1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 2, 2024

বেঁচে থাকার গল্প

 

ছবি : ইন্টারনেট

বেঁচে থাকার গল্প

ডাঃ সুখময় বারিক

মনে অনেক দ্বিধা নিয়েও অবশেষে ব্যারাকপুর এর এক সরকারি হাসপাতালে  জয়েন করেই নিলাম । রোগীর চাপে হাঁসফাঁস অবস্থা তো থাকবেই।সেটা বড় ব্যাপার না। মূল ব্যাপার হলো  সরকারি হাসপাতালে সব কিছু জিনিস এর অপ্রতুলটা। যে দিকেই তাকাই শুধু নেই আর নেই। প্রয়োজনীয় ওষুধ নেই, অধিকাংশ পরীক্ষা হয় না। বাইরে থেকে করানোর ক্ষমতা নেই। চুক্তি ভিত্তিক ডাক্তার দিয়ে কোন রকমে  চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ।  কিন্তু এত কিছু না থাকার মাঝেও আছে কিছু বেঁচে থাকার গল্প ।

চারিদিকে থিকথিকে মানুষের মাথা, ওয়ার্ডে এক  বেডে  গাদাগাদি করে মায়েদের শোয়া, হাসপাতালে রোগী  আর বেড়ালের সহাবস্থান এর মাঝেও সরকারি হাসপাতালে কাজ করতে ভালো লাগে। কারণ এখানে কোণে কোণে গল্প তৈরি হয়। বেঁচে থাকার গল্প। এমার্জেন্সি থেকে বেরোনোর সময় একটা পাঁচ  বছরের শিশুর নিষ্পাপ চোখ দুটো যখন দু মিনিট পরে বন্ধ হয়ে যায় , তখন মনে হয় জীবন কতটা তুচ্ছ। পড়ে যাবার কিছুক্ষণ আগেও একটা প্রাণবন্ত শিশু ছাদে খেলে বেড়াচ্ছিল। একটা দমকা হাওয়ার মতো মৃত্যু এসে মায়ের  কোল খালি করে চলে গেলো । মৃত্যু এখন আর ভাবায়  না,  মন খারাপ করায় । বাড়ি ফিরে অসহায় এর মত মেয়েকে জাপটে ধরে ভাবি জীবন কতটা সস্তা।

পাশ করার পর কত আশা নিয়ে সরকারি হাসপাতালে আসা। জীবন পালটে দেব, আধমরা মানুষদের ঘা মেরে বাঁচিয়ে দেব। এখন মনে হয় এগুলো সব  সদ্য পাশ করা ডাক্তারের ইউটোপিয়া । এখানে সব কিছু নিয়মের জাঁতাকল আটকে থাকে। আর তার মাঝে আমি হলাম নিধিরাম সর্দার। আউটডোর এ রোগী দেখা অনেকটা রোবট এর মতো। সেখানে রোগ কে দেখা হয়, রোগী কে ছুয়ে দেখার সময় কোথায় । সেই সমস্ত মহিলারা , যারা বাইরের দামি চিকিৎসার সাথে পেরে উঠে না অথবা পাড়ার দোকান বা হাতুড়ে ডাক্তার এর থেকে ঘেঁটে যাওয়া রোগ নিয়ে আসে, সেই রোগ ছুয়ে দেখার চেষ্টা করি মাত্র। বাচ্চার ওজন কম দেখে রোজ দুধ, ডিম্ খেতে বলি। দুধ কেনার টাকা মাথাই আসে না। সারা গায়ে চুলকুনি ভরে থাকা বাচ্চাটাকে শুধু ঢিলে সুতির জামা পরাতে বলি। মনে পড়ে না, ওর বছরে একবারই জামা হয়, পুজোর সময়।জন্ডিস দেখে হবু মা কে খাওয়া দাওয়া ঠিক করতে বলি। জন্ডিস যত বাড়ে মাদুলির ওজন তত বাড়ে। চল্লিশ কিলো মায়ের গলায় পাঁচ কিলোর মাদুলী। বড় বাচ্চা হলে নরমাল ডেলিভারি হবে না বলে মা কে একবেলা অভুক্ত রাখা হয় তাতে বাচ্চা শুকিয়ে মারা গেলেও যাক। বিয়ের পর বাচ্চা না হলে বউমার গলায় তাবিজ ঝুলতে থাকে। বছর ঘুরলে তাবিজ এর সংখ্য বাড়ে নয়তো বাড়িতে সতীন আসে। হইতো বাড়ির বউমা মা হয়ে যাবে, কিন্তু এটা বোঝাতে পারবো না কেন  বন্ধাত্য দম্পতি কে ডাক্তারের কাছে না এনে বাড়ির বউমা কে মাদুলিওয়ালার কাছে নিয়ে যায় দোষ কাটাতে। আন্দাজই করতে পারবো না, কেন জন্ডিস নিয়ে আসা মায়ের  গলায় জন্ডিসের মালা  বা সদ্য মা হতে যাওয়া মহিলার পেটের উপর সায়ার দড়ি শক্ত করে বাধা হয় যাতে বাচ্চা উপরের দিকে উঠে না যায় । ওই যে বললাম, শুধু রোগটুকুই ছুঁই। রোগ হইতো সেরে যায় । রোগী কি সেরে উঠে ?

রোজকার কার জীবনের আয়ু যত কমছে, জমা গল্পের পাহাড় তত উঁচু হচ্ছে। আজকাল বেশি আর লিখি না, থুরি লেখার সময় পাইনা।বয়স বাড়লে কলমে মরচা পরে যায় । আর এত গল্প জমে আছে। কাকে ছেড়ে কাকে লিখব। বিয়ের আগে বন্ধুদের উপদেশে সুস্থ্য সবল ছেলের প্যান্ট  অবলীলায় ডাক্তার এর কাছে খুলে যায় । বাজারের অনেক তেল মালিশ এও সাইজ বাড়ে না। যদিও দেখলাম, 'ওটা' এমন কিছু ছোট নয়।

- আসলে ডাক্তারবাবু ওটাই তো আসল জিনিস তাই দেখিয়ে নিচ্ছি। বন্ধুদের মতো অত ইঞ্চি নয়।

-আরে  না, না।তোমার  এমন কিছু ছোট নয়।আর ইঞ্চি জামা কাপড়ের মাপ হয়, পুরুষত্বের নয়।

আশেপাশে হাসির ধুম নেমেছে বুঝতে পারছিলাম।

ছেলে কিছুতেই থামবে না। ইঞ্চি বাড়ানোর ওষুধ চাই।

- দেখুন, কদিন বাদে বৌ  আসবে। আসল জিনিসটা ঠিক করে রাখতেই হবে।

কিছু একটা ভিটামিন দিয়ে পরের রোগীকে ডেকে নিলাম।

আজকাল কেমন একটা হয়ে যাচ্ছি । মনের অভিব্যক্তি কোন ভাবেই  মুখে ফুটে উঠে না। হয়তো রোগী কে ছুয়ে উঠতে সময় পায় না বলে।

লাইনে দাঁড়ানো সব কালো মাথা শেষ। চোখ মুছে টেবিলে স্টেথ নামিয়ে রাখি। আরও একটা দিন শেষ হয়ে যায় । ঝুড়ি ঝুড়ি গল্প বোঝাই করে বাড়ি ফিরে আসি। রাতে মেয়ের সাথে আকাশের তারা গুনি। মেয়ে বড় হচ্ছে, আর বুড়ো বাবার গল্পের চাপে ক্রমশ চুল পাকছে।

...(সমাপ্ত)...


No comments:

Post a Comment