ছবি : ইন্টারনেট |
ভাগ্য
সিমা ব্যানার্জী রায়
আমি রান্নাঘরে চলে এলাম। বাড়িতে আজ অতিথি আসবে। শ্বশুর বাবার খুব কাছের আত্মীয়। আজ ওনাদের প্ঞ্চাশ বছরের বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে চলছে বিশাল আয়োজন৷
'ও বউমা, কাটলেট সবগুলো ভাজা শেষ হল?'
ডায়নিংরুম থেকে প্রশ্ন করলেন শাশুড়ি মা। আমি রান্নাঘর থেকে উত্তর দিলাম, 'হ্যাঁ, মা। শেষ হয়ে গেছে।'
'পায়েসের কত দূর? সালাদ টা রেডি করে রাখো-আসলে তখন সালাদ ড্রেসিং দিও।'
'এই তো মা প্রায় হয়ে আসছে।'
রান্নাঘরে আমি আর কাজের মেয়ে দুগগা রান্নাবান্নার আয়োজন করছি।
দুগগাকে তাড়াতাড়ি কাজ করার তাগাদা দিয়ে শাশুড়ি মা'র কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'মা, তারা কখন আসবেন?'
'সন্ধ্যেবেলার আগেই চলে আসবেন, তাই তো বলা আছে।'
'মাহি একটু এদিকে এসো তো গাড়ির চাবিটা খুঁজে পাচ্ছি না।'
অনুষ্টুপের ডাকে তাড়াহুড়ো করে ছুটে গেলাম বেডরুমে। চাবিটা খুঁজে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কোথায় যাচ্ছো? সন্ধ্যেবেলা অতিথিরা এসে পড়বে তো!'
'আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে না হয় বেরিয়ে আসব।। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ফিরে আসব।'
আমি 'আচ্ছা' বলে আবার রান্নাঘরে চলে এলাম। অনুষ্টুপের সঙ্গে বিয়ের পর এটাই প্রথম বড় উৎসব এ বাড়িতে। এ বাড়িতে প্রতিদিন কিছু না কিছু লেগেই থাকে। সেইসময় হরেক রকমের খাবার দিয়ে টেবিল সাজানো থাকে। আমার তখন বাড়ির কথা বড্ড মনে পড়ে।
শ্বশুর বাবা এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'বউমা, আমার জন্য তোমার হাতের ওই স্পেশাল সুজির বিরিয়ানিটা করেছো তো?'
আমি হেসে বললাম, 'হ্যাঁ, বাবা।'
আবার হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির গন্ধ সারা বাড়ি ছড়িয়ে গিয়েছে৷ শাশুড়ি মা এটা নিজ হাতে রান্না করেছেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খেতে চমৎকার হবে। আমার ছোট ভাইটার আবার হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানী খুব পছন্দের। ওর কথা আজ খুব মনে পড়ছে। ছোট বেলা থেকেই আমার আবার মুরগি পোলাও ভিষন পছন্দ । বাবা বাজারে গেলেই সব সময় খোঁজ করতো কোথাও মোটা তাজা মুরগি কোথায় আছে কিনা। কিনে এনেই আমাকে ডেকে বলতেন - "এই দ্যাখ মা কি এনেছি?”
আজ বাড়ীতে মুরগি পোলাও ও রান্না হচ্ছে । আমার বর ইয়া বড়ো মুরগি এনে বললো এটা আজকে রান্না করো খুব সুন্দর করে আমাদের চারজন প্রিয় অতিথি আসবে। আর আমরা চারজন-দুগগাও খাবে আজ।
রাতে সবাই এক সাথে ডিনার করবো।
এই বলেই অফিসে চলে গেল ।
আমি মুরগি টাকে কেটেকুটে সুন্দর করে রান্না চড়ালাম। কিন্তু আমার মন রয়েছে সেই পুরনো দিনে । বার বার বাবা মায়ের মুখটা মনে পড়ছে । মা আমার জন্য নিজের হাতে মুরগি নিয়ে অপেক্ষা করছে পথ চেয়ে ।
দুপুরে খেতে গিয়ে পারলাম না। চোখ ভিজে যাচ্ছে বারবার । ওভাবে রেখে উঠে গেলাম । শাশুড়ি মা আর শ্বশুর বাবা বারে বারে দেখছেন কিন্তু মুখে কিছু বলছেন না।
সন্ধ্যেবেলায় আমার বর এলো বাসায় । এসে বললো খাবার রেডি করো আমি তাদের নিয়ে আসছি।
শাশুড়ি মা আমাকে পছন্দ করে তার ছেলের বউ হিসেবে নিয়ে আসেন এ বাড়িতে। অর্থে বিত্তে এ বাড়ির ধারে কাছেও নয় আমার পরিবারের অবস্থান। ভালো সম্বন্ধ পেয়ে বাবা-মা মহাখুশিতেই বিয়েটা দিয়ে দিলেন।
রান্নাবান্না পর্ব শেষ করে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াই। আজকেও সুন্দর সব খাবারে ভরপুর থাকবে টেবিলটা। সবার সঙ্গে আমাকেও মজা করার ভান করে খেয়ে উঠতে হবে। এসব ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে আসে। দামি কোনো খাবার আমার পেটে হজম হতে চায় না। এসব খাবার মুখে তুলতেই বাড়ির সবার কথা মনে পড়ে। তারা কী খাচ্ছে, এই কথাটা ভাবতেই খিদে যেন পালিয়ে যায়। তবুও জোর করে খেয়ে উঠতে হয় আমাকে।
দরিদ্র পরিবারে খুব টানাটানির সংসারে বড় হয়েছি। অভাব ছিলো নিত্য দিনের সঙ্গী। ভালো খাবারের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও খাওয়া হত না। ভালো খাবারের পেছনে টাকা নষ্ট করার মতো যথেষ্ট টাকাটাও যে থাকতো না। খুব হিসেব করে চলা সংসারে অনেকদিন বাদে ভালো কিছু রান্না করতেন মা। সেদিন আমরা খুব আনন্দ নিয়ে খেতে বসতাম। বাকি দিনগুলোতে এত বেশি আনন্দ না থাকলেও অভিযোগ থাকতো না। কারণ এতেই তো অভ্যস্ত আমরা।
বিয়ের পরে এমন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছি না। অন্য সবকিছুর বেলায় মানিয়ে নিতে পারলেও খাবার সময়টা খুব অস্বস্তিতে কাটে আমার। পুজোর মাস চলে আসতেই খাবারের আয়োজন আরও বেড়ে গেলো। আমার মানসিক কষ্টও বেড়ে গেলো। ছোট ভাইবোন আর বাবা মায়ের কথা মনে হতে থাকে খুব বেশি করে।
শাশুড়ি মা একদিন আমার প্লেটে মাছের বড় একটা মাথা তুলে দিয়ে বললেন, 'এটা তুমি খাও।'
খেতে না চাইলেও আমাকে সেদিন খেতে হয়েছিল। মাছের মাথা খাওয়া নিয়ে ভাই বোনদের মধ্যে কত ঝগড়া লাগত, এসব মনে পড়তেই চোখের কোণে জল জমে গিয়েছিল।
শ্বশুর বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'কী হয়েছে বউমা? তোমার চোখে জল কেন?'
আমি তখন তাড়াতাড়ি চোখের জল লুকিয়ে বলেছিলাম, 'ঝালটা একটু বেশি হয়েছে বাবা।'
এভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অজুহাতে আড়াল করে গিয়েছি ভেতরের অনুভূতি। এখানে ভালো থাকার সবকিছু থাকলেও আমি যেন ভালো থাকতে পারছি না৷
সেদিন ছোট বোনের সঙ্গে কথা হওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম পুজো উপলক্ষে মা কী কী তৈরি করছে রে।
বোনটা হেসে বললো, 'ছোলা বাতাসা মুড়ি আর গুড় ছাতু।'
তারপর থেকে পুজোতে আমি ছোলা মুড়ি আর ছাতুর শরবত ছাড়া কিছুই তৃপ্তি সহকারে খেতে পারি না। গলা দিয়ে নামতে চায় না খাবারগুলো।
আজকে এত এত খাবারের মাঝে আবার আমাকে অস্বস্তিতে পড়তে হবে। তবুও সবার সঙ্গে হাসিমুখে খেয়ে উঠতে হবে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখের কোণে জমে থাকা জল মুছে নিয়ে ডায়নিংরুমে গিয়ে দাঁড়ালাম। সন্ধ্যে হয়ে আসছে তাড়াতাড়ি। অতিথিদের আসারও আর খুব বেশিক্ষণ বাকি নেই। টেবিলে সব খাবার সাজিয়ে দিয়েছে দুগগা। ডায়নিংরুম ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াবো এমন সময় কলিংবেলের শব্দ। শাশুড়ি মা আমাকে দরজা খুলতে বললেন। আমি দরজা খুলতেই দেখি মা বাবা, ছোট বোন আর ভাইটা। তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অনুষ্টুপ।
এমন সময় পিছনে কেউ আমার মাথায় হাত দিলো। চমকে উঠে পিছনে ফিরে দেখলাম শ্বশুর বাবা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শাশুড়ি মা ও পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে । আমি অবাক হয়ে গেলাম । বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম । বাবা বললো- “ জামাই আজ অফিস ছুটি দিয়ে আমাদের আনতে গিয়েছিল । তুই নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদিস? বোকা মেয়ে একটা আমরা ভাল আছি ।" ভাই বোনদের মুখে দুষ্টু হাসি দেখে মনটা ভরে উঠল।
দূরে দাঁড়িয়ে আমার বর হাসছে । ওর হাসি দেখে মনটায় খুব আনন্দ হল । চোখের জল মুছে বললাম - "বাবা আমার ভিষন খিদে পেয়েছে চলো আমাকে খাইয়ে দেবে না? তোমার হাতে কতোদিন খাইনা। বাবা অন্য দিকে ঘুরিয়ে চোখ মুছে নিল-কিন্তু আমার চোখ এড়ালো না।
আমি হুহু করে কাঁদতে লাগলাম ।
এমন সময় আমার বর বলল - এখন খেতে দাও ভীষণ খিদে পেয়েছে আমাদের। আমি সবাইকে খেতে দিলাম । বাবা আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে ।মনে হচ্ছে সেই ছোট্ট আমি । আমার প্লেট থেকে এক টুকরো মাংস বাবার মুখে দিতেই বাবা বললো - “ জানিস মা আমি যখন ছোট্ট ছিলাম আমার মা ঠিক এভাবে মাংসের টুকরো আমার মুখে তুলে দিতো। আমি আমার মায়ের চেহারা তোর মাঝে দেখতে পাই। তুই যে আমার মা আমার জননী ।"
আমি আহ্লাদী হয়ে বললাম, 'তোমরা আসবে আমাকে জানালে না তো!'
মা হাসলেন। বাবা বললেন, 'না জানিয়ে এসে দেখলাম কেমন খুশি হোস তুই।'
শ্বশুর বাবা এসে হাসিমুখে বললেন, 'তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে নিন। অনুষ্ঠানের খুব বেশি বাকি নেই।'
তাড়াহুড়ো করে সবাই ফ্রেশ হয়ে বসে পড়লো। আমি শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'মা, অতিথি আসার কথা তারা আসবেন না?'
শাশুড়ি মা হেসে বললেন, 'অতিথি চলে এসেছে তো। আর কেউ আসার নেই।'
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'তাহলে বললেন যে বাবার খুব কাছের আত্মীয় আসবেন?'
শাশুড়ি মা হা হা করে হেসে উঠে বললেন, 'তোমার পরিবারই তো আমাদের খুব কাছের আত্মীয় বৌমা। তাই না? বড্ড সরল আমার এই বৌমা হয়েছে।'
আমার মুখ জুড়ে খুশি আর চোখে চকচক করছে জল। আনন্দের জল নিয়েই সবাই মিলে হৈ হুল্লোড় করে খেয়ে নিলাম।
সবার আড়ালে উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছি। শাশুড়ি মা পাশে এসে দাঁড়ান। আমি তার দিকে তাকালাম।
তিনি লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বললেন, 'জানো বৌমা, এ বাড়িতে যখন আমি বউ হয়ে আসি তখন আমিও তোমার মতো খেতে পারতাম না। খাবার যেন গলায় বেধে থাকতো। বাড়ির মানুষের কথা খুব মনে পড়তো।'
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম, 'মা, আপনি আমার অনুভূতি বুঝতে পারতেন!'
'আমারও যে তোমার মতো একটা পরিবার ছিলো৷ এই অনুভূতিগুলো যে আমার খুব চেনা মা, বুঝতে পারব না কেন!'
আমি চুপচাপ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার চোখে জল।
জল ভরা চোখে তাকিয়ে বললেন, 'দুঃখের বিষয় হলো এ বাড়িতে আমার সেই অনুভূতির কোনো দাম ছিলো না৷ তোমার শ্বশুর বাবা আমাকে পছন্দ করে এ বাড়ি নিয়ে আসেন৷ আমার শাশুড়ি মা আমাকে একদমই পছন্দ করতেন না। গরীবের মেয়ে-ওনার সংসারে মানিয়ে নিতে পারবে তো? এই ছিল ওনার আক্ষেপ। সংসারে তার উপরে কেউ কথা বলতো না। তোমার শ্বশুর বাবা আমার অনুভূতি বুঝলেও কখনো তার মায়ের উপরে কথা বলতে পারেনি।'
আমার চোখে ছলছল করছে জল। যেন তার কষ্টটা আমি অনুভব করছি খুব কাছ থেকে।
তিনি চোখের জল মুছে হেসে বললেন, 'কিন্তু সুখের কথা হলো যে আমি অমন শাশুড়ি মা হতে চাইনি আর চাইও না।'
আমার ভেজা চোখে নিমিষেই আনন্দ ফিরে এলো। সত্যি আমি ভাগ্যবতী।
শাশুড়ি মা আমার হাতটা ধরে বললেন, 'যখন যেটা করলে ভেতরে স্বস্তি পাবে, ভালো থাকতে পারবে সেটাই করবে কেমন, মনে থাকবে তো? আমি তোমার পাশে আছি৷ ভালো থাকার এত আয়োজনে তুমি খারাপ থাকো এটা আমি কখনো চাইব না। তুমি যে আমার আদরের বৌমা।'
আমার ভেতরে শীতল এক
হাওয়া বইছে৷ এতদিনের সমস্ত অস্বস্তি, খারাপ লাগা একটু একটু করে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। তিনি চলে গেলেন আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে
ভাবছি, ভালো মানুষেরা বোধহয় এমনই
হয়৷ কে বলে, ভালো মানুষ আজকাল
আর দেখা যায় না?
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment