1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 21, 2025

আমার পুজো

ছবি : ইন্টারনেট

আমার পুজো

জগদীশ গাঙ্গুলি 

আমাকে কেউ পুজো সমন্ধে লিখতে অনুরোধ করলে বাঙালির শ্রেষ্ঠ শারদীয়া উৎসব কে তিনটে ভাগে ভাগ করবো, প্রথম ভাগে বয়সীমা জ্ঞান হওয়া আর পুজো সমন্ধে বুঝতে পারা মোটামুটি পাঁচ বছর থেকে পনেরো বছর! এর পর পনেরো থেকে মোটামুটি পয়তিরিশ, এরপরে এখন অব্দি! এই বিন্যাসের কারণ বয়সের সাথে সাথে এই আনন্দ উৎসবের আনন্দর ধরণ, এর রূপ রস গন্ধ ক্রমশঃ পরিবর্তন হয়েছে, তাহলে আমার পুজো নির্ভেজাল সত্যি লেখা দিয়ে শুরু করি!

আমি প্রবাসী বাঙালী, জন্মস্থান  বিহার জামশেদপুর অধুনা ঝাড়খন্ড! বাবা ছিলেন টাটা স্টিল এর কর্মচারী। আমরা টাটার কোয়ার্টার শিদগড়া বলে একটা জায়গায় থাকতাম, টাটাদের কোয়ার্টার এর বিশেষত্ব হচ্ছে এই কোয়ার্টারগুলোর এক এক টা টাইপ ছিলো আর ঐ টাইপ গুলোকে লেখা হতো X টাইপ, XN টাইপ, SL টাইপ, L4 টাইপ, L5আর L6 এরপর সর্বোচ্চ ছিলো KD টাইপ। এই টাইপ দেখে কোয়ার্টার এর চরিত্র বোঝা যেতো, যেমন SL টাইপ মানে একটা বেড রুম, রান্নাঘর, ল্যাট্রিন বাথরুম, L4 মানে দুটো বেড রুম, রান্নাঘর, ল্যাট্রিন বাথরুম, L5 মানে তিনটে বেড রুম, L6 মানে তিনটে বেড রুম, রান্না ঘর এর লাগোয়া আরো একটা স্টোর রুম সাথে ল্যাট্রিন বাথরুম, KD ফ্ল্যাট গুলো ছিলো বাংলো প্যাটার্ন এর, এগুলো টাটার বড় বড় অফিসার্স দের জন্য এলোটেড হতো,  এইসব কোয়ার্টার এর সব গুলোতে একটাই বিশেষত্ব ছিল প্রতিটা কোয়ার্টার এর সামনে একফালি করে বাগান হতো!আমার জন্ম L4 কোয়ার্টার এ। তখন ছিলো যৌথ পরিবার প্রথা, বাবা দেশভাগের পর ভাগ্য অম্বসনে টাটা নগর বা জামশেদপুর যায় আর টাটা স্টিল এ চাকরি পায়! এর পর ওপার থেকে আমার এক কাকু, তিন পিসিমা(এর মধ্যে একজন ছিলো বাল্য বিধবা) আর ঠাকুমা আসে, আমার জ্ঞান যখন হয়েছে ততক্ষনে আমার কাকু TRF( টাটা রবিনশন ফ্রেসার) এ চাকুরী পেয়েছে, কাকুর বিয়ে হয়েছে আর কাকুর তখন দুই মেয়ে, বড়োপিসির  বিয়ে হয়ে গিয়েছে, ভাই বোনদের মধ্যে আমি সবচেয়ে ছোটো আমার উপর দুই দাদা (এক দাদা 12বছর বয়সেই মারা যায়) তার উপরেও এক দিদি। তখন সব মিলিয়ে বারো জনের যৌথ পরিবার। ছোটো পিসি একটা প্রাইমারি স্কুলের হেড মিস্ট্রেস! দিদি তখন পড়ে ক্লাস নাইন সম্ভবত! দাদা ক্লাস সিক্স, আমি তখন আপার কেজি, আমার খুড়তোতো বোন একজন আমার থেকে এক বছরের বড়, সে ক্লাস ওয়ান, ছোটটি তখনো স্কুল যায়না, ঐ সময় রান্না ঘর, ভিতরের উঠোন টাকেও শেড করে শোয়ার ঘর করা হয়েছিল, রান্না হতো বাইরে। এতো শিবের গাজন পুজো নিয়ে লেখা শুরু করার জন্যে এতো গাওয়া কারণ পাঠক পাঠিকা কে অবগত করানো আমার ছোটবেলায় আর্থ সামাজিক পরিবেশ কেমন ছিলো তা জানানো যার উপর শারদীয়া পুজোর আনন্দ অনেকটাই নির্ভরশীল!

মোটামুটি পাঁচ থেকে পনেরো বছর বয়সে আমার পুজো শুরু হতো পুজোর ঠিক একমাস আগে, টাটাদের যে কোনো কনসার্ন এ বোনাস দেওয়া হতো পুজোর একমাস আগে,আমাদের জামশেদপুর এ বড় বাজার বলতে দুটো প্রথমটা শাকচি বাজার, দ্বিতীয়টা বিস্টুপুর বাজার! টাটার লোকদের ঐ সময় একটা ধারণা ছিলো বিস্টুপুর মানে বড়লোকদের আর শাকচি মানে মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্তদের বাজার(এই ধারণা এখন অব্দি আছে কিনা জানিনা!) বোনাস পাওয়ার আগের দিন বাবা মা কে বলে দিতো পরেরদিন বিকাল চারটায় আমায়, দাদা, দিদি কে নিয়ে শাকচি বাজারে চলে যেতে, সারা রাত আনন্দে ঘুম হতোনা, পরের দিন স্কুল এ গিয়ে আনমনা হয়ে পড়তাম এই চিন্তা করে কখন বাড়ী যাবো তারপর শাকচি বাজার যাবো! মোটামুটি স্কুল থেকে বারোটার সময় ফিরে স্নান, খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম করেই বেলা তিনটের সময় আমরা শাকচির উদ্দেশ্যে রওনা দিতাম, পথে দাদার সাথে হাল ফ্যাশন এর কি ড্রেস চলছে সেই নিয়ে আলোচনা চলতো! ঠিক বিকাল চারটাতে বাবা সাইকেল নিয়ে অফিস থেকে আসতো, দূর থেকেই বাবাকে দেখে মনটা খুশিতে নেচে উঠতো! বাবা আসার পর সাইকেল এর মালিকানা দাদার হাতে চলে যেতো! প্রথমেই কেনা কাটা শুরু হতো জুতো দিয়ে! মুখোমুখি দুটো দোকান "শ্রী লেদার্স "(এটাই শ্রী লেদার্স এর প্রথম দোকান) উল্টোদিকে "বাটা"! শ্রী লেদার্স এর দাম তুলনামূলক কম থাকার জন্যে (ঐ সময়ে বাবার কাছে সাশ্রয় টাই মুখ্য ছিলো) আমরা শ্রী লেদার্স এ প্রবেশ করতাম, সবার জুতো কেনা হলে ঠাকুমার কাপড় দিয়ে পুজোর বাজার শুরু হতো, এক এক করে পিসিদের, মার, দিদির তারপর সব শেষে আমার আর দাদার(আমার হয়ে দাদাই আমার শার্ট প্যান্ট পছন্দ করতো ) এর সাথেই পুজোর কদিন পাতার জন্যে নতুন চাদর, পর্দার কাপড় কেনা হতো, পর্দা বানাবার দায়িত্ব নিতো মেজো পিসি!  এর মধ্যেই আমার ঘ্যান ঘ্যানানী শুরু হতো জল তেষ্টা পেয়েছে বলে! তখন বোতলজাত জল পাওয়া যেতোনা, জল খাবার জন্যে কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্ট এ ঢুকতে হতো, আমার উদ্যেশ্য জল খাবার নামে ঢুকে জলযোগ করা! বাবা আর মাও সেটা বুঝতো! শাকচি বাজারে ঐ সময়ে একটি গুজরাটি মিষ্টির দোকান ছিলো " ভোলা মহারাজ"(এখনো আছে) ওখানে ঘি এ ভাজা সিঙ্গারা পাওয়া যেতো, ওটা খেয়ে একটা লস্যি খেয়ে বাড়ির পথ ধরতাম।

আমাদের কোয়ার্টার এর ঠিক উল্টোদিকের কোয়ার্টার এ একটি পারিবারিক পুজো হতো, ওটা ছিলো স্বপ্নে পাওয়া পুজো, এখানে মায়ের মুখ হতো কালো, সেটাই নাকি মা স্বপ্নে আদেশ দিয়েছিলেন,  এর প্রতিমা তৈরির জন্যে কলকাতার কুমারটুলি থেকে একমাস আগে মৃৎশিল্পী আসতো, আমি আর আমার মতো কচিকাচার দল সন্ধ্যেবেলা কোনোরকমে একটু পড়াশুনা করে চলে যেতাম মূর্তি বানানো দেখতে, সামনের বাগানের চারদিক কানাত দিয়ে ঘিরে কাঠামোর উপর একটু একটু করে প্রথমে পুয়াল এর আবরণ তারপর মাটি লেপা থেকে চোখের সামনে তিলে তিলে মৃন্ময়ীর রূপে মাকে গড়ে তোলা সবটাই হতো চোখের সামনে, সামনে বসে নিরনিমেষ চোখে আমরা তাকিয়ে দেখতাম! ঐ একমাস আগের থেকেই আমার পুজো শুরু হয়ে যেতো! মহালয়ার আগের দিন বাবা প্রায় পাঁচ প্যাকেট লেরো বিস্কুট নিয়ে আসতো, দিদি রাতে রেডিওর "কলকাতা ক" স্টেশন টিউন করে রেখে দিতো, সারা রাত প্রায় অনিদ্রায় কাটাতাম কখন ভোর হবে! শেষের দিকে হয়তো চোখটা একটু লেগে আসতো, হঠাৎ মার ঠেলা খেয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠতাম, ততক্ষনে রেডিওতে চন্ডীপাঠ শুরু হয়ে গিয়েছে, যে রুম এ রেডিও সেখানে সবাই গোল হয়ে বসতো, উল্টোদিকের কোয়ার্টার থেকে চৌধুরী কাকু, তার ছেলে, দুই মেয়ে তারাও আসতো, দিদি এক ডেকচি জল স্টোভ এ বসাতো গরম করার জন্যে(তখনো গ্যাস বা ইলেকট্রিক গাজেট আসিনি, স্টোভ আর কয়লার চুলোই তখন ভরসা) এরপর চা হতো, হাতে হাতে গরম চায়ের কাপ, লেরো বিস্কুট,আমি চা শেষ করেই ছুটতাম সাজি হাতে ফুল তোলার জন্যে! সারা বছর ফুল তুলি বা না তুলি ঐ দিনটা অবশ্যই নির্ধারিত ছিলো ফুল তোলার জন্যে! চোখের সামনে পুব দিক অল্প অল্প করে ফর্সা হচ্ছে, বাতাসে হিমেল পরশ,  শিউলির গন্ধ,,মাঠ ঘাট শিশিরে মাখামাখি! ঘন্টাখানেক ফুলতুলে কোনোরকমে বাড়ী দিয়েই বাড়ির পাশে "অমল সংঘ" ক্লাব এ ছুটতাম ফুটবল খেলার জন্যে, বেলা 9.00নাগাদ ক্লান্ত বিধস্ত হয়ে বাড়ী ফিরে স্নান করে মার হাতে তৈরী পরোটা আর খোসাশুদ্ধ আলুর চচড়ি খেয়ে বিশ্রাম করতাম, সেদিন পড়াশুনার সাথে আড়ি থাকতো!

এর মাঝে একটু একটু করে কালো দূর্গা খ্যাত মার আকার সম্পূর্ণতা পেতো, পঞ্চমীর আগের দিন মাকে ঘাম তেল লাগিয়ে চকচকে করে নতুন কাপড় পড়ানো হতো, হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হতো, চোখ আঁকার সময় কারোর কাছে থাকার অনুমতি থাকতো না, পঞ্চমীর আগের দিন মাকে সম্পূর্ণ সাজিয়ে গুছিয়ে তোলা হতো আর পঞ্চমীর থেকে ঢাকি ভাই এর ঢাকে কাঠি পরে যেতো! কালো দূর্গার মণ্ডপের সামনে একটা ঘুগনি আর ফুচকার দোকান বসতো, তখন চাইনিজ, মোমো বা মুঘলাই খানার চল ছিলোনা বা পাওয়াই যেতোনা এমনকি রোল অব্দি!

পঞ্চমীর থেকে পুজো পরিক্রমা শুরু হতো,  নতুন কাপড় পড়ে হেঁটে হেঁটে বন্ধুরা মিলে ঠাকুর দেখতে বেড়াতাম, আমাদের আশেপাশে মোটামুটি পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার দূরত্ব হেঁটেই ঘুরতাম! এগ্রিকো, টেলকো, গোলমুড়ি, বার্মামাইনস, বাড়িডি, কাশিদীহ, বারোদুয়ারী, আমবাগান এসব জায়গার পুজো হেঁটেই ঘুরতাম, পথে কখনো পচিশ পয়সার হাফ প্লেট ঘুগনি বা সত্তর পয়সায় একটা দোসা, বা পঞ্চাশ পয়সার চাট ইত্যাদি খেতাম, তখন 5টা ফুচকার দাম ছিলো পচিশ পয়সা, একটা কাঠি আইস ক্রিম পাঁচ পয়সা,  কাপ আইস ক্রিম যারা খেত তাদের আমরা ঈর্ষার চোখে দেখতাম। পঞ্চমী, ষষ্টি ঠাকুর দেখে সপ্তমীর সকাল থেকে কালো দূর্গার পুজোতে গিয়ে বসতাম, ওখানে তিনদিন দুপুরের ভোগ(অষ্টমীর দুপুরে গরম ভাত আর বলির পাঁঠার মাংস, তখন তিনদিনই পাঁঠা বলি হতো ) খেতাম, সন্ধ্যায় ধুনুচি নাচ এর সাথে বিখ্যাত সব পুজোর গান আশা, লতা, কিশোর, মান্না বা আরো শিল্পীর কণ্ঠে সে এক স্বর্গীয় পরিবেশ মনে হতো!  নবমীর রাতে মনটা খুব খারাপ হয়ে যেতো কেমন একটা শূন্যতা গ্রাস করতো যেই চিন্তা করতাম কাল বিসর্জন! বিসর্জনের সকালে ঘুম ভাঙতো গুড় জালের গন্ধে, তারসাথে কুঁচো নিমকি ভাজার গন্ধ, ঘুম থেকে উঠেই বাইরে এসে দেখতাম মা, কাকিমা, ঠাকুমা পিসিরা সবাই ব্যাস্ত মুড়ি, চিড়ার মোয়া, নারকোলের নাড়ু, তক্তি, কুচো নিমকি তৈরী করতে, একদিকে বড় একটা গামলায় কাবুলি মটর ভেজানো যা দিয়ে ঘুগনি হবে, একটু বেলা করে বাবা আমাকে নিয়ে বাজার যেতো, বাজার থেকে মটন কিমা নেওয়া হতো ঘুগনীর জন্যে, এর সাথে আনুসাঙ্গিক বাজার করে বাবার সাথে বাড়ী ফিরতাম, ঐ দিন বাবার ছুটি থাকতো, ততক্ষনে মা আর কাকিমা সিঁদুর খেলে বাড়ী ফিরত, দুপুরে তাড়াতাড়ি স্নান খাওয়া সেরে মেইন রাস্তায় আর সবার সাথে গিয়ে দাঁড়াতাম, ঐ রাস্তা ধরে একটার পর একটা প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্যে সুবর্ণরেখা নদীর দিকে এগিয়ে চলতো, খুব ইচ্ছে হতো ঐ মিছিলে পা মিলিয়ে সুবর্ণরেখা যাওযার কিন্তু বাবা মার বুকুনির ভয়ে সাহস হতোনা, আমার কিছু অবাঙালি আমার থেকে বয়সে একটু বড় যারা ওরা যেতো আর সন্ধ্যে বেলায় ওদের কাছে বসে গোগ্রাসে নদীর পারে বিসর্জনের গল্প শুনতাম, এর পর শান্তি জল আসতো, শান্তি জল নিয়ে নতুন প্যান্ট শার্ট পড়ে বড়োদের প্রণাম করে পাড়ায় বেড়াতাম দশমী সারতে, ঐ সময় দশমী চলতো প্রায় কালী পুজো অব্দি, যার জন্যে মাঝে মধ্যেই বাড়িতে কুচো নিমকি, মোয়া ইত্যাদি বানানো হতো কিন্তু তার জন্যে মা ঠাকুমাদের কখনো বিরক্ত বা অভিযোগ করতে শুনিনি!এইসমকার দুটো ঘটনা আমার খুব মনে আছে,  দুটোই নবমীর রাতে, প্রথমটা নবমীর দিন রাতে একটা পুজো প্যান্ডেল এ যাত্রাপালা হবে, তখন খুব যাত্রার চল ছিলো, কলকাতা থেকে বড় বড় যাত্রাদল যেতো পালা করতে, বাবা যাত্রা দেখতে খুব ভালোবাসতো, বাবা যাবে বলে বেড়াতে যাবে আমার দাদা বায়না ধরলো তাকেও নিয়ে যেতে হবে, অনেকক্ষন ঘ্যানঘ্যান করার পর বাবা নিয়ে যেতে রাজী হয়, আমাদের কোয়ার্টার থেকে যেখানে পালা হবে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে! ফাঁকা মাঠে যাত্রার আয়োজন করা হয়েছে, নিশুল্ক প্রবেশ, বাবা দাদাকে একটা জায়গায় বসিয়ে বললো " এখানে বসে থাকো আমি এখুনি আসছি " পালা শুরু হতে তখনো মিনিট পনেরো বাকি, তো বাবা দাদাকে বসিয়ে রেখে পান খেতে একটা পান দোকানে গেলো, কিছুক্ষন পরে এসে দেখে দাদা নেই, বাবার যাত্রা দেখা মাথায় উঠলো,  চারদিকে খোঁজ করেও দাদাকে পাওয়া গেলোনা, বাবা ভয়ে ভয়ে বাড়ী এসে দরজার কড়া নাড়তে মা দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলো " একি তুমি একা, বাবু (দাদার ডাক নাম) কোথায় "! বাবা আমতা আমতা করে কিছু অজুহাত দিতেই যাচ্ছিলো তখনই দেখলো দাদা খাটে শুয়ে ঘুমাচ্ছে, বাবা হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে দাদার কান ধরে উঠিয়ে বসালো, এবার মা বলে উঠলো" তোমার জ্ঞান গম্মি নেই! একটা বাচ্ছা ছেলেকে রাত বারোটায় একা বসিয়ে চলে গিয়েছিলে"! এই নিয়ে মা বাবার ঐ রাতে চাপান উতার শুরু হলো! আসলে বাবা দাদাকে বসিয়ে যাওযার কিছুক্ষন পরেই দাদার মনে হতে থাকে যদি বাবা না আসে, ভুলে যায়! ঐ ভয় থেকে দাদা ওখান থেকে বেড়িয়ে ছুটতে ছুটতে বাড়ী চলে আসে। দ্বিতীয়টা আমাদের কোয়ার্টার এর থেকে কিছু দূরে " বিহারি ক্লাব " বলে একটা ক্লাব ছিলো ফি বছর ওরা পুজো করতো আর নবমীর দিন রাতে ক্লাবের মাঠে নিশুল্ক সিনেমা দেখানো হতো আমরা বলতাম ফকোটিয়া সিনেমা। সেবার সিনেমা চলছে, বইটার নাম ছিলো "সবন ভাদো" নিশ্চল হয়ে সিনেমায় ডুবে গিয়েছি, হঠাৎ সামনের দিকে শিদগড়া বাজার সেই দিকটায় দেখছি আকাশের রং একটু একটু করে লাল হচ্ছে, হঠাৎ তার মধ্যে কেউ চিৎকার করে ওঠে "আগ লাগালবা"!ব্যাস সব মিলিয়ে কয়েকশো লোক ওদিকে দৌড়াই, গিয়ে দেখি বীভৎস আগুন লেগে একের পর এক দোকান ছারখার হয়ে যাচ্ছে, এরমধ্যেও কিছু লোক দোকান লুঠতে বাস্ত্য! আমরাও কিছু বন্ধু একটা পানের দোকানের থেকে কোনোরকমে কিছু লজেন্স আর বিস্কুট বার করি, এরমধ্যে পুলিশ আর দমকল চলে আসে, পুলিশ পুরো জায়গা জুড়ে ব্যারিকেড করে আর দমকল আগুন নেভায়! ভোর রা নাগাদ আগুন নেভে, দোকান মালিকদের হাহাকার, কান্নার মাঝে ভোর বেলা আমরা বাড়ী ফিরে আসি!

এরপর ক্লাস এইট পড়াকালীন বাবা L5 কোয়ার্টার নিয়ে চলে আসে এগ্রিকোতে, তখন বন্ধু বান্ধবের সংখ্যা আরো বেড়েছে, এগ্রিকোর পুজো মণ্ডপে আমার থেকে কিছু সিনিয়র দাদারা আমার বন্ধু এবং দাদাসম, ওদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, ওখানে পুজোর তিনদিন ভোগ(আমরা বলতাম মালসা ভোগ, মাটির হাড়িতে খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি আর পায়েস দেওয়া হতো!) বিতরণের দায়িত্বে আমরা কজন থাকতাম, সকালে টাকা দিয়ে রশিদ কাটতে হতো আর বেলা এগোরোটা থেকে ভোগ বিতরণ শুরু হতো, রশিদ দেখিয়ে ভোগ নিতে হতো!  ভোগ এর সবচেয়ে বেশী চাহিদা থাকতো অষ্টমীর দিন। সারাদিন মণ্ডপে কাটিয়ে সন্ধ্যে বেলায় সব বন্ধুরা মিলে মণ্ডপেই আড্ডা মারতাম আর নবমীর রাতে স্কুটার নিয়ে বেড়ানো হতো, একটা স্কুটার এ দুই জন! সারারাত জামশেদপুর চষে ঠাকুর দেখা হতো! এই প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা মনে পরে গেলো, তখন ক্লাস টেন, সেবার জামশেদপুর এ পেট্রল এর প্রচন্ড আকাল, পুজোর ঠিক আগে ট্যাংকার ধর্মঘটের জন্যে, পাম্প এ পাম্প এ বিশাল তেল নেওয়ার লাইন! সে বছর দাদা একটা নতুন স্কুটার নিয়েছিল "অলউইন পুষ্পক", ঐ স্কুটার এই আমার বাইক আর স্কুটার চালানো শেখার হাতে খড়ি! তো আমিও পঞ্চমীর দিন লাইন দিয়ে তিন লিটার তেল ভরালাম, নবমীর দিন রাত এ ঘুরতে বেড়াবো বলে। তখন প্রায় রাত দশটা! দাদাকে ম্যানেজ করে আমার এক বন্ধু(যদিও বয়সে আমার চেয়ে 10বছরের প্রায় বড় ছিলো, আজ বছর তিনেক আগে মারা গিয়েছে যার একটা স্কুটার রিপেয়ার এর গ্যারেজ ছিলো আর ওটাই আমাদের আড্ডা স্থল ছিলো)বাবলুদার ওখানে গেলাম, চারটে স্কুটার আমার দাদারটা, একটা বাজাজ চেতক আর দুটো লামব্রেটা, রুট প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করে বেড়াতে যাবো, হঠাৎ ডাবু বলে এক বন্ধু বললো "ওর গাড়ী রিসার্ভ এ আছে, ওর বাড়িতে পাঁচ লিটার পেট্রল মজুত আছে, আমরা আগে ওখানে যাই ও তেল টা ভরেই বেড়িয়ে পরবে, এই শুনে আরো এক বন্ধু কাজল বললো, ডাবু আমাকেও এক লিটার দিস, আমার গাড়িতেও তেল কম আছে, আমি ভাবলাম এই সুযোগ আমি কেনো হাতছাড়া করি! আমিও বললাম ডাবু আমার দাদা কত তেল ভরেছে আর খরচ হয়েছে জানিনা আমাকেও এক লিটার দিস! ঠিক হলো ডাবু নিজের গাড়িতে দুই লিটার তেল ভরবে বাকি এক লিটার করে আমরা নেবো! তখন রাত্রি প্রায় সাড়ে দশটা, ডাবুর বাড়ির উল্টোদিকে একটা মাঠ ছিলো সেখানে আমরা দাঁড়ালাম, ডাবু বাড়ির ভিতর গিয়ে একটা পাঁচ লিটার তেলের জার এনে নিজের স্কুটার এ দুই লিটার ভরলো আর বাকিটা আমরা ভাগ করে আমাদের স্কুটার এ ঢেলে গন্তব্য স্থির হলো সর্ব প্রথম গোলমুড়ির "উৎকল ক্লাব" দিয়ে,সেইমতে আমরা স্কুটার স্টার্ট করে বেড়ালাম! হঠাৎ দেখলাম সামনে ডাবুর স্কুটার বন্ধ হয়ে গেল, ডাবু আমাদের বললো  " মনে হচ্ছে প্লাগ এ ময়লা এসেছে, পরিষ্কার করছি ততক্ষন আমরা যেনো পুজো মণ্ডপে গিয়ে দাড়াই ও প্লাগ পরিষ্কার করেই আসছে! ওর কথামতো একটু এগোতে আমার স্কুটারও ভুর ভুর করে নক করতে করতে দাঁড়িয়ে পড়লো, এরপর আরো দুটো! এটা দেখে বাবলুদা বললো " এটা কি করে সম্ভব যে চারটে স্কুটার ই একসাথে বন্ধ হয়ে যাবে! হঠাৎ বাবলুদার কি মনে হলো ও আমার স্কুটার এর ঢাকনা খুলে তেলের পাইপ টা খুলে আঙুলে একটু তেল নিয়ে গন্ধ সুঙে ডাবু কে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো, পেট্রল এর জায়গায় ঐ জারে অন্য কিছু ছিলনাতো! এটা শুনে ডাবু মাথা চাপড়ে বসে পড়লো! কি ব্যাপার! যা জানলাম, ডাবুর রান্নাঘরে একটা জারে ছিলো পেট্রল আর একটাতে ছিলো সর্ষের তেল(ঐ সময় পেট্রল থেকে সর্ষের তেলের দাম অনেকটাই বেশী ছিলো!) ডাবু তাড়াহুড়োতে ভুল করে পেট্রল এর জায়গায় সর্ষের তেল এর জার টা নিয়ে এসেছে যা আমরা প্রত্যেকে স্কুটার এ ঢেলেছি! সবাই এবার ডাবু কে গালিগালাজ শুরু করলো, আমাদের ঘোরা মাথায় উঠলো, পাশের একটা মাঠে স্কুটার গুলো পার্ক করিয়ে তেলের পাইপ খুলে দেওয়া হলো আর এইভাবে ট্যাংকের তেল ড্রেন আউট করে পরের দিন গ্যাস কাটার এর দোকানে স্কুটার নিয়ে ট্যাংক কেটে, সাইলেনসার কেটে সব পেট্রল দিয়ে ক্লিন করে লাগানো হলো, আমাদের ভাগ্য প্রত্যেকের ভালো যে কারোর স্কুটার এর ইঞ্জিন সিজ করেনি, এরপর প্রায় মাসখানেক স্কুটার চালালে সাইলেনসার পাইপ দিয়ে পোড়া সরসো তেলের গন্ধ বেড়াতো!

এরপর শুরু হলো কলেজ জীবন, এর মধ্যে বাবা টাটার থেকে রিটায়ারড করেছে, পুজোর আনন্দ সামান্য হলেও ফিকে হয়ে গিয়েছে কারণ পকেট এ টান ধরেছে। পকেট খরচ চালাবার জন্যে দিনে একটা ইনডেন এর ডিলার এর কাছে চাকরি ধরেছি আর সন্ধ্যে বেলায় পড়াশুনা চালিয়ে যেতে একটা সান্ধ্য কলেজ এ ভর্তি হয়েছি। কেনো জানিনা জীবন যুদ্ধ শুরু করার পর সেই একই শিউলির গন্ধ, ঢাকের আওয়াজ, সেই পুজোর কোলাহল, উন্মাদনা আর আগের মতো আকৃষ্ট করতোনা,সাথে সাথে এটাও বুঝতে পারছি কোথায় যেনো তখন আর এখন এর মধ্যে একটা শূন্যতা তৈরী হয়ে গিয়েছে! এরপর বিবাহের সুবাদে প্রথম প্রথম বছর দুই শ্বশুর বাড়ির সবাইকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেড়ালেও সেই ছোটবেলার পুজো, তিনদিনের ছয় টাকার হাত খরচা, কালো দূর্গা পূজার(কালের নিয়মে যা বহুদিন পূর্বে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।)সেই নির্মল আনন্দ, মহালয়ার সেই লেরো বিস্কুট, চা, শিউলির সুবাস এখনো মন কে ভারাক্রান্ত করে! ধীরে ধীরে পুজোর এই উন্মাদনা, উচ্ছাস জীবন থেকে হারাতে হারাতে এমন হয়েছে এখন পুজোর ঐ তিনদিন পালিয়ে এমন জায়গায় চলে যাই যেখানে স্মশানের স্তব্ধতা, সভ্যতার ছোঁয়া খুব একটা প্রকট হয়নি, অনারাম্বর একটা দুটো সেই পুজো যেখানে আন্তরিকতা আছে, তালপাতার থালা বা মাটির হাড়িতে খিচুড়ি ভোগ আছে কোনো চাকচিক্য নেই, জৌলুস নেই, থিমের ছোঁয়া নেই!এখন যেটা পুজো মানেই আড়ম্বর, কর্পোরেটের ছোঁয়া, থিম এইসবের আড়ালে আসল পুজোটাই যাচ্ছে! এখনকার বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে শাপলা চেনেনা, মালসা কি জানেনা, পুজোর সময় ফোটা ছাতিম গাছ বা তার ফুল চেনেনা হয়তো ব্যার্থতা আমাদেরই যারা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কে এগুলো শেখাতে উৎসাহ বোধ করিনি!

...(সমাপ্ত)...


No comments:

Post a Comment