ছবি : ইন্টারনেট |
একটা
প্রেমের গল্প
পার্থ ঘোষ
এই সময়টা ছাদের ওপর একাকী বসে থাকতে বেশ লাগে সৌমর। একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করে
এখানে। চারপাশের শব্দগুলো কেমন স্পষ্ট কিন্তু কেমন যেন একটা দুরত্ব বজায় রেখে ভেসে
আসে। ছাদটা নিস্তব্ধ। ভেসে আসা শব্দগুলো পাখির ডাক, রাস্তা দিয়ে ছুটে যাওয়া যানবাহনের
যান্ত্রিক শব্দ, দূর থেকে ভেসে আসা রেলগাড়ির হর্ণ কিংবা চাকার ঘর্ষণের শব্দ। আবছা ভেসে
আসা মানুষের কথপোকথন। মাথার ওপর দিয়ে ঘরমুখো কাকের ডানায় বাতাস কাটার শন্ শন্ শব্দ।
সময়টা শেষ বিকেল। কিছুক্ষণ পরই নেমে আসবে সন্ধ্যা। গোধূলীবেলা, তবে আজ রঙহীন। আকাশে
হালকা মেঘের আনাগোনা। বাতাসে ঠান্ডা আমেজ।
সদ্য মিটে যাওয়া দোল উৎসব। বসন্ত এসে গেছে। এবার পরিবেশ উষ্ণ হওয়ার অপেক্ষায়। তবুও
শীতের চলে যাওয়া আর গরমের আগমনের মাঝামাঝি এই সময়টা একটু অন্যরকম। সব ক্ষেত্রেই যাওয়া
আর আসার মাঝের সময়টা একটু অন্যরকম হয়েই থাকে, সে পরিবেশের ক্ষেত্রেই হোক বা জীবনের।
অদ্রিজার কিশোরী বয়স বিদায় নেওয়ার সময় আগতপ্রায়। আগত যৌবনের বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে
শরীর মন। আর ছয়টা মাস, তারপরই প্রাপ্তবয়ঃস্ক তকমা ঝুলে যাবে জীবনের ক্যানভাসে।
মনটা কেমন যেন বদলে গেছে সহসাই। একটা অন্য অনুভূতি খেলা করে ফেরে সব সময়। বয়ঃসন্ধি কথাটার মানে বুঝত না আগে। এখন ব্যাপারটার শুধু মানে নয় রক্তে রক্তে
অনুভব করে।
ঘরে ফেরা পাখিগুলো কেমন জোট বেঁধে যায় উড়তে উড়তে। সেদিকে তাকিয়ে মনটা কেন যে
উদাস হয়ে পড়ে ভেবে পায় না অদ্রিজা। নারকোল গাছের কঠিন শরীরে কাঠঠোকরা দম্পতির
একসাথে ঠোক্কর দেওয়া দেখে সেদিকে তাকায় অদ্রিজা। স্বামী-স্ত্রী
পাখি দুটো একজন গাছ বেয়ে ওপরে ওঠে, একজন নামে। ওদের নামা ওঠা দেখে নারকোল গাছে যারা
নারকোল পাড়তে ওঠে তাদের কথা মনে পড়ে। একই ভাবে
পাখি দুটোও ওঠা নামা করে। মাঝে মাঝে ঠোকর দিয়ে গর্ত করতে চায় গাছের শরীরে। হঠাৎই ডেকে ওঠে ওরা, অদ্ভুত স্বরে। চমকে
ওঠে অদ্রিজা। উদাস হয়ে ওঠে অদ্রিজার মন। মনটা কেমন অসুখী যেন? অদ্রিজা মনের ভাসা বুঝতে পারে না। মন বড়
চঞ্চল। কথা শোনে না।
সৌমর মনটা বিদ্রোহ করতে চায়। একঘেয়ে নিয়মকানুন সব কেমন সেকেলে লাগে। ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে নতুন করে কিছু তৈরি করতে। আঠারো পেরিয়েছে ছয় মাস। নিজের ছাড়া অন্যের কথা কেমন যেন জ্ঞান বলে মনে হয়। সবাই কেমন যেন বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাবে বোঝাতে চায়। ওর মনে হয় ও কি কচি খোকা? কিছুই বোঝে না? এতো জ্ঞান ওর ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে করে। মনে হয় সব কিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে ওই ঘরে ফেরা একাকী কাকের মত। কাকের পাখায় ভর করে সন্ধ্যা নামে আস্তে আস্তে। ছাদ থেকে অনেক নীচের পাঁচিলে কালো বেড়ালটা গুটি গুটি পায়ে এগোয়। ওপাশের বাড়ির ছাদে অদ্রীজার কালোচুলের মত সন্ধ্যা ঘণায় প্রকৃতির বুকে। অদ্রিজার বুকের ওড়না খসে দমকা হাওয়ায়। অভ্যস্ত হাত সেই ওড়না স্বস্থানে তুলে নেয়। লজ্জা হারায় সাঁঝের আঁধারে। নীচু স্বরে ভেসে আসে – আমি ঘরে চললাম।
- আমারটা দিয়ে যাও।
- না! প্রতিদিন নয়। মুখে বলেও জিব ভেঙচে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দেয় অদ্রিজা। দৌড়ে পালায় ছাদ থেকে।
সৌম্য মুঠোয় ধরে কাল্পনিক চুমু প্রতিদিনের মত। চেঁচিয়ে বলে
– ডিউ রইল এটাও। শোধ করব একসাথে।
(২)
অদ্রিজার সঙ্গে পরিচয় ছিল আগেই। সৌম্যদের বাড়ির পড়ে একটা সরু সিমেন্ট বাঁধান গলিপথ।
যে গলিপথ শেষ হয়েছে রজত কাকার বাড়ির দরজায়। এককথায় গলিটা কানা। কানাগলি বলতে যা বোঝায়,
সেরকমই। কানা গলি মানে যে গলিতে ঢোকার পথ আছে, বেরোবার পথ নেই। প্রেম মনে হয় এরকম গলিতেই
মাখোমাখো হয়। “সেই গলিতেই ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে দেখি, বন্ধু সেজে শত্রু আমার দাঁড়িয়ে
আছে একি!”
সেই গলির অপর পাড়ে, অর্থাৎ সৌম্যদের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে মুখোমুখি ভাবে যে বাড়িটা
আছে, সেটাই অদ্রিজার বাড়ি। ছাদে ওঠার ব্যাপারটা অদ্রিজা বা সৌম্যর কারোরই সেভাবে ছিল
না। ছাদ বলে যে একটা ব্যাপার আছে, সেখানে উঠেও যে অনেক কিছু অনুভব করা যায়, যেখানে
দাঁড়িয়ে মাথার ওপরের আকাশটাকে উল্টোনো গামলার মত মনে হয়; কিংবা ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে ওপরের
নীলাকাশের তিনশো ষাট ডিগ্রী এঙ্গেল অনুভব করা যায়, সেটা কেউই সেভাবে উপলব্ধি করতে পারত
না। যেভাবে সেসব দিনে পারত।
ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখা একটা সুন্দর অনুভূতি। আকাশেরও যে কতরকম রঙ বদল হয়, আকাশও
যে কতভাবে সাজতে পারে, কিংবা আকাশেরও যে আনন্দ হয়, দুঃখ হয় সে আগে বোঝার কোন উপায়ই
ছিল না। কোন আকাশ কথা বলে, কোন আকাশ দুঃখে কাঁদে, কোন আকাশ আনন্দে হাসে কিংবা কোন আকাশকে
ফালা ফালা করে অশনি সংকেত সেসব যারা রাতের আকাশে কালপুরুষ বা সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখে বেড়ান,
একমাত্র তাঁরাই জানতেন, আর সাধারণ মানুষ জানত – আকাশ মানে প্লানেটোরিয়ামের ছাদ। আসলে
যে জিনিস জন্ম থেকে দেখতে দেখতে একঘেয়ে হয়ে যায়, তার দিকে কেউ তাকায় না, তাকে জানতেও
চায় না।
সেই আকাশকেও সবাই জানতে শিখল। ছাদকেও সবাই আপন করে নিতে শিখল। ছাদে ছাদে সেই সময়
কত কাহিনীর জন্ম হল। কত কথা, কত রাগ, অভিমান, পরকীয়া বা পরনিন্দা পরচর্চা অর্থাৎ পিএনপিসি-র
জন্ম হল সে আর এক কাহিনী। সেসব নিয়ে লিখতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে।
অদ্রিজা আর সৌম্যর প্রেম জমাট বেঁধেছিল সেই সময়েই । প্রেম হয়ত এমনই। প্রেমের কোন স্থান কাল নেই। প্রেম শ্মশানেও হতে পারে, আবার প্রেম
যুদ্ধক্ষেত্রেও হতে পারে। প্রেম হতে পারে সারিসারি মৃতদেহের মধ্যে কিংবা প্রেমের
অঙ্কুর জন্ম নিতে পারে মহামারী বা অতিমারীর ভয়ংকর বাতাবরণে। অদ্রিজা আর সৌম্য এমনই
এক অতিমারীর পটভূমিকায় প্রেমে পড়ে গেছিল একে অপরের। তখন সারা পৃথিবীকে কোভিড তার
কালো চাদরে ঢাকা দিয়ে দিয়েছে। চারিদিকে শুধু মৃত্যুর গন্ধ। হাহাকার আর কান্নার
শব্দ। একাকীত্ব আর ভেঙে যাওয়া সংসার, হারিয়ে যাওয়া প্রেমের মাঝে মৃতদেহের মিছিল।
সম্পর্কের মৃত্যু, ভয়ের বাতাবরণ, মানুষ ঘরবন্দী। পশুরা অনাহারে ক্ষুধার্ত। রাজপথে
বেজে ওঠা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেণ, ‘পাড়ের
তরী’ শ্মশান যাত্রার গাড়ির তীক্ষ্ণ হর্নের শব্দ আর রাতচোরা জন্তুদের অবাধ বিচরণ
শুনশান রাস্তার প্রাগৈতিহাসিক পটভূমিতে।
সৌম্য এমনই এক গোধুলি লগ্নে প্রপোজ করেছিল অদ্রিজাকে – আমি কি তোমার মন পেতে
পারি?
সেদিন সেইসময় আকাশ থেকে চুঁইয়ে পড়া গোধূলি বেলার মনমড়া হলদে আলো যেন অদ্রিজার মুখে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল সৌম্যর
মুখ নিঃসৃত শব্দের বহিঃপ্রকাশে। কেঁপে উঠেছিল কিশোরীর শরীর। দেহের মধ্যে ঝরণা ঝরে
পড়তে শুরু করেছিল। এরকম একটা ভালো লাগা ক’দিন ধরে যে অদ্রিজার মনের ভেতরেও
বুদবুদাকারে গেঁজিয়ে উঠছিল, কিন্তু বাঙালি মেয়ের লাজ-লজ্জা আধুনিকা নারীকেও বোবা
করে দিতে বাধ্য থাকায় সেই গেঁজিয়ে ওঠা গ্যাঁজলার বহিঃপ্রকাশ হতে না পেরে, মনের চার
দেওয়ালের মধ্যেই ধাক্কা খেয়ে ফিরছিল অতিমারী আক্রান্ত পৃথিবীর দিন রাত্রির
রোজনামচার সাথে সাথেই।
আদ্রিজা সেদিন দৌড়ে পালিয়েছিল ছাদ থেকে। আর তারপর পরই ওর হাতের স্পর্শ ফোনের পর্দায় দেখেছিল সৌম্যর নাম ও ফোন নম্বর। ভলিয়্যুম কি চিপে ফোনটা সাইলেন্ট করে ফোন নিয়েই বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছিল অদ্রিজা। দেয়ালে পিঠ চেপে ধরে ফোনটা পায়রার শরীরের মত নরম ও গরম কিশোরী বুকে চেপে ধরে তিরতির করে কেঁপেছিল। ফোনটা বেজে যাচ্ছিল। অদ্রিজার শরীরে কোথাও জলপ্রপাত ঝরে পড়ছিল অঝোর ধারায়। ফোনটা একসময় বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অদ্রিজা ফোনটা নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছিল বোতাম টিপে। অনুভব করেছিল কপালে, ঠোঁটের ওপরে, ক্লিভেজে আর দুই উরুর সন্ধিক্ষণে ঘাম জমেছে বিন্দু বিন্দু। কোমল বুকের ভেতর থেকে হৃদপিন্ডটা যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে জোরে জোরে কাঁপতে কাঁপতে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভেবেছিল – এরপর কি উত্তর দেবে সৌম্যকে? চমক ভেঙেছিল রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া অ্যাম্বুলন্সের হুটারের বিকট শব্দে – আবারও কেউ অতিমারী আক্রান্ত হয়ে চলে গেল নিরুদ্দেশের পথে। অদ্রিজা নিজেকে সামলে স্নানঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের স্টাডিতে ঢুকে বসেছিল দু’হাতের ওপর মাথা রেখে টেবিলের ওপরে কনুইয়ের ভর দিয়ে।
(৩)
পাড়ায় যেদিন বিকেলে খবরটা এলো, অংশুকাকু আর নেই, সেদিনই সকালে স্নান শেষে ছাদে
জামাকাপড় শুকোতে দিতে গিয়ে সৌম্যর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এর মাঝে দিন তিনেক সময় পার
হয়ে গেছে। সেদিন সৌম্যর মুখোমুখি হতেই সৌম্য প্রতিদিনের মত জিজ্ঞেস করেছিল ঈশারায়
তার প্রশ্নের জবাবটা কি? অদ্রিজা সেদিন নিজেকে তৈরি করেই এসেছিল। সৌম্যর চোখে চোখ
রেখে দড়িতে মেলা কাপড়ের আড়াল থেকে শুধু মুখটা বার করে জিব ভেংচে বলেছিল – প্রেম
করার খুব সখ? তা, উত্তর জানার আর কি আছে? আমি কি মন দেব না বলেছি? – কথাটা বলেই
কাপড়ের আড়ালে নিজেকে আড়াল করে দৌড়ে নেমে গিয়েছিল ছাদ থেকে। সৌম্য অদ্রিজার মুখ
দেখতে পায়নি, শুধু দুটো আলতা পড়া ফর্সা পা যুগলকে নুপূর নিক্কন ছড়িয়ে চলে যেতে
দেখেছিল। সৌম্য ইয়াঃ! শব্দ করে দু’হাত তুলে লাফিয়ে উঠেছিল। ছাদের ওপর লাফালে ঢক্
করে একটা আওয়াজ ওঠে। সেই আওয়াজ ছড়িয়ে গিয়েছিল নিচের তলা পর্যন্ত। সৌম্যর
হৃদপিন্ডটাও যেন লাফিয়ে উঠেছিল ওর সঙ্গে। ওদের প্রেম স্বীকৃতি পেয়েছিল।
অতিমারী তখন একে একে ধ্বংস করছিল প্রেমের সম্পর্ক গুলোকে। গৃহবন্দী মানুষের তখন একটাই ঠিকানা – বাড়ির ছাদ। যাদের ছাদ নেই তাদের ঠিকানা উঠোন। তবে সব কিছুই দুরত্ব রেখে। ছাদ এমনই একটা মাধ্যম হয়ে উঠেছিল, যেখান থেকে মানুষের সঙ্গে মানুষ মেলামেশা করতে পারত, কিন্তু জড়াজড়ি করতে পারত না। ফলে যেসব প্রেম ছাদে ছাদে সংঘটিত হয়ে উঠেছিল তারা কথা বলে মনের খিদে মেটাতে পারলেও শরীরের খিদে মেটাতে না পেরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল নিজ নিজ ভালোবাসার মানুষদের নিয়ে। স্বপ্নে তারা মিলিত হতে শুরু করেছিল একে অপরের সঙ্গে । সেই সময় সারাদিন শুয়ে বসে ঘরের মধ্যে কাটাতে কাটাতে ঘুম ব্যাপারটা অনেকটাই কম হচ্ছিল সবারই । তাই পাতলা ঘুমের মাঝে নানান স্বপ্নরা এসে ভীড় করছিল প্রেমিক প্রেমিকার চোখের পাতায়। এতো প্রেমের মধ্যে পরকীয়াও থাকত কিছু কিছু, যেমন সৌম্যর পাশের বাড়ির রত্না কাকিমার সাথে গলির মুখের স্বজল কাকার পরকীয়া জমে উঠেছিল। রত্না কাকিমার স্বামী কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরতে না পারার কারণে আর স্বজল কাকার স্ত্রীর বাপের বাড়ি থেকে নিজ সংসারে এসে পৌঁছতে না পারার কারণে। সেই সময় পরিবহন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ থাকার কারণে যারা বাইরে ছিল তারা ফিরে আসতে পারেনি নিজ নিকেতনে। তাছাড়াও সতর্কীকরণ অনুযায়ী ওই সময় কেউ স্থান ত্যাগ করতে পারছিলেন না। কেউ যদি কোন জায়গা থেকে অপর জায়গায় চলে যেতেন তবেই পাড়ার লোক তাঁকে ধরে প্রশাসনের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। সবাই মৃত্যুভয়ে কাতর হয়ে নিজেকে বাঁচাতে, নিজের পরিবারকে বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এমত সময়ে একমাত্র প্রেম আর মৃত্যু নিজ নিজ কর্মে আসীন হয়েছিল চিরকালের প্রথা মেনে। পালপাড়ার ঠাকুরগলির সেই কানাগলিতেও তাই প্রেম আর মৃত্যু পাশাপাশি এগিয়ে চলেছিল হাত ধরাধরি করে। তাই প্রেম সংঘটিত হয়েছিল সৌম্য আর অদ্রিজার, পরকীয়া প্রেম গড়ে উঠেছিল রত্না কাকিমা আর স্বজল কাকার ওদিকে গলির অংশুকাকা মারা গিয়েছিল । তার মৃতদেহ আর তার পরিবার দেখতে পায়নি। সে সময় এমনই নিয়ম ছিল। করোনায় মৃত্যু হলে সে শরীর আর বাড়ি ফিরবে না। ছাদে প্রেম আর মাটিতে মৃত্যু। এভাবেই কেটেছিল জীবনের অভিশপ্ত সময়।
৪
তবে সৌম্য আর অদ্রিজার প্রেম পেকে উঠলেও পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে,
অতিমারীর অতিশয় প্রকোপের নিবৃত্তির সাথে সাথে রত্না কাকিমা আর স্বজল কাকার পরকীয়া
কিন্তু চাপা পড়ে গিয়েছিল সাধারণ ভাবেই, রত্না কাকিমার স্বামী আর স্বজল কাকার
স্ত্রী বাড়ি ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই।
সেই থেকেই ছাদের প্রতি একটা ভালোবাসা জন্মে গিয়েছিল সৌম্যর। সেই করোনা কালে
সারাদিন ছাদে থাকতে থাকতে সে আবিষ্কার করেছিল প্রকৃতির নগ্ন রূপ। দেখেছিল বিশাল
আকাশে কত রকমের পরিবর্তন হয়। পুর্নিমায় একরকম, অমাবস্যায় একরকম। ছাদের ওপর থাকলে
প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলা যায়। একটা আলাদা অনুভূতি একটা আলাদা আনন্দ ভর করে থাকে
মনকে।
তারপর কেটে গেছে পাঁচটা বছর। স্বাভাবিক ভাবেই সম্পর্কের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেছে দুই বাড়িতে। এখন
অতিমারী চলে যাওয়ায় ছন্দে ফিরে আসা জীবনযাত্রায় মেলামেশা বা দেখা স্বাক্ষাৎ হয় দু’জনের বাড়ির বাইরে। কখনও কখনও একে অপরের
বাড়িতেও চলে যায়। একসঙ্গে ওরা ছাদেও কাটায় এক এক সময়। সৌম্য অদ্রিজাকে আকাশ দেখতে
শিখিয়েছে, শিখয়েছে প্রকৃতিকে দেখতে । অদ্রিজা সৌম্যকে শিখিয়েছে প্রকৃতির শরীরে কি
ভাবে হারিয়ে যেতে হয়, কিভাবে প্রকৃতিতে মিশে যেতে হয় সোঁদা গন্ধের ঘ্রাণ নিতে
নিতে। সৌম্যকে বুঝিয়েছে অদ্রিজা মেয়েরাই প্রকৃতি, মেয়েরাই ধরিত্রী, মেয়েরাই আবাদী
জমি। সৌম্য এখন চাকরি করে সেক্টর ফাইভে। অদ্রিজাও চাকরি করে এক ট্যুর কোম্পানীতে।
আর কিছুদিন পরই ওদের প্রেমের বলিদানের দিন আসছে। সব ঠিক হয়ে গেছে। শুধু
দিনক্ষণের শুভক্ষণে চার হাতের মিলন হতে যতক্ষণ। তাই এখন ওদের আর দেখা স্বাক্ষাৎ হয়
না। দুই বাড়ি থেকেই বলে দিয়েছে, বিয়ের আগে আর ঘোরাঘুরি নয়। যা হবে আবার বিয়ের পরে।
তাই এখন ওরা রেস্টুরেন্টে যায় না, যায় না মাল্টিপ্লেক্স বা ক্যাফেতে কিংবা পার্কে।
এখন ওরা ছাদেই দেখা করে। ছাদ থেকে ছাদে উড়ন্ত চুমু দেওয়া নেওয়া করে। শরীরের ভেতরের
আগুনটাকে ছাই চাপা দিয়ে ধিকিধিকি করে জ্বালাতে থাকে সেদিনের জন্য, যেদিন ফুলের
সজ্জায় দাবানল লাগবে শরীরে শরীরে, মনে মনে, রক্তবাহী শিরা থেকে ধমনীতে।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment