1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 2, 2024

মা, আমি গণেশ হব

 


মা, আমি গণেশ হব

দিব্যেন্দু ঘোষ

পুজোর আগে স্ত্রী ধূর্মবতী এবং ছেলে কার্তিককে কুমোরটুলি নিয়ে গিয়েছিলেন রজতশুভ্র। সেখানেই ঠাকুর গড়া দেখতে দেখতে প্রশ্ন ছেলের, এই ঠাকুরটার সবটা মানুষের মতো, কিন্তু মাথাটা হাতির মতো কেন?

              এই ঠাকুরটা এমনই, খোকাবাবু। সে অনেকদিন থেকেই। তাই আমরা ওর মাথা হাতির মতো বানাই।

ধুর, তোমরা না কিচ্ছু জানো না। ও মা, বলো না! বাবি, বলো না, এই ঠাকুরটার কেন এমন মাথা? কার্তিক মাকে বলতে থাকে, মা, আমি গণেশ হব। তোমরা আমার নাম কার্তিক রেখেছো কেন? ধূর্মবতীর আঙুল ধরে টানতে টানতে বায়না জুড়ে দেয় ছোট্ট কার্তিক।

              ঠিক সেই সময়েই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। ঠিক যেখানটা ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রজতশুভ্র আর ধূর্মবতী ঠাকুর গড়া দেখছিলেন, তার পাশেই দাঁড় করানো ছিল বিশাল এক আটচালার ঠাকুর। প্রায় দোতলা-সমান উঁচু। হুড়মুড় করে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে আটচালার একপাশটা পড়ল রাস্তার দিকে। অনেকেই চাপা পড়ল। সবাই হইহই করে ছুটে এল। পায়ে চোট পেয়েছেন ধূর্মবতী। সেন্সলেস হয়ে গেছে বাচ্চা ছেলেটা। রজতশুভ্র কোনওমতে ওদের বের করে নিয়ে বড় রাস্তার ওপর এলেন। হাত দেখিয়ে একটা ট্যাক্সি থামিয়ে সোজা হাসপাতাল। রাস্তাতেই ডাক্তারবন্ধু অরুণ ঘোষকে ফোন করলেন। আইসিইউ-তে নিতে হল কার্তিককে। রজতশুভ্রের খুব একটা চোট লাগেনি। ধূর্মবতী পায়ে যেখানে আঘাত পেয়েছিলেন, চটজলদি ফার্স্ট এইড করে দেওয়া হল। পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলেটার এখনও জ্ঞান ফেরেনি। কাঁধে এসে হাত রাখলেন বন্ধু ডাক্তার অরুণ, ডোন্ট ওয়রি, সব ঠিক হয়ে যাবে।

               প্রায় পঞ্চাশ ঘণ্টা পর জ্ঞান ফেরে কার্তিকের। তবে সেন্স ফিরছিল, আবার চলেও যাচ্ছিল। শহরের নামী মেডিসিন স্পেশালিস্ট অরুণ ঘোষ বন্ধুর ছেলের জন্য দিনরাত এক করে পড়ে ছিলেন হাসপাতালে। পাঁচদিন আইসিইউ-তেই ছিল কার্তিক। শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি তাকে। রজতশুভ্র-ধূর্মবতী দুজনেই ভীষণ শক পেলেন, তাঁদেরও ভর্তি করতে হয় হাসপাতালে। দেখতে দেখতে কেটে যায় দু-দুটো বছর। ফের সন্তানসম্ভবা হলেন ধূর্মবতী।

             এখন অফিস যাওয়ার তাড়া নেই। রান্নাবান্না নেই। বাড়ির কাজও বিশেষ করতে হয় না। শুধু ভালমন্দ খাওয়া আর ঘুম। মাঝে সাঝে বিছানাতেই আধশোয়া হয়ে গল্পের বই কিংবা মোবাইলে ওয়েব সিরিজ। কখনও গান শুনতে ইচ্ছে করলে বরকেই বলেন। কম্পিউটারে ভলিউম লো করে রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে দেন রজতশুভ্র। শুধু ধূর্মবতীই নন, স্বামী রজতশুভ্রর মনটাও এখন বেশ ফুরফুরে। তবে, চিন্তা যে একেবারেই হয় না, তা নয়। কার্তিকের ইনসিডেন্ট তো মন থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। স্ত্রীকে আনন্দে রেখেছেন রজতশুভ্র। যত্ন-আত্তিরের শেষ নেই।

অফিস থেকে ফেরার সময় কী আনব, বলো? বিছানায় স্ত্রীর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করতে থাকেন রজতশুভ্র। শাশুড়ি অধরবালা দেবীও যত্নআত্তিরে ত্রুটি রাখেন না। মাঝে সাঝে বউমার বিছানার পাশে এসে বসে পুরাণের গল্প শোনান, কখনও গীতা পাঠ করেন, কখনও রামায়ণ-মহাভারত সুর করে পড়েন। মনটা শান্তিতে ভরে ওঠে। ছোট থেকেই পুরাণের প্রতি আলাদা টান ছিল ধূর্মবতীর।

             সেদিন কেমন যেন একটা ঘোর। ঠিক ভোরবেলাতেই স্বপ্নটা দেখলেন ধূর্মবতী। এ স্বপ্ন আগে কোনওদিন দেখেননি। ধূর্মবতী স্পষ্ট দেখলেন, স্নানে গেছেন পার্বতী। বাইরে দরজা পাহারা দিচ্ছে নন্দী। হঠাত্‍ই মহাদেবের আবির্ভাব। নন্দীকে বকলেন খুব, তারপর পার্বতীর স্নানাগারে প্রবেশ করলেন। স্বামীর এমন কাণ্ড দেখে বেজায় চটে গেলেন পার্বতী। ঠিক করলেন, স্বামীর এমন কাজ আটকাতেই হবে। সখী জয়া ও বিজয়ার সঙ্গে পরামর্শ করলেন তিনি। নদীতে গিয়ে পাঁক তুলে আনলেন। তারপর একটি সুন্দর পুত্রের মূর্তি নির্মাণ করলেন। সেই মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তাকে নিজের বিশ্বস্ত অনুচর নিয়োগ করলেন পার্বতী। এরপর একদিন এই কুমারকে দ্বারী নিয়োগ করে পার্বতী স্নানে গেলেন। ফের শিবের আবির্ভাব। কুমার শিবকে যেতে বাধা দিলেন। রেগে গেলেন শিব। অন্য দেবতাদের সঙ্গে বিবাদ বাধল শিবের। পরে পার্বতীর ইঙ্গিতে যুদ্ধ শুরু হল। ধূর্মবতী স্পষ্ট দেখছেন, বিষ্ণু থেকে শুরু করে সব দেবতা যুদ্ধে হেরে গেলেন। শিবের রাগ কমাতে নারদের পরামর্শে বিষ্ণু কুমারকে মোহাচ্ছন্ন করলেন এবং শিব শূলের দ্বারা তার মস্তক ছিন্ন করলেন। পার্বতী তো এই খবর পেয়ে রাগে কাঁপতে থাকেন। গোটা বিশ্বকে ধ্বংস করতে উদ্যত হলেন। নারদ ও দেবগণ তাঁকে শান্ত করলেন। পার্বতী তাঁর পুত্রের পুনর্জীবন দাবি করলেন। কিন্তু গোল বাধল কুমারের মুণ্ডটি নিয়ে। কোথাও সেটি পাওয়া যাচ্ছে না। শিব তখন তাঁর অনুচরদের উত্তরদিকে পাঠিয়ে দিলেন এবং আদেশ দিলেন, যাকে প্রথমে দেখা যাবে তারই মাথা যেন তারা নিয়ে আসে। অনুচররা তো একটি একদন্ত হস্তিমুণ্ড নিয়ে উপস্থিত হলেনসেই হস্তিমুণ্ডের সাহায্যেই সকল দেবতা কুমারকে জীবিত করে তুললেন। কুমারকে নিজের পুত্ররূপে স্বীকার করে নিলেন শিবতাঁর নাম রাখা হল গণেশ শিব বললেন, সব কাজের আগে এঁর পুজো না করলে কার্যসিদ্ধি হবে না। পার্বতী তার হাতে মোদকপূর্ণ সুগন্ধযুক্ত ভোজনপাত্র তুলে দিলেন। মোদকের গন্ধে ইঁদুর এঁসে জুটল গণেশের কাছে। ইঁদুর গণেশের বাহন হয়ে গেল।

          হঠাত্‍ ঘুম ভেঙে গেল ধূর্মবতীর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন ভোর সাড়ে চারটে। এমন স্বপ্ন দেখলেন কেন? ভাবতে থাকেন ধূর্মবতী। ভোরের স্বপ্ন। স্বপ্নে গণেশের জন্ম। শাশুড়িমাকে কি বলবে? বা রজতশুভ্রকে? না, থাক।

             ধূর্মবতীর সন্তান জন্মের দিন এগিয়ে আসছে। শহরের নামী হাসপাতালে ভর্তি করা হল তাঁকে। স্বামী কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসার। ধূর্মবতী নিজে একটি বড় প্রাইভেট কোম্পানির মোটা মাইনের চাকুরে। সুতরাং শহরের সেরা হাসপাতালেই ভর্তি করা হল। শহরের অন্যতম সেরা গাইনোকলজিস্ট এতদিন দেখেছেন তাঁকে। তিনিই অপারেশন করবেন। সুপ্রকাশ বটব্যালের টকটকে গায়ের রং। মোটা ভুরু। মুখে সব সময় অমায়িক হাসি। সব পেশেন্টকে মেয়ে ডাকেন। হাসপাতালে রাউন্ডে এসে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কী রে মা, আজ কেমন আছিস?

            রজতশুভ্রর মোবাইলে সেদিন রাতের দিকেই ফোনটা এল হাসপাতাল থেকে। মিস্টার পত্রনবিশ, ডক্টর বটব্যাল আপনার সঙ্গে একবার কথা বলবেন।

মিস্টার পত্রনবিশ, আপনি হাসপাতালে চলে আসুন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ধূর্মবতীর অপারেশন করতে হবে। প্রায় ছুটতে ছুটতে রজতশুভ্র হাসপাতালে এলেন। অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ধূর্মবতীকে। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে রজতশুভ্রর কাঁধে একটু চাপ দিয়ে গেলেন ডক্টর বটব্যাল, কাম অন।

টেনশনে বুকটা হাপরের মতো উঠছে-নামছে রজতশুভ্রর। কতক্ষণ যে কেটেছে, কে জানে। হঠাত্‍ই অপারেশন থিয়েটারের দরজাটা খুলে গেল। ওটি নার্স মুখ বাড়িয়ে বললেন, মিস্টার পত্রনবিশ, ভেরি গুড নিউজ। ইউ হ্যাভ আ ভেরি হেলদি বেবি বয়।

বেশ খানিক পরে বেরিয়ে এলেন ডক্টর বটব্যাল। রজতশুভ্রর কাঁধে হাত রেখে বললেন, বেবি একটু অস্বাভাবিক। মানে, আর পাঁচটা বেবির চেয়ে কান দুটো খুব বড়। অ্যান্ড নাকের সামনের দিকটা অনেকটা লম্বা। শহরের নামী প্লাস্টিক সার্জন ইন্দ্রজিত্‍ সর্দারকে আমি রেফার করে দিচ্ছি। উনি আমার খুব ভাল বন্ধু। উনি অপারেট করে দেবেন। নো প্রবলেম।

কিন্তু ডাক্তারবাবু, আমি এই অপারেশনটা চাইছি না। বললেন রজতশুভ্র।

এগজ্যাক্টলি এই কথাটা বলছেন আপনার স্ত্রীও। ওঁকেও বলেছিলাম। কিন্তু উনিও অপারেশন করাতে চান না। আরে, ধূর্মবতী ভীষণ খুশি। নামও নাকি উনি ঠিক করে ফেলেছেন।

কী নাম বলল ধূর্মবতী? ডক্টর বটব্যালকে জিজ্ঞেস করলেন রজতশুভ্র।

গণেশ। ওদিকে ধূর্মবতী ওটি নার্সকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, আমার বেবি কটার সময় হয়েছেন?

নার্স বললেন, ভোর সাড়ে চারটে।

চমকে উঠলেন ধূর্মবতী। তাঁর কানের কাছে খুব আদুরে গলায় কে যেন বলে চলেছে, মা, আমি গণেশ হব।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment