ছবি : ইন্টারনেট |
মধ্যবিত্ত
তপতী রায়
আকাশ মধ্যবিও পরিবারের বড় ছেলে। পরিবারে এগারো জন সদস্য।বাবা সরোজ ঘটকএকমাত্র চাকরি করেন। একটি ছোট বেসরকারি অফিসে কেরানির কাজ। কেরানি শব্দটা এখন তেমন শোনা যায় না। আকাশ ছেলে বেলা থেকে বাবার মুখে শুনে অভ্যস্ত। বাবা প্রায় বলত, "তুই বাড়ির বড় ছেলে, বেশি স্বপ্ন দেখিস না।তার ওপর কেরানি বাপ! ছবি আঁকা,গান বাজনা তোকে মানায় না। বিএ টা পাশ করলেই শ্যামলাল বাবুর বড়বাজারের গুদামে ঢুকিয়ে দেব।তোর জন্য আসনটা খালি রেখেছেন"আকাশ চুপ করে থাকতো। টিউসান করে যতটুকু রেজাগার করতো মার হাতে তুলে দিতো। মায়ের মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকতো। কখনও বিরক্ত হতে দেখিনি।সব কাজ সেরে পুজোর সময় বোনেদের জন্য জামা বানাতে বসতো। পাড়ার বহু মহিলারা আসতেন মার কাছে সেলাই শিখতে। টাকা নেবার কথা অনেকেই বলতো। মার চিন্তার বাইরে। কত বড় ঘরের মেয়ে। বিয়ের আগে খেয়ে উঠলে , শীতের দিনে কাজের মেয়ে হাতে গরম জল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। বাবাও তখন মস্ত অফিসার। ব্যবসা করে সব হারালো। আস্তে আস্তে মধ্যবিত্ত পরিবার হয়ে গেলাম।
প্রচুর অভাব ছিল। বাড়ি দেখলে কেউ বুঝতেই পারতোনা। এত সুন্দর পরিপাটি ঘর। বড় পরিবারের সদস্যদের এই একটা মস্ত বড় গুন। মার মা, বেথুন স্কুলে এর প্রথম ছাত্রী ছিলেন। বেথুন সাহেব সারা কলকাতা শহর ঘুরে ঘুরে তিনজন ছাত্রী জোগাড় করে ছিলেন। নারী শিক্ষা উন্নয়ন এর জন্য। মেয়েদের জন্য বাসে পর্দা থাকতো। এরপর অবশ্য পূর্ববঙ্গ, পশ্চিম বঙ্গে পার্টিসান আন্দোলন এর সময়ে বহু মেয়ের বাবা বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে আসা মেয়েরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এগিয়ে আসে।
অভাব অনটনের শেষ নেই মধ্যবিত্ত পরিবারে। মায়েরা মানষিকতার দিক থেকে শিক্ষিত নারী। নম্রতার গুনে এতেই মহান ছিলেন, সকলের সাথে সহজেই মেলামেশা করতে পারতেন । বাড়ির মধ্যেই গড়ে উঠে শিক্ষার পরিবেশ। মান সম্মান কোন দিন বিসর্জন দিতে পারে না।
এর মধ্যেই আকাশ মাঝে মধ্যে ঠাকুমা-দাদুর ঘরে গানের রেওয়াজ ,দুচার বন্ধু নিয়ে আঁকা , মনের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতো।পাড়ায় গান আঁকা নিয়ে বেশ ভালোই
সুনাম হয়েছিল। সব আশা বিএ পাশ করার পর ছাড়তে হোলো। বাবা একদিন শ্যামলাল বাবু গুদমে নিয়ে গিয়ে পাকা চাকরির ব্যবস্থা করে এলেন ।
পরিবারের দায়িত্ব শুরু হোলো ইচ্ছের বিরুদ্ধে লড়াই।
মধ্যবিত্তের লড়াই বোধহয় এই ভাবেই শুরু হয়।
একুশ হতে না হতে পরিবারের সমস্ত বোঝা কাঁধে নিজের অজান্তেই এসে পরে। ইচ্ছের ডানা, কিছু একান্ত রঙ্গিন কল্পনা, অবসর সময়ের আনন্দের বন্ধু হয়ে রয়ে যায।
কোথায় হারিয়ে যায় । খুঁজে পাওয়া মুস্কিল,গোপন প্রতিভা!
একদিন বড়বাজারের গুদাম থেকে বেড়িয়ে লড়ি বোঝাই চাল,আটা,ময়দার বস্তা নিয়ে লড়িতে বসতে যাবে, ধাক্কা খেল তার বিশেষ বন্ধু কাবেরীর সাথে—”একি আকাশ তুমি এখানে, পড়াশুনা ছেড়ে শেষ পর্যন্ত বড়বাজারের গুদামে! কি দরকার ছিল এত ভালো রেজাল্ট করার?--ফোন করলে ফোন ধরো না। তোমার বাড়ির ঠিকানা বহুদিন আগে চেয়েছি, দাওনি।”মালদার মাড়োয়ারি মেয়ে ঠিক হয়ে গেছে নাকি "?
আকাশ একটু চুপ করে বলল,"একটু সময় লাগবে সব কিছু বলতে, তুমি বরং তোমার পছন্দের সল্ট লেকের সিএ মার্কেটর সামনে রবিবার সকাল দশটা নাগাদ, এই অভাগার জন্য একটু অপেক্ষা করো।সবার জন্য সব কিছু নয়। আমি তোমার খবর পাই। ভালো আছো। আরও সুন্দর দেখতে হয়েছ, এটা আমার জীবনের মস্ত বড় পাওয়া। এর বেশি সময় তোমায় দিলে চাকরিটা থাকবে না। অপেক্ষা করে থাকবো তোমার জন্য।”
আকাশ ড্রাইভারের পাশে বসল।গাড়ি ছূটে চলল জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে ঠিক বড়বাজারের রাস্তার মত ঢিমে তালে ঢকর ঢকর করতে করতে।
জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কাবেরী কে আর একবার দেখলো। সূর্যের ম্লান আলোর সাথে মুখের হাসি কেমন ম্লান দেখালো। গভীর ছায়া অন্তরে বাইরে। আকাশের মনে এই প্রথম উপলদ্ধি হলো কাবেরী কত খানি জুরে মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। এত তাড়াতাড়ি জীবনটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে উল্টো পথ নেবে বুঝতে পারিনি। চোখ বন্ধ করে ভাববার চেষ্টা করল,ত্যাগে শান্তি! না, সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলা মধ্যবিত্তের জীবনের মস্তবড় সংগ্রাম। মন বলল, সকলকে ঠেলে ফেলে দিয়ে নিজের দিন গুছিয়ে নেয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে -মেয়েদের বিরাট ধাক্কা! মানসিকতায়; সারা জীবনের মতো মেরুদন্ড ঝুঁকে যায় নিজের পায়ের নিচে।
দেখা যাক আজ রাতে স্বামী বিবেকানন্দের বেদান্ত আমাকে কতটা লড়াই করার শক্তি দিতে পারেন। যুব
সমাজের চলার পথের শক্তি। বিরাট শব্দ করে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো আর এক বড় গুদামের সামনে।
শনিবার রাতে আকাশের ভালো ঘুম হোলো না।পাখাটা শব্দ করে মাঝ রাতে বন্ধ হয়ে গেল। ছাদে এসে শুলো। আকাশের সামনে খোলা আকাশ। বেশ কিছুদিন আগের কথা। ভরা দুপুরে নির্জন রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে গল্পের ছলে কাবেরীকে বলে ছিল আকাশ,”ছাদে শুতে আমার দারুন লাগে। তারপর কল্পনায় তুমি এলে কাবেরী ফুলের মৃদু গন্ধে ভরে ওঠে সারা ছাদ। সেদিন ঘুমের বারোটা বেজে যায়।” কাবেরী আকাশ এর হাত দুটো ধরে অনেকটা কাছে এসেছিল।
ছাদে শুতে এলেই মন কাবেরী কে চায়। শনিবার রাতে আকাশের কিছুতেই ঘুম এলোনা। ভোরের শুকতারা দেখতে হোলো। সব অবসাদ ঘুচিয়ে উঠে বসল ,আজ কাছের আপনজনের সাথে জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ডেট।
আজ দেখা করতেই হবে। তারপর শুরু হবে চলার পথ।
আকাশ বাস থেকে নামতেই কাবেরী কে দেখতে পেল। উল্টো দিকের ফুটপাতে গাড়ি থেকে নামছে।হাত নাড়িয়ে এগিয়ে এলো।
—- “দাদার ফ্ল্যাটের চাবি এনেছি,ঐ খানে বসেই জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে”। কাবেরী হাসতে হাসতে বলল,"কি হোলো ভয় করছে? ফাঁকা বাড়িতে আমার সাথে থাকতে"।
আকাশ একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, “এর আগে বহুবার এসেছি। আকাশ খোলা আকাশ।তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন
অঘটন হতেই পারেনা। হাসতে হাসতে বলল, তোমাদের তিনগুণ ভয় পাই আমরা। মেয়েদের অনেক প্লাস পয়েন্ট আছে।তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ন্যাকা”।
দাদার বাড়ি এসে গেল।ছোট ফ্লাট।একটা ঘর একটু ছিমছাম সাজানো। বাকি ফাঁকা।
কাবেরী ব্যাগ খুলে টেবিলের ওপর অনেক কিছু সাজিয়ে ফেলল।লাল বেনারসি,ধুতি পাঞ্জাবি আরও কতো কি আকাশের ঘাম ছুটতে লাগলো।
কলিং বেল বেজে উঠলো। আমাদের একগাদা বন্ধু বান্ধব।
সাথে অনুপমের উকিল দা- বৌদি। হল্লোর করে ঘরে ঢুকল।
—-আজকেই বিয়ে কাবেরী, মাথায় কাপড় তুলে হাসতে হাসতে বলল, —- “তোমার বাড়ির ছাদে জায়গা টুকু পেলেই হবে। বাকি আমি ম্যানেজ করব। প্রথমেই গুদম থেকে সোজা ইউনিভার্সিটি। তারপর মধ্যবিও ছেলের মাঝখানে একটা বড় লছমন রেখা, শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন আর কল্পনা।
ত্যাগ করতে হবে। আমার অধিনে থাকতে হবেনা।যেমন তুমি বাবা মাকে,ভাই বোন কে দেখেছ সেই ভাবেই চলবে।
আমি কেবল তোমার পাশে থাকব। কিছু মনে করোনা আকাশ, মধ্যবিত্তের মধ্যে বাঙালির ক্যালচারটা এখনো দু’চোখ খুলে বেঁচে আছে, বিবেক , মনুষ্যত্ব, আত্মসম্মান! কেবলমাত্র কিছু ইগো তাকে ওপরে উঠতে দেয়না।কাল কি খাব তার ঠিকানা নেই,অথিতি নারায়ন!থালা ভর্তি খাবার তার জন্য তৈরি।বাড়ির ছোট ছোট শিশুরা করুন চোখে তাকিয়ে সেই সব থালার দিকে। অদ্ভুত চিন্তা ধারা।
তোমার বাবা বলতেন কেরানির ছেলে কেরানিই হবে। শব্দটা তোমার রক্তে মিশে গেছে। তুমি মুক্তি পাও। পরিবারের সকলের মুক্তি। এগিয়ে যাওয়া কোন অন্যায় নয়। কেবল নিজের জন্য কর্ম , স্বার্থপরতা”।
আকাশের পরিবারের সকলে,কাবেরীর বাড়ির সকলে এসে পড়ল। দু'দিন আগেই সব ঠিকঠাক করেছিল কাবেরী ও তার বাবা।গোপন রাখা হয়েছিল। সকলকে অবাক করে দেবে বলে। আকাশের বাবা নিজের ভুল স্বীকার করেছেন। আকাশের হাত আকাশ ছোঁয়া তে সাহায্য করবেন! “ওর মা সীমা, ভেতরে ভেতরে ভেঙেই পড়ে ছিল। বার বার বলতো, আর একটু কষ্ট করি আমরা। আমার ছেলে খোলা আকাশ। সকলের জন্য। কালো মেঘের চাদরে ঢাকা দিয়ে দিওনা।” সরোজবাবু চুপ করে থাকতো। নিরুপায়!
কেউ জানতে পারলনা । আকাশ কাবেরী কে বলল, “মনে হচ্ছে ঘুম থেকে তুলে কে যেন বলছে চল বিয়ে করতে, বৌ ছাঁদনা তলায় বসে আছে হ্যাপিতেস করে। এমন বিয়ে পাগলা মেয়ে জীবনে দেখিনি।”
ফুলশয্যা হোলো খোলা আকাশের নীচে। সাক্ষী রইল বাঁকা চাঁদ,হাজার হাজার তারা, এলোমেলো বসন্তের হাওয়া ,আর ভালোবাসার প্রতীক দুটো সদ্য ফোটা গোলাপ।
...(সমাপ্ত)...
আমার লেখা শেয়ার করতে তো পারি। এটি কি রকম নিয়ম। আমি থ
ReplyDeleteআমি তো আপনাদের অনেক এর কবিতা শেয়ার করেছি। Comment দিয়েছে।Ok নমস্কার জানবেন।
ম
Khub bhalo hoyeche.....darun
ReplyDelete