1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 2, 2024

সহাবস্থান

ছবি  : ইন্টারনেট

সহাবস্থান

উত্তম চক্রবর্তী

একজন খাস বাঙ্গাল, ঢাকার লোক। আরেকজন খাস ঘটি, হুগলীর লোক। দুজনেই মাঝবয়সী, মানিকতলার একই সোসাইটিতে ফ্লাট নিয়েছেন। এখন দুই প্রতিবেশী ভদ্রলোক ভাল বন্ধু আবার সাথে সাথে দুই জন দুই জনের ভাল শত্রু বললেও ভুল হবে না। বাঙ্গাল অনিল চক্রবর্তী চাকরি করেন রাইটার্সে, সেচ দপ্তরে। আর ঘটি জীবন দাস চাকরি করেন রেলে, কয়লাঘাটা অফিসে। অনিল চক্রবর্তী বিয়ে করেছেন এদেশি মেয়ে মুক্তা ঘোষালকে। আর জীবন দাস ভালবেসে বিয়ে করেছেন বাঙ্গাল ব্রাহ্মণের মেয়ে দূর্বা ভটচায্যিকে।

দুই বন্ধু প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় একজন আরেক জনের বাড়িতে গিয়ে বেশি রাত পর্যন্ত তাস খেলে আড্ডা মেরে সময় কাটায়, আবার প্রায়ই রবিবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত দুজন দাবার বোর্ডে বসে সময় কাটায়। এই খেলার ফাঁকেই ফাঁকেই দুজনের মধ্যে চলে যত রাজ্যের রাজনৈতিক, সামাজিক, সিনেমা, থিয়েটার বা ঘরোয়া বিষয় নিয়ে আলোচনা সমালোচনা। সেখানে মতান্তর হলেই তর্কাতর্কী আর তুমুল ঝগড়া। দুজনের স্ত্রী এসব দেখে দেখে কেবল হাসে আর নিজেদের মধ্যে দুই বন্ধুর ভাব আর ঝগড়া নিয়ে মজার মজার গালগল্প করে। গিন্নিদের দুজনের মধ্যে কিন্তু কখনই ভাব ছাড়া ঝগড়ার ঝ পর্যন্ত দেখা যায়নি।

এ হেন বাঙ্গাল আর ঘটির মধ্যে প্রায়ই আর পাঁচটা বাঙ্গাল ঘটির প্রিয় বিষয়ের মত ইলিশ - চিংড়ি আর ইষ্ট বেঙ্গল - মোহন বাগানের খেলা নিয়ে ঝগড়া প্রায়ই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। তখন ওঁদের স্ত্রীরা এসে হস্তক্ষেপ করে স্বামীদের ঝগড়া থামায়। এটা এখন এই ফ্লাট বাড়ির অন্য দশ জন বাসিন্দারাও জেনে গেছে এবং সোসাইটি হলের ছুটির দিনের আড্ডায় তাদের মধ্যে কেউ কেউ এদের এই নিয়ে টিটকারি দিতে ছাড়ে না। কিন্তু অনিল বাবু বা জীবন বাবু এসব হেসে উড়িয়ে দেন। আবার দুজন দুজনের বাড়িতে গিয়ে তাস বা দাবা খেলতে বসে পরেন।

সেদিন ছিল রবিবার সকাল। দুজন একসাথে বাজার করে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে ফিরছিলেন। হঠাৎ অনিল বাবু বাড়ির মেয়েদের একটা গোপন কথা বন্ধুকে বলে বসলেন, ‘আরে জীবন বাবু বুঝলেন, এই ঘটি বাড়ির মেয়েরা ভীষণ হিংসুটে হয় মশাই। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি আমার স্ত্রী মুক্তা এই আপনার স্ত্রী কী রান্না করল, কী শাড়ি কিনল, কোথায় কোথায় বেড়াতে গেছে এই সব নিয়ে প্রায়ই খুব শোনায় আমাকে। এমন ভাবে বলে যেন আমি কিছুই করিনি ওর জন্য, কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাইনি। মানে আমার এখন মাঝে মাঝে মনে হয় কেন যে ঘটির মেয়ে বিয়ে করতে গেলাম ? একটা বাঙ্গাল ঘরের মেয়ে আনলেই বোধ হয় ভাল ছিল।’ 

জীবন বাবু ‘ঘটির বাড়ির মেয়েরা হিংসুট হয়’ শুনেই মনে মনে খুব রেগে গেছিলেন। তার মানে কি ওর মা , দিদি, বোন বা কাকা কাকীমা জ্যাঠা জেঠিমা সবাই হিংসুটে ? রেগে গিয়ে বললেন, ’আরে মশাই আপনাদের বাঙ্গাল বাড়ির মেয়েরাই বা কোন ভাল শুনি। এই তো আমার স্ত্রী দূর্বা, খালি আমার ভুল ত্রুটি ধরবে আর সারাদিন খীট খীট করবে। যেন আমি কোন কাজই সঠিক ভাবে করতে পাড়ি না। সবেতেই আমার দোষ ত্রুটি খুঁজে বেড়াবে। জীবনটা একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে গেল মশাই। কোন কুক্ষণে যে দূর্বার প্রেমের জালে ফেঁসে গেছিলাম, আজ আফশোশ হয় মশাই।’

এই দুই বন্ধুর এই মনে কথা কারোরই পেটে বেশিক্ষণ চাপা থাকল না। বাড়ি ফিরে দুজনেই খাবার টেবিলে গল্প করতে করতে মুক্তা আর দূর্বার কানে আরেক জনের মনের দুখের কথা জানিয়ে দেয়। নিজেদের কথা কিন্তু কেউই বলেনি। মুক্তা বা দূর্বা দুজনেই সব শুনে স্বামীর বন্ধুর উপর রেগে কাই হয়ে যায়, কিন্তু মুখে কিছুই বলেনা। ঘটির মেয়ে মুক্তা রেগে যায় ঘটি জীবন বাবুর উপর আর বাঙ্গাল মেয়ে দূর্বা রেগে যায় বাঙ্গাল অনিল বাবুর উপর। দুজনেই ভাবে ‘জাত তুলে কথা বলেছে ! এর একটা বিহিত করতে হবে। কী বলেছে না বলেছে সেটা বড় কথা নয়, জাত তুলে কথা বলার সাহস কোথায় পায় এরা ? দূর্বা ভাবে আসুক অনিল বাবু ওঁদের বাড়িতে। ধনে পাতার বড়া, পাট পাতার বড়া দিয়ে রস করে চায়ের সাথে রসের আড্ডা বের করছি। এক কাপ চাও পাবেনা এরপর থেকে। আর মুক্তা ভাবে আসুক জীবন বাবু এই বাড়িতে, চায়ের সাথে চিংড়ি মাছের বড়া, প্লেটে করে মোচার ঘণ্ট এসব এবার বন্ধ হয়ে যাবে। এখন থেকে ওঁকে এক কাপ চাও খাওয়াব না। খালি মুখেই বন্ধুর সাথে আড্ডা মারবে দুজন।

সেদিন রবিবার সন্ধ্যায় অনিল বাবু এলেন জীবন বাবুর বাড়ি। বৈঠকখানা ঘরে দুজন দাবার বোর্ড নিয়ে খেলা শুরু করে প্রায় আধ ঘণ্টা খেলেছেন, কিন্তু তখনো কোন চায়ের দেখা নেই। জীবন বাবু তার একমাত্র মেয়ে জলিকে ডাকলেন, জলি, মাকে বলতো সামনের ঘরে চা দিতে। নিজের ঘর থেকে দশ বছরের জলি বেরিয়ে এসে বলল, ‘বাবা, মাতো ঘরে নেই, আনটির বাড়িতে গেছে।’ আসলে দূর্বা অনিল বাবু ঘরে ঢোকার পরেই ওঁদের ফাঁকি দেবার জন্য বেরিয়ে চলে গেছে পাশের মুক্তার ফ্ল্যাটে। সেখানে গিয়েই দু বন্ধু তাদের কর্তাদের সকালের আলোচনা শেয়ার করে শুধু কর্তাদের জব্দ করবার প্লানই করল না, ওঁদের কীভাবে বৌদের কাছে মাথা নত করাতে হয় তারও ফন্দি করছিল তখন।

অনিল বাবু বিনা চায়ে আরও কিছুক্ষণ দাবা খেলে উঠে চলে গেলেন। জীবন বাবুর মূডটাও অফ হয়ে গেছিল দূর্বা বাড়িতে নেই শুনেই। একবার বলে পর্যন্ত গেলো না ! অনিল বাবুকে খালি মুখেই বাড়ি ফিরতে হল, ছিঃ। এদিকে অনিল বাবু বাড়িতে এসে দেখেন আট বছরের ছেলে টুকাই বসে টি ভিতে পোকেমণ দেখছে আর ওঁদের বেডরুমে বসে দুই বান্ধবী আড্ডা মারছে। অনিল বাবু ফিরে এসেছে বুঝতে পেড়েই দূর্বা চলে গেল নিজের ফ্ল্যাটে।

ফ্লটে গিয়েই দূর্বা চেপে ধরে জীবন বাবুকে, ‘তোমার বন্ধু কী বলেছে সেটা তো খুব বললে আমাকে, আর তুমি নাকি বোলেছ যে আমি তোমার সব কাজেই ভুল ধরি, তোমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছি আমি ! কোথায় সেই কথাটাই তো বলোনি আমাকে। বাঙালের মেয়ে বিয়ে করে এখন খুব পস্তাচ্ছ না ? আমি সব শুনেছি তুমি কী বলেছ আমার ব্যাপারে। তোমার লজ্জা লাগে না। নিজের বৌয়ের নিন্দা করেছ বন্ধুর কাছে। ছিঃ, আমি কালকেই জলিকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাব। থেকো তুমি তোমার ঐ বন্ধুকে নিয়ে। দেখব তখন কে রান্না বাণ্ণা করে খাওয়ায় তোমাকে। খাবার বেলায় তো এই বাঙালের মেয়ের রান্না চেটে পুটে খাও, খালি বল আরেকটু দাও আরেকটু দাও। এবার কী কর আমি দেখব।‘রাগে গজ গজ করতে করতে নিজের ঘরে গিয়েই দরজা আঁটকে দেয় দূর্বা। 

ওদিকে অনিল বাবুর অবস্থা আরও খারাপ তখন। দূর্বা চলে যাবার পর মুক্তা সেই যে দরজা আঁটকে ঘরে বসে আছে, আর দরজা খুলছে না। অনিল বাবু নিজে এবং ছেলে টুকাইকে দিয়ে বেশ কয়েকবার দরজা খুলবার জন্য কাকুতি মিনতি করলেন, কিন্তু গিন্নির তাতেও রাগ কমলো না। ভিতর থেকেই চেঁচিয়ে বলল, ‘কেন, এখন আমি কেন ? যাও না, আজ রাতে তোমার ঐ ঘটি বন্ধুর বাঙ্গাল বৌয়ের হাতের রান্না খেয়ে এসে সামনের ঘরের সোফায় ঘূমাও গিয়ে। আমি খাবোও না, দরজাও খুলবো না। টুকাই আর তুমি চলে যাও তোমার বন্ধুর বাঙ্গাল বৌয়ের কাছে। আমি তো ঘটি বাড়ির মেয়ে না। আমি হিংসা করি, আমি ঈর্ষা কাতর।’

অনিল বাবু চমকে উঠলেন। কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে। জীবন ওর বৌকে সব বলে দিয়েছে। তার মানে এখন দুজনেই জেনে গেছে আজ সকালে কে কি বলেছে। আর এই জাত তুলে কথা বলেছে বলেই বোধ হয় এরা রেগে কাই হয়ে আছে। আজ ও বাড়িতে এক কাপ চাও খাওয়ায় নি। ঈশ তখনই বোঝা উচিত ছিল সব। অনিল বাবু গুম মেরে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। টুকাই টি ভি দেখা বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে গেছে। অনিল বাবু ভাবছেন এখন কীভাবে সামলাবেন বৌকে। টুকাই বারান্দায় গিয়ে মার কাছ থেকে বুদ্ধি নিয়ে আসে। মুক্তা ছেলেকে ফিস ফিস করে বলে, ‘বাবাকে বল মার কাছে মিথ্যা কথা বলার জন্য ক্ষমা চাও বাবা, নইলে কিন্তু আজ না খেয়েই শুতে হবে। আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে বাবা। জা জা , গিয়ে বাবাকে অতিষ্ঠ করে টোল। আমি কিছুতেই দরজা খুল্ব না জতক্ষন না তোর বাবা আমার কাছে মাফ চাইবে। যা, গিয়ে বল বাবাকে। আমার কথা আবার বলিস না যেন।‘ টুকাই ঘাড় নেড়ে সামনের ঘরে ফিরে যায়।

অবশেষে দুই বন্ধু তাদের বৌদের কাছে রিতিমত ক্ষমা চেয়ে তার পর দরজা খোলায় আর রাতের খাবার পায়। দুজনেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে আর কোনদিন বৌদের বিষয়ে আরেকজনের কাছে কিচ্ছু বলবে না। এবার যদি আর কিছু বলে তাহলে ওদিকে জীবনের বৌ দূর্বা আর এদিকে অনিলের বৌ মুক্তা সোজা বাপের বাড়ি চলে যাবে ধমকি দিয়ে রেখেছে। শেষ খবর পাওয়া অবধি জানা গেছে যে দূর্বা আর মুক্তা বহাল তবিয়তে তাদের কর্তাদের উপর রাজ করছে। অনিল আর জীবন বাবু তাস খেলে, দাবা খেলে, কিন্তু বৌদের সম্পর্কে নিন্দা করে ওদের মন নিয়ে আর কোনদিন ছিনি মিনি খেলেনি। জীবনে দুই মেরুর দুইজন স্ত্রীলোককে বিয়ে করে সহধর্মিণী করবার পর এতোদিনে ওদের শিক্ষা হয়েছে যে ঘরের গোপন কথা বাইরে না বলে ঘরেই সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। আমাদের জীবনে অনেক সময় অনেক কিছু এডজাস্ট করে চলতে হয়, মেনে নিতে হয়। আর তারই নাম হল সহাবস্থান।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment