|
সায়াহ্নের আঁধারে
গোপা চক্রবর্তী
হেমন্তে বিকেলের উপসংহার পর্বে সূর্যের তাপ প্রায় অস্তমিত বা ঝিমনো। জীবন সায়াহ্নে যৌবনের প্রচণ্ড তেজ বা দীপ্তি কমে যায় প্রৌঢ়ত্বে। কিন্তু তখনও এক ঝলক যে দীপ্তি থাকে অনেকের মধ্যে, সেটাই ঠিকরে পড়ে তার জীবন চালনার ওঠা পড়ার মধ্যে দিয়ে যা কিনা তারতম্য ঘটায় আর পাঁচ জনের থেকে তাকে বিশেষ ভাবে আলাদা করতে। জীবন সায়াহ্নে সেই তেজ বা দীপ্তি ঠিক পড়ন্ত বিকেলের ছেঁড়া মেঘের মধ্যে দিয়ে সূর্য্য রশ্মির ঝলকের মত।
কখনো সে ঝলক যৌবনের শেষ দ্বারে পৌঁছনো লাবণ্যের আভিজাত্য, কখনো বা সম্পদের পড়ন্ত ঐশ্বর্যের আভিজাত্য , আর এই দুইয়েরি অস্পষ্ট রেখা তখনও ছিল অরুণ ও অনিমার জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে।
প্রায় কুড়ি বছর হলো অরুনের মেয়ে বিদেশে বাস করছে তার স্বামীর কাজের সুবাদে। অরুনের ঘর আলো করে থাকা, মন জুড়ে থাকা ভালোবাসার একমাত্র মেয়ে। যাবার সময় মলি কিছুটা আশ্বস্ত করার জন্য বাবাকে বলেছিল,
" বাবা তুমি চিন্তা করছ কেন ? আমি তো আবার আসবো। তুমি,মা আমাদের ওখানে চলে এসো।"
হ্যাঁ ঠিকই, কুড়ি বছর ধরে অরুণ ও অনিমা মেয়ের কাছে যাতায়াত করছে। মেয়ে বছরে একবার আসলেও তাঁদের মন ভরে না। মনে ভাবে তাঁদের পড়ন্ত বিকেলে মেয়ে যদি তাঁদের কাছে এসে থাকত তাহলে আরো ভালো হতো।কিন্তু সে গুড়ে বালি। তাই শূন্য হৃদয়ে বিরাজ করে নৈঃশব্দের সীমাহীন বিস্তৃতি।যে নিস্তব্ধতা মাঝে মাঝে খান খান হয় যায় যখন পরস্পরের মধ্যে তীব্র বাকযুদ্ধ চলে। সে যুদ্ধ থামলে আবার সেই নিস্তব্ধতা।
শীতের শুরু হলেও কলকাতার গড়িয়াহাটের এদিকটা ঠান্ডার তেমন দাপট থাকে না। বালিগঞ্জ, ঢাকুরিয়া, কিছুটা দূরত্বে হিন্দুস্থান পার্ক বরাবর এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা আবাসনের দেয়ালে উত্তরে বাতাস সজোরে ধাক্কা খেয়ে হারিয়ে যায়। কিছুটা বাতাস যদি ঢুকেও পড়ে তেমন জোর দিয়ে হাকে না। কিন্তু গড়িয়াহাটের দামী কোঅপারেটিভ ফ্ল্যাটের তিন তলার বারন্দায় আজ সকাল থেকেই অশীতি পর যুবক অরুণকে শাল জড়িয়ে টুপি মাথায় দিয়ে বসে থাকতে দেখে অনিমা একটু ঘাবড়ে যায়।অনিমা ভাবে শাল জড়িয়ে অরুণকে এর আগেও একবার বসতে দেখেছিল, বিবেকানন্দ রোডের বাড়িতে ওর বাবার হার্ট অ্যাটাকের সময়। বিদেশের বাজার ধরার জন্য অরুণকে প্রায়ই বিদেশে যেতে হতো।একা অরুনের পক্ষে এতো বড়ো ব্যবসা সামাল দেওয়া কষ্টকর হবে জেনেও ভয়ে প্রচণ্ড শীতে যেন অরুণকে পেয়ে বসেছিল।
একটি মেঘলা চাপা গুমোট রাতের অন্ধকার একটু একটু করে সরে গিয়ে কলকাকলির কলতানে দিনের আলো ঘুমের আড়মোড়া ভাঙিয়ে জেগে উঠছিল।অরুনের মা রোজকার অভ্যাস বসত ঘুম থেকে উঠে গাছে জল দিচ্ছিলেন। অরুনের ভাই যে পৈতৃক ব্যবসায় কোনোই খোঁজ রাখে না, বাড়িতে যার অস্তিত্ব বোঝা যায় ভোর বেলা গানের রেয়াজ থেকে,সেদিন সে এবং অরুনের মেয়ে আসন্ন পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিল। আর রবীন বাবু ছেলের অনুপস্থিতিতে একমাস ধরে পুরো ব্যবসা দেখা শোনা করেছেন এবং পরের দিনও কিছু কাজের পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু সেইদিন ভোরে কাজের মেয়ে চা দিতে গিয়ে দেখল, রবীন বাবু বিছানায় শোয়া অবস্থায় প্রচণ্ড জোরে শ্বাস নিতে চাইছেন কিন্তু পারছেন না। ডাকা ডাকিতে বাড়ির সবাই যখন তাঁর কাছে এসে পৌঁছাল তখন সব শেষ। অরুণ বাবার গায়ে মাথায় হাত বুলনোর সঙ্গে সঙ্গে রবীন বাবু জোরে একবার শ্বাস টানার পরই অরুনের কোলে মাথা রেখে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।অরুণ বাবার এই আকস্মিক হার্ট অ্যাটাকে খুবই ভেঙে পড়েছিল।
অরুনের বাবা ছিলেন অ্যালুমিনিয়াম তারের বড়ো স্টকিস্ট। খুব ছোট বয়সেই রবীন বাবু পয়সার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে দেখেছিলেন তাঁর বাবাকে। একেবারে কপর্দক শূন্য অবস্থা থেকে তিলে তিলে বড়ো করেছেন এই ব্যবসাকে। প্রথম দিকে বিদেশের বাজারে পশার জমাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। নিজের দেশের বিক্রি যা ছিল তা আরো বেড়েছে অরুনের বিয়ের পর।অনিমার বাবা কলকাতা জোনে তখন মেন ডিস্ট্রিবিউটর হওয়ার কারনে ব্যবসা আরো বড়ো হয়ে ছিল।
অরুনের মাঝে মাঝেই ওর বাবার মারা যাওয়ার দিনের কথা মনে পড়ে যায়। তখন অরুণ বেশ কিছুক্ষন কারোর সাথেই কথা বলতে চায় না। অনিমার তখন বেশ অসুবিধা হয়। সারাদিন হাজার কাজের ফিরিস্তি---- কখন কোনটা কার চাই না চাই সবই অনিমাকে দেখতে হয়। একাকী এত বড়ো ব্যবসা চালানোর গুরু দায়িত্ব যে বহন করছে তাকে ঠিকঠাক রাখা ও মানসিক সাপোর্ট দেওয়া, এসব অনিমা বেশ দক্ষ হাতেই সামলিয়েছে।আবার পান থেকে চুন খসলেও আসামি ওই স্বামীই।
তবে আজ ব্যাপার অন্য। গতকাল রাত্রে অরুনের মেয়ে মলি জানিয়েছে তাঁদের জামাইয়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। এই অযাচিত সংবাদ স্তম্ভিত করেছিল ওদের দুজনকেই। তবু অরুণ
কি আর তার নিত্য নৈমিত্তিক কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পেরেছে।তবু মানসিক ভাবে মেয়েকে জোর দেওয়া, তার পাশে থেকে কিভাবে তাকে সাহায্য করা যায় সেই চেষ্টাই করেছেন।ডাক্তার বলেছে , " প্রাথমিক স্টেজে ধরা পড়েছে চিকিৎসা করালে সেরে যেতে পারে।" চিকিৎসা শুরু হয়েছে। মেয়ে মলি বাবাকে, টাকার প্রয়োজন বলে জানিয়েছে। তাই অরুণ ঠিক করেছে মলির নামে কিনে রাখা ফ্ল্যাট যদি বিক্রি করা যায়। এতে ওদের দুজনেরই মাথা গোঁজার ছাদ চলে যাবে আপাতত।এই শেষ বয়সে সেটা খুবই কষ্টকর হবে শারীরিক দিক থেকে। তবু সন্তানের সুখেই যে বাবা মা'র সুখ। জীবন সায়াহ্নে এইটুকু সুখ অরুন, অনিমার।
জীবনের ফেলে আসা দিনের সুখস্মৃতি অনিমার মনেপড়ে যায়।মনে পড়ে অনিমার.....সেই ছোট্ট মেয়ে বিবেকানন্দ রোডের বাড়িতে যখন নিয়ে এলো নার্সিং হোম থেকে.....অরুনের আর তর সয় না কি নাম দেবে ভেবে।সেদিন থেকেই গেয়ে উঠত রবিঠাকুরের গানের দু-কলি....আমার মল্লিকা বনে....যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার মল্লিকা বনে। আর ওই গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে কাঁদুনে মেয়ে কেমন চুপ করে যেত কান্না থামিয়ে। তখন থেকেই দেখতাম অরুনের মন ব্যবসার কাজে যেমন থাকত পাশাপাশি আমার মল্লিকা ফুলের খবর জানতে চেয়ে ফোন খুব কম আসত না। তখন মনে মনে একটু রাগ হতো না অনিমার এমন নয়। একবার মেয়ের অভিমান হয়েছিল অরুনের ওপর। কাকুর গানের অনুষ্ঠানে মেয়ের যাওয়ার কথা, অরুণ তখনও এসে পৌঁছয়নি বিদেশ থেকে প্লেন লেট করেছে বলে। সেদিনও অরুণ মেয়ের মান ভাঙাতে রবি ঠাকুরের গান গাইতে হয়েছিল।সেদিন অরুণ বলেছিল," তোরা সবাই যদি ব্যবসা মুখো হয়ে যাস তবে আমার একার পক্ষে হলেও আরও কয়েক পুরুষ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
অরুনের কপাল বটে,অরুনের বাবা মারা যাওয়ার ঠিক ছয় মাসের মধ্যে অনিমার বাবাও মারা গেল।তাই লোকাল বাজারও দিন দিন কমে গেল। লাভ কমার ফলে ব্যবসা মার খেতে লাগল। অরুনের ভাই বিয়ের পর ব্যবসার ভাগ বুঝে আলাদা হয়ে গেল। অতঃপর এই ব্যবসাকে দেউলিয়া ঘোষনা করে উঠিয়ে দিতে হলো অরুণকেই।
সেসব দিনের কথা অরুনের মনে পড়ে ওর বাবার কথা মনে করে। তখন অরুনের অবস্থা ঠিক ভরা শ্রাবনে যেমন চারিদিক আঁধার করে বৃষ্টি নামে অরুনের অবস্থাও তেমন হয় ঠিক বৃষ্টি ঝরার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। পরে অঝোরে বৃষ্টি না হলেও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ার মতো চোখ দিয়ে জল পড়ে নিশব্দে। অনিমার চোখ তা কখনো এড়িয়ে যায় না। অনিমা,অরুনের এই ভারাক্রান্ত মনকে সাময়িক ভাবে কিছুটা হাল্কা করার জন্য মাঝে মাঝেই বাক বিতণ্ডায় জড়ায়। অনিমা, আজ বারন্দায় চেয়ার টেনে বসে ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালতে গিয়ে দেখে চা পুরো শেষ। অনিমা বলল , " আমার চা কোথায় ? চা রাখনি ?" অরুণ কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে বিসন্ন হয়ে থাকতেই অনিমা ততোধিক বিরক্ত হয়ে বলল, " কী হয়েছে টা কী ? ঠান্ডা কোথায় ! শাল মুড়ি দিয়ে চার কাপ চা খেয়ে ফেলেছ ?! জ্বর হয়েছে কী ?" অরুনের আজ কিছুই ঠিক থাকছে না।সব কেমন যেন উল্টো পাল্টা হয়ে যাচ্ছে।অরুণ যখন প্রথম ফ্ল্যাট কিনেছিল তখনকার গড়িয়াহাট আর এখনের মধ্যে অনেক তফাৎ হয়ে গেছে। তখন অরুণ মেয়ের বিয়ে দিয়ে বিবেকানন্দ রোডের বাড়ি বিক্রি করে সদ্য এবাড়িতে এসেছিল। অরুনের কেনা দুটো ফ্ল্যাটের মধ্যে একটা মেয়ের নামে কেনা ফ্ল্যাট রেখেছিল।যদি মেয়ে এসে থাকে বুড়ো বাবা,মা'য়ের পাশে। কিন্তু সেসব হওয়ার নয়। তাই নিজের নামে রাখা ফ্ল্যাট বিক্রি করে মেয়ের নামে কেনা ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করে।
অরুনের ঠিকে কাজের মেয়ে চা বিবাদ শুনতে পেয়ে দুকাপ চা বানিয়ে চলে যায়। অরুণ বিসন্ন গলায় মৃদু স্বরে বলল, " অনি সকালে হেঁটে ফেরার সময় আমাদের কোঅপারেটিভ ফ্ল্যাট ওনার্স এসোসিয়েশনের সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা হলো। অনিমা কিছু আশঙ্কা করে অত্যুৎসাহী হয়ে জানতে চাইল, কী বলল ? অরুণ ভালো করে শাল টাকে জড়িয়ে নিয়ে বলল, "আমাদের মেয়ের ফ্ল্যাট এখন বিক্রি করা যাবে না।" অনিমা ভাবতে থাকে এখান থেকে অদূরেই তার বাপের বাড়ি ঢাকুরিয়া। জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, পড়াশুনো তারপর অরুনের সাথে বিয়ে সবই কাছাকাছি এই গড়িয়াহাট থেকে।এই জায়গা ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই যেন অনিমা পারছেনা। অথচ টাকার প্রয়োজন মেয়ের জন্য। অরুণ আবার বলল, "এই ফ্ল্যাটের কোঅপারেটিভ
ওনার্স এসোসিয়েশন থেকে কোর্টে একটা মামলা রুজু করা হয়েছে। সেই মামলা অনুযায়ী এই ফ্ল্যাটের মালিক যদি অন্য দেশের নাগরিকত্ব পেয়ে যায় তবে তার নামে এই ফ্ল্যাট আর রাখা যাবে না। এই ফ্ল্যাট মলি অন্য কাউকেই এখন বিক্রি করতে পারবে না। এপার্টমেন্টের নিরাপত্তার জন্য কোঅপারেটিভ ওনার্স এসোসিয়েশন যাকে বলবে তাকেই ফ্ল্যাট টা মলিকে বিক্রি করতে হবে। তাই কোর্ট থেকে মলির নামে ইনজাংশন লেটার বা চিঠি এসেছে মলির নামে এসোসিয়েশনের কাছে। যাতে মলি এখনই এই ফ্ল্যাট বিক্রি করতে না পারে।তাই প্রতিম বাবু আমাকে বললেন,"আপনার মেয়েকে আসতে বলুন, " দেখি কি করা যায়।"
অনিমা বিসন্ন গলায় বলল, " মলি কী এখুনি আসতে পারবে !"
অরুণ বলল, "এসোসিয়েশনের নিয়ম অনুযায়ী চুক্তি পত্র মেন নিয়ে সই করতে হবে মলিকে। সেই জন্য মলিকে একবার আসতে হবে।"
বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে অরুণ কে আজ কেমন যেন একটু হলেও অন্যরকম লাগছে। অনিমা শুনতে পাচ্ছে অরুণ গান গাইছে। " জীবন যতো পূজা হলো না সারা জানি হয়ে জানি তাও হয়নি হারা...." রবি ঠাকুরের গান দুকলি গুন গুন করে চলেছে আপন মনে খুব ভোরে উঠে। অনিমার গান গলায় আসে না। কিন্তু অরুণ গান করলে ওর মনটা আনন্দে ভরে যায়। তখনকার মতো কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়। তাই অনিমা একটু উৎসাহী হয়ে জানতে চাইল, "কী ব্যাপার মলির কোনো খবর আছে ?" অরুণ বলল,
"গতকাল রাত্রে মেল করে মলি জানিয়েছে, " তোমার জামাই এখন আপাতত ক্যান্সার মুক্ত হয়েছে। আগামী দুবছরের মধ্যে যদি আর না বাড়ে তাহলে ভয়ের কারন নেই। তবে আমি আগামী সপ্তাহে তোমাদের কাছে আসছি। তখন সব কথা হবে।
অন্যান্য দিনের মতো অরুণ আজও সকালে চা নিয়ে বারন্দায় বসেছে। নতুন দিনের নতুন ভোর , নতুন আশার আলো আগের দিনের দুশ্চিন্তা কিছুটা মুক্ত করেছে , কিন্তু আবার তো সন্ধ্যে নামছে তার জন্য মনকে প্রস্তুত করতে লাগল।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment