1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 2, 2024

মোমবাতির ছায়া

ছবি  : ইন্টারনেট

মোমবাতির ছায়া

পিনাকী চক্রবর্তী

বাস থেমে  যেতেই, ব্যাগ নিয়ে পিয়ালী গ্রামের মেঠো পথে  নেমে  পড়ল। সামনে মাঠ,  সবুজের কার্পেটে পা রেখে এগিয়ে  যেতেই, মাত্র সাত মিনিট বাদে একটা পুকুর দেখা যাচ্ছে। তার পাশ দিয়ে হেঁটে  একটা ভাঙা  দ্বোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। ঘড়িতে  বেলা সাতটা। শীতের রোদ উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। 

পিয়ালী  উঠানে দাঁড়িয়ে বলল- কেউ আছেন?

উঠান ছড়ানো  রোদ, বাড়ির পরিবেশ জুড়ে একটা অদ্ভুত নীরবতা।

একজন  বয়স্ক লোক  বেড়িয়ে এসে  ভাঙা গলায় বলল- ঠিক চিনলাম না মা, তুমি কে?

পিয়ালীর  বুকটা ছ্যাঁত করে  উঠল!

এই অপরিচিত মানুষটাকে সে নিজেও চেনেনা।  তাহলে  ভুল  ঠিকানায় এসেছে? পিয়ালী এখানে এসেছে যার সাথে দেখা করবে বলে, তার পরিবর্তে সামনে দাঁড়িয়ে আছে অপরিচিত বছর ষাটের বৃদ্ধ ।

পিয়ালী মনে মনে বলল -  চিঠি এই ঠিকানা থেকেই আসতো। বাইরে পাথরের উপর স্পষ্ট  ঠিকানা লেখা রয়েছে।

মুখে অস্থিরতার ছায়া, পিয়ালী বলল

-আমি কলকাতা  থেকে  এসেছি।  অভিজ্ঞান বাবুর খোঁজ  করতে।

লোকটি  হেসে  বলল – বুঝেছি। মা, সন্ধ্যায় দেখা  হবে। এখন সে  নেই।

পিয়ালীর বিরক্তি বোধ হচ্ছিলো। বলল

-আমি রাতের ট্রেনেই  কলকাতায় ফিরে যাবো  মেসোমশাই। এখানে থাকবার জায়গা হবে, মানে গেস্টহাউস।

লোকটি হেসে বলল

-মা, যদি  কিছু  মনে না  করো, এই বাড়িতেই থাকো। দুপুরে এখানেই খাওয়া দাওয়া  করবে। সে  বিকেলের দিকে  আসবে।

পিয়ালীর হাতে অপেক্ষার বিকল্প কোন রাস্তা নেই। যেই উদ্দেশ্যে এসেছে, তার সাথে বিকেলের আগে দেখা হবে না। পিয়ালী বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল, পুরানো বাড়ি, দ্বোতলা। ছাদটা ন্যাড়া, এই বাড়িতে মানুষজন তেমন একটা থাকে না। স্যাঁতস্যাতে সিঁড়ি পেড়িয়ে, পিয়ালী একটা ঘরে ঢুকল; নোংরা অগোছালো ঘর। বাইরে দিনের আলো খুব একটা ঢোকেনা। ঘরের ভিতর গিয়ে, খাটের উপর বসল। মনে মনে বলল - কয়েক ঘন্টা মাত্র, ঠিক কেটে যাবে ।

পিয়ালী জানালার শিকে হাত রেখে  অতীতের  বহু  কথা মনে  করছিল। অনেকক্ষণ বিছানায় বসে বসে কোমর ব্যাথা হয়ে গিয়েছে। জানালার ধারে এসে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় তিরিশ মিনিট;  স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ,   পিয়ালী সেন খেয়াল করেনি ঘড়ির কাঁটা দ্রুত এগিয়ে চলেছে!  ঘড়িতে বেলা চারটে। সে খেতে না চাইলেও , বুড়ো লোকটাকে ঘরেই খাবার দিয়ে গিয়েছে। পিয়ালী ইদানিং নিরামিষ খায়। ইসকনের থেকে দীক্ষা নিয়েছে।

অনেক স্মৃতিই ভাসছে, পিয়ালী যেই মানুষটার জন্য এই এতদূর ছুটে এসেছে, তারসাথে কলকাতায় আলাপ। যেই চাকরিটা পিয়ালী এখন করছে, সেই প্রাইমারি স্কুলের চাকরির জন্য অনেক আন্দোলন করতে হয়েছিল। তখন সবেমাত্র পিয়ালীর প্রেম ভেঙেছে।

একটা কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনীতে  কাজ করা; গ্রামের বাইক চালানো ছেলেটির সাথে  প্রেম হয়েছিল পিয়ালীর। সেই প্রেম বিয়ে অবধি এগিয়ে যায়নি। প্রেম অবশ্য শুরু হয়েছিল যখন পিয়ালী প্রাইমারি স্কুলের পরীক্ষায় বসবে  বলে টিচার্স ট্রেনিং নিচ্ছিলো। প্রেম পর্ব প্রায় তিন বছর চলেছে। তারপর আচমকাই রোগা, ময়লা রঙের কৃষক পরিবারের মেয়ে পিয়ালীকে , ছেলেটি অপমান করতে শুরু করল,। বাইক চালানো  কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি করা ছেলেটির অপমানের  যন্ত্রণায় পিয়ালী সম্পর্ক ভাঙতে বাধ্য হয়।

পিয়ালীর জীবনে আসে অভিজ্ঞান। তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক কতদূর এগিয়েছিল , তা হচ্ছে তর্কের কথা। সদ্য প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার যন্ত্রণা ও চাকরি পরীক্ষার জন্য প্রতিদিন আন্দোলন করা, চাকরি জুটবে কিনা সেই  চিন্তা -এইসব থেকে রেহাই পাবে বলেই অভিজ্ঞানের প্রতি দুর্বল হয়ে যায়। প্রেম নয় তবে প্রেমিকের মতন কেউ থাকলে মনের সারাদিনের জমে থাকা কথা তার সাথে শেয়ার করা যায়; মনের কথা বলবার মতন মন খুঁজছিল।

প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি পেতেই, পিয়ালী নিজেকে সম্পর্কে  বাঁধতে চায়নি। একটা নতুন জগৎ, আলাদা ব্যাপার, বাঙালি জীবনে সরকারি চাকরি হচ্ছে মহাকাশ অভিযানের সুযোগ পাওয়ার মতন। জীবন যে কতটা বিচিত্র, রহস্যময়, সুন্দর; অনুভব করবার মন  বাঙালিদের নেই। একটা বেকার ছেলের হাত ধরবার মতন ভিতরের টান পিয়ালীর ছিল না। বয়স তখন তিরিশ , ছেলেটির পঁয়ত্রিশ;  সরকারি চাকরি হবেনা, ব্যবসায়িক বা অন্য কোন ভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। পিয়ালী ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিল।

এখন পিয়ালীর বয়স বাহান্ন।

কিছুক্ষণ আগেই ঘরের বাইরে থেকে আচমকা অন্ধকারে নেমেছে । ঘড়িতে বিকেল ছ'টা। পিয়ালীর  জীবনে এই বছরে অনেক    পরিবর্তন এসেছে। সমীরের সাথে একবছর আগেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। একমাত্র ছেলে বাবার সাথে থাকে।

সরকারী  স্কুলের চাকরিটা যেই দিন পেয়েছিল, বুঝতেও পারেনি এতো দ্রুত জীবনে সাঁঝের মুখোমুখি হবে!

কথা গুলো একমনে ভেবেই চলেছে, পিয়ালী খেয়াল করল পিছনে এক পুরুষের ছায়া!  ঘাড়  ঘোরাতেই দেখল বছর বাহান্নর একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন।   

পুরুষটি নরম  কণ্ঠে  বলল- পিয়ালি, জন্মদিনের শুভেচ্ছা। এই বছর বাহান্ন  হয়েছে।

পিয়ালীর মুখে লজ্জার ছোঁয়া।

-ধুস, বুড়ি হয়ে  গেলাম।

লোকটি হাসতে হাসতে বলল

-ভালোবাসার যেমন বয়স থাকেনা,  শুভকামনার বয়স আছে নাকি? আমি সুকান্ত। অভিজ্ঞানের বন্ধু।

অভিজ্ঞান ,নামটা শুনতেই পিয়ালী অস্থির হয়ে বলল

-অভিজ্ঞান কোথায়?

পিয়ালীর প্রশ্ন শুনে, লোকটি বলল

- একুশটা চিঠি এনেছো ? 

পিয়ালীর  কণ্ঠে উত্তেজনা। বলল - ও একটা পাগল। সেই একবার আমাদের  মধ্যে  ভীষণ তর্ক হল। অভিজ্ঞান বলল,  আমার  জন্মদিন ওকে কেন জানানো হয়নি। আমি বললাম আমার  ভালোবাসার মানুষটা যখন মনে রাখেনা, তখন আর কেই বা  উইশ করবে? অভিজ্ঞান বলল, সে করবে।  বাইশ বছর ধরে  করবে। পাগলটা কথা রেখেছে।

লোকটি স্থির কণ্ঠে বলল

-আপনি ওকে ভালবাসলেও, সম্পর্কটা  বন্ধুর্ত্বের স্থানেই রেখে দিলেন তাইতো ! চাকরি পেলেন, অন্য কাউকে বিয়ে  করলেন,  সন্তান হয়েছে; বছরে কতবার ফোন করেছিলেন?

পিয়ালী ধীরে ধীরে বলল

-প্রায় ছয়বার। ধরেনি। ভেবেছি অভি সংসার করেছে।

 -আজ কেন ছুটে  এলেন?

পিয়ালী ভাঙা গলায় বলল

-ওকে বলা দরকার, সব কিছু পেয়েও আমি  একা। ওর একুশটা চিঠিই আমার এই জীবনের সম্বল। একাকীত্ব এক কঠিন  সত্য । এর মোকাবিলা করা খুব শক্ত। কিন্তু অভি কোথায়?

সুকান্ত মাথা নামিয়ে  ধীর  কণ্ঠে বলল- যেই বছর আপনার বিয়ে  হয়েছিল, ঠিক দু’মাস বাদেই লিভারে ক্যান্সার ধরা পড়ে।  ছয়মাসের মধ্যেই সব শেষ।

পিয়ালী আঁতকে উঠল! খুব কাঁদতে ইচ্ছা  করছে। কান্নায় গলা বুজে আসছে, বলল- তাহলে এই চিঠি গুলো আমার ঠিকানায় কেমন করে ?

সুকান্ত নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে পিয়ালীর দিকে। সেই দৃষ্টিতে অবজ্ঞা ছিল। বলল

-ওর বাড়িটা আমাকে দিয়ে  যায়।  আপনার নামে লেখা একুশটা  চিঠি আমাকে দিয়ে যায়।

পিয়ালী অবাক হয়ে বলল

- ঠিক বুঝলাম না!

সুকান্ত ধীরে ধীরে বলছে

 - আমার দায়িত্ব ছিল,  প্রতি জন্মদিনে আপনার  ঠিকানায় চিঠি গুলো পাঠিয়ে  দেওয়ার।

-আপনি নিজে  বিয়ে  করেননি?

সুকান্ত এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা গুলো বলছিল। ফতুয়া আর পাতলা পাজামা পড়ে আছে। সামনে কাঠের চেয়ারের উপর বসে পড়ল। বলল

-আমি অভিকে আজও ভালোবাসি। অভি যেমন আপনাকে ভালোবাসে।

পিয়ালী অবাক হয়ে শুনছে। সুকান্ত স্থির দৃষ্টিতে বলে চলেছে

-আমার ইচ্ছা ছিল অভির সাথেই সংসার করার। আপনি যেমন অন্যের সাথে সংসার করেছেন। আপনার ডিভোর্সের খবর আমি জানি।

পিয়ালী বলল - বুঝলাম না!

সুকান্ত শক্ত দৃষ্টিতে পিয়ালীর দিকে তাকিয়ে বলল - সরকারি চাকরি পেয়ে, খাঁটি মানুষটাকে ভুলে গেলেন! আপনার প্রেমিক যখন আপনার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিল, সম্পর্ক ভেঙে নতুন ভাবে শুরু করতেন, যদি অভিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হতো।

কথাগুলো ততটাই সত্যি, যতটা শুনে পিয়ালীর নিজের উপর ঘৃণা আসছিল। পিয়ালী বলল - সেটা অপরাধের নয়। আমিতো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিইনি।

- এটা আপনার কাছে খুব স্বাভাবিক, আপনাদের মতন মানুষদের কাছে সম্পর্ক মানেই নিজের যন্ত্রণা ভাগ করে নেওয়ার অংশীদার। যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে সে আপনার।

পিয়ালী নিজেকে সামলাতে পারল না। চিৎকার করে বলল

- সবাই তাই করে। আমি তখন নতুন চাকরি পেয়ে স্বাধীনতার স্বাদ নিচ্ছিলাম। আমরা কেউই অন্যের সাথে দায়বদ্ধ নই। যার জীবন সে সামলাবে, এটা অন্যায় নয়।

সুকান্ত বলল - আমি কিন্তু অভিকে একজন প্রেমিকার মতন একান্তে জড়িয়ে থেকেছি। ওকে কখনো নিজের থেকে আলাদা করিনি। সমাজ আমাকে নিয়ে অনেক ঠাট্টা করেছে। পাত্তা দিইনি।

কিছুক্ষণ  থেমে সুকান্ত ভেজা  গলায়  বলল- বলতে পারেন, আমার প্রেমকে অভি বন্ধুর্ত্বের স্থানেই রেখে চলে গেলো। জানেন মৃত্যুর সময় অভি একটা অদ্ভুত শর্ত  দিয়ে গেলো!

পিয়ালী সেন উত্তেজিত হয়ে বলল

-কিসের শর্ত?

-ওর ভালোবাসাকে আপনি স্বীকৃতি  না দিলেও, আমি যেনও  দিই। যদি পরের জন্ম বলে কিছু থাকে, আমি নারী হয়ে অভিজ্ঞানের পিয়ালী হতে চাই।   বলুনতো মোমবাতির খুব নিকটে  কে থাকে, আলো না ছায়া ?

পিয়ালী চুপ করে রয়েছে। জানালার  উল্টোদিকে নিথর  অন্ধকার  নামছে, ঘড়িতে এখন পুরোপুরি সাতটা বাজল। একমাস আগে এই সময়েই সে ডিভোর্স পেপারে উকিলের সামনেই স্বাক্ষর করেছিল।

ঘরটা অন্ধকারে ভরে গিয়েছে। বাইরে বারান্দায় কেউ এসে হালকা হলুদ রঙের কম পাওয়ারের আলো জ্বালিয়েছে। সুকান্তের চোখের দিকে পিয়ালীর তাকিয়ে থাকবার সাহস নেই। সেই চোখ আমরা পড়ছি। পিয়ালীর একুশ চিঠির বিশ্বাস ঘাতকতার ইতিহাস, তার স্বামী, সন্তান জেনে গিয়েছে কিনা জানিনা, সুকান্ত ডিভোর্সের খবর জেনে গিয়েছে কেমন ভাবে ?

অভিজ্ঞান বেঁচে থাকলে কাকে বেশী ভালোবাসতো - পিয়ালী, না সুকান্ত? প্রেম শুধুই শরীরের, সেখানে ত্যাগের ভূমিকা ক্ষীণ!!

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment