ছবি : ইন্টারনেট |
মায়েরা অন্যরকম হয়
রণিত ভৌমিক
কাজ শেষে অজয় ফ্ল্যাটে ফিরেছে। একদিকে, ক্লান্তি অন্যদিকে তার খিদে পেয়েছে খুব। স্ত্রী বাপের বাড়ি গেছে। সুতরাং ক্লান্ত শরীরটা সামনে রাখা চেয়ারে ছুঁড়ে দিয়ে নিজের মনে মনে সে বলতে লাগল,
- উপফ! আজ অফিসে যা কাজের চাপ গেল। বাপরে, বাপ। অনেকদিন পর আমরা এমন চাপ সামলালাম। বড্ড ক্লান্ত লাগছে।
অজান্তেই একটু উচ্চস্বরে সে বলে উঠল,
- ও গো, রুমা। একটু চা পাওয়া যাবে?
কেউ সারা দিচ্ছে না দেখে অজয়ের বোধোদয় হল যে রুমা গতকালই বাপের বাড়ি গেছে। অতএব তাকে রান্নাঘরে গিয়ে নিজের খাবার নিজেকেই করে নিতে হবে। ঘড়িতে তখন বাজে রাত সাড়ে দশটা, হেলতে দুলতে রান্না ঘরের দিকে গেল অজয় এবং রান্নাঘরে গিয়ে ডাল, ডিমের তরকারি রান্না করে রাখা আছে দেখে সে একেবারে অবাক।
- (নিজের মনে) একি রে, বাবা। রুমা এসেছিল নাকি? ভাত, ডাল, ডিমের তরকারি কে রান্না করে দিয়ে গেল!
খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে ঠিকই কিন্তু খিদের জ্বালা আর সহ্য করতে না পেরে সেই খাবার বেড়ে সে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে এসে খেতে লাগল। খেতে খেতে অজয়ের মনে হল সে যেন মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ পাচ্ছে।
- বাহ! দারুণ লাগছে তো খেতে। একেবারে মনে হচ্ছে মায়ের হাতের রান্না। তাহলে কি মা এসেছিল? আরে, ধুর! মা কি করে এখন আসবে। আজ পাঁচ পাঁচটা বছর হয়ে গেল তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছি। মাঝে মধ্যে দেখা করতে গেলেও, মায়ের সঙ্গে আর রাত জেগে কথা হয় না। কত স্মৃতি যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই ফ্যাটে। অনেক দিন হয়ে গেল মায়ের হাতের রান্না খাইনি। আচ্ছা, তাহলে এই খাবারগুলো এলো কীভাবে? মায়ের হাতের রান্নার সেই অবিকল স্বাদ। তারমানে কি মা সত্যিই এসেছিল?
আবারও মায়ের ভাবনায় তলিয়ে যায় অজয়। চমক ভাঙে একটা চেনা কন্ঠস্বরে,
- কি রে, না খেয়ে অত কি ভাবছিস? কিছুই তো খাচ্ছিস না, বাবু।
চমকে উঠে সামনে তাকিয়ে অজয় দেখে তার মা দাঁড়িয়ে আছে। বেশ অবাক হয়ে অজয় তার মাকে জিজ্ঞেস করল,
- একি মা, তুমি কখন এলে? আর কি করে এলে? এসব রান্না কি তুমি করেছ?
মৃদুলাদেবী মৃদু হেসে বললেন,
- হ্যাঁ! আমি করেছি।
- কিন্তু তোমাকে এতক্ষণ দেখিনি কেন? কোথায় ছিলে মা তুমি?
- আমি ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালের মধ্যেই ছিলাম বাবু। চারপাশটা একটু ঘুরে দেখছিলাম। আমার স্বাধের ফ্ল্যাটে এখন কতকিছুই না পাল্টেছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তোরাও অনেকটা বদলেছিস দেখতে পাচ্ছি।
একটু চুপ করে থাকার পর অজয় বলল,
- তুমি কীভাবে এখানে এলে মা?
মৃদুলাদেবী আগের মতোই মৃদু হেসে উত্তর দিলেন,
- এখানে কি করে এলাম জানি না রে, বাবু। শুধু তোকে একবার চোখের দেখা দেখতে ইচ্ছে করল, তাই চলে এলাম।
- কিন্তু এটা কি করে…।
- কি করে এলাম আমি অত জানি না। তবে, তোরা যে ভালো আছিস এটা দেখে অনেকটাই শান্তি পাচ্ছি রে, বাবু। চোখের সামনে বারবার যেন তোর ছেলেবেলাটা ভেসে উঠছে। আচ্ছা, তোর মনে আছে বাবু, সেই প্রথম যেদিন তুই স্কুলে গেলি। আমার হাত ছেড়ে গেটের দিকে এগোতেই ভুরু দুটো কুঁচকে অঝোরে কাঁদতে লাগলি।
- হ্যাঁ, সে কথা কি আর ভোলা যায়। তুমি সেদিন বাড়ি ফেরার পর কোলে তুলে নিয়ে এমন ভাবে আগলে বসলে যেন মনে হবে আমি কোথাও একটা হারিয়ে গেছিলাম।
- আসলে তুই তো আমার নয়নের মণি। তুই একা কোথাও গেলে আমার বড্ড চিন্তা হত। একদিনও তোকে নিজের কাছ ছাড়া করতে পারতাম না যে!
- জানি মা। তাই তো আমাকে সবাই তোমার নেওটা বলত। আমার পড়াশোনার ব্যাপারে তুমি কখনও খরচ করতে কার্পণ্য করনি। পুজোর সময় নিজের জন্য শাড়ি কম কিনে, সেই টাকায় তুমি আমাকে বেশি করে জামা কিনে দিয়েছ যাতে বন্ধুদের সঙ্গে রোজ নতুন জামা পড়ে আমি ঘুরতে যেতে পারি। এর জন্য অবশ্য তুমি বাবার কাছে কম বকুনি খাওনি।
- (হেসে উঠলেন মৃদুলাদেবী) হা-হা-হা! ওরে, পাগল ছেলে আমার। আমি কিবা করেছি তোর জন্য। জানিস, একজন মা তার সন্তানের জন্য এর থেকে আরও বেশি কিছু করতে পারে। আচ্ছা, তোর মনে পড়ে মহাভারতের কাহিনিগুলো যখন তোকে পড়ে শোনাতাম। কৌরব মাতা গান্ধারীর মতো একজন মহিয়ষী নারী জন্মান্ধ স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বিয়ের সময় থেকেই নিজের চোখে কাপড় বেঁধে রাখতেন। কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষ লগ্নে, মৃত্যুর প্রায় কাছে পৌঁছে যাওয়া পুত্র দুর্যোধনের প্রতি মাতৃস্নেহে দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি। নিজের সারাজীবনের তপস্যা ও ধর্মরক্ষার ফল হিসেবে একটিবার পুত্রের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকে একটি কবচ পড়াতে চান গান্ধারী। হ্যাঁ, মায়েরা যে এমনি হয় রে। সন্তানের জন্য সে নিজের সবটুকু দিয়ে দিতে পারে।
- জানো, মা। আজ আমি একটা বিষয় খুব অনুতপ্ত। ছোটবেলায় তোমার পাশে বসে দিনের পর দিন মোঘলাই খেয়েছি অথচ তোমাকে একটিবারও খাওয়ার জন্য কখনো সাধিনি। এখন সেই কথা ভাবলে লজ্জা লাগে। তোমাকে না দিয়ে আমি কিনা দিব্বি খেয়ে গেছি!
- বাবু, তোর সেই পুরনো ছেলেবেলার বিকেলগুলোর কথা আজও মনে আছে?
খাওয়া থামিয়ে অজয় বলল,
- এমা, এটা মনে থাকবে না কেন? আমরা ভাই বোনেরা ছোটবেলায় কেমন লোডশেডিং হলেই লুকোচুরি খেলতাম। ঠাকুরদার লন্ঠনটা দালানের মাঝে রেখে সারা বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করতাম। তারপর জ্যাঠামশাই কাকুরা আলাদা হয়ে চলে গেল, আমরাও কিছু বছর বাদে চলে এলাম এই ফ্ল্যাটে। পুরনো উত্তর কলকাতার বাড়িটা আজ প্রমোটিং হয়ে ফ্ল্যাট উঠে গেছে।
- সত্যি, রে বাবু। বহুকাল আগের সেই কথা। এমন দিন আর কখনো ফিরবে না। বড় পরিবার কি, সেটা এই প্রজন্ম বুঝবে না রে। পরিবারগুলো সেই সময় থেকে ক্রমশ ভাঙতে ভাঙতে আজ আমি-তুমিতে এসে ঠেকেছে। আমাদের উত্তর কলকাতার ওই এলাকাটা তখন এখনকার মতো জনবহুল ছিল না। তখন লোডশেডিং হলে এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে গল্প হত, আমরা বউরা পাশের বাড়ির মেয়ে বউদের সঙ্গে কত গল্প করতাম। পাড়ায় পাড়ায় বিকেলে ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেয়েরাও খেলতে যেত। কিন্তু কালের নিয়মে আজ শহুরে ব্যস্ততা সবাইকে গ্রাস করেছে, তাও শৈশব আর কৈশোরের মধুর স্মৃতি রয়ে গেছে মনে। আমার মতো বয়স্ক মানুষগুলোর মধ্যে রয়ে গেছে সেই পুরনো ভালোবাসার রেশ। ঠিক যেভাবে এই ঘরের জানালার পাশে রাখা সূক্ষ মোমবাতির গা বেয়ে নামতে থাকা তরল মোমের চিহ্ন এখনো বিলীন হয়ে যায়নি, চিহ্নটুকু এখনো লেগে আছে কাঠের ওই টেবিলে। যেমন হারিয়ে যাওয়া চড়ুইয়ের ডাক এখনো অজান্তে কানে ভেসে আসে। সেই ভাবেই অনেক না থাকার মাঝেও, অনেক কিছু থাকার শান্তি সেইসব স্মৃতি-তে মিশে আছে।
- তবে, যাই বলো মা। আমার কিন্তু ওই বোর্ড এক্সামের সময় ওমনভাবে খেলতে যাওয়ার জন্য তোমার হাতে স্কেল দিয়ে পিটুনি, সেটা কখনোই ভুলতে পারব না। ওটা সবার আগে মনে আছে। হা-হা-হা!
- স্কেল দিয়ে পিটুনিটা খুব মনে রেখেছিস, বাবু। কিন্তু এটা কি অস্বীকার করতে পারবি যে সেই সময় ওই পিটুনি খাওয়ার জন্যই আজ তুই এতো বড় হতে পেরেছিস। এমন বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে নিজের সংসার চালাচ্ছিস।
- শুধু বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি, সেটাই দেখছ মা। এদিকে, রোজ যে কত ঝামেলা পোয়াতে হয়, সেটা যদি বুঝাতে তাহলে বলতে বাবার সরকারী চাকরিটাই ঢের ভালো ছিল।
হা-হা-হা! ছেলে আর মা দুজনেই হেসে উঠল, তারপর মৃদুলাদেবী বললেন,
- তবে, একটা বিষয় দেখে ভালো লাগছে যে পুরনো কথাগুলো তোর আজও মনে আছে। না, আসলে এখন তো তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস। বড় চাকরি করছিস, কি সুন্দর করে সংসার গুছিয়ে নিয়েছিস। তাই ধূলো জমে যাওয়া স্মৃতির কথাগুলো তোর মনে আছে দেখে একটু অবাক হলাম! সেই দিনগুলোর সঙ্গে আজকের সময়কে মেলাতে গেলে ভুল হবে। তবে কি বলত, ওইদিনগুলো আমি আজও রোজ উপভোগ করি। আজও ওইদিনগুলোতেই বেঁচে থাকি। তোর বাবার কাছ থেকে ঘরের কিছু জিনিস কিনব বলে তোর আবদারগুলো কীভাবে ওনার আড়ালে মিটিয়েছি সেটা একমাত্র আমিই জানি। কখনো তৃপ্তি কেবিনের মোঘলাই, তো কখনো আবার নকুরের মিষ্টি।
- হ্যাঁ, মা। এই কথাগুলো আমি এখনো রুমাকে শোনাই। আমার মা আমার জন্য অনেক কিছু করেছে। আমার মায়ের জীবনের দ্বিতীয় ভাগ আমাকে ঘিরেই কেটেছে। অবশ্য রুমা কতটা অনুভব করতে পারে, জানি না। ওর ছেলেবেলা তো আবার কেটেছে অনেকটাই পাশ্চাত্য কায়দায়। বাবা-মা দুজনেই অফিসের কাজে সারাদিন বাইরে থাকত। আর একা মেয়ে রুমা থাকত মাসির কাছে। একটু বড় হতেই চলে যায় দিল্লি। সেখানেই পড়াশোনা হোস্টেলে থেকে। সুতরাং ওর কাছে বিকেল মানে বন্ধুদের সঙ্গে কফি শপে বসে আড্ডা কিংবা নিজের কাজে ব্যস্ত থাকা। হ্যারিকেনের আলোতে পড়াশোনা করার মজাটাই যে ও পায়নি।
- এই বাবু, এবার কিন্তু আমার কাছে বকা খাবি। রুমা নেই বলে মায়ের কাছে বউয়ের নামে নিন্দা করছিস? আমার বউমা খারাপ নয় রে, আসলে কেউই খারাপ হয় না। সময় এবং পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়। তবে, তোকে ভালো রেখেছে এই দেখে আমি নিশ্চিন্ত। আমার সেই বাবু, যে কিনা আমি পাশে না শুলে ঘুমাতেই পারত না। আমি খাইয়ে না দিলে, মুখে খাবার তুলত না। আজ সেই কিনা দিব্বি মাকে ছাড়া ঘুমাতে পারে, তাকে খাইয়ে দিতে আর মাকে ছুটে আসতে হয় না।
- মা গো, আজ তোমার হাতে আমাকে খাইয়ে দেবে? সেই ছেলেবেলার অভ্যাসটা আবারও নতুন করে ফিরে পেতে চাই।
- সব কি আর ফিরে পাওয়া সম্ভব? সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যে অনেকটা সময় বয়ে গেছে।
- তারমানে আমাকে আজ আর খাইয়ে দেবে না, তাই তো?
- ওমা, সেটা আবার আমি বললাম কখন। আমি তো স্রেফ বাস্তবটা তোমার সামনে তুলে ধরলাম। আচ্ছা, আয়। আজ আমি খাইয়ে দি তোকে। জানি না, আর কোনোদিন পারব কিনা। হয়ত মৃত্যুর পর এটাই আমার পরম শান্তি।
মৃত্যু কথাটা শোনা মাত্র অজয় গেল রেগে। সে বলল,
- উপফ! এই মৃত্যুর কথাটা তোমার মাঝে ডেকে না আনলে চলে না, তাই না? সবসময় মরার কথা বলো কেন?
- ওরে, পাগল ছেলে আমার। মৃত্যু তো একদিন না একদিন সকলেরই হবে। বাস্তব জীবনের চরম সত্য হচ্ছে মৃত্যু অবধারিত। অতএব তাকে কি এড়িয়ে চলা যায়?
- আচ্ছা! বেশ। মেনে নিলাম তোমার কথা। তোমার সঙ্গে কথায় পারব, তেমন সাধ্যি আমার নেই। তবে, মা তুমি আজও আমার দেওয়া ঘড়িটা ব্যবহার করলে না বলো! এমনকি যাওয়ার সময়ও ওটিকে ভুলেই চলে গেলে। আমার কিন্তু খুব খারাপ লেগেছে। যতবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ঘড়িটা দিয়ে আসতে চেয়েছি, তুমি ফেরত পাঠিয়েছ। আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো। ওই ঘড়িটা কি তোমার পছন্দ নয়?
অজয়কে খাওয়াতে খাওয়াতে মৃদুলাদেবী বললেন,
- ওমা, এ আবার কীরকম কথা! ছেলের দেওয়া জিনিস মায়ের কাছে আবার পছন্দ অপছন্দ কি? তোর দেওয়া সবকিছুই আমার পছন্দ, সুখ-দুঃখ সব। কলেজ পাশ করার পর যখন প্রথম চাকরির বেতন দিয়ে তুই আমার জন্য নতুন ঘড়িটা কিনে এনে হাতে তুলে দিলি, তখন মনে আছে আমি তোকে একটা কথা বলেছিলাম?
- কী কথা মা?
মুচকি হেসে মৃদুলাদেবী বললেন,
- জানি, সেই কথা তোর মনে থাকবে না, আর থাকার কথাও নয়।
- ওহ! মনে পড়েছে। হ্যাঁ! হ্যাঁ! তুমি তো ঘড়িটা পড়লেই না। বরং বাবার দেওয়া সেই আদ্দি আমলের মরচে পরে যাওয়া ঘড়িটাই পড়ে ঘুরে বেড়িয়েছ। শতবার বলেও তোমাকে ওই ঘড়ি খুলিয়ে নতুনটা পড়াতে পারিনি।
শেষের কথাটা একটু রেগেই বলল অজয়। আর তাই কাতর স্বরে মৃদুলাদেবী বললেন,
- রাগ করিস না, বাবা। আসলে সেই কথাটা বলেছিলাম কারণ বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সন্তানদের কাছে তাদের পিতামাতা এতোই বোঝা হয়ে যাচ্ছে যে বুড়ো বয়সে তাদের অবস্থা কী রকম হয় জানিস?
- (জানতে চাইল অজয়) কী রকম?
- তোর ব্যাগের কোনায় পড়ে থাকা পরিত্যক্ত ফোনটির মতো, যেটা পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রম দেখায়।
বৃদ্ধাশ্রম শব্দটা শোনা মাত্র অজয় ওর মাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
- দাঁড়াও। দাঁড়াও। আচ্ছা, এবার বুঝলাম মা। তুমি এই কারণেই আমার দেওয়া ঘড়িটা আজও পড়লে না। উপফ! মা। আমি তোমাকে পরিত্যক্ত পণ্য জিনিস ভাবি না, না কখনও ভেবেছি।
- সেদিন যখন কথাটা বলেছিলাম, তুই একইভাবে রাগ করে উঠে চলে গেছিলিস। তুই আমার কথা সেদিন মানতে চাসনি। তবে, আমি কিন্তু নিজের ভবিষ্যতটা দেখতে পেয়েছিলাম। তাই সেই মুহূর্তে তোকে একটা সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলাম যে আমি তোর মা। এখনো নড়তে-চড়তে পারি। তোদের কাছে আমার মূল্য অনেক বেশি। আমার সাথে এসে গল্প করছিস। তোদের রান্না করে খাওয়াচ্ছি, যখন যা প্রয়োজন তা করে দিচ্ছি। কিন্তু একসময় গিয়ে আমি বুড়ো বয়সে উপনীত হব। তখন তোদের এই সময়ের মতো কিছুই করে দিতে পারব না। বুড়ো বয়সে হয়তো আমার সাথে আর তেমন গল্পও করতে আসবি না। বয়সের ভারের কারণে তোদের জন্য রান্নাটা তখন আর করা হবে না। আমার মূল্যটা তখনই কমে যাবে। পড়ে থাকব ঘরের এক কোনায়, তোর পরিত্যক্ত ফোনটির মতো। ঐ ফোনটিও একসময় তোর কাছে খুব মূল্যবান ছিল, যখন ফোনটি তোকে ভালো সার্ভিস দিচ্ছিল! আর যখনই পরিত্যক্ত হয়ে তোকে সার্ভিস দিতে পারছে না, তখন তোর কাছে ফোনটি মূল্যহীন হয়ে গেল। ফেলে রাখলি ব্যাগের এক কোনায়। ব্যবহার করছিস এখন কত দামী অত্যাধুনিক ফোন। দীর্ঘদিন ব্যবহারে পরিত্যক্ত হয়ে ফোনটি দেখলো ব্যাগের কোনা। আর বয়স বেড়ে অবশ হয়ে পিতামাতা দেখে বৃদ্ধাশ্রম, যেমনটা আমিও দেখলাম। এই হলো বর্তমান সময় সন্তানদের কাছে পিতামাতার মূল্য।
একটু থেমে মৃদুলাদেবী ফের বললেন,
- বাবু, তুই আমাকে সেদিন বলেছিলিস, আমি অন্য সবার মতো হব না মা। তুমি বুড়ো বয়সে উপনীত হলেও তোমাকে আগের মতোই ভালোবাসবো। তোমার পাশে গিয়ে বসে এই সময়ের মতো গল্প জুড়ে দেব। কিন্তু ছেলে আমার কখন বড় হয়ে গেল, বুঝতে পারলাম না। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ, তারপর চাকরি। সময়ের নিয়মে সবকিছুই এগিয়ে চলল, মোটা বেতন পাওয়া ছেলের বিয়ে দিয়ে বউমাও নিয়ে এলাম বাড়িতে। প্রথম প্রথম আমাদের সংসারে সুখের দেবী বিরাজমান হলেও, ধীরে ধীরে চিত্র বদলালো। মেঘেরা জমাট বাধতে লাগল।
সময় যেন ওই মুহূর্তে মা আর ছেলেকে ক্রমশ তাদের ফেলে আসা তিক্ত অভিজ্ঞতার দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করছে।
- মা গো, আমার প্রতি তোমার অনেক ক্ষোভ আছে বুঝি সেটা। তবে, তোমাকে ছেড়ে দূরে থাকলেও অন্তত প্রত্যেক মাসে একবার হলেও একটা মিনিট ব্যয় করে তোমাকে ফোনে খবর নিয়ে গেছি, মা খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করছ তো? ওষুধ ঠিকমতো খাচ্ছ তো?
মৃদুলাদেবী কাঁপা গলায় বললেন,
- হ্যাঁ, বাবা। তুই তোর ছেলে হওয়ার দায়িত্ব যথাযত পালন করেছিস। সেইজন্য আমি তো বাসুদেবদা, মালতি ওদের প্রত্যেককে গর্ব করে বলি যে আমার ছেলে আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যাওয়ার পরও ভুলে যায়নি। সে নিজের শত ব্যস্তার মাঝেও ঠিক মনে করে আমাকে মাসে একবার ফোন করে খবর জানতে চায়, আমি কেমন আছি। এমন ভাগ্য আর কজনের হয় বল?
কথাটা শুনে অজয় বলে উঠল,
-তা তোমার কথা শুনে আমার ব্যাপারে ওরা কি বলে?
উত্তরে মৃদুলাদেবী বললেন,
- ওরা আর কি বলবে। বাসুদেবদার মেয়ে তো প্রতিদিন ফোন করে তার বাপের খবর জানে। আর মালতির ছেলে মাসে একবার বৃদ্ধাশ্রমে এসে ওর সঙ্গে দেখা করে যায়। আমি অবশ্য তোর কথা উঠলেই সোজাসুজি ওদের বলে দি যে দেখো বাপু আমার ছেলে মস্ত বড় কোম্পানিতে চাকরি করে। ওর কাঁধে অনেক দায়িত্ব। সুতরাং ওর অত সময় নেই। তাও ব্যস্তার মাঝে বাবু যতটুকু করে, এটাই আমার কাছে যথেষ্ট। ওরা হয়ত আমার সুখ দেখে হিংসাতে চুপ করে যায়।
এরপর অনেকক্ষণ অজয়কে চুপ করে থাকতে দেখে মৃদুলাদেবী ছেলের ভাতের থালার দিকে চেয়ে বললেন,
- আরেকটু ভাত দি বাবু? মাছের ঝাল দিয়ে তো খাওয়া বাকি তোর।
- হ্যাঁ, মা। দাও। কতদিন পর তোমার হাতের স্পর্শ পেলাম। আজ মনে হচ্ছে তোমার হাতে যেন অমৃতর স্বাদ পাচ্ছি। আমার খালি তোমার হাতে আজ খেয়েই যেতে ইচ্ছা করছে।
- হা-হা-হা! পাগল একটা।
তারপর একটু থেমে ছেলের দিকে চেয়ে বললেন মৃদুলাদেবী,
- জানিস, বাবু বৃদ্ধাশ্রমে আমার ঘরের জানালা দিয়ে সামনে মান্নাবাবুদের বাড়ির বারান্দাটা দেখা যায়। একদিন সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যাওয়ায়, কি করব বুঝে উঠতে না পেরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রকৃতি এবং সকালের পরিবেষটা আমার সবসময় খুব প্রিয় কিন্তু অনেক রাত অবধি গাঁটের ব্যথার কারণে ঘুম আসতে চায়না। ফলে, অত সকালে আর ঘুম থেকে ওঠা হয় না। তবে, সেদিনের আগের রাতে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হওয়ার কারণে, তখনও যেন একটা মিষ্টি বাতাস বইছিল। সামনে রাখা চেয়ারটায় বসার সময় লক্ষ্য করলাম তাদের বাড়ির ছাদের সব কটা ফুলের টবের মধ্যে একখান সূর্যমুখী ফুলের টবে সবে মাত্র একটা কুরি ফুটেছে আর তার চারিপাশে বনবন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা প্রজাপতি।
মায়ের কথার মাঝেই রেগে অজয় বলে উঠল,
- কীসব আবার বলতে শুরু করলে মা! প্রজাপতি, সূর্যমুখী এইসব কি? আর তাছাড়া তুমি যে বারান্দায় দাঁড়াও, কৈ আমাকে বলনি তো? ওই জায়গাটা মটেও মজবুত নয়। এখন কোনও বিপদ হয়ে গেলে কি হবে ভেবে দেখেছ?
- আরে, কথার মাঝে কথা বলিস না তো। আমার কিছুই হবে না। ওসব কথা তাই বাদ দে। এখন আমি যেটা বলছি, চুপ করে শোন। সেই প্রজাপতির ডানার রঙটা ছিল নীল, আর সেই নীল ডানায় ছিল নানা রঙ্গের ছড়াছড়ি। ওই দৃশ্য দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, আচ্ছা! সব ফুলের টব ছেড়ে প্রজাপতিটা কেন সবে মাত্র ফোটা ওই কুরির পেছনে পড়ে রয়েছে? একবার ভাবলাম ঢিল ছুঁড়ে প্রজাপতিটাকে তারিয়ে দি। কিন্তু পরক্ষনে সেই ভাবনা কে বাস্তবান্তর করা থেকে নিজেকে সংযত রাখলাম। দু-দিন পর, আবার ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় আসতেই ওই একই দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে পেলাম। তবে, সেদিন লক্ষ্য করলাম ওই কুরি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে আর সে প্রজাপতির দিকে এমন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে যে মনে হবে, হয়ত ভালোবাসার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে সূর্যমুখীর মনে। আর সূর্যমুখীকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রজাপতিটাও যেন নিজের মধ্যে মাতৃত্বের স্বাদ উপভোগ করতে লেগেছিল। ফলস্বরূপ, আরও ডানা মেলে তার চারিপাশে সে উড়তে লাগল। সেদিনের দৃশটা আরোই মুগ্ধ করল আমায়। প্রকৃতির এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা সত্যি মানব ভালোবাসার চেয়েও কত সুন্দর! এখানে না থাকে কোনো স্বার্থ, না থাকে কোনো চাহিদা। শুধু একটা জিনিসই সবসময় প্রাধান্য পেয়ে থাকে, সেটা হল- ভালোবাসা। আমি যেখানে অত সকালে ঘুম থেকে ওঠাটাই প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলাম, সেখানে এখন রোজ ওই একই সময় আমি ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে যাই বারান্দায়। হ্যাঁ! বারান্দায় যাই সেই মা আর সন্তানের অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য দেখতে।
- (খেতে খেতে অজয়) এরপর?
- এরপর যত দিন যাচ্ছে, ততই যেন বেড়ে উঠছে ওই সন্তান তুল্য সূর্যমুখী। আর প্রজাপতিও মায়ের মতো করেই তার খেয়াল রাখছিল। তার চারিপাশে প্রদক্ষিণ করার সময় সে দিব্বি বাড়িয়ে চলেছে। এখন খুব ভোরেই প্রজাপতি ছুটে আসে সূর্যমুখীর কাছে, যাতে আরও বেশি সময় তারা একসঙ্গে কাটাতে পারে। প্রথম দিকে তাদের মান-অভিমান, হাসিঠাট্টা কিছুই আমি বুঝতে পারতাম না। কিন্তু ওই মিষ্টি বাতাসে মিশে থাকা মা আর সন্তানের স্নেহের গন্ধ, ভালোবাসার গন্ধ এবং প্রজাপতির সেই প্রদক্ষিণ করা তার প্রিয় সূর্যমুখীকে দেখে, এই সকল বিষয়গুলোর মধ্যে আমি যেন আমার নিজের হারানো সময়গুলোকে আবারও অনুভব করতে শুরু করলাম। তাদের ভাষা না বুঝলেও, সম্পর্কের ভঙ্গি দেখে আমি ধীরে ধীরে তাদের কথাবার্তা বুঝতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু একটা ক্ষেত্রে যে পৃথিবীর সকল প্রাণী এক শ্রেণিতে এসে দাঁড়ায়, সেটার টের পেলাম যখন হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলাম যে সেই সূর্যমুখী কুরি আর কুরি নেই। সে এখন ফুল হয়ে মান্না বাবুর স্ত্রীর সাজীতে স্থান পেয়েছে। আর অন্য দিকে সেই অভাগা প্রজাপতি দিশাহীন ভাবে খুঁজে চলেছে তার সন্তান তুল্য সূর্যমুখীকে। প্রজাপতি সকালে আসার সময় হয়ত ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে ওইদিন এসে তাকে এই কঠিন বাস্তবের সম্মখিন হতে হবে। ওইদিন সারা সকাল এমনকী সন্ধ্যে হওয়ার আগে অবধি যখন বারান্দার দরজাটা বন্ধ করতে গেলাম, তখনও চোখে পড়ল ওই একই ভাবে প্রজাপতিটা ঘুরে বেড়াচ্ছে তার হারিয়ে যাওয়া সন্তান তুল্য সূর্যমুখীর জন্য। ওই সময় নিজেকে খুব নিরুপায় মনে হচ্ছিল। আমি যদি একবার ওই কঠিন কথাটা প্রজাপতিটাকে বলতে পারতাম, তাহলে হয়ত তার এই পাগলের মতো খুঁজে চলা, শেষ হলেও হতে পারত। ওই রাতে বাড়ি ফিরে গিয়ে হয়ত প্রজাপতিটা খুব কেঁদেছিল এবং সেই যন্ত্রণা যে কতটা, তা আমি জানি।
মায়ের কথা শুনতে শুনতে অজয়ের চোখে তখন জল। কাঁপা গলায় সে বলল,
- তার পরের দিন কি হল মা?
মৃদুলাদেবী বললেন,
- পরদিন সকালে আমার আর ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নেই। নিজের ফেলে আসা দিনগুলোকে আরেকবার ওই দুটো প্রাণীর মধ্যে দেখার আর তাড়া নেই যে! সবটাই শেষ হয়ে গেছে। ওই ঘটনার বেশ কিছুদিন বাদে, একদিন দুপুরে খওয়ার পর যখন বারান্দায় এসে একটু বসতে গেলাম, তখন অদ্ভুত ভাবে চোখে পড়ল সেই একই প্রজাপতি এবং তার একই ভাবে খুঁজে চলা তার হারিয়ে যাওয়া সন্তান তুল্য সূর্যমুখীকে। ততদিনে সে হয়ত জেনে গেছে যে ওই সূর্যমুখী আর কোনদিনও তার কাছে ফিরে আসবে না। কিন্তু তাও ওই একই ডালের চারিপাশে তার প্রদক্ষিণ করার মনোভাবটাই বুঝিয়ে গেল যে মায়ের ভালোবাসা কখনো মরে না। সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার পরও, আজীবন বেঁচে থাকে। প্রজাপতিটা পারত অন্য ফুলের কুরির ওপর গিয়ে বসতে, এমনকী সেই কুরির চারিপাশে ঠিক একই ভাবে প্রদক্ষিণ করতে পারত কিন্তু সেই কাজ সে করেনি বরং নিঃশব্দে রোজ সকালে একবার করে এসে প্রজাপতি ওই সূর্যমুখী ফুলের টবের সবুজ পাতার ভীড়ের মাঝে সেই ডালটাকে খুঁজে বের করে, তার চারিপাশে প্রদক্ষিণ করে আবার নিজের বাড়ি ফিরে যেত। জীবনের প্রত্যেকটা ধাপেই এমন বেশ কিছু দিক থাকে, যা একেবারে মনের গভীরে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং তা বিজ্ঞানেরও বোঝার বাইরে। তবে, মুশকিল হল আমাদের দৈনদিনের নানা ব্যস্ততার কারণে, এই সকল দিকগুলো আমাদের অজান্তেই কখন যে নিজেরদের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে, তার টের টুকুও আমরা পাই না। প্রকৃতির মধ্যে এই সামান্য ঘটে যাওয়া ঘটনাটা, জীবনে আমায় অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেল।
মৃদুলাদেবীর কথা শেষ হতে না হতেই অজয় তার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
- জানি, মা। আমি জানি। ভুলটা আমারই হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমাকে আমি খুব ভালোবাসা মা। খুব ভালোবাসি। বিয়ের পর, রুমার সঙ্গে তোমার ভুল বোঝাবুঝিগুলো বাড়তে বাড়তে এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম আমরা যে আমি কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আর তাছাড়া আমি তো তোমাকে বৃদ্ধাশ্রম রেখে আসতে চাইনি। তুমি তো স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমের পথটাই একমাত্র শান্তির পথ হিসাবে বেছে নিলে।
আর অজয়ের এই কথাটা শেষ হওয়ার আগেই তার ফোনটা বেজে উঠল। বৃদ্ধাশ্রম থেকে ফোন এসেছে। ফোনটা রিসিভ করেই অজয় শুনতে পেল,
- নমস্কার, 'বৃদ্ধের ঠিকানা' বৃদ্ধাশ্রম থেকে আমি অতনু বলছি। মৃদুলাদেবী মানে আপনার মা আর বেঁচে নেই। আজ রাত সাড়ে দশটার সময় উনি হার্টফেল করে মারা গেছেন। আপনি এক্ষুনি চলে আসুন।
কথাটা শুনে অজয়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।
- এটা কি করে, সম্ভব। মা তো আমার সামনেই…।
কিন্তু তার আর কথা শেষ হলো না। সামনে তাকিয়ে সে দেখে, কোথায় তার মা? কেউ তো নেই!
- (নিজের মনে অজয় বলতে লাগল) তাহলে এতক্ষণ আমি কার সাথে কথা বলছিলাম? সবটাই স্বপ্ন! আচ্ছা, স্বপ্নই যদি হয় তাহলে এই খাবারগুলো কে বানালো!
অজয়ের চোখ ছলছল করছে। সে নিজের মনে বলছে,
- মা, তার মানে তুমি সত্যিই আমার সাথে শেষবারের মতো দেখা করতে এসেছিল এবং খাইয়ে দিয়ে গেলে!
এতক্ষণ অজয় তার লেখা গল্পটা দেবেশকে পড়ে শোনাচ্ছিল। খাতায় লেখা গল্পের শেষ অংশটি অজয় পড়ছে,
- আজকের দিনে দাঁড়িয়েও এসব ঘটনা সত্যিই ঘটে? কি জানি, হয়ত ঘটে! কারণ দেহ যখন জীবিত থাকে, তখন এর ভেতরে আত্মা থাকে। আর মৃত্যুর সময় আত্মা দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। তবে, মায়েরা সত্যিই অন্যরকম হয়। তা নাহলে যেই ছেলে মাকে পাঁচ বছর বৃদ্ধাশ্রমে রাখল, সেই ছেলের প্রতি মায়ের এখনো এতো ভালোবাসা যে শেষবারের মতো একবার দেখা করে গেল।
গল্পে মিশে থাকা আবেগ দেবেশকে এতোটাই স্পর্শ করেছে যে অজয়ের মুখে গল্পটা শুনতে শুনতে কখন যে তার চোখেও জল চলে এসেছে দেবেশ বুঝতে পারেনি। তার চমক ভাঙল অজয়ের কথায়,
- কী রে, কোথায় হারিয়ে গেলি?
দেবেশ মৃদু হেসে বলল,
- কই? কোথাও না তো।
তারপর অজয় দেবেশকে বলতে লাগল,
- আসলে কি জানিস, এই গল্পটার মধ্যে একটা আবেগ মিশে আছে। সেই আবেগ যদি পাঠক-পাঠিকারা উপলব্ধি করতে পারে, তবেই গল্প লেখা সার্থক। আমার চোখে বৃদ্ধাশ্রম হল বয়স্কদের এমন এক থাকার জায়গা যার সঙ্গে আমাদের কলেজ লাইফের হোস্টেলের অনেকটাই মিল রয়েছে। তবে, একটাই তফাৎ আমরা হোস্টেলে থাকি আনন্দে আর তারা ওখানে থাকে কষ্টে হাসি মুখে। যে সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দেখার কেউ নেই তাদের জন্যই তৈরি হয় এইসব আবাসন।
- বুঝলাম। কিন্তু আবেগের চেয়েও আমার চোখে আরও একটা বিষয় ধরা পড়েছে।
দেবেশের মুখে কথাটা শোনা মাত্র অজয় কিছুটা অনুমান করে নিয়েই বলল,
- জানি। আমার অনুশোচনা বোধের কথা বলতে চাইছিস, তাই তো?
- (কৌতূহলপূর্বক দেবেশের প্রশ্ন) আচ্ছা, অজয়। কাকিমাকে সেবার বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার জন্য তোর আজও অনুশোচনা হয়, তাই না?
অজয়ের উত্তর,
- মিথ্যে বলব না। অবশ্যই হয়। সেই রাতে যখন মায়ের মৃত্যুর খবরটা পেলাম, তখন একটা কথা খুব মনে হচ্ছিল জানিস। একবার যদি মাকে ফিরিয়ে আনতাম। একবার যদি ওদের দুজনকে দুজনের সম্মুখীন দাঁড় করিয়ে বলতে পারতাম যে- যা হয়েছে সব ভুলে যাও, আমরা নতুন করে আবার শুরু করি। কিন্তু...।
- কিন্তু কি?
- ওই যে সাংসারিক অশান্তির ভয়। যদি আবারও একই ভাবে রুমা আর মায়ের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয় এবং সেই থেকে অশান্তি। আর মাও যে ফিরে আসতে চাইল না।
- অজয়, সত্যি কথা বলত। এক্ষেত্রে কাকিমার চাওয়াটা কি সত্যিই প্রাধান্য পেত? আসলে কি বলত, বৃদ্ধাশ্রম কথাটা শুনলেই মনের মধ্যে ভেসে ওঠে কতগুলো করুণ চেহারার জলছবি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় যারা একটু ভালোবাসা খুঁজে বেড়ায়। মাথার ছাদ হারিয়ে যারা একেবারে পথে নেমে গেছেন। যারা নিজের সন্তান ও পরবর্তী প্রজন্মকে আগলে রেখে শেষ জীবনটা হাসি-খুশি কাটাতে চান। জীবনসায়াহ্নে সন্তান ও নাতিনাতনীদের পাশে থেকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে চান। অথচ মানবতার চরম উপহাস! সন্তানরা ক্রমে ভুলে যায় তাদের বাবা-মায়ের আদুরে স্মৃতিবিজড়িত সেই দিনগুলো। অস্বীকার করে বসে স্বযত্নে আগলে রাখার প্রতিটি মুহূর্ত, ভালোবাসার প্রতিটি ক্ষণ।
- হ্যাঁ, দেবেশ। তুই ঠিকই বলেছিস। আর সেইজন্য আজও মনে হয়, একজন সফল স্বামী হওয়ার চেয়ে বোধহয় একজন ব্যর্থ সন্তান হয়েই আমি রয়ে গেলাম।
- তুই সন্তান হিসাবে ব্যর্থ কিনা আমি বলতে চাই না। তবে,এইটুকু বলতে পারি যে মা রূপে কাকিমা সফল। বাকি আর পাঁচজন মায়ের মতো সেও নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে, বেছে নিয়েছিল বৃদ্ধাশ্রমের ওই ছোট্ট ঘরটাকে স্রেফ সন্তানের সুখের জন্য।
কিছক্ষণ মাথা নিচু করে থাকার পর, অজয় বলে উঠল,
- আচ্ছা, দেবেশ। মায়েরা কী অন্যরকম হয়?
মৃদু হেসে দেবেশ বলল,
- তোর কী মনে হয়?
প্রত্যুত্তরে অজয়ও ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসি রেখে বলল,
- কি জানি, হয়ত মায়েরা সত্যিই অন্যরকম হয়।
- উপফ! আজ অফিসে যা কাজের চাপ গেল। বাপরে, বাপ। অনেকদিন পর আমরা এমন চাপ সামলালাম। বড্ড ক্লান্ত লাগছে।
অজান্তেই একটু উচ্চস্বরে সে বলে উঠল,
- ও গো, রুমা। একটু চা পাওয়া যাবে?
কেউ সারা দিচ্ছে না দেখে অজয়ের বোধোদয় হল যে রুমা গতকালই বাপের বাড়ি গেছে। অতএব তাকে রান্নাঘরে গিয়ে নিজের খাবার নিজেকেই করে নিতে হবে। ঘড়িতে তখন বাজে রাত সাড়ে দশটা, হেলতে দুলতে রান্না ঘরের দিকে গেল অজয় এবং রান্নাঘরে গিয়ে ডাল, ডিমের তরকারি রান্না করে রাখা আছে দেখে সে একেবারে অবাক।
- (নিজের মনে) একি রে, বাবা। রুমা এসেছিল নাকি? ভাত, ডাল, ডিমের তরকারি কে রান্না করে দিয়ে গেল!
খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে ঠিকই কিন্তু খিদের জ্বালা আর সহ্য করতে না পেরে সেই খাবার বেড়ে সে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে এসে খেতে লাগল। খেতে খেতে অজয়ের মনে হল সে যেন মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ পাচ্ছে।
- বাহ! দারুণ লাগছে তো খেতে। একেবারে মনে হচ্ছে মায়ের হাতের রান্না। তাহলে কি মা এসেছিল? আরে, ধুর! মা কি করে এখন আসবে। আজ পাঁচ পাঁচটা বছর হয়ে গেল তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছি। মাঝে মধ্যে দেখা করতে গেলেও, মায়ের সঙ্গে আর রাত জেগে কথা হয় না। কত স্মৃতি যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই ফ্যাটে। অনেক দিন হয়ে গেল মায়ের হাতের রান্না খাইনি। আচ্ছা, তাহলে এই খাবারগুলো এলো কীভাবে? মায়ের হাতের রান্নার সেই অবিকল স্বাদ। তারমানে কি মা সত্যিই এসেছিল?
আবারও মায়ের ভাবনায় তলিয়ে যায় অজয়। চমক ভাঙে একটা চেনা কন্ঠস্বরে,
- কি রে, না খেয়ে অত কি ভাবছিস? কিছুই তো খাচ্ছিস না, বাবু।
চমকে উঠে সামনে তাকিয়ে অজয় দেখে তার মা দাঁড়িয়ে আছে। বেশ অবাক হয়ে অজয় তার মাকে জিজ্ঞেস করল,
- একি মা, তুমি কখন এলে? আর কি করে এলে? এসব রান্না কি তুমি করেছ?
মৃদুলাদেবী মৃদু হেসে বললেন,
- হ্যাঁ! আমি করেছি।
- কিন্তু তোমাকে এতক্ষণ দেখিনি কেন? কোথায় ছিলে মা তুমি?
- আমি ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালের মধ্যেই ছিলাম বাবু। চারপাশটা একটু ঘুরে দেখছিলাম। আমার স্বাধের ফ্ল্যাটে এখন কতকিছুই না পাল্টেছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তোরাও অনেকটা বদলেছিস দেখতে পাচ্ছি।
একটু চুপ করে থাকার পর অজয় বলল,
- তুমি কীভাবে এখানে এলে মা?
মৃদুলাদেবী আগের মতোই মৃদু হেসে উত্তর দিলেন,
- এখানে কি করে এলাম জানি না রে, বাবু। শুধু তোকে একবার চোখের দেখা দেখতে ইচ্ছে করল, তাই চলে এলাম।
- কিন্তু এটা কি করে…।
- কি করে এলাম আমি অত জানি না। তবে, তোরা যে ভালো আছিস এটা দেখে অনেকটাই শান্তি পাচ্ছি রে, বাবু। চোখের সামনে বারবার যেন তোর ছেলেবেলাটা ভেসে উঠছে। আচ্ছা, তোর মনে আছে বাবু, সেই প্রথম যেদিন তুই স্কুলে গেলি। আমার হাত ছেড়ে গেটের দিকে এগোতেই ভুরু দুটো কুঁচকে অঝোরে কাঁদতে লাগলি।
- হ্যাঁ, সে কথা কি আর ভোলা যায়। তুমি সেদিন বাড়ি ফেরার পর কোলে তুলে নিয়ে এমন ভাবে আগলে বসলে যেন মনে হবে আমি কোথাও একটা হারিয়ে গেছিলাম।
- আসলে তুই তো আমার নয়নের মণি। তুই একা কোথাও গেলে আমার বড্ড চিন্তা হত। একদিনও তোকে নিজের কাছ ছাড়া করতে পারতাম না যে!
- জানি মা। তাই তো আমাকে সবাই তোমার নেওটা বলত। আমার পড়াশোনার ব্যাপারে তুমি কখনও খরচ করতে কার্পণ্য করনি। পুজোর সময় নিজের জন্য শাড়ি কম কিনে, সেই টাকায় তুমি আমাকে বেশি করে জামা কিনে দিয়েছ যাতে বন্ধুদের সঙ্গে রোজ নতুন জামা পড়ে আমি ঘুরতে যেতে পারি। এর জন্য অবশ্য তুমি বাবার কাছে কম বকুনি খাওনি।
- (হেসে উঠলেন মৃদুলাদেবী) হা-হা-হা! ওরে, পাগল ছেলে আমার। আমি কিবা করেছি তোর জন্য। জানিস, একজন মা তার সন্তানের জন্য এর থেকে আরও বেশি কিছু করতে পারে। আচ্ছা, তোর মনে পড়ে মহাভারতের কাহিনিগুলো যখন তোকে পড়ে শোনাতাম। কৌরব মাতা গান্ধারীর মতো একজন মহিয়ষী নারী জন্মান্ধ স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বিয়ের সময় থেকেই নিজের চোখে কাপড় বেঁধে রাখতেন। কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষ লগ্নে, মৃত্যুর প্রায় কাছে পৌঁছে যাওয়া পুত্র দুর্যোধনের প্রতি মাতৃস্নেহে দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি। নিজের সারাজীবনের তপস্যা ও ধর্মরক্ষার ফল হিসেবে একটিবার পুত্রের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকে একটি কবচ পড়াতে চান গান্ধারী। হ্যাঁ, মায়েরা যে এমনি হয় রে। সন্তানের জন্য সে নিজের সবটুকু দিয়ে দিতে পারে।
- জানো, মা। আজ আমি একটা বিষয় খুব অনুতপ্ত। ছোটবেলায় তোমার পাশে বসে দিনের পর দিন মোঘলাই খেয়েছি অথচ তোমাকে একটিবারও খাওয়ার জন্য কখনো সাধিনি। এখন সেই কথা ভাবলে লজ্জা লাগে। তোমাকে না দিয়ে আমি কিনা দিব্বি খেয়ে গেছি!
- বাবু, তোর সেই পুরনো ছেলেবেলার বিকেলগুলোর কথা আজও মনে আছে?
খাওয়া থামিয়ে অজয় বলল,
- এমা, এটা মনে থাকবে না কেন? আমরা ভাই বোনেরা ছোটবেলায় কেমন লোডশেডিং হলেই লুকোচুরি খেলতাম। ঠাকুরদার লন্ঠনটা দালানের মাঝে রেখে সারা বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করতাম। তারপর জ্যাঠামশাই কাকুরা আলাদা হয়ে চলে গেল, আমরাও কিছু বছর বাদে চলে এলাম এই ফ্ল্যাটে। পুরনো উত্তর কলকাতার বাড়িটা আজ প্রমোটিং হয়ে ফ্ল্যাট উঠে গেছে।
- সত্যি, রে বাবু। বহুকাল আগের সেই কথা। এমন দিন আর কখনো ফিরবে না। বড় পরিবার কি, সেটা এই প্রজন্ম বুঝবে না রে। পরিবারগুলো সেই সময় থেকে ক্রমশ ভাঙতে ভাঙতে আজ আমি-তুমিতে এসে ঠেকেছে। আমাদের উত্তর কলকাতার ওই এলাকাটা তখন এখনকার মতো জনবহুল ছিল না। তখন লোডশেডিং হলে এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে গল্প হত, আমরা বউরা পাশের বাড়ির মেয়ে বউদের সঙ্গে কত গল্প করতাম। পাড়ায় পাড়ায় বিকেলে ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেয়েরাও খেলতে যেত। কিন্তু কালের নিয়মে আজ শহুরে ব্যস্ততা সবাইকে গ্রাস করেছে, তাও শৈশব আর কৈশোরের মধুর স্মৃতি রয়ে গেছে মনে। আমার মতো বয়স্ক মানুষগুলোর মধ্যে রয়ে গেছে সেই পুরনো ভালোবাসার রেশ। ঠিক যেভাবে এই ঘরের জানালার পাশে রাখা সূক্ষ মোমবাতির গা বেয়ে নামতে থাকা তরল মোমের চিহ্ন এখনো বিলীন হয়ে যায়নি, চিহ্নটুকু এখনো লেগে আছে কাঠের ওই টেবিলে। যেমন হারিয়ে যাওয়া চড়ুইয়ের ডাক এখনো অজান্তে কানে ভেসে আসে। সেই ভাবেই অনেক না থাকার মাঝেও, অনেক কিছু থাকার শান্তি সেইসব স্মৃতি-তে মিশে আছে।
- তবে, যাই বলো মা। আমার কিন্তু ওই বোর্ড এক্সামের সময় ওমনভাবে খেলতে যাওয়ার জন্য তোমার হাতে স্কেল দিয়ে পিটুনি, সেটা কখনোই ভুলতে পারব না। ওটা সবার আগে মনে আছে। হা-হা-হা!
- স্কেল দিয়ে পিটুনিটা খুব মনে রেখেছিস, বাবু। কিন্তু এটা কি অস্বীকার করতে পারবি যে সেই সময় ওই পিটুনি খাওয়ার জন্যই আজ তুই এতো বড় হতে পেরেছিস। এমন বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে নিজের সংসার চালাচ্ছিস।
- শুধু বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি, সেটাই দেখছ মা। এদিকে, রোজ যে কত ঝামেলা পোয়াতে হয়, সেটা যদি বুঝাতে তাহলে বলতে বাবার সরকারী চাকরিটাই ঢের ভালো ছিল।
হা-হা-হা! ছেলে আর মা দুজনেই হেসে উঠল, তারপর মৃদুলাদেবী বললেন,
- তবে, একটা বিষয় দেখে ভালো লাগছে যে পুরনো কথাগুলো তোর আজও মনে আছে। না, আসলে এখন তো তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস। বড় চাকরি করছিস, কি সুন্দর করে সংসার গুছিয়ে নিয়েছিস। তাই ধূলো জমে যাওয়া স্মৃতির কথাগুলো তোর মনে আছে দেখে একটু অবাক হলাম! সেই দিনগুলোর সঙ্গে আজকের সময়কে মেলাতে গেলে ভুল হবে। তবে কি বলত, ওইদিনগুলো আমি আজও রোজ উপভোগ করি। আজও ওইদিনগুলোতেই বেঁচে থাকি। তোর বাবার কাছ থেকে ঘরের কিছু জিনিস কিনব বলে তোর আবদারগুলো কীভাবে ওনার আড়ালে মিটিয়েছি সেটা একমাত্র আমিই জানি। কখনো তৃপ্তি কেবিনের মোঘলাই, তো কখনো আবার নকুরের মিষ্টি।
- হ্যাঁ, মা। এই কথাগুলো আমি এখনো রুমাকে শোনাই। আমার মা আমার জন্য অনেক কিছু করেছে। আমার মায়ের জীবনের দ্বিতীয় ভাগ আমাকে ঘিরেই কেটেছে। অবশ্য রুমা কতটা অনুভব করতে পারে, জানি না। ওর ছেলেবেলা তো আবার কেটেছে অনেকটাই পাশ্চাত্য কায়দায়। বাবা-মা দুজনেই অফিসের কাজে সারাদিন বাইরে থাকত। আর একা মেয়ে রুমা থাকত মাসির কাছে। একটু বড় হতেই চলে যায় দিল্লি। সেখানেই পড়াশোনা হোস্টেলে থেকে। সুতরাং ওর কাছে বিকেল মানে বন্ধুদের সঙ্গে কফি শপে বসে আড্ডা কিংবা নিজের কাজে ব্যস্ত থাকা। হ্যারিকেনের আলোতে পড়াশোনা করার মজাটাই যে ও পায়নি।
- এই বাবু, এবার কিন্তু আমার কাছে বকা খাবি। রুমা নেই বলে মায়ের কাছে বউয়ের নামে নিন্দা করছিস? আমার বউমা খারাপ নয় রে, আসলে কেউই খারাপ হয় না। সময় এবং পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়। তবে, তোকে ভালো রেখেছে এই দেখে আমি নিশ্চিন্ত। আমার সেই বাবু, যে কিনা আমি পাশে না শুলে ঘুমাতেই পারত না। আমি খাইয়ে না দিলে, মুখে খাবার তুলত না। আজ সেই কিনা দিব্বি মাকে ছাড়া ঘুমাতে পারে, তাকে খাইয়ে দিতে আর মাকে ছুটে আসতে হয় না।
- মা গো, আজ তোমার হাতে আমাকে খাইয়ে দেবে? সেই ছেলেবেলার অভ্যাসটা আবারও নতুন করে ফিরে পেতে চাই।
- সব কি আর ফিরে পাওয়া সম্ভব? সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যে অনেকটা সময় বয়ে গেছে।
- তারমানে আমাকে আজ আর খাইয়ে দেবে না, তাই তো?
- ওমা, সেটা আবার আমি বললাম কখন। আমি তো স্রেফ বাস্তবটা তোমার সামনে তুলে ধরলাম। আচ্ছা, আয়। আজ আমি খাইয়ে দি তোকে। জানি না, আর কোনোদিন পারব কিনা। হয়ত মৃত্যুর পর এটাই আমার পরম শান্তি।
মৃত্যু কথাটা শোনা মাত্র অজয় গেল রেগে। সে বলল,
- উপফ! এই মৃত্যুর কথাটা তোমার মাঝে ডেকে না আনলে চলে না, তাই না? সবসময় মরার কথা বলো কেন?
- ওরে, পাগল ছেলে আমার। মৃত্যু তো একদিন না একদিন সকলেরই হবে। বাস্তব জীবনের চরম সত্য হচ্ছে মৃত্যু অবধারিত। অতএব তাকে কি এড়িয়ে চলা যায়?
- আচ্ছা! বেশ। মেনে নিলাম তোমার কথা। তোমার সঙ্গে কথায় পারব, তেমন সাধ্যি আমার নেই। তবে, মা তুমি আজও আমার দেওয়া ঘড়িটা ব্যবহার করলে না বলো! এমনকি যাওয়ার সময়ও ওটিকে ভুলেই চলে গেলে। আমার কিন্তু খুব খারাপ লেগেছে। যতবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ঘড়িটা দিয়ে আসতে চেয়েছি, তুমি ফেরত পাঠিয়েছ। আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো। ওই ঘড়িটা কি তোমার পছন্দ নয়?
অজয়কে খাওয়াতে খাওয়াতে মৃদুলাদেবী বললেন,
- ওমা, এ আবার কীরকম কথা! ছেলের দেওয়া জিনিস মায়ের কাছে আবার পছন্দ অপছন্দ কি? তোর দেওয়া সবকিছুই আমার পছন্দ, সুখ-দুঃখ সব। কলেজ পাশ করার পর যখন প্রথম চাকরির বেতন দিয়ে তুই আমার জন্য নতুন ঘড়িটা কিনে এনে হাতে তুলে দিলি, তখন মনে আছে আমি তোকে একটা কথা বলেছিলাম?
- কী কথা মা?
মুচকি হেসে মৃদুলাদেবী বললেন,
- জানি, সেই কথা তোর মনে থাকবে না, আর থাকার কথাও নয়।
- ওহ! মনে পড়েছে। হ্যাঁ! হ্যাঁ! তুমি তো ঘড়িটা পড়লেই না। বরং বাবার দেওয়া সেই আদ্দি আমলের মরচে পরে যাওয়া ঘড়িটাই পড়ে ঘুরে বেড়িয়েছ। শতবার বলেও তোমাকে ওই ঘড়ি খুলিয়ে নতুনটা পড়াতে পারিনি।
শেষের কথাটা একটু রেগেই বলল অজয়। আর তাই কাতর স্বরে মৃদুলাদেবী বললেন,
- রাগ করিস না, বাবা। আসলে সেই কথাটা বলেছিলাম কারণ বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সন্তানদের কাছে তাদের পিতামাতা এতোই বোঝা হয়ে যাচ্ছে যে বুড়ো বয়সে তাদের অবস্থা কী রকম হয় জানিস?
- (জানতে চাইল অজয়) কী রকম?
- তোর ব্যাগের কোনায় পড়ে থাকা পরিত্যক্ত ফোনটির মতো, যেটা পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রম দেখায়।
বৃদ্ধাশ্রম শব্দটা শোনা মাত্র অজয় ওর মাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
- দাঁড়াও। দাঁড়াও। আচ্ছা, এবার বুঝলাম মা। তুমি এই কারণেই আমার দেওয়া ঘড়িটা আজও পড়লে না। উপফ! মা। আমি তোমাকে পরিত্যক্ত পণ্য জিনিস ভাবি না, না কখনও ভেবেছি।
- সেদিন যখন কথাটা বলেছিলাম, তুই একইভাবে রাগ করে উঠে চলে গেছিলিস। তুই আমার কথা সেদিন মানতে চাসনি। তবে, আমি কিন্তু নিজের ভবিষ্যতটা দেখতে পেয়েছিলাম। তাই সেই মুহূর্তে তোকে একটা সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলাম যে আমি তোর মা। এখনো নড়তে-চড়তে পারি। তোদের কাছে আমার মূল্য অনেক বেশি। আমার সাথে এসে গল্প করছিস। তোদের রান্না করে খাওয়াচ্ছি, যখন যা প্রয়োজন তা করে দিচ্ছি। কিন্তু একসময় গিয়ে আমি বুড়ো বয়সে উপনীত হব। তখন তোদের এই সময়ের মতো কিছুই করে দিতে পারব না। বুড়ো বয়সে হয়তো আমার সাথে আর তেমন গল্পও করতে আসবি না। বয়সের ভারের কারণে তোদের জন্য রান্নাটা তখন আর করা হবে না। আমার মূল্যটা তখনই কমে যাবে। পড়ে থাকব ঘরের এক কোনায়, তোর পরিত্যক্ত ফোনটির মতো। ঐ ফোনটিও একসময় তোর কাছে খুব মূল্যবান ছিল, যখন ফোনটি তোকে ভালো সার্ভিস দিচ্ছিল! আর যখনই পরিত্যক্ত হয়ে তোকে সার্ভিস দিতে পারছে না, তখন তোর কাছে ফোনটি মূল্যহীন হয়ে গেল। ফেলে রাখলি ব্যাগের এক কোনায়। ব্যবহার করছিস এখন কত দামী অত্যাধুনিক ফোন। দীর্ঘদিন ব্যবহারে পরিত্যক্ত হয়ে ফোনটি দেখলো ব্যাগের কোনা। আর বয়স বেড়ে অবশ হয়ে পিতামাতা দেখে বৃদ্ধাশ্রম, যেমনটা আমিও দেখলাম। এই হলো বর্তমান সময় সন্তানদের কাছে পিতামাতার মূল্য।
একটু থেমে মৃদুলাদেবী ফের বললেন,
- বাবু, তুই আমাকে সেদিন বলেছিলিস, আমি অন্য সবার মতো হব না মা। তুমি বুড়ো বয়সে উপনীত হলেও তোমাকে আগের মতোই ভালোবাসবো। তোমার পাশে গিয়ে বসে এই সময়ের মতো গল্প জুড়ে দেব। কিন্তু ছেলে আমার কখন বড় হয়ে গেল, বুঝতে পারলাম না। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ, তারপর চাকরি। সময়ের নিয়মে সবকিছুই এগিয়ে চলল, মোটা বেতন পাওয়া ছেলের বিয়ে দিয়ে বউমাও নিয়ে এলাম বাড়িতে। প্রথম প্রথম আমাদের সংসারে সুখের দেবী বিরাজমান হলেও, ধীরে ধীরে চিত্র বদলালো। মেঘেরা জমাট বাধতে লাগল।
সময় যেন ওই মুহূর্তে মা আর ছেলেকে ক্রমশ তাদের ফেলে আসা তিক্ত অভিজ্ঞতার দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করছে।
- মা গো, আমার প্রতি তোমার অনেক ক্ষোভ আছে বুঝি সেটা। তবে, তোমাকে ছেড়ে দূরে থাকলেও অন্তত প্রত্যেক মাসে একবার হলেও একটা মিনিট ব্যয় করে তোমাকে ফোনে খবর নিয়ে গেছি, মা খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করছ তো? ওষুধ ঠিকমতো খাচ্ছ তো?
মৃদুলাদেবী কাঁপা গলায় বললেন,
- হ্যাঁ, বাবা। তুই তোর ছেলে হওয়ার দায়িত্ব যথাযত পালন করেছিস। সেইজন্য আমি তো বাসুদেবদা, মালতি ওদের প্রত্যেককে গর্ব করে বলি যে আমার ছেলে আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যাওয়ার পরও ভুলে যায়নি। সে নিজের শত ব্যস্তার মাঝেও ঠিক মনে করে আমাকে মাসে একবার ফোন করে খবর জানতে চায়, আমি কেমন আছি। এমন ভাগ্য আর কজনের হয় বল?
কথাটা শুনে অজয় বলে উঠল,
-তা তোমার কথা শুনে আমার ব্যাপারে ওরা কি বলে?
উত্তরে মৃদুলাদেবী বললেন,
- ওরা আর কি বলবে। বাসুদেবদার মেয়ে তো প্রতিদিন ফোন করে তার বাপের খবর জানে। আর মালতির ছেলে মাসে একবার বৃদ্ধাশ্রমে এসে ওর সঙ্গে দেখা করে যায়। আমি অবশ্য তোর কথা উঠলেই সোজাসুজি ওদের বলে দি যে দেখো বাপু আমার ছেলে মস্ত বড় কোম্পানিতে চাকরি করে। ওর কাঁধে অনেক দায়িত্ব। সুতরাং ওর অত সময় নেই। তাও ব্যস্তার মাঝে বাবু যতটুকু করে, এটাই আমার কাছে যথেষ্ট। ওরা হয়ত আমার সুখ দেখে হিংসাতে চুপ করে যায়।
এরপর অনেকক্ষণ অজয়কে চুপ করে থাকতে দেখে মৃদুলাদেবী ছেলের ভাতের থালার দিকে চেয়ে বললেন,
- আরেকটু ভাত দি বাবু? মাছের ঝাল দিয়ে তো খাওয়া বাকি তোর।
- হ্যাঁ, মা। দাও। কতদিন পর তোমার হাতের স্পর্শ পেলাম। আজ মনে হচ্ছে তোমার হাতে যেন অমৃতর স্বাদ পাচ্ছি। আমার খালি তোমার হাতে আজ খেয়েই যেতে ইচ্ছা করছে।
- হা-হা-হা! পাগল একটা।
তারপর একটু থেমে ছেলের দিকে চেয়ে বললেন মৃদুলাদেবী,
- জানিস, বাবু বৃদ্ধাশ্রমে আমার ঘরের জানালা দিয়ে সামনে মান্নাবাবুদের বাড়ির বারান্দাটা দেখা যায়। একদিন সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যাওয়ায়, কি করব বুঝে উঠতে না পেরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রকৃতি এবং সকালের পরিবেষটা আমার সবসময় খুব প্রিয় কিন্তু অনেক রাত অবধি গাঁটের ব্যথার কারণে ঘুম আসতে চায়না। ফলে, অত সকালে আর ঘুম থেকে ওঠা হয় না। তবে, সেদিনের আগের রাতে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হওয়ার কারণে, তখনও যেন একটা মিষ্টি বাতাস বইছিল। সামনে রাখা চেয়ারটায় বসার সময় লক্ষ্য করলাম তাদের বাড়ির ছাদের সব কটা ফুলের টবের মধ্যে একখান সূর্যমুখী ফুলের টবে সবে মাত্র একটা কুরি ফুটেছে আর তার চারিপাশে বনবন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা প্রজাপতি।
মায়ের কথার মাঝেই রেগে অজয় বলে উঠল,
- কীসব আবার বলতে শুরু করলে মা! প্রজাপতি, সূর্যমুখী এইসব কি? আর তাছাড়া তুমি যে বারান্দায় দাঁড়াও, কৈ আমাকে বলনি তো? ওই জায়গাটা মটেও মজবুত নয়। এখন কোনও বিপদ হয়ে গেলে কি হবে ভেবে দেখেছ?
- আরে, কথার মাঝে কথা বলিস না তো। আমার কিছুই হবে না। ওসব কথা তাই বাদ দে। এখন আমি যেটা বলছি, চুপ করে শোন। সেই প্রজাপতির ডানার রঙটা ছিল নীল, আর সেই নীল ডানায় ছিল নানা রঙ্গের ছড়াছড়ি। ওই দৃশ্য দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, আচ্ছা! সব ফুলের টব ছেড়ে প্রজাপতিটা কেন সবে মাত্র ফোটা ওই কুরির পেছনে পড়ে রয়েছে? একবার ভাবলাম ঢিল ছুঁড়ে প্রজাপতিটাকে তারিয়ে দি। কিন্তু পরক্ষনে সেই ভাবনা কে বাস্তবান্তর করা থেকে নিজেকে সংযত রাখলাম। দু-দিন পর, আবার ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় আসতেই ওই একই দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে পেলাম। তবে, সেদিন লক্ষ্য করলাম ওই কুরি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে আর সে প্রজাপতির দিকে এমন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে যে মনে হবে, হয়ত ভালোবাসার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে সূর্যমুখীর মনে। আর সূর্যমুখীকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রজাপতিটাও যেন নিজের মধ্যে মাতৃত্বের স্বাদ উপভোগ করতে লেগেছিল। ফলস্বরূপ, আরও ডানা মেলে তার চারিপাশে সে উড়তে লাগল। সেদিনের দৃশটা আরোই মুগ্ধ করল আমায়। প্রকৃতির এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা সত্যি মানব ভালোবাসার চেয়েও কত সুন্দর! এখানে না থাকে কোনো স্বার্থ, না থাকে কোনো চাহিদা। শুধু একটা জিনিসই সবসময় প্রাধান্য পেয়ে থাকে, সেটা হল- ভালোবাসা। আমি যেখানে অত সকালে ঘুম থেকে ওঠাটাই প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলাম, সেখানে এখন রোজ ওই একই সময় আমি ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে যাই বারান্দায়। হ্যাঁ! বারান্দায় যাই সেই মা আর সন্তানের অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য দেখতে।
- (খেতে খেতে অজয়) এরপর?
- এরপর যত দিন যাচ্ছে, ততই যেন বেড়ে উঠছে ওই সন্তান তুল্য সূর্যমুখী। আর প্রজাপতিও মায়ের মতো করেই তার খেয়াল রাখছিল। তার চারিপাশে প্রদক্ষিণ করার সময় সে দিব্বি বাড়িয়ে চলেছে। এখন খুব ভোরেই প্রজাপতি ছুটে আসে সূর্যমুখীর কাছে, যাতে আরও বেশি সময় তারা একসঙ্গে কাটাতে পারে। প্রথম দিকে তাদের মান-অভিমান, হাসিঠাট্টা কিছুই আমি বুঝতে পারতাম না। কিন্তু ওই মিষ্টি বাতাসে মিশে থাকা মা আর সন্তানের স্নেহের গন্ধ, ভালোবাসার গন্ধ এবং প্রজাপতির সেই প্রদক্ষিণ করা তার প্রিয় সূর্যমুখীকে দেখে, এই সকল বিষয়গুলোর মধ্যে আমি যেন আমার নিজের হারানো সময়গুলোকে আবারও অনুভব করতে শুরু করলাম। তাদের ভাষা না বুঝলেও, সম্পর্কের ভঙ্গি দেখে আমি ধীরে ধীরে তাদের কথাবার্তা বুঝতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু একটা ক্ষেত্রে যে পৃথিবীর সকল প্রাণী এক শ্রেণিতে এসে দাঁড়ায়, সেটার টের পেলাম যখন হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলাম যে সেই সূর্যমুখী কুরি আর কুরি নেই। সে এখন ফুল হয়ে মান্না বাবুর স্ত্রীর সাজীতে স্থান পেয়েছে। আর অন্য দিকে সেই অভাগা প্রজাপতি দিশাহীন ভাবে খুঁজে চলেছে তার সন্তান তুল্য সূর্যমুখীকে। প্রজাপতি সকালে আসার সময় হয়ত ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে ওইদিন এসে তাকে এই কঠিন বাস্তবের সম্মখিন হতে হবে। ওইদিন সারা সকাল এমনকী সন্ধ্যে হওয়ার আগে অবধি যখন বারান্দার দরজাটা বন্ধ করতে গেলাম, তখনও চোখে পড়ল ওই একই ভাবে প্রজাপতিটা ঘুরে বেড়াচ্ছে তার হারিয়ে যাওয়া সন্তান তুল্য সূর্যমুখীর জন্য। ওই সময় নিজেকে খুব নিরুপায় মনে হচ্ছিল। আমি যদি একবার ওই কঠিন কথাটা প্রজাপতিটাকে বলতে পারতাম, তাহলে হয়ত তার এই পাগলের মতো খুঁজে চলা, শেষ হলেও হতে পারত। ওই রাতে বাড়ি ফিরে গিয়ে হয়ত প্রজাপতিটা খুব কেঁদেছিল এবং সেই যন্ত্রণা যে কতটা, তা আমি জানি।
মায়ের কথা শুনতে শুনতে অজয়ের চোখে তখন জল। কাঁপা গলায় সে বলল,
- তার পরের দিন কি হল মা?
মৃদুলাদেবী বললেন,
- পরদিন সকালে আমার আর ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নেই। নিজের ফেলে আসা দিনগুলোকে আরেকবার ওই দুটো প্রাণীর মধ্যে দেখার আর তাড়া নেই যে! সবটাই শেষ হয়ে গেছে। ওই ঘটনার বেশ কিছুদিন বাদে, একদিন দুপুরে খওয়ার পর যখন বারান্দায় এসে একটু বসতে গেলাম, তখন অদ্ভুত ভাবে চোখে পড়ল সেই একই প্রজাপতি এবং তার একই ভাবে খুঁজে চলা তার হারিয়ে যাওয়া সন্তান তুল্য সূর্যমুখীকে। ততদিনে সে হয়ত জেনে গেছে যে ওই সূর্যমুখী আর কোনদিনও তার কাছে ফিরে আসবে না। কিন্তু তাও ওই একই ডালের চারিপাশে তার প্রদক্ষিণ করার মনোভাবটাই বুঝিয়ে গেল যে মায়ের ভালোবাসা কখনো মরে না। সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার পরও, আজীবন বেঁচে থাকে। প্রজাপতিটা পারত অন্য ফুলের কুরির ওপর গিয়ে বসতে, এমনকী সেই কুরির চারিপাশে ঠিক একই ভাবে প্রদক্ষিণ করতে পারত কিন্তু সেই কাজ সে করেনি বরং নিঃশব্দে রোজ সকালে একবার করে এসে প্রজাপতি ওই সূর্যমুখী ফুলের টবের সবুজ পাতার ভীড়ের মাঝে সেই ডালটাকে খুঁজে বের করে, তার চারিপাশে প্রদক্ষিণ করে আবার নিজের বাড়ি ফিরে যেত। জীবনের প্রত্যেকটা ধাপেই এমন বেশ কিছু দিক থাকে, যা একেবারে মনের গভীরে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং তা বিজ্ঞানেরও বোঝার বাইরে। তবে, মুশকিল হল আমাদের দৈনদিনের নানা ব্যস্ততার কারণে, এই সকল দিকগুলো আমাদের অজান্তেই কখন যে নিজেরদের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে, তার টের টুকুও আমরা পাই না। প্রকৃতির মধ্যে এই সামান্য ঘটে যাওয়া ঘটনাটা, জীবনে আমায় অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেল।
মৃদুলাদেবীর কথা শেষ হতে না হতেই অজয় তার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
- জানি, মা। আমি জানি। ভুলটা আমারই হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমাকে আমি খুব ভালোবাসা মা। খুব ভালোবাসি। বিয়ের পর, রুমার সঙ্গে তোমার ভুল বোঝাবুঝিগুলো বাড়তে বাড়তে এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম আমরা যে আমি কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আর তাছাড়া আমি তো তোমাকে বৃদ্ধাশ্রম রেখে আসতে চাইনি। তুমি তো স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমের পথটাই একমাত্র শান্তির পথ হিসাবে বেছে নিলে।
আর অজয়ের এই কথাটা শেষ হওয়ার আগেই তার ফোনটা বেজে উঠল। বৃদ্ধাশ্রম থেকে ফোন এসেছে। ফোনটা রিসিভ করেই অজয় শুনতে পেল,
- নমস্কার, 'বৃদ্ধের ঠিকানা' বৃদ্ধাশ্রম থেকে আমি অতনু বলছি। মৃদুলাদেবী মানে আপনার মা আর বেঁচে নেই। আজ রাত সাড়ে দশটার সময় উনি হার্টফেল করে মারা গেছেন। আপনি এক্ষুনি চলে আসুন।
কথাটা শুনে অজয়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।
- এটা কি করে, সম্ভব। মা তো আমার সামনেই…।
কিন্তু তার আর কথা শেষ হলো না। সামনে তাকিয়ে সে দেখে, কোথায় তার মা? কেউ তো নেই!
- (নিজের মনে অজয় বলতে লাগল) তাহলে এতক্ষণ আমি কার সাথে কথা বলছিলাম? সবটাই স্বপ্ন! আচ্ছা, স্বপ্নই যদি হয় তাহলে এই খাবারগুলো কে বানালো!
অজয়ের চোখ ছলছল করছে। সে নিজের মনে বলছে,
- মা, তার মানে তুমি সত্যিই আমার সাথে শেষবারের মতো দেখা করতে এসেছিল এবং খাইয়ে দিয়ে গেলে!
এতক্ষণ অজয় তার লেখা গল্পটা দেবেশকে পড়ে শোনাচ্ছিল। খাতায় লেখা গল্পের শেষ অংশটি অজয় পড়ছে,
- আজকের দিনে দাঁড়িয়েও এসব ঘটনা সত্যিই ঘটে? কি জানি, হয়ত ঘটে! কারণ দেহ যখন জীবিত থাকে, তখন এর ভেতরে আত্মা থাকে। আর মৃত্যুর সময় আত্মা দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। তবে, মায়েরা সত্যিই অন্যরকম হয়। তা নাহলে যেই ছেলে মাকে পাঁচ বছর বৃদ্ধাশ্রমে রাখল, সেই ছেলের প্রতি মায়ের এখনো এতো ভালোবাসা যে শেষবারের মতো একবার দেখা করে গেল।
গল্পে মিশে থাকা আবেগ দেবেশকে এতোটাই স্পর্শ করেছে যে অজয়ের মুখে গল্পটা শুনতে শুনতে কখন যে তার চোখেও জল চলে এসেছে দেবেশ বুঝতে পারেনি। তার চমক ভাঙল অজয়ের কথায়,
- কী রে, কোথায় হারিয়ে গেলি?
দেবেশ মৃদু হেসে বলল,
- কই? কোথাও না তো।
তারপর অজয় দেবেশকে বলতে লাগল,
- আসলে কি জানিস, এই গল্পটার মধ্যে একটা আবেগ মিশে আছে। সেই আবেগ যদি পাঠক-পাঠিকারা উপলব্ধি করতে পারে, তবেই গল্প লেখা সার্থক। আমার চোখে বৃদ্ধাশ্রম হল বয়স্কদের এমন এক থাকার জায়গা যার সঙ্গে আমাদের কলেজ লাইফের হোস্টেলের অনেকটাই মিল রয়েছে। তবে, একটাই তফাৎ আমরা হোস্টেলে থাকি আনন্দে আর তারা ওখানে থাকে কষ্টে হাসি মুখে। যে সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দেখার কেউ নেই তাদের জন্যই তৈরি হয় এইসব আবাসন।
- বুঝলাম। কিন্তু আবেগের চেয়েও আমার চোখে আরও একটা বিষয় ধরা পড়েছে।
দেবেশের মুখে কথাটা শোনা মাত্র অজয় কিছুটা অনুমান করে নিয়েই বলল,
- জানি। আমার অনুশোচনা বোধের কথা বলতে চাইছিস, তাই তো?
- (কৌতূহলপূর্বক দেবেশের প্রশ্ন) আচ্ছা, অজয়। কাকিমাকে সেবার বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার জন্য তোর আজও অনুশোচনা হয়, তাই না?
অজয়ের উত্তর,
- মিথ্যে বলব না। অবশ্যই হয়। সেই রাতে যখন মায়ের মৃত্যুর খবরটা পেলাম, তখন একটা কথা খুব মনে হচ্ছিল জানিস। একবার যদি মাকে ফিরিয়ে আনতাম। একবার যদি ওদের দুজনকে দুজনের সম্মুখীন দাঁড় করিয়ে বলতে পারতাম যে- যা হয়েছে সব ভুলে যাও, আমরা নতুন করে আবার শুরু করি। কিন্তু...।
- কিন্তু কি?
- ওই যে সাংসারিক অশান্তির ভয়। যদি আবারও একই ভাবে রুমা আর মায়ের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয় এবং সেই থেকে অশান্তি। আর মাও যে ফিরে আসতে চাইল না।
- অজয়, সত্যি কথা বলত। এক্ষেত্রে কাকিমার চাওয়াটা কি সত্যিই প্রাধান্য পেত? আসলে কি বলত, বৃদ্ধাশ্রম কথাটা শুনলেই মনের মধ্যে ভেসে ওঠে কতগুলো করুণ চেহারার জলছবি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় যারা একটু ভালোবাসা খুঁজে বেড়ায়। মাথার ছাদ হারিয়ে যারা একেবারে পথে নেমে গেছেন। যারা নিজের সন্তান ও পরবর্তী প্রজন্মকে আগলে রেখে শেষ জীবনটা হাসি-খুশি কাটাতে চান। জীবনসায়াহ্নে সন্তান ও নাতিনাতনীদের পাশে থেকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে চান। অথচ মানবতার চরম উপহাস! সন্তানরা ক্রমে ভুলে যায় তাদের বাবা-মায়ের আদুরে স্মৃতিবিজড়িত সেই দিনগুলো। অস্বীকার করে বসে স্বযত্নে আগলে রাখার প্রতিটি মুহূর্ত, ভালোবাসার প্রতিটি ক্ষণ।
- হ্যাঁ, দেবেশ। তুই ঠিকই বলেছিস। আর সেইজন্য আজও মনে হয়, একজন সফল স্বামী হওয়ার চেয়ে বোধহয় একজন ব্যর্থ সন্তান হয়েই আমি রয়ে গেলাম।
- তুই সন্তান হিসাবে ব্যর্থ কিনা আমি বলতে চাই না। তবে,এইটুকু বলতে পারি যে মা রূপে কাকিমা সফল। বাকি আর পাঁচজন মায়ের মতো সেও নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে, বেছে নিয়েছিল বৃদ্ধাশ্রমের ওই ছোট্ট ঘরটাকে স্রেফ সন্তানের সুখের জন্য।
কিছক্ষণ মাথা নিচু করে থাকার পর, অজয় বলে উঠল,
- আচ্ছা, দেবেশ। মায়েরা কী অন্যরকম হয়?
মৃদু হেসে দেবেশ বলল,
- তোর কী মনে হয়?
প্রত্যুত্তরে অজয়ও ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসি রেখে বলল,
- কি জানি, হয়ত মায়েরা সত্যিই অন্যরকম হয়।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment