|
দেবোপম
পার্থ ঘোষ
ছোটো পত্রিকার অনুষ্ঠান আছে শহরের বড় প্রেক্ষাগৃহে। সেই অনুষ্ঠানে আমি চিত্রগ্রাহক। ছবি তুলতে হবে সমগ্র অনুষ্ঠানের। আমার দামী ক্যামেরা নেই; তবে একটা মাঝারি দামের ক্যামেরা আছে। তাতেই ছবি তুলি । যদিও সেসব ছবির প্রিন্ট নিলে খুব একটা দৃষ্টিনন্দন হয় না তবুও লোকসানের স্রোতে গা ভাসিয়ে এগিয়ে চলা ছোটো পত্রিকার বিনা পয়সার চিত্রগ্রাহকের সেসব ছবিই আনন্দের সঙ্গে ছাপেন পত্রিকার সম্পাদক। তাতে আমার পকেট না ভরলেও মন ভরে। টাকায় তো সব কিছু কেনা যায় না। তাই আমার আনন্দটাকেও আমি বিক্রি করার কথাও মনে করি না। লাভ যে একদম হয় না তা নয়। ছবি তুলতে তুলতে পরিচিতির পারদটা বাড়তে থাকে। অনেক নামি-দামী মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পারি। তাঁদের সঙ্গে চেনা পরিচিতি হয়। এটাও একধরণের নেশা, আবার ভালোবাসাও । অর্থের বিনিময়ে প্রাপ্ত পারিশ্রমিকের থেকে অনেকটাই বড় পাওনাও বটে।
যাক্ যেখান থেকে শুরু করেছিলাম – অফিস থেকে বেরিয়ে বাস ধরে সোজা ষ্টেশনে আসতেই ঘোষণা শুনলাম – ট্রেন আসছে।
আসছে মানে আসছেই। দু’মিনিট, পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট – ট্রেন আর আসে না। ক্রমশঃ ভীড় বাড়ছে ষ্টেশনে। ভীড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মনে বাড়ছে উৎকণ্ঠা – ট্রেনটা দেরী করছে মানে মানুষের ভীড়ে ভর্ত্তি হয়েই আসবে, উঠতে পারবো তো?
ভীড় ট্রেনে ওঠা অভ্যেসের ব্যাপার। কায়দাও আছে। প্রতিদিন যাতায়াত করতে করতে নিত্যযাত্রীরা অভ্যস্ত হয়ে যায়। তবু জনতা জনার্দন তো, তাই জনতার ভীড় মনে একটু ভীতির সঞ্চার করেই। কারণ, এই জনতার অনেক ক্ষমতা। জনতা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে সে যে কোনো ক্ষেত্রেই।
প্রায় পনেরো মিনিটের ধৈর্য্য পরীক্ষার পর ট্রেন ষ্টেশনে এলো। সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম একসাথে। যেন ষ্টেশনে মহাজাগতিক বিস্ফোরণ হবে একটু পরেই, আর এটাই আজকের শেষ ট্রেন।
গুঁতো, লাথি, খামচা-খামচি, জটলা, লেঙ্গা-লেঙ্গি – উঠে পড়লাম । টেনশন কমলো। প্রতিদিনের অভ্যাস; ভুল হবার নয়। এবার কোমরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পালা। কোমড়ের ঠেলায় ট্রেনের পেটের ভেতরে সেঁধিয়ে যাওয়ার যুদ্ধ। সে যুদ্ধে পায়ের ওপর পা, ব্যাগের হ্যাণ্ডেলের মধ্যে জড়িয়ে যাওয়া হাত, বগলের তলায় মাথা, পাছা আর পিঠের মাঝের গড়ান অংশে খাপে খাপে বসে যাওয়া নেয়াপাতি ভুঁড়ি। পদচালনার দরকার নেই; উচ্চগতির গাড়ী হঠাৎ ব্রেক কষলে যেভাবে ঘষ্টে যায় সেভাবে একে বারে ট্রেনের ভেতরের জানলার ধারের প্যাসেজে ঢুকে যেতে লাগলাম। কারো রেশমী ওড়না জড়িয়ে গেল শরীরের সঙ্গে ক্ষণিকের অসাবধানতায়।
হঠাৎই ওড়নায় হ্যাঁচকা টান; কারণ, ওড়নার টানে সেই মহিলার গলায় ফাঁস পড়ার যোগাড়। সঙ্গে ‘কানা নাকি!’ শব্দের ব্যাক্ পাস। অসহায় আমায় সহ্য করতেই হ’ল। এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আর এক কান দিয়ে বার করে দিলাম সেই শব্দের ব্রহ্মাস্ত্র। এই জন্যেই মনে হয় বিধাতা মানুষের দুটো কান সরলরেখায় করেছেন। বিধাতা ভদ্রলোকের ব্রেনটা যেন সত্যিই কম্পিউটর। এটা প্রমাণিত।
এমতাবস্থায় এক চড়া গন্ধ নাকে এসে লাগল। এই গন্ধ চিনতে ভুল হয় না। অ্যালকোহলিক সুবাস! তাও আবার দেশী। একে সুবাস বলা যায় কিনা জানি না তবে সেই গন্ধ লক্ষ্য করে পাশে তাকিয়ে দেখি ঢুলুঢুলু চোখ, টালমাটাল পা, উস্কোখুস্কো চুল, বোতাম খোলা জামার ফাঁকের রুগ্ন শরীর নিয়ে একজন আমার বামদিকে দাঁড়িয়ে গা ঘেঁষে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বলে উঠল জড়ান স্বরে – “আপনার ওপাশে একটু জায়গা হবে?”
একটু বিরক্তই হলাম। মনে মনে বললাম, এ আপদ আবার এখানেই এসে জুটল! যদিও সুটেড-বুটেড বিলাতী খাওয়া কেউ হলে তার সম্বন্ধে আপদ কথাটা মনে আসতো কিনা জানি না, তবে এর ক্ষেত্রে এলো।
ব্যাজার মুখে বললাম – “পেছন দিয়ে চলে যাও”। আসলে তাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা। গরীব মানুষ তো তার ওপর আবার বাংলার সেবক, তাই এই অচ্ছেদ্দা।
সে আমায় গুঁতো দিতে লাগল। তবে খুব একটা নড়ে চড়ে ওপাশে যাবার চেষ্টা করল না। আমি পুনরায় বললাম বিরক্তি সহকারে – “কি হ’ল? ঠেলা দিচ্ছ কেন?” বিলাতী সেবককে হয়ত আপনি বলতাম, কিন্তু যেহেতু বাংলার সেবক তাই তুমি ছাড়া মুখ থেকে কিছু বেরলো না। যেমন এম. এ. পাশ করা রিক্সাচালককেও আমরা ‘তুই’ সম্বোধন করে থাকি, তেমনই।
সে এবার নেশা মাখা কণ্ঠে বলল – “ঠেলা! ঠেলা দিলাম কই! আমি তো ওদিকে যাবো”।
বললাম – “যাও! কোথায় যাবে? ওদিকে জায়গা আছে? দেখতে পাচ্ছ না? ঠিক করে দাঁড়াও। গায়ে পড়ছ কেন?”
মানুষটা হাত উল্টে ঠোঁট উল্টে একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করে বলল – “যাঃ! বাবা! ওদিকে জায়গা নেই? কেন বাবাঃ!”
এবার সীটে বসা একজন তথাকথিত ভদ্রলোক লোকটাকে বললেন – “এখান থেকে যাও তো। ঝামেলা বাড়িও না। ঘাড়ের ওপর উঠে আসছ কেন? দেখছো না ভীড় রয়েছে?”
লোকটা মুখটা নীচু করে সেই যাত্রীটার দিকে তাকাল। বলল – “কি ভুল করলাম? ট্রেনে উঠেছি দাঁড়াব না?” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল – “আপনি কোথায় যাবেন?”
আমি বিরক্ত হলাম অনধিকার চর্চায় । ঝাঁঝিয়ে বলেই উঠলাম – “তোমার কি? আমি যেখানেই যাই? চুপ করে দাঁড়াও। গন্ধ বেরোচ্ছে”।
লোকটা বলে উঠল – “ওই একটু খেয়ে ফেলেছি। বাংলা খেয়েছি”।
- “এই দিনদুপুরে খেয়ে ট্রেনে উঠেছো, তাও আবার বড় গলায় বলছ, লজ্জা করে না? তার ওপর টলছো!”
- “ট্রেন তো চলছে, তাই টল্ছি”।
- “এতো খেলে পায়ে জোর থাকে? টলবে তো বটেই। ঠিক করে দাঁড়াও। গায়ে ভর দিও না”।
- “যাঃ শ্লা! পড়ে যাচ্ছি, ধরে দাঁড়ালেও দোষ?” – লোকটা বলল জড়ান গলায়।
- “আমি কি তোমার ধরে দাঁড়াবার জিনিষ নাকি?” – বললাম আমি।
মানুষটা আরও আমার গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। ওর পায়ের জোর শেষ। ভীড়ের চাপ ওকে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। সমস্ত শরীরটা আমার শরীরের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। আমার অস্বস্তি হচ্ছে। সেই সঙ্গে তীব্র গন্ধে নিঃশ্বাস জড়িয়ে আসছে। আমি বিরক্ত প্রকাশ করলাম – “কি হলো! এভাবে দাঁড়ান যায়?”
সে জড়ান গলায় কিছু বলল। মুখ খুলতেই আবার অ্যালকোহলের গন্ধ নাকে এসে লাগল। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। বুঝলাম, সমস্ত পথটা এভাবেই যেতে হবে। বেশী কিছু বলার সাহসও পাচ্ছি না। আমি সুটেড-বুটেড তথাকথিত ভদ্রলোক। আর এতক্ষণ ধরে দেখে মানুষটাকে আমি নীচু ক্লাসের লোক বলে মনে করেই নিয়েছি। তারপর আবার বাংলা খাওয়া মাতাল। বেশী কথা বললে আমার ভদ্রতার মুখোশটা সে খুলে দিতে পারে। তাই নিজের ভদ্রতা নিজের কাছে গুটিয়ে রাখলাম। অসহ্যতা সহ্য করেও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম। মধ্যবিত্ত ছা-পোষা কেরানীরা এভাবেই সব কিছুর সঙ্গে আপোষ করে চলে। এটা আমার জন্মগত অভ্যাস।
একটা জংশন স্টেশন এল। হুড়মুড় করে এক দঙ্গল লোক নামতে থাকল সেই নিত্যদিনের কে আগে যাবে পদ্ধতীতে। এ ওর ঘাড়ের ওপর দিয়ে, পা মাড়িয়ে, গুঁতো মেরে। কামরাটা একটু ফাঁকা হলো। নতুন যাত্রী উঠল কিছু। তবে সংখ্যায় কম। আগের মত গা ঘেঁষাঘেঁষি ভাবটা এখন আর নেই। একটু হাত-পা ছড়িয়ে দাঁড়াবার মত অবস্থা হয়েছে। আমি একটু সরে দাঁড়ালাম। তাতে লাভ কিছু হলো না।
মানুষটা আমার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়াল। আমি বাধ্য হয়ে বললাম – “কাঁধ থেকে হাত নামাও”। আমার গলার স্বরে দৃঢ়তা ফুটে উঠল। তাতে কাজ হলো। সে হাতটা নামালো। তবে বিড়্বিড় করে বলল – “একটু ধরা যাবে না? গাড়ী যে চলছে!”
আমি ওর কথার কোন উত্তর দিলাম না।
ইতিমধ্যে জানলার ধার থেকে একজন যাত্রী উঠে যাওয়ায় আমার পেছনে দাঁড়ান আগের ষ্টেশন থেকে সদ্য ট্রেনে ওঠা এক পরিবারের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্যাকে তার বাবা জানলার ধারে এগিয়ে দিলেন। ছোট্টো মেয়েটি গুটি গুটি পায়ে তার ঈপ্সিত জায়গাটায় গিয়ে বসল।
শিশুটিকে দেখে আমার ছোটোবেলার কথা মনে পড়ল। ট্রেনে হাওয়ার দিকের জানলার ধারটা পেলে তখন খুব খুশী হতাম। ভাই-বোনদের সঙ্গে মারপিট লেগে যেত ওখানে বসার জন্য। কে বসবে? জানলা দিয়ে বাইরের চলমান পৃথিবী দেখার আনন্দই আলাদা । বিশেষ করে শিশু বয়সে। এখন তো প্রতিদিনের যাত্রাপথের একই দৃশ্য আর দেখতে ইচ্ছে করে না। তার ওপর স্মার্ট ফোনের সৌজন্যে বাইরের চলমান দৃশ্য উপভোগ করার লোকও অনেক কমেছে। শিশুটির মুখে একশো প্রদীপ জ্বলে উঠল। সে দৃষ্টি প্রসারিত করল বাইরের পিছ্লে যাওয়া দৃশ্যাবলীর দিকে।
মাতাল যাত্রীটি হঠাৎই হাত বাড়িয়ে মেয়েটার চিবুক ছুঁয়ে আদর করে উঠল ‘পরী মা’ বলে। শিশুটি একটু চমকে গেল। তার চোখের সামনের সচল পৃথিবী থমকে গেল। সে অবাক দৃষ্টিতে মানুষটার দিকে তাকাল।
আমি এবার একটু ধমকে উঠলাম – “চুপ করে দাঁড়াতে পারছো না? মেয়েটাকে বিরক্ত করছ কেন?”
অন্য যাত্রীরা যারা ব্যাপারটা দেখেছে তারাও ফিরে তাকাল। তাদের চোখে মুখে কিছুর প্রতীক্ষা নজরে পড়ল। আমার মনে হল মাতালটা প্রতিবাদ করলেই ওরা গর্জে উঠবে।
মাতালটা চুপ করে গেল। তার মুখে যেন দুঃখের ছায়া পড়ল। কোনো কথা না বলে নিজের জায়গায় সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। আমি ভাবলাম, আমায় নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছে।
শিশুটির পাশে বসা বয়স্ক যাত্রীটি উঠে গেলেন। একইসঙ্গে উঠে পড়লেন পাশের আরো দুজন যাত্রী। ওঁদের গন্তব্য এসে গেছে। শিশুটির মা এবার এগিয়ে এসে ওর পাশে বসলেন। নিত্য যাত্রীদের অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী তারপর বসার কথা মাতাল লোকটির, তারপর আমার।
বসার ব্যাপারটা সেভাবেই হল নিয়ম মেনে। আমি চার নম্বর আসনে বসলেও অনেকটা জায়গা পেলাম। যেহেতু জানলার ধারে এক নম্বর আসনে বাচ্ছা মেয়েটা বসেছে তাই স্থান সঙ্কুলান ব্যাপারটা পীড়া দায়ক হল না।
মাতাল লোকটা মহিলার পাশে বসেই দেখল তার সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলার স্বামী। কি মনে হতেই সে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। স্বামী ভদ্রলোকটিকে বলল – “দাদা, বসুন”।
আমি চমকে তাকালাম। ভদ্রলোক বলে উঠলেন বিনয় ভরে – “না, না, ঠিক আছে; আপনিই বসুন”।
মাতাল আবার বলল – “বসুন না, আমি দাঁড়াচ্ছি”।
ভদ্রলোক হাসি মুখে প্রতিবাদ করলেন – “আপনি বসুন। আপনারই বসার কথা ওখানে”।
আমার এবার ব্যাপারটা কেমন অন্যরকম লাগল। এতক্ষণের মানুষটাকে এখন ঠিক চিনতে পারছি না। কোথায় যেন অঙ্ক মিলছে না। সেতারের তারটা যেন বাজাতে বাজাতে হঠাৎই কেটে গেছে। আমি পরের ঘটনার জন্য সবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম।
লোকটি বসল। বসেই অনেকটা সরে এল আমার দিকে। একেবারে আমার গায়ের সঙ্গে গা মিলিয়ে। আমি দেখলাম, সে একটা দুরত্ব রাখল ভদ্রমহিলার শরীর থেকে। যে জায়গায় ওর বসার কথা সেখানে বসলে ওর শরীরের সঙ্গে ভদ্রমহিলার শরীর গায়ে গায়ে লেগে যাবে। ভদ্রমহিলা একটু স্বাস্থবতী। আমার কেমন যেন মনে হল মানুষটা মহিলাকে সন্মান দিতে চাইছে। আমি আর একটু বামে সরে এসে মানুষটাকে জায়গা দিলাম ভালো করে বসতে। সে বসল।
আমি ওর দিকে তাকালাম। ঢুলুঢুলু রক্তিম চোখে যেন এক অন্য হাসির ঝিলিক। তাতে কি লজ্জা মেশান রয়েছে? বোঝার চেষ্টা করলাম।
জড়ান স্বরে স্বগতোক্তি করল মাতাল – “ আসলে, সকালে বেরোই। সারাদিন কাজ। নোংরা ঘাঁটতে হয়। সুইপারের কাজ করি। মদ না খেলে কাজ করতে পারি না। চাকরি জীবনের প্রথম থেকে অভ্যেস হয়ে গেছে”। আমার সামনে কেউ যেন চড় মারার জন্য করতল উঁচু করে ধরল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম – “কোথায় নামবে?” – এই প্রশ্নকে সে আমার মতো অনধিকার চর্চা বলে মনে করল না। সে উত্তর দিল – “আর চারটে ষ্টেশন পরে”।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম – “কতদিন হল কাজ করছ?
সে বলল – “তা পঁচিশ বছর হল। যুবক বয়সে ঢুকেছিলাম। বাবা সুইপার ছিল। মদ খেয়ে খেয়ে শেষ হয়ে গেল। বাবুরা বাবার কাজটা আমাকে দিল। তারপর থেকে আমিই করছি। প্রথম প্রথম খুব ঘেন্না করত। বাড়ী এসে খেতে পারতাম না। ডান হাতটা মুখে তুলতে গেলে কেমন বমি পেতো। ভেবেছিলাম চাকরী ছেড়ে দেব। পারিনি। ঘরে তখন অনেকগুলো মুখ আমার রোজগারে বেঁচে থাকত। চেয়ে থাকত আমার দিকে। অফিসের একজন পুরান সুইপার আমায় মদ খাওয়া ধরাল। বলেছিল, কাজ করার আগে খেয়ে নিবি, আর কোন অসুবিধা হবে না। প্রথম প্রথম সেটাও ভালো লাগত না। তারপর সয়ে গেল। দু’হাতে নোংরা পরিষ্কার করতে তখন আর কিছু মনে হতো না। আমি মাতাল হয়ে গেলাম আস্তে আস্তে। সে অভ্যেস রয়ে গেছে”। - একটু থামল মানুষটা। তারপর আবার বলতে শুরু করল – “জানি গন্ধ বেরোয়। আমার নাতনিটাও বলে, দাদু তোমার মুখে গন্ধ। ওই ছোট্টো মেয়েটার বয়সি আমার নাতনি। খুব মিষ্টি দেখতে। ইংরাজী স্কুলে পড়ে। ট্রেনে আপনাদেরও অসুবিধা হয়। কিন্তু কি করব? মদ যে এখন আমাকে খায়। আমার ঘামে মদের গন্ধ, আমার রক্তে এখন বাংলা মদ। তাই আমি মহিলাদের পাশে বসতে চাই না। আমি আট ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনা জানি। পয়সার অভাবে আর পড়া হয়ে ওঠেনি তারপর। মদ খাই, কিন্তু নিজের সন্মানটাকে এখনও খেয়ে ফেলতে পারিনি বাবু, লজ্জা করে”।
আমি কি বলব ভেবে পাই না। উঠিয়ে রাখা অদৃশ্য হাতটার চপেটাঘাত যেন আমার গালের ওপর ‘চটাস্’ শব্দে নেমে আসে। এখন আমার কোন গন্ধ লাগছে না। সুইপারের পাশে বসে আছি বলে কোন ঘেন্না লাগছে না। মনে হচ্ছে মানুষটাকে দু’হাতে আলিঙ্গন করে বলি – “তুমি মাতাল নও; তুমি সেই মানুষ, যার মান ও হুঁশ দুটোই বর্ত্তমান। তুমিই ভদ্রলোক আর আমি তোমার পাশে বসে থাকা কেরানি-আমি একটা নীচ মনের অভদ্র, অহংকারী মানুষ।
আমি ওঁকে আর ‘তুমি’ সম্বোধন করতে পারিনা। জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলি – “আপনি ভালো করে বসুন। আরাম করে। আমাকে এবার নামতে হবে।
মানুষটা সরে বসেন আমার জায়গায়। তারপর ভদ্রমহিলার স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে ওঠেন – “এবার বসুন, দাদা”।
ভদ্রলোক মৃদু হেসে ফাঁকা জায়গায় বসে পড়েন তাঁর সহধর্মিনীর পাশে।
আমি ট্রেন থেকে ষ্টেশনে নামার আগে শেষ বারের মত মানুষটার দিকে একবার তাকাই ভালো করে দেখার জন্য। এবার যেন ওঁনার মুখে শান্তির ছায়া দেখি। মনে মনে ভাবি, মানুষটার নাম জানা হল না। আমি তাঁর অজান্তে তাঁর নতুন নাম দিয়ে ফেলি – ‘দেবোপম’।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment