভাবে এসব কথা কেউ জানে না। গ্রামের তো নয়ই, পাশের গ্রামেরও কেউ না। তাই জানার কথা নয় রোশনিরও। চেহারাটাও খুব সুন্দর অনন্তর। প্রথম দর্শনেই অনেক মেয়ের ওর প্রেমে পড়ে যাওয়ার  সম্ভাবনা। কিন্তু মেয়েরা ছেলেদের শুধু রূপ চায় না।চায় গুণও । গুণধর অনন্তর  অনন্ত গুণের কথা বন্ধু মহলে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে। জানতে পারে কলেজের মেয়েরাও। জানতে পারে রোশনিও।

      প্রথম প্রথম অনন্তেতে এক আধটু মন মজেছিল রোশনিরও। একটু প্রশ্রয়ও দিতে চেয়েছিল তাকে। কিন্তু ভুল ভাঙ্গে কিছুদিন পরে। অনন্ত ফোন করলে ফোন কেটে দেয় রোশনি। রাস্তাঘাটে কথা বলতে এলে পাত্তা দেয় না সে। অনন্ত অবশ্য চায় রোশনিকে। তবে সে চাওয়া ভালোবাসা নয়--- রোশনির রূপের মোহ। সে জানে তার প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া দেবে না রোশনি। তাকে জীবনসঙ্গিনীরূপে পাবার আশা দুরাশা মাত্র। তবুও রোশনিকে তার চাই। একবারের জন্যেও অন্ততঃ চাই। আলো যেমন পতঙ্গকে নিজের দিকে টানে, তেমনি রোশনির রূপের আগুনও বারংবার টানে অনন্তকে।

     কলেজ থেকে একবার এডুকেশানল টুরের আয়োজন করা হয়েছিল। যাবে বলে নাম লিখিয়েছিল রোশনি। কিন্তু শেষ বেলায় যখন জানতে পারে অনন্তও যাবে তখন বিশেষ কারণ দেখিয়ে নাম প্রত্যাহার করে নেয় রোশনি। অনন্তও ভাবে সে যাবে বলেই নাম তুলে নিয়েছে রোশনি। রোশনির উপর তখন থেকেই রাগটা জমতে থাকে অনন্তর। সব সময় সে থাকে সুযোগের সন্ধানে।

     বছর খানেক আগে একবার একলা পেয়েছিল রোশনিকে। মিনতির সুরে বারবার সেধেছিল তাকে। বলেছিল রোশনি যদি তাকে ভালোবাসে তাহলে আজ থেকে সব নেশা ছেড়ে দেবে সে। জীবনে কোনোদিন তার কথার অবাধ্য হবে না। রোশনি চাইলে তার মা বাবার কাছ থেকে তাকে ভিক্ষা মেগে নেবে। সে যেন অনন্তকে তার হৃদয়ে একটু জায়গা দেয়। যেন একসাথে সারাটা জীবন কাটানোর ছাড়পত্র দেয় তাকে। সে আর কো(নোকিছু চায় না। চায় তাকে প্রেমের রানী সাজিয়ে রাখতে। না ,সেদিন রোশনিকে কোনো জোর জবরদস্তি করেনি অনন্তও। সেধেছিল--- ভিখারির মতোই সেধেছিল। তার সেই সকরুণ আকুতি দেখে রোশনির মন একটু টলেছিল কিনা সেই জানে। তবে কোনো সদুত্তর দেয়নি সেদিন কিছুদিন ভাবার জন্যে সময় চেয়ে নিয়েছিল অনন্তর কাছে। অপেক্ষা করতে রাজীও হয়েছিল অনন্ত।  এমনকি নেশামুক্তি কেন্দ্রে এক আধবার তাকে যেতেও দেখেছিল অনেকে। তবুও কোন আশার বাণী আসেনি রোশনির কাছ থেকে। বারবার ফোন করে জানতে চেয়েছে তার সিধান্ত। কিন্তু সব বারেই না বলে দিয়েছে রোশনি। সে অন্তর দিয়ে অনুভব করেছিল একবার যে ড্রাগ আসক্ত হয়ে পড়েছে, ড্রাগের নেশা থেকে সরে আসা  তার পক্ষে কোনমতেই সম্ভব নয়। তাছাড়া তার নিজেরও ভবিষ্যৎ আছে। ভাল রেজাল্ট করে অনন্ত যে কোনোদিন চাকরি বাকরি পাবে সে আশাও দুরাশা মাত্র। এইভাবেই পেরিয়ে যায় একটি বছর। তার পরেই নীলাঞ্জনের সঙ্গে পরিচয় ও ভালোবাসা।

(৫)


রোশনির সঙ্গে ডাক্তারের প্রণয় কাহিনি বেশ রসালো ভাবেই প্রচারিত হয়েছিল সারা গ্রামে। বাসস্ট্যান্ডের সেই ভদ্রলোক একদিন বিনা কারণেই দেখা করতে এলেন রোশনির বাবার সঙ্গে। চা পান শেষে উপযাচক হয়ে নিজেই তুললেন রোশনির কথা। পরম শুভাকাঙ্খীর মতো সাবধানও করে দিলেন রোশনির বাবাকে। তার কল্পনাপ্রসূত অনেক ব্যর্থ প্রেমের কাহিনি শুনিয়ে যেতেও ভুল করলেন না ভদ্রলোক। ব্যাপারটা নিয়ে যে গ্রামে কানাকানিও শুরু হয়েছে সে কথাও জানাতে ভুললেন না তিনি।

   সন্ধ্যেবেলায় রোশনির মা বাবা নিজেদের রুমে ডেকে পাঠালেন মেয়েকে। আদ্যোপান্ত শুনতে চাইলেন নীলাঞ্জনের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা। অকপটে সব কথা স্বীকার করল রোশনি। কিন্তু একটা খটকা লেগেই রইল ওদের মনে।

    ‘ দেখ মা তুই বড় হয়েছিস। নিজের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতাও তোর হয়েছে। নীলাঞ্জন ডাক্তার মানুষ। তোর মতো সাধারণ মেয়েকে ও বিয়ে করবে কিনা সে বিষয়ে  আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এবার তোকেই সিধান্ত নিতে হবে কোন পথে এগোবি তুই ।‘--- কথাগুলো বলেই মেয়ের মুখের দিকে উত্তরের জন্যে তাকিয়ে থাকেন অম্বিকাবাবু।

  ‘ তুমি ভেবোনা বাবা। নীলাঞ্জনের মনটাকে আমি আতস কাঁচের মতো চিনে ফেলেছি। ও কোনোদিন আমাকে ঠকাবে না।‘ – মুখ নামিয়ে বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গেই জবাব দেয় রোশনি।

    মা মল্লিকাদেবিও মেয়েকে সাবধান করে বলেন---‘তোর কথা যদি সত্যি হয় তাহলে আমাদের চেয়ে সুখি কেউ হবে না। কিন্তু বিয়েটা না হওয়া পর্যন্ত আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারছি না।‘

   নীলাঞ্জনের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখলেও সামান্য একটু উদ্বেগ কাঁটার মতো খোঁচা দিতে থাকে রোশনির মনে। তাছাড়া আরও একটা উদ্বেগ তার অনন্তকে নিয়ে।অনেকদিন রোশনি ভেবেছে নীলাঞ্জনকে অনন্তর কথা জানাবে। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারেনি সে কথা। নীলাঞ্জনের সঙ্গে তার সম্পর্কটা যে জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে তার কাছে আর কোনো কথা গোপন করা চলে না। তাই সাহস করে নিজের বেডরুমে গিয়ে রাত্রি নটার পর বালিশে মাথা রেখে ভি, ডি, ও কলে ধরে নীলাঞ্জনকে।

    ‘ জান নীলু, একটা কথা তোমাকে বলা খুবই দরকার বলে মনে করি। তুমি যেন আমাকে ভুল বুঝো না। ‘—কাঁপা কাঁপা গলায় বলে রোশনি।

‘ তোমাকে আমি মন প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করি। যা বলার আছে স্বছন্দে বলতে পার।‘—আশ্বাস দেয় নীলাঞ্জন।

‘ তোমাকে বলতে বাধা নেই অনন্ত বলে একটা ছেলে আমাকে খুবই জ্বালাতন করে। বহুবার ও আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু আমি ‘না’ বলায় আমার উপর দারুণ খাপ্পা হয়ে আছে। যে কোনো সময় অঘটন ঘটাতে পারে। তাই বলছিলাম---‘এই বলেই থেমে যায় রোশনি। তার চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জলও গড়িয়ে আসে।

   ‘তোমার মানসিক অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি রোশনি। তোমাকে এই মুহূর্তে বিয়ে করে কাছে নিয়ে এলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু আমাকে এক্টুখানি সময় দাও ডারলিং। কিছুদিনের মধ্যেই আমি টাউনের হাসপাতালে পোস্টিং পেয়ে যাব।তারপর দুজনে মিলে শুরু করব নতুন জীবন।‘

নীলাঞ্জনের কথাগুলো ভরসা যোগায় রোশনির মনে। ফোনে নিয়মিত চলতে থাকে ওদের আলাপচারিতা। মাঝে মধ্যে মুখোমুখি দেখা,কথা বলা,কোনোকোনো দিন দুজনে মিলে একটু ঘুরে আসা।

(৬)

রোশনির বাবার কাছ থেকেই তার নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়েছিল নীলাঞ্জন।বড় উদ্বেগের মধ্যে সময় পার হচ্ছিল তার। নিখোঁজ হওয়ার দিনই থানায় মিসিং ডাইরি করেছিলেন রোশনির বাবা। সন্দেহের তীরটা স্বাভাবিকভাবেই ছিল অনন্তর দিকে। অভিযোগ পেয়েই অনন্তর বাড়িতে গিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু ঘরে পায়নি তাকে।‘ তাহলে কি রোশনি কে নিয়ে পালিয়েছে আপনাদের ছেলে?’ – এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল অনন্তর মা বাবাকে। কিন্তু তারা স্পস্টই জানিয়েছিলেন অনন্তর সঙ্গে রোশনি বলে কোনো মেয়ের সম্পর্কের কথা তারা ঘুণাক্ষরেও জানেন না। অনন্তদের কিছু আত্মীয় স্বজনদের  ঠিকানাও নোট করে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। জানিয়েছিল পার্শ্ববর্তী থানাগুলোকেও। শুধু নিজেদের জেলায় নয় অন্য জেলা এবং ভিনরাজ্যেও নিজেদের সোর্স  কাজে লাগিয়েছিল তারা। কিন্তু তখনও পর্যন্ত কোনো হদিশ করতে পারেনি। তবে এই অপকর্মের নায়ক যে অনন্ত তা বুঝতে  ভুল হয়নি পুলিশের।

 (৭)

 গ্রামের অনতি দূরে একটা মেলায় গিয়েছিল রোশনি। পায়ে হেঁটে ফিরছিল অন্য অনেকের সঙ্গে। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে একটু রাত হয়েছে। ওপাড়ার মেয়েরা যারা তার সঙ্গে গিয়েছিল তারা আপন আপন ঘরে চলে যায়। রোশনিকে জিগ্যেস করে সে একা যেতে পারবে কিনা।

     ‘ এইত সবে রাত সাড়ে আটটা বাজে। এত ভীতু নই যে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে? তোরা নিশিন্তে চলে যা। ‘ এটাই ছিল বান্ধবীদের সঙ্গে রোশনির শেষ কথা। পুলিশের কাছে একথা জানিয়েছিল ওর বান্ধবীরা।

   রোশনিদের বাড়ির কাছেই ওত পেতে বসে ছিল অনন্ত। সুযোগ পেয়ে ওর মুখে কাপড় বেঁধে একটা মোটর বাইকে রোশনিকে তুলে নেয়। বাইকটি চালাচ্ছিল অন্য একটা ছেলে।

   জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে রোশনিকে ধর্ষণ করে অনন্ত। পাহারা দেয় সেই ছেলেটা।এরপর দুজনে মিলে রোশনিকে খুন করে বেপাত্তা হয়ে যায় ওরা।

(৮)

পোস্টমর্টেম টেবিল থেকে নিজের কোয়ার্টারে ফিরে একটা সুইসাইড নোট লিখল নীলাঞ্জন। তাতে লেখা—‘আমি একজন ডাক্তার। মানুষের জীবন বাঁচানোই আমার পেশা। কিন্তু আমারই ভুলের জন্যে আমারই একান্ত আপনজন আমার বাগদত্তাকে আমি বাঁচাতে পার লাম না। এই দুঃসহ শোকের বোঝা নিয়ে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। ‘

   সিলিং থেকে দড়ির ফাঁস দিয়ে ঝোলা নীলাঞ্জনের ডেড বডি নামাতে গিয়ে তারই জামার পকেট থেকে সুইসাইড নোটটা খুঁজে পেল পুলিশ। নিমেষের মধ্যে খবরটা ভাইরাল হয়ে গেল সোশ্যাল মিডিয়ায়।

...(সমাপ্ত)...


No comments:

Post a Comment