![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
জীবন হয়তো এমনও হয়
শাশ্বত বোস
ঝিরি ঝিরি ছন্দময় বৃষ্টির দিন। আকাশে তবু দু একটা ঘুড়ি উড়ছে এর মধ্যেই। কিছুক্ষণ পরেই একটা ঘুড়ি কেটে ভেসে গেল। কত নগর-বন্দর, বাঁধানো ছাদ, অন্তঃপুর, নির্মল দৃশ্য পেরিয়ে, অলিগলি পথের ভুলভুলাইয়া হয়ে আকাশেই মেঘের মধ্যে মিলিয়ে গেলো ঘুড়িটা! যেন পেটভর্তি অফুরান জন্মস্মৃতির মাঝে সেটাকে গপ করে গিলে নিল, নীলের টুঁটি কামড়ে ধরা কোন গাংচিল! ঠিক যেন মৃত্যুর কিছু পূর্বের কোন সংসারী মানুষের মুখ! এ দৃশ্য আগেও কয়েক হাজার বার দেখেছেন সুশীল, তবু এখন দৃশ্যটা দেখতে দেখতে মনের ভেতরটা কেমন জানি শিরশির করে উঠল ওঁর। আজ সকালে লিখতে বসে লেখায় মন নেই, চোখ কেবল চলে যাচ্ছে বাইরের দিকে। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ঝাড়া দেড় ঘন্টা যোগা-প্রাণায়াম, বাড়ির পাশের জগার্স পার্কে জগিং, বাড়ি ফিরে স্নান সেরে লিখতে বসা, এই তাঁর নিত্য রুটিন। নাহ! পুজো-আচ্চা-ঠাকুর-দেবতা এসবে কোনোদিনই বিশেষ আস্থা নেই সুশীলের। লেখালিখিই তাঁর কাছে অনশ্বর ঈশ্বর সম। লিখতে বসে তাই রোজ একটা করে ধুপ জ্বালাতে ভোলেন না তিনি। তাঁর স্ত্রী বেঁচে থাকাকালীন এই লেখার সময়টা, এক ফ্লাস্ক গরম চা বানিয়ে এনে, তার লেখার টেবিলে রেখে দিয়ে যেতেন রোজ। লিখতে বসলে মাঝে মাঝে চা খাওয়াটা দীর্ঘ্যদিনের অভ্যাস সুশীলের। শুধু মাত্র লিখবেন বলে কেন্দ্রীয় সরকারী চাকরী থেকে ভি.আর.এস নিয়েছিলেন সুশীল। দেশের জমিজমা নিজের আত্মীয়দের কাছে বেঁচে দিয়ে, নিজের ছেলে রোহন আর স্ত্রী রমনা কে নিয়ে কসবার এই দুই বেডরুমের ফ্ল্যাটটায় সেটল করে গেছিলেন। রোহন তখন মাধ্যমিক দিয়েছে সবে। বয়স কত আর! ওই ষোলো-সতেরো হবে। রমনা চুয়াল্লিশ। তারপর তো কসবা খালে সংস্কার হয়েছে কতবার। পাটুলীতে ভ্রাম্যমান বাজার বসেছে। ই.এম. বাইপাস, ‘বিশ্ব বাংলা সরনী’ হয়ে গেছে। জয়েন্টে চান্স পেয়ে দুর্গাপুর আর.ই কলেজে পড়তে হোস্টেলে চলে গেল রোহন। সেখানে চার বছর কাটানোর পর চাকরী নিয়ে বিদেশে। বরাবরই পড়াশোনায় মেধাবী ছাত্র ছিল ও। এরকম কিছুই তো ওর থেকে আশা করেছিলেন সুশীল। প্রৌঢ়ত্বের চৌকাঠে পৌঁছে নিজের স্ত্রীকে আরো কাছে পেয়ে, পরম শান্তিতে লেখায় ডুব দিলেন সুশীল। সংসার উপান্তে পৌঁছে ‘ইনভেস্টমেন্ট যা আছে, দুজনের বাকি কটা দিন হেসে খেলে চলে যাবে’, এই আনন্দের খনজনি যেন দিনরাত কানের কাছে বেজে চললো ঝনঝন। কিন্তু এই কুসুম কুসুম সুখী গৃহস্থের আখ্যান যেন হঠাৎ করে ভেঙেও গেল, আকাশের পশ্চিম দিকের কোণে জমে থাকা একটা কালো মেখখণ্ডের ছায়া নেমে এলো যেন গোটা জীবন জুড়ে! পঞ্চাশের দোরগোড়ায় এসে হুট করেই সুশীলের স্ত্রী হৃদরোগে মারা গেলেন, প্রায় বিনা নোটিশেই। নার্সিংহোমে নিয়ে যাবার সময়টুকু অবধি পাওয়া গেলো না। সিভিয়ার করোনারি থ্রম্বোসিস! ততদিনে দীর্ঘ্য পনেরো বছরের লেখালিখির জীবন কাটিয়েছেন সুশীল। তিলতিল করে গড়ে তুলেছেন নিজের সাম্রাজ্য! আধুনিক বাংলা সাহিত্যে নারীকেন্দ্রিক থেকে সামাজিক মনস্তত্ত্ব, ভৌতিক কিংবা রহস্য থেকে রম্য রস, যে কোনো ধারায়, যে কোনো ঘরানার লেখায়, সুশীল সেন যেন একচ্ছত্র অধিপতি এখন। পত্নী বিয়োগের পর লেখালিখির ভূতটা যেন আরো বেশী করে পেয়ে বসলো সুশীলকে। হয়তো মৃত্যুর পরে পড়ে থাকা দিনের ছায়ার মতন, ছোপ ছোপ নিঃসঙ্গতা, ওঁর মন মাথা জুড়ে যাতে আরো বেশী করে জাঁকিয়ে বসতে না পারে, সেই জন্যই এই সৃজনশীল কেমোফ্লাজ! কৃষ্টিচর্চ্চা হোক বা নিজের ব্যক্তি সংবেদনকে আড়াল দেবার ভণ্ডামি, সেদিনের চাকরী ছাড়ার সিদ্ধান্তটাকে কিন্তু আজ মনে মনে কুর্নিশ জানান সুশীল।
মা মারা যাবার পর বাবার কথা ভেবেই দেশে ফিরে আসে রোহন। কলকাতাতেই পোস্টিং নেয়। বেশ মোটা মাইনের ডেটা এনালিটিক্স এর চাকরী! সুশীলেরও মোটা টাকা পেনশন! সব মিলে বাবা-ছেলের ঝাড়া হাত পা জীবন চলে যাচ্ছিল বেশ। কিন্তু বাঁধ সাধলেন সুশীলের মায়ের পেটের বোন কমলিনী, ‘কমলি’। এই ছাড়া ছাড়া দুনিয়াতে এই কমলিনীই হলেন ওঁদের একমাত্র সুহৃদ, আপনার জন! উনিই নিয়ম করে ওঁদের বাপ বেটার খোঁজ খবর নেন। রোহনকে তো নিজের প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবাসেন এই পিসি। রোহন তখন পেটে, রমনার কন্ডিশন একবার খুব সিরিয়াস হয়েছিল। এমনিতেই ওঁর গাইনোলজিক্যাল ক্রিটিক্যালিটি ছিলই। প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে সেটা আরো বেড়ে গিয়ে প্রায় প্রাণ সংশয় হয়েছিল! তখন এই কমলিনী আর তপন মানে ওঁর হাসব্যান্ড, এঁরাই ডাক্তার-ঘর-হাসপাতাল সব করেছিলেন। তারপর তো সুশীল-রমনার কোল জুড়ে রোহন এল। রোহন যখন বিদেশে, যখন একটু একটু করে বার্ধক্য আর রোগভোগের যুগল গ্রাসে পড়ে রমনা আস্তে আস্তে বিছানা নিচ্ছেন, প্রায় বাড়ি থেকে আর বিশেষ বেরোতে চান না, সেই সময় এই কমলিনীই রোজ বিকেলে এবাড়িতে এসে, পাশের জগার্স পার্কে নিয়ম করে রমনাকে নিয়ে হাঁটতে বেরোতেন। তা এহেন কমলিই একদিন শুভক্ষণে, মানে সেই যেদিন ‘গোধূলি লগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা’, সেইরকম একটা উপচে ওঠা বিকেলবেলায় মোক্ষম কথাটি সেরে বসলেন, “দাদাগো, বাবানের বে দেবে না?” বাবান রোহনের ডাক নাম। সুশীলের বাবার দিকে আদি বাড়ি কাটোয়ায়। কাটোয়ায় সেনেদের ভীষণ দপদপা ছিল একসময়ে, ‘জমিদার, রাজা-রাজড়াদের থেকে নাকি কিছু কম নয়’, এরকমই এতকাল শুনে এসেছেন সুশীল! তাছাড়া ওঁদের ফ্যামিলির কেউ একটা ফ্রিডম ফাইটার ছিলেন। ‘এরকম একটা প্রেস্টিজিয়াস ফ্যামিলির মেয়ে হয়েও, কমলিটা সেই গাইয়াই থেকে গেল’, মনে মনে গজরাতে থাকেন সুশীল। আসলে অনেকগুলো দিন কলকাতায় কাটিয়েও গ্রাম্য ভাষার টানটা পুরোপুরি যায়নি কমলিনীর মুখ থেকে। এমনিতে ঠিক আছে, কিন্তু মাঝে মধ্যেই ঘরোয়া পরিবেশে মুখ ফস্কে দু একখানা বেরিয়ে পরে। সে নিয়ে অবশ্য ওঁর নিজের কোন সংকোচ নেই। আর তাঁর আশেপাশে কে কি ভাবলো তাতে তাঁর ভারী বয়েই গেলো!
“দাদা বলি কথা শোনো। উঠতি বয়সের ছেলে! বলি ভালো চাও তো এবেলা ছেলের বে দে দাও। এই আমি বললুম! কোথাও কোন লটর পটর করে বসে আছে কিনা খোঁজ নাও। ছেলেকে শুধোও। বাবান ছেলে আমাদের হীরের টুকরো ছেলে! নিজেই দেখে টেখে রাখলে তো আর অসুবিধেই নেই! ভালো দিন-ক্ষণ দেখে বে দে দাও। ব্যাস চুকে গেলো ল্যাটা!” তা রোহন অবশ্য সে কথার মান রাখলো, আর জিজ্ঞেস করাকরির অপেক্ষা না করে, আষাঢ়স্য দ্বিতীয় দিবসে নিজের আদরের পিসির সাধ পূর্ণ করে দিয়ে, অফিসেরই এক কলিগকে রেজিস্ট্রি করে নিয়ে এসে তুললো বাড়িতে! ‘হৃদয় গগনে সজল ঘন নবীন মেঘে রসের ধারা বরষে’, সুশীল নিজে লেখক মানুষ আর লেখালিখির সাথে যুক্ত মানেই তাঁকে তো প্রগতিবাদী হতেই হবে! তাছাড়া সুশীল নিজেও মন থেকে এইসব ‘দেখেশুনে, ঠিকুজী-কুষ্ঠী মিলিয়ে ছেলের বিয়ে দেওয়া’ জাতীয় সেকেলে ক্লিশে কনসেপ্টে বিশ্বাস করেন না আগা গোড়াই। ঠিক যেমন, ‘দুটো পরিবারের নিজেদের মধ্যে পরিচয়, মত দেওয়া-নেওয়া থেকে শুরু করে, শালিগ্রাম, অগ্নিস্বাক্ষী এসব অচল এখনকার দিনে!’ এটাও তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। তবু লোকলজ্জা বলে তো একটা ব্যাপার আছে! তাই লেখার জগতের বিশিষ্ট জন, আশ-পড়শী, পাশ-পড়শী, সাথে রোহনের অফিসের বন্ধুবান্ধব, সুশীলের নিজের ক্লোস রিলেটিভস, সকলকে নিয়ে একটা রিসেপশন পার্টি ডেকে, পেট পুড়ে খাওয়া দাওয়ার একটা ব্যবস্থা রেখেছিলেন, এক সুজন সন্ধ্যায় কলকাতার রোটারি ক্লাবে। তা সে যতই মেনু হোক না কেন ক্যাটারিংয়ের চলতি কাঁচা কাঁচা বেবি নান সাথে গাঢ় জলপাই রঙের পালক পনীর, উপস্থিত অভ্যাগতদের টেস্ট বাড ঝলসে দেওয়া গরম-গরম, শক্ত-শক্ত ‘মাটন রোগান জোশ’! যদিও তাতে রোগ ভাসছিল লাল লাল আর সেটা খানেওয়ালাদের জোশ ছিল পুরোদমে। খাওয়াদাওয়া শেষ হতে না হতেই ক্যাটারিং এর ছেলেরা সব রকম পদ আধ বালতি করে আর ক্যাটারিংয়ের মালিক কড়কড়ে নতুন নোট গুনে নিয়ে সুরুৎ করে হাওয়া হয়ে গেল। দেঁতো হাসি হেসে, আধসিদ্ধ মাটনের আঁশ দাঁতের ফাঁকের সবচাইতে রহস্যময় গুহা থেকে, কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে বার করার মরিয়া কসরত করতে করতে, লোকজন সব বিদায় নিল নবদম্পতিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে। লোকও রইলো, লজ্জাও রইলো! মাঝখান থেকে ‘ছেলে ধরে এনেছে’ এই শ্রেণীবৈষম্যের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেল ক্লোস সার্কেলে। শুধু ছেলের রিসেপশন পার্টিতে খুব করে রবীন্দ্রসংগীত বাজিয়েছিলেন সুশীল। সুশীলের ফ্যামিলিতে সব স্কেপ্টিকাল মানসিকতার আত্মীয় স্বজন। চারপাশের সব কিছু নিয়েই তাঁদের হাসাহাসি-ফিসফাস, বিয়েবাড়ির ভিড় ভাট্টা ঠেলে ঠুলে ইতি উতি দৌড় দিয়ে বেড়ানো ঘুরন্ত চরকিসুলভ ছানা পোনাদের ট্যাঁ প্যাঁ, বর্তমান সরকার ঘনিষ্ট বিশিষ্ট আধুনিক কবি সুগতর কবিতা পাঠ, রোহনের কর্পোরেট বন্ধুদের ড্রিঙ্কস আর স্ন্যাক্স হাতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অ্যাসেন্ট্রিক আর ডিসেন্ট্রিক কার্ভের এনালিটিক্যাল কথাবার্তা, এসবের মাঝে ‘টেগোর সঙ্গ’, ঠিক যেন ব্যস্ততম শিয়ালদহ চত্ত্বরে কোন নাম করা ওস্তাদের উচ্চাঙ্গ সংগীত পরিবেশন, গান আছে মান নেই! আসলে শয়নে স্বপনে কিংবা ভাবনার ক্ষরণে রবি ঠাকুরই তাঁর একমাত্র আশ্রয়! জীবনের যোগ কিংবা বিয়োগ প্রতিটা ক্ষণেই যেন তাঁর মাথার ভিতর রবি ঠাকুর বেজে ওঠেন। এও যে তাঁর এক স্বপ্নদোষ!
নতুন বৌমা চাকরি করেন সুতরাং ফুলসজ্জার পরের দিন নিজে হাতে বানিয়ে শ্বশুরের মুখে চা এনে ধরবেন লজ্জাবতীটি হয়ে, এ আশা কোনোদিনই করেননি সুশীল। তিনি আধুনিক মনস্ক! এসব তুচ্ছ ব্যাপারে মাইন্ড করার রুচি তাঁর কোনদিনই ছিল না। কোনদিন এ ব্যাপারে ছেলেকে ডেকে আলাদা করে কিছু বলেনওনি। শুধু রোহনের বিয়ের পর কমবয়সী একটা কাজের লোক রেখে দিয়েছিলেন। রোহন আর তার স্ত্রী অফিস বেরিয়ে গেলে সে শুধু লিভিং রুমে এসি চালিয়ে সোফায় শুয়ে শুয়ে ‘সিরিয়েল’ দেখত আর ফোনে তাঁর নতুন ‘বয়ফেন্ড’ এর সাথে গল্প করতো। প্রেমটি যে চৈত্র সেলে নতুন আমদানী সেটা অবশ্য সুশীল বুঝেছিলেন একদিন তাদের ফোনিল বাক্যালাপ ভাঙা ভাঙা আড়ি পেতে শুনে। বাম হাতের পুরোনো ট্যাটু মুছে নতুন আশিকের নাম খোদাতে চাইছিল লক্ষ্মী। ‘গৈরাহাট বিরিজের তলায়’ সেই প্রেমজ খনন এর অপেক্ষায় আকুল হয় এক কৃষ্ণাঙ্গী বিরহিনী! ‘তাহারে দেখিনা যে দেখিনা, শুধু মনে মনে ক্ষণে ক্ষণে ওই শোনা যায়’, আর তার কাজল কালো ভাসা ভাসা চোখের বিচিত্র জ্যামিতিক আঁকিবুঁকি, অন্তস্বলীলা হয়ে ঝড় তোলে সুশীলের বুকে। মনে হয় মাঝে মাঝে যখন তাঁর পড়ার টেবিলের কাছে, বেণী দুলিয়ে এসে লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করে যায়, “দাদাবাবু, কিছু খাবানি?” তখন হাতদুটো চেপে ধরে তাকে নিজের পাশে টেনে নিয়ে এসে বসান সুশীল। নিজের শিল্পী হাতের জাদুগরী আঙ্গুলগুলো বুলিয়ে দেন লক্ষ্মীর ভয়ে শুকিয়ে আসা দুটো ফুটিফাটা ঠোঁটে! ওর গলার পাশটা বেয়ে জমতে থাকা চিকচিকে ঘামের ফোঁটাগুলো রোদের মত ধীরে, খুব ধীরে ছড়িয়ে পড়ুক ওর ঘুমন্ত স্তনবৃন্তে, মেদহীন প্যাপিরাস তলপেটে, গোলাপী ধূসর যোনিদেশে! লজ্জা, ভীরুতা কাটিয়ে ওর ক্লান্ত অবসন্ন শরীর জুড়ে আঁকা হতে থাকা এই গোপন প্রেমিকের নির্বাক কামজ ভাস্কর্য্য, রচনা করুক এক গূঢ়, গোপন প্রস্রবনের! ওর কালো শরীরে তখন ঝোড়ো বাতাসের পর আছড়ে পড়া, শেষ শ্রাবণের হড়পা বান ডাকুক! ঠিক তখনই কলিং এর ঘন্টাটায় চমক ভাঙে সুশীলের। ‘আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু গন্ধভরে তন্দ্রাহারা’, হয়তো পার্সেল এ পত্রিকা বা বই পাঠিয়েছে কেউ! পোস্টম্যান সেটাই ডেলিভারি করতে এসেছে। দুপুরবেলা ফ্ল্যাটে এই সময়টা খুব একটা কাউকে আসতে অ্যালাও করেন না সুশীল। এই সময়টা ওর এক পশলা কবিতায় আত্মমগ্ন হয়ে থাকার সময়! কবিতা, যা লিখে সুশীল খ্যাতি পাননি বরং কবিতার নামে বা বেনামে বায়োলজিক্যাল আইডেন্টিটি বিহীন কোন নারীর যূথবদ্ধ শরীর হাতড়াতে চেয়েছেন তিনি বরাবর। রাস্তায় চলতে চলতে অগুনতি মুখের মাঝে ভেসে ওঠে যে মেয়েটির মুখ, যে মুখের কোন অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই, যে মুখ জুড়ে শুধু অনন্তকাল ধরে খেলা করে যায় ঋতুবৈচিত্র, একের পর এক ট্রাফিক সিগন্যাল। সেই মুখ এই বিশেষ, পরমুহূর্তেই অপ্রাসঙ্গিক! অজানা সেই মুখে হয়তো প্রতিদিন লেগে থাকে সহস্র গল্পের সাতকাহন! সেই মুখটাকে তিনি ছায়া ছায়া দেখতে পান তাঁর লেখা বিষন্ন কবিতায়। তবু কবিতা তিনি লেখেন রোজ! পরিচিত কেউ চাইলে দিয়ে দেন। এও তাঁর এক নিত্যনৈমিত্তিক পাগলামি!
সুশীলের অকবি মন বলে ওঠে, “হরি হে নিত্যানন্দ, জীবনে আসলে যত হাভাস, তত আনন্দ!” আসলে ওঁর বয়সটাই হয়তো এরকম! নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করে না! বাইরে থেকে হয়তো শুকনো, ভেতরে ফল্গুধারা! তাছাড়া রমনা মারা যাবার পর কতগুলো বছর তো একা একাই কেটে গেল সুশীলের! থাকার মধ্যে আছে শুধু খুচরো ডায়াবেটিস আর একটু আধটু ব্লাড প্রেসার! এতে কি আর শরীর বুড়ো হয়? আর যদি বুড়ো হয়ই বা মন তো ভেতরে ভেতরে পুরো বোহেমিয়ান ঘোড়া! তাছাড়া সুশীল যৌবনকাল থেকেই এরকম। বয়সকালে কত যে বান্ধবী ছিল আর তার মধ্যে স্রেফ কতজন যে শুধু ভালোবাসার দিব্যি খেয়ে বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন সুশীলের কথা ভেবে, তার গুণতি উনি নিজেই রাখেননি বোধহয়! সুরেন্দ্রনাথে পড়াকালীন শিয়ালদহ চত্ত্বরে হেন লজ ছিল না যেখানে সুশীল আর তাঁর প্রেয়সীদের গোপন অভিসার চলতো না। বিয়ের পর বিছানাতেও ওঁর পারফরমেন্স ছিল টপ ক্লাস! রমনা তো হামেশা ওঁকে বলতেন, “তুমি মেয়েদের শরীর পড়তে পারো। এরকম পড়া পড়তে খুব কম পুরুষই পারে, বুঝলে?” বিয়ের বেশ কিছু বছর পর একবার সুশীল তাঁর এক সরকারি আমলা বন্ধুর স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। রমনাকে তুমুল ভালোবাসার পরও একই নারীর শরীরে দীর্ঘ্যকাল ধরে আটকা পড়ে থাকতে ভীষণ একঘেঁয়ে লাগতো সুশীলের। ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে?’ পক্ষকালের মধুচন্দ্রিমা কাটাতে সে ভদ্রমহিলাকে নিয়ে পাহাড় থেকে সাগরে ছুটে বেরিয়েছিলেন সুশীল। পরস্ত্রীর স্বরলিপি শরীর জুড়ে ভালোবাসার নতুন অভিধান বুনতে চেয়েছিলেন হয়তো! তোলপাড় বর্ষণে যেমন কানুপ্রিয়ার বাহুমূলে কৃষ্ণপ্রেম লেগে থাকে ঠিক তেমনতর শঙ্খচূড় পিপাসা মিটিয়েছিলেন খোলা রাত আর সপ্তর্ষিমণ্ডলকে স্বাক্ষ্মী রেখে। তাদের ধরতে প্রায় হিমশিম খেয়েছিলেন সেই আমলা ভদ্রলোক, প্রশাসনে অগাধ জান-পেহচান থাকা সত্ত্বেও! এই মোহনীয় বিভাস অবশ্য ফুরিয়েছিল অচিরেই! যেমনটা সচরাচর ফোরায় আর কি! উথলে পড়া দোলনচাঁপা কিংবা ভিড় করা রুদ্রপলাশের পিপাসা সঙ্গে করে ঘরে ফিরে এসেছিলেন সুশীল, সুবোধ স্বামীটির মতন। ‘সেই তো শেষমেশ আমার কাছেই ফিরলো, পাখি পালিয়ে আর যাবে কোথায়? শিল্পী, সাহিত্যিকদের ওরকম একটু আধটু দোষ-টোশ থাকে। ওসব মানিয়ে নিতে হয়।’ এসব সাত পাঁচ ভেবে শেষমেশ নিজেকে শান্ত করেন রমনা। অবশ্য ওর আর করারই বা কি ছিল! একদিন সুশীলের অক্ষরময়তার প্রেমে ভেসে গিয়েছিলেন রমনা। একেবারে যাকে বলে লাজুক লাজুক জলকথায় সংবেদী আত্মসমর্পণ! কবিতা পর্যায়ের আদরে, আলেয়ায় ভুলে, স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো জলজ আশ্রয়ের খোঁজে ভেসে পড়েছিলেন সুশীলের হাতদুটো ধরে। তরুণ সুশীলের কলম ফুঁড়ে তখন সে এক অনন্য স্পর্শের কাহিনী, ‘আমি তো অক্ষর ছুঁয়ে বাঁচি, অভ্যেসে ঘর বাঁধি, হাতে গড়া ভালোবাসা, শরীরে তার পোড়া বিপ্লবের বাঁধুনি।’ বাড়ির অমতে বিয়ে করার সাথে সাথে আসানসোলের বাপের বাড়ির সাথে সব সম্পর্কও ছিঁড়ে যায় রমনার। ফলত এখন এসব মেনে নেওয়া ছাড়া আর তো কোন পথ খোলা নেই ওঁর কাছে! আর সুশীলের সেই আমলা বন্ধুটিও নিশ্চয়ই নিপাট পত্নীনিষ্ঠ বাঙালি পুরুষ ছিলেন! ‘যাক চেনা জানা লোকের সঙ্গেই তো পালিয়েছে! শেষমেশ ফিরে তো এল! ওরকম একটু আধটু ভুল মানুষের হয়।’, এসব মহাশূন্যের জাগতিক তত্ত্ব আওড়ে তিনিও ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিলেন। আসলে বৌ তো তাঁর, লজ্জা তো তাঁর বেশী! হাজার হোক বন্ধুর বৌকে নিয়ে পালানোয় পুরুষের মধ্যে একটা শভেনিস্ট গ্লোরী কাজ করে! একটা পুরুষ হয়ে অন্য আরেকটি পুরুষকে হারিয়ে দেওয়ার এক বেহুদা আত্মশ্লাঘা! রোহন হবার পরও একটা ছোট্ট লাল ডায়েরীতে মেয়েদের পিরিয়ডের ডেট লিখে রাখতেন সুশীল, সাথে কোন নারীর শরীর ঠিক কোথায় ছুঁলে ছটফটিয়ে ওঠে, সেসবও। রমনা জানতেন সে কথা। আজ সুশীল ভাবেন, সত্যি ভাগ্য করলে রমনার মত স্ত্রী পাওয়া যায়! এখনো পর্যন্ত্য দিকে দিকে রাখী বন্ধন আর বসন্ত উৎসবে হাজির হবার গাদা গাদা আমন্ত্রণ আসে সুশীলের কাছে। গলায় পলাশ, খোঁপায় পলাশ, চারপাশ তখন শুধু লালে লাল! সেই লাল সারা শরীরে মেখে সেলফি তুললেন হয়তো, চারপাশের ঢলঢলে কবিনীদের সাথে গলা জড়াজড়ি করে। সে ছবি ফেসবুকে আপলোড করে হয়তো ক্যাপশন দিয়ে রাখলেন, ‘আজ সকাল থেকেই দুলছি!’ সেই ছবিতে দু হাজার লাইক, হাজার খানেক লাভ রিএক্ট! ‘গুরুদেব, তোমাকেই মানায়’ কমেন্ট! ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলডোরে বাঁধা হল না’, শত শত ‘অক্ষরসেবী’ কবিনীদের বুক ভাঙা আক্ষেপ, সাহিত্যের এই অমৃত অভিলাসী প্রাণ পুরুষটিকে শুধু দুহাতে জড়িয়ে ধরেই মেটে হয়তো! আজও যখন সুশীল বিভিন্ন সাহিত্য সভায় যান, বক্তব্য রাখেন, কচি কচি মেয়েদের চোখে তিনি অপার মুগ্ধতা দেখেন। এই মুগ্ধতাকে প্রেমে পরিণত করতে জানেন সুশীল! এসব কাজে খুব বেশী সময় লাগে না তাঁর। মঞ্চে উঠে কথা বলার সময় হয়তো সেই মোহাবিষ্ট নারীটির দিকে, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ কিংবা বৃষ্টির চোখে তাকালেন কয়েকবার! কথায় সবুজ প্রকৃতির অনুষঙ্গ টেনে আনলেন! তারপর বলতেই থাকলেন, গাছেদের সাথে তার যত কথকতা, অবসর পেলেই চলে যান সবুজের জালে ঘেরা এক আষাঢ় অরণ্যের কাছে! ব্যাস! সহজ সরল শব্দের কুহক, ব্যাক্তিত্ত্বের ঝুমঝুমি হয়ে তীরের মতন গিয়ে বেঁধে ভিন্ন বয়সের দুটি পাখিকে। ততক্ষণে তাঁর কথার কোলাজে মগ্ন, আলুথালু রীনাদির হাত থেকে পড়ে রুমাল হারিয়ে যায়। হঠাৎ করেই পাখিদের হৃদয়তন্ত্রে অবেলায় উজানী বাতাস বইতে আরম্ভ করে। আয়নার এপার থেকে চুপচাপ সে দৃশ্য উপভোগ করেন সুশীল, একটা আস্ত লাইট হাউসের উপর থেকে দেখা সূর্য্যাস্তের মত! তারপর টুক করে কমবয়সী পাখিটাকে কসবার ফ্ল্যাটে ডেকে নেওয়া! লিভিং রুমের সোফায় বসিয়ে কবিতা শোনা! অপরদিকে শীতল গভীর ভেজা দুটো চোখে তখন নির্ভুল বশ্যতা ঘনিয়ে উঠেছে। রোহন তখন অফিসে, ঝি বেটিকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। লিভিং রুমের সোফাতে বসেই মেয়েটি তখন সুশীলের শিশ্নাগ্রে লেহন-শোষণ-শাসন সবই করতে থাকে! চাইতে তাঁকে হয়না, মেয়েরা এমনিই আসে ওঁর কাছে, নানা বর্ণে নানা উপাচারে! ইদানীঙ ওঁর নিজের পুরুষাঙ্গটি ওঁর নিজের সাথেই প্রতারণা করে! তাই মেয়েটির উষ্ণ মুখমেহনের বিপরীতে তার মোহগ্রস্ত ঠোঁটের প্রতিটি উচ্চারণে, নিজের জিভের সহজিয়া গমনে, ছদ্মবেশী প্রেম এঁকে দেন সুশীল! মেয়েটি খুশি হয়ে ফিরে যায়। এই দুপুরগুলোর বিনিময়ে এরা সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠা খোঁজে! ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’, এই আনুগত্য, উল্টোদিকের রঙিন পোশাক পরা নারী শরীরগুলো জুড়ে মেলতে পারা এই নিরঙ্কুশ আধিপত্য, ভেতরে ভেতরে খুশি করে তোলে সুশীলকে। কোন বাণিজ্যিক পত্রিকাকে একবার হয়তো বলে দেবেন মেয়েটির নাম। এরপর কয়েকটা সাহিত্যসভায় হয়তো দেখা হবে এই সম্ভাবনাটির সাথে। তার কবিতাময় চোখদুটি বেয়ে তখন ঝরে পড়বে শব্দের চূর্ণ বিচুর্ণতা! তারপর পুরুষের আদিম রিপুর ভারে ন্যুব্জ হয়ে হয়তো মেয়েটি চাপা পড়ে যাবে একদিন, কবিতা নিয়ে হেলাফেলা কিংবা ছেলেখেলা করার অপরাধে। সরে যে এঁকে যেতেই হবে, অপেক্ষার এই দুপুরে নতুন কাউকে জায়গা করে দিতে গিয়ে! রমণ মাত্রার অতিমারীতে সাঁতরে বেড়ানো দুপুরগুলোর এই আধা অধুরা সত্যিতে, একটা গোপন আকাঙ্খা ও অসহায়তা, মশলার মতন মিলে মিশে থাকে। খুল যা সিম সিমের মত পরিত্যক্ত দরজার একপাশে পড়ে থাকা সেই অনুচ্চারিত কবিতাগুলো, তখন শুধু যেন শব্দের আব্দারে, অভিশপ্ত অক্ষরমায়ার কবলে পড়ে, নিরন্তর খেলে চলা তিনপাত্তি নয়, এ যেন উরোগামী রক্ত মাংসের বুকে মৌন হামাগুড়ি, মৌন সওদা, আত্মপ্রেমী বাণিজ্য, মৃতের মত বেঁচে থাকা সাহিত্যের বুকে, ফুটে ওঠা এক ফোঁটা ম্যাজিক রিয়ালিজম!
সুশীল-রমনার সাধের ‘কবিতাবাড়ি’র আলসেতে কবি মোনালিসা, শর্বরী কিংবা সোমদত্তারা এক ফালি রোদ হয়ে এভাবেই লেগে থাকে অনন্ত কাল ধরে, কখনো গড়িয়ে পরে ফেটে যায় না। লেখার টেবিলে বসে কিংবা লিভিং রুমের সোফাতে অথবা প্রেম আরো গাঢ় হলে বিছানায়, তখন কবিতার টাটকা চিতা থেকে তুলে কিছু আধপোড়া শব্দখন্ড নিয়ে নতুন নতুন রান্না চাপান সুশীল। তাতে কখনো মৌরি, কখনো শুধু মৌরি নয় সাথে মেথি, কিছুটা জিরে ভাজা ফোড়ন দেন। অল্প আঁচে ভেজে নিয়ে কষে কষে প্রতিষ্ঠালোভী মেয়ে মানুষগুলোকে দিয়ে একটা নমকীন স্বাদের পুরের মণ্ড তৈরী করেন। কতটুকু শুকনো লংকায় কতটুকু লবণ, ঝাঁঝালো সর্ষের তেলে ফোড়ন, এসব খুব ভালো ভাবে জানা আছে তাঁর! তারপর রান্না করা শেষ হলে যৌন সস আর স্যালাড দিয়ে সেই পুর তিনি নিজেই পরিবেশন করেন নিজের খাবার টেবিলে! সেই ফাঁকে ফেসবুকে উঁকি দিয়ে দেখে নেন নতুন বা পুরোনো কোন লেখক কি পোস্ট দিলো, বিশেষ করে কবিতা! হ্যাঁ সেই কবিতা, যাকে তিনি জনপ্রিয়তার নিসর্গে পাননি কোনোদিনও। চিরটাকাল ভিক্ষাপাত্র হাতে দাঁড়িয়ে থেকেছেন যে গুলমোহর কবিতাদের সামনে, জাঁকজমকহীন জনশূন্য কোন আদিম গুমফার বৌদ্ধ ভিখ্খুটি হয়ে, সেই কবিতার মোহ তাঁর গেল না আজও। কবিতার নির্যাস, কবিনীদের সঙ্গম তাঁকে এক ভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত করে যেন! কোন এক পরিশ্রমী অক্ষর শ্রমিক এর ফেক প্রোফাইলের আড়ালে মুখ লুকিয়ে, স্ক্রিনে আগত দৃশ্যবিন্যাসে শব্দ কৌলিন্য খোঁজেন সুশীল। পছন্দ হলে নিজের হোয়াটস অ্যাপ চ্যাটে ফেলে নেন। বেশীরভাগই পাতে দেবার মত নয়। শব্দকে আদর করতে শেখেনি এঁরা, শুধু ধর্ষণ করে যেন। বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত সব ‘গ্রপ’ তাঁর চেনা। যে কোন পত্রিকার লেখক সূচী দেখে অনায়াসে বলে দিতে পারেন কোন গ্রুপে খেলা হল! আর হবে নাইবা কেন! তিনি ‘সুশীল সেন’! বাংলা সাহিত্যের লৌহ ঈশ্বর! অবশিষ্ট বিষের মাঝে একখণ্ড হীরে! সুগত যদি শাসকের পা চাটে তবে সেই শাসকেরই শিরোস্ত্রাণে তিনি শোভা দেন। আর অনেকটা উপর থেকে হয়তো বাকিদের খুব ছোট দেখায়, তবু দেখতে তো পাওয়া যায়! তেমনি কোন এক তথাকথিত গ্রুপ যারা তাঁর শিল্পকর্মের প্রতি অসূয়া মনোভাব পোষণ করেন অনেকদিন ধরেই, বিষয়টা নজরে ছিল সুশীলের। সেই গ্রুপেরই কোন এক নামজাদা উঠতি কবি, যাঁর হয়তো সদ্য সিগনেট প্রেস থেকে বই বেরিয়েছে, নিয়মিত সকাল সন্ধ্যা নিজের সৃজনশীলতা প্রচার করছেন ফেসবুকে, তাঁর কবিতার পোস্টে গিয়ে বেনামে লিখে দিয়ে এলেন সুশীল, “বাল হইসে!” সুশীল মনে করেন, ‘ঈশ্বরের থেকে শয়তান আরো ভালো কারিগর!’ বাইরের জগৎ এই সুশীল সেন কে চেনে না! হিংস্র, ক্ষীপ্র, কুটিল চিন্তার স্রোত তখন চুম্বকের মতন আকর্ষণ করে তাঁর আমিত্ত্বের শলাকাকে! বাংলার সাহিত্য প্রেমীদের মনন জুড়ে শুধু যে তিনি থাকবেন এবং রয়েই যেতে হবে তাঁকে, ‘চিরকালীন’ হয়ে। আবার কয়েকদিন পর নিজের অরিজিনাল প্রোফাইল থেকে গিয়ে হয়তো সেই পোস্টেই তিনি লিখবেন, “অভিনন্দন!” ‘অভিনন্দন’, এই বাহুল্য বর্জিত শব্দটাই অবশ্য সুশীল প্রশংসাসূচক অর্থে ব্যবহার করেন সব সময়! ওই একটা ছোট্ট শব্দ লিখলেই যেন সমস্ত উন্নত সৃষ্টির প্রতি নিজের দায়বদ্ধতাটুকু ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যায় এক নিমেষে! নীতিবোধ বনাম ‘টিকে যাওয়ার লড়াই’ এই ডাইকোটমির আসল উৎসমূল যে বিশেষ ধরণের শব্দহীনতা, তার তো কোন ক্লিনিক্যাল চিকিৎসা নেই, তাই জোরে বৃষ্টি পড়ার শব্দ, ঠান্ডা বাতাস কিংবা আগত মেধাবী কবিদের উষ্ণ আলিঙ্গনেও মাথা থেকে এই ছ্যাঁচড়া ভাবনাগুলো যায় না সুশীলের। পয়সা ছাড়া লেখেন না সুশীল কিংবা নতুন কোন পত্রিকার জন্য লেখা কিছু বেশীদিন ফেলে রাখেন না তিনি। টাকা দিতে গড়িমসি করছে দেখলেই সে লেখা অন্য জায়গায় দিয়ে দেন। অবশ্য পলিসির এই ধারাপাত ছোট-বড়-মেজ-সেজ সবার জন্যই প্রযোজ্য এবং বাজারে এটাই সুশীল সেনের ওপেন সিক্রেট! হুঁহুঁ বাওয়া, ‘তুমি মোর পাও নাই পরিচয়!’
আত্মহীন প্রদর্শনের অকৃত্রিম নেশায়, বিষবাষ্পের অবিরাম দংশনে, হয়তো এর কিছু পরেই হাতে ধরা ফোন আয়নাটার গোটা স্ক্রিন জুড়ে শুরু হয়ে যাবে, “ঞ্চ যোগ করে ভাত হল ভাঞ্চাত, ডাল হল ডাঞ্চাল!” এবং অবধারিত ভাবে বড় বড় করে তাতে লেবেল সাঁটা থাকবে “বাঞ্চোৎ ফাঞ্চোৎ কি সব বলছে!!” সুশীলের তর্জনী নড়া চড়া করতে থাকে চঞ্চল ভিডিওগুলোর গা বরাবর উপর থেকে নীচে। সমবেত কলতলায় তখন শিহরণ তুলেছে পেআউট আর রিচের ফাঁদে পা দেওয়া লোভী গৃহিণীদের শ্রমহীন শিল্পবিপ্লব! স্বচ্ছ পোশাকে অর্ধ উলঙ্গ হয়ে হয়তো তাঁরা ততক্ষনে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছেন কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই! সুতোর অলংকারে গায়ে সেঁটে জড়িয়ে যাওয়া কাপড়ের ফাঁক থেকে উঁকি দিচ্ছে এক অনায়াস শরীর বিহঙ্গ, কমললতা স্তন, পুরু নিতম্ব! কমেন্ট সেক্শনে তখন উপচে পড়ছে হাজারখানেক টুটা ফাটা পৌরুষ! নারী শাসিত মৃত্যুর দোকানে আজীবন কারাবাসের দণ্ড পাওয়া, নিজেদের মেল ইগোর কণ্টকময় শরীরের জন্য, হয়তো নিবৃত্তির সেলাই খুঁজছে তারা! যশলোভী কবিনী আর এই সব কনটেন্ট মেকাররা কোথাও গিয়ে মিলে মিশে একাকার হয়ে যান, সুশীলের চোখে। এঁদের এই শরীর দেখিয়ে ভিক্ষে চাওয়ার কৌশলটা মনে মনে বেশ উপভোগ করেন সুশীল। ঠিক সেই মুহূর্তে পৃথিবীর সব স্বামীকে ‘বঞ্চিত বাঞ্চোৎ’ ভেবে আর নিজেকে সাক্ষাৎ কামদেব মনে করে দুষ্টুবীর্য্যের উল্লাসে মন ভরে ওঠে তাঁর। ঢুলুঢুলু চোখে নিজেদের নারী বিশারদ ভাবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাজানো প্রশ্নগুচ্ছ শুনে তিনি অবাক হন! হয়তো কিছুটা দিগ্ভ্রান্তও মনে করেন এঁদের! “আপনি কি জানেন মেয়েরা কেন এতো ফুচকা খেতে ভালোবাসে? আপনি কি জানেন মেয়েরা রতিসুখে এতো মজা পায় কেন? আসলে সেই মহাভারতের সময় শ্রীকৃষ্ণ...!”
“ওরে বালছাল, যৌনক্রীড়ায় নারী কেন দাঁও মেরে বেরিয়ে যায় জানো? কারণ তোমাদের মত না-মরদ, খেলাটা ভালো করে খেলতেই জানে না! আফটার অল ইটস এ গেম! বিগ গেম! ঠিক সময় তলায় ফেলে শঙ্খিনী স্তনে মোক্ষম একটা খপ, ঋতূমতীর টাটিয়ে ওঠা স্তনবৃন্তে আলতো একটা মোচড়, তার তৃষ্ণার্ত প্রজাপতির ধূসর উড়াল ডানার মতন রুক্ষ্ম যৌনকেশে, চিরুনির মত আঁচড়, ব্যাস! বহু ক্ষুধার্ত নারীও এক লহমায় পোষ মানা ময়নাটি যেন!” এসব খেলায় সুশীল সেন চিরটাকাল সিদ্ধহস্ত! যেই না সুশীল তাঁর অভিজ্ঞ দিনেমারী জাহাজের মাস্তুলে যোনিচিহ্ন আঁকা পাল তুলে দিলেন কেষ্ট ঠাকুরের মত, অমনি কিনা এ.আই. বাবাজি আর পালাবার পথ না পেয়ে রূপ পাল্টে, খনা গলায়, কদর্য, কাপুরুষ কবিতার মত হাতে মাইক দুলিয়ে নেচে নেচে গান ধরল, “নৈতিকতার স্খলন দেখেও, মানবতার পতন দেখেও, নির্লজ্জ অলসভাবে বইছো কেনো..ও..ও..ও?” সে গানের তখন কিন্তু আর কোন মানে দাঁড়ায় না। শুধু ঝুটো শোলার সাজ কিংবা শব্দ জখমের নির্মম খবর হয়েই সে ভেসে ওঠে এই কবিতাবাড়ির আনাচে কানাচে, আলোহীন বিবর্ণ রাতে ভন্ডসন্ন্যাসীর লোলুপতার ফাঁদে জড়িয়ে গিয়ে, নিঃশব্দ জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলা মায়াহরিণীর মতন!
দেখে শুনে ছেলের বিয়ে দিতে পারেননি সুশীল। সেই বিয়েও তেমনি ছমাসের বেশী টিকলো না। আজকালকার শ্রেণীহীন, জাতপাতবিহীন, সেক্যুলার কসমোপলিটন মানসিকতার বিয়ে যেমন হয় আর কি! বিয়ের মাস দুয়েকের ভিতরে পাশের ঘরে অশান্তি শুরু! ততদিনে অবশ্য রোহনের হানিমুনের নিউজিল্যান্ড ট্যুরটা কমপ্লিট হয়ে গেছে। বেশ কিছুদিন ফাঁকা ফ্ল্যাটে বেশ কিছু ভালো ফিগারের কবিতার কনফিগারেশন, ভালো করে মেপে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন সুশীল। শোনপাঁপড়ির মত করে চেটে খেয়েছেন, তাদের ইতিহাস ভূগোল কিংবা আনুনাসিক শীৎকারের বিনির্মাণ! কবিতা জুড়ে তখন শুধু বুক-স্তন-যোনি! তিনি মনোবিদ! তিনিই আবার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ! কবি ছাড়া তখন তিনি বাকি সব কিছু! কিন্তু সমস্যাটা শুরু হল রোহন-অভিলাসা হানিমুন সেরে ফিরে আসার পর থেকে। রোজই রাতে প্রায় অশান্তি! চিৎকার চেঁচামেচি! মায় গালাগালি পর্যন্ত্য! দিনের পর দিন তো এটা আর চলতে পারে না! এর মধ্যেই আশপাশের ফ্ল্যাট থেকে উঁকিঝুঁকি মারা শুরু হয়ে গেছে! আর যাই হোক সুশীল সেন সভ্য সমাজের একজন বরিষ্ঠ সদস্য! রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিক! বাংলা সাহিত্যের ফাদার ফিগার! তাঁর ঘরেই কিনা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স! ‘যত নষ্টের গোড়া ওই কমলিটা! রোহনের বিয়ের পর ওর কোন এক গুরুভাইকে এ বাড়িতে নিয়ে এল! সাধের ভাইপো নিজে দেখে বিয়ে করেছে, তা সেই গুরুভাই নাকি মুখ দেখে বলে দেবেন নতুন বৌ কেমন! থেকে থেকে এইরকম অশান্তিই বা কেন হয় ওদের মধ্যে! প্রতিকার হিসেবেই বা কি করণীয়! বাবাজী যেন ত্রিকালের শীর্ষে উঠে যাওয়া বৈদিক ম্যারেজ কাউন্সিলর! স্বর্গ থেকে নেমে এসে ঈশ্বরের পা আঁকড়ে বসে রয়েছেন! আবার নামখানা বেশ বাহারী নিয়েছেন, ‘স্বামী জগন্নাথানন্দ আচার্য্য পুরী!’ অবশ্য আজকের দিনে সন্ন্যাসটা নিলে, পুরীর পাশে স্বচ্ছন্দে দীঘাটাও বসিয়ে নিতে পারতেন। ট্রেনে, বাসে, গরম চায়ে বাঙালির তো এখন এই এক ‘ধাম’ চর্চ্চা! সরকারি প্রচেষ্টায়, সরকারি খরচ-খরচায় ‘ভক্তের ভগবান’ এই বাংলায় উজিয়ে এসেছেন, এও কি কম গৌরবের!”, ভাবনাগুলোর মধ্যে নিশ্চয়ই অন্তহীন বিরক্তি ছিল সাথে হয়তো কিছুটা তাচ্ছিল্যও মিশে ছিল! আসলে এই দেখনদারি আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনার পেছনে যে একটা লঘু কপটতা আর অনেকখানি শূন্যতা লুকিয়ে থাকে সব সময়, সেটা সম্যক রূপে জানা আছে সুশীলের।
শুরু থেকেই এসবে বেশ জোরালো রকমের আপত্তি করেছিলেন সুশীল, “বুর্জোয়া ভণ্ডামি যত! কমলিটার সবেতে বাড়াবাড়ি! এ শালাও সিওর ইউ টিউব ফেসবুকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ফলো করে! ন্যাকা ন্যাকা মগা মার্কা জ্যোতিষ সব! শালা মুখ্যুর দল! ‘ইউ টিউব’ এ ভিডিও করে, ভালো করে কথা বলতে অবধি জানে না, আবার ইংরিজি ফুটায়! ‘প্রোবলেম হবে’, ‘পসিটিভ মেন্টালিটি তৈরী করুন’, ‘নতুন প্রোসেক্ট পেতে কোন অসুবিধাই হবে না’, ‘যাঁরা সুতোর কারবার করেন মানে লেংটি বিক্কিরি করেন, তাদের ওভার অল প্রোসপেক্ট ভালোই আছে’, বাল! অনেকটা যেন মাননীয়ার মুখে গর্মেন্টের মত শোনায়!” এয়ারপোর্ট যাবার পথে কিংবা দমদম নাগের বাজার মোড়ে কি বিশাল বিশাল হোর্ডিং দেখেছেন সুশীল, এই সব আলফাল জ্যোতিষীদের! কিন্তু কোনোদিন কোন লেখকের নামে তো এরকম বড় করে বিজ্ঞাপন হয় না! তাঁর বেলায় পত্রিকার ব্যাক কভারে ছোট করে, প্রপঞ্চময় হিপোক্রিসি যত! তা সে যতই সুশীলের এসব প্রতারণা মনে হোক, শেষমেশ পাঁজি দেখে অমৃতযোগে খাঁটি জহুরীর মত, চোখ কুঁচকে, ভুরু ছোট করে, দ্বারিকের কাঁচাগোল্লাটির মত নধর ভুঁড়িটা তিনবার নাচিয়ে, নিজের আলু সদৃশ পৃথুল মুখমণ্ডলে আলুথালু গজিয়ে ওঠা গোঁসাই কবির মত গোঁফ দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে, সেই স্বামীজী বললেন, “আপনি ভাগ্যবান সেন মশায়! এরকম বৌমা, ভূ-ভারতে খুঁজলেও আর পেতেন না। সাক্ষ্মাৎ লক্ষ্মী পায়ে হেঁটে এসেছেন আপনার সংসারে! এ তো রাজযোটক! বৃহস্পতি, শুক্র আর বুধের ত্রিগ্রহী যোগ দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট এদের ছকে! এর ফলে সন্তান-সুখ-সমৃদ্ধিতে অচিরেই ভরে যাবে এদের জীবন। সাথে আপনিও অসীম সুখ অনুভব করবেন। আমার কথা মিলিয়ে নেবেন। শুধু শনির বিপরীত গমনে রাহু আর মঙ্গল, রবির ঘরে প্রবেশ করেছে। তাতেই এই টুকটাক যাকে বলে খুচরো অশান্তি হচ্ছে। ও আমি হোম জাগ করে দেব, দেখবেন সব কুদৃষ্টি আপনার ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে!” কার ঘর থেকে যে কে বেরোবে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহে ছিলেন সুশীল। তবু বোনের জোরাজুরিতেই এক প্রকার নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে, কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে, শান্তি স্বস্ত্যয়ন করলেন বটে, কিন্তু ওই আধমন ঘিই পুড়লো, রাধা কিন্তু নাচলো না! বরং রোজ রাতে পাশের ঘরের চলতি কাহিনীর তোড় আরও বেড়ে গেল! খাট কাঁপলে তাও নাহয় ঠিক ছিল, কিন্তু এ যে রীতিমত জিনিসপত্র ছোঁড়াছুঁড়ি, খেস্তাখিস্তি! এই কি আজকালকার ইয়ং কাপলদের কালচার! এতো ফ্রাস্ট্রেশান! এনার্জির অপচয় যাকে বলে! এরা কি বিছানায় সুখী নয়? তা সে কথা আর জানতে হল না। একদিন সকালে উঠে সুশীল দেখলেন, খাবার টেবিলে রোহন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে, বৌমা ভাগলবা! যাই হোক তার বাপের বাড়িতে ফোন করে জানা গেল, তিনি সেখানে গিয়ে উঠেছেন। এ বাড়িতে আর কোনোভাবেই ফিরবেন না। সেও আজ প্রায় দু বছর হয়ে গেল। নাহ! উঠে গিয়ে স্বামী-শ্বশুরের বিরুদ্ধে কোন ক্রিমিনাল কেস করেননি তিনি! কেস-কামারী করেও বিশেষ কিছু সুবিধা হয়তো তিনি করতে পারতেন না। প্রশাসনে যথেষ্ট দহরম মহরম আছে সুশীলের। তাছাড়া কি অভিযোগেই বা কেস করতেন তিনি? তাঁকে কি কেউ কোনোদিন মারধর করেছে? ‘Has anybody tortured her?’ নিজের ছেলেকে সে শিক্ষা-দীক্ষায় বড়োই করেননি সুশীল। বৌমার কিছু গয়না গাঁটি হয়তো আজও পরে আছে এ বাড়িতে। সেসব কোনোদিন ছুঁয়েও দেখেননি তিনি! অবশ্য, ‘মেরে কুছ সামান তুমহারে পাস পারা হ্যায়, শাওয়ানকে কুছ ভিগে ভিগে দিন, রাখে হ্যায়! অর মেরে ইক খৎ মেইন লিপটি রাত পড়ি হ্যায়! উও রাখ বুঝা দো! মেরা উও সামান লওটা দো!” বলে কোন আবেগঘন শায়েরী মার্কা চিঠিও আসেনি ও তরফ থেকে! এই গেল মাসে কোর্টে একটা ডিভোর্স পিটিশন সাবমিট করেছে রোহন। সেই থেকে সমানে উকিল ঘর চলছে। চেষ্টা চলছে যাতে মিউচুয়াল ডিভোর্সটা পাওয়া যায় নাহলে কন্টেস্টে যেতে হবে! আচ্ছা রোহনকে কি আদৌ কোনোদিন ভালোবেসেছিল অভিলাসা? ভালোবাসলে তো এক পক্ষকে চুপ করে সব মেনে নিতে হয়, যেমনটা রমনা সুশীলের সব দোষ গুণ মেনে নিয়ে এসেছেন চিরটাকাল। অন্তত সুশীল তো তাই জানতেন। ভালোবাসায় তো আসলে সত্যিই কোন অন্তিম বিন্দু নেই। যে জীবনকে পূর্ণ মাত্রায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছেনা সামনে, যার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আদৌ কোন কনক্লুশনে আসা যাচ্ছে না এখনই, তার সাধনাই তো ভালোবাসা! কিন্তু সময়ের নিরিখে তো ভালোবাসা, পাত্র কিংবা পাত্রী পাল্টায়! মানুষের মনও তো তখন বিবর্তিত হয়! তেল রঙে আঁকা ছবির মত আবছা হয়ে আসে বাহারী মানুষের মুখ, যে মুখটা একদিন আনকোরা ছিল, ছিল সৌখিন জীবনের নবতম সংযোজন! যে মুখটাকে একদিন ভালোবাসতাম আমরা নিজের থেকেও বেশী! ধীরে ধীরে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলি আমরা, পিছে পড়ে থাকে শুধু স্নায়ুহীন, দ্যুতিহীন অশ্রুময়তার এক রেখা, যার আর কোন উচ্চারণ থাকে না!
আজ কাজের ঝি লক্ষ্মী ডুব দিয়েছে। কে জানে তাঁর নয়া প্রেমিকের সাথে মিলে গড়িয়াহাট ব্রিজের তলায়, ‘পুরোনো প্রেম মোছা হয়’ এর দোকানে গেছে কিনা! আজ সকালে লিখতে বসে একদম মুড নেই সুশীলের। একটা গোটা ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা আজ কেউ রাখেনি ওর লেখার টেবিলে। ধূপের গন্ধটা এই শূন্য স্পেসে আপাতত ঢেলে দিতে পারছে না কোন উর্বশী গান্ধর্ব পরাগ! কাল সারা রাতের বৃষ্টিতে গলির মোড় থেকে পুরো রাস্তাটায় এখন শুধু সোঁদা গন্ধের জল থৈ থৈ! সাথে সানাইয়ের পোঁ বেঁধেছে আজ ভোর রাতে অনাহুত অথিতি সেজে হাজির হওয়া বিদঘুটে এই লোড শেডিং! কসবার যত মশা, বিভিন্ন সাইজের ও ভ্যারাইটির সব যেন একসাথে জুটে গিয়ে, সুশীলের ফ্ল্যাটের পাশে মাতলামির কীর্তন জুড়ে দিয়েছে! নতুন পত্রিকা করবে বলে একটি ছেলে যোগাযোগ করেছিল কদিন আগে, ম্যাসেঞ্জারে। আজ সকালে বাড়িতে আসতে বলেছিলেন সুশীল। নাহ! এই নাছোড় বৃষ্টির পাল্লায় পড়ে সেও বেপাত্তা! দীর্ঘ্য সময় ধরে থেমে থাকার এক অন্ধকারময় বিরক্তি বুকে করে, লেখার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন সুশীল। নিজেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন, দু পা যেতে না যেতেই তাঁর পায়ে বাস্কেটবলের মত গড়িয়ে এল, একটা বড়সড় সাইজের স্কচের বোতল। রোহনের ঘরের পর্দার আড়াল থেকে তখন উঁকি দিচ্ছে একজোড়া মায়াময় বালকের চোখ! গেলো হপ্তায় একটা ‘হঠাৎ করেই ফাঁকা লাগতে থাকা সন্ধ্যেবেলায়’, সুশীল কে পুরো ভেবলে দিয়ে রোহন হঠাৎ একটা কান্ড করে বসেছে! কাউকে কিছু না জানিয়ে দুম করে, ওদের অফিসের এইচ.আর এর এক ধুমসী মহিলাকে গাই বাছুর সমেত তুলে নিয়ে এসেছে সোজা, এই কবিতাবাড়িতে। দেখলেই বোঝা যায় সেই মহিলা রোহনের থেকে বেশ কিছুটা বয়সে বড়! হাতে ডাফেল ব্যাগটা নিয়ে, ডেনিম জিন্স আর অফ হোয়াইট কালারের শার্ট পরে সেই স্বাস্থ্যবতী যখন সেদিন এসে ওঁদের ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়ালেন, দেখে তো পুরো রোহনের দিদি লাগছিল! ডিভোর্সী! তার ওপর আবার জাতে বিহারী! সাউ ফাউ কিসব যেন টাইটেল! তাও সে বিয়ের আগের টাইটেল না পরের, কে জানে? কিরকম বিয়ে! কটা বিয়ে! সেই বা কে জানে! রোহনের সঙ্গে নাকি অনেকদিন ধরেই ইটিশ পিটিশ চলছিল1 তাই বলে সোজা বাড়িতে!? রোহনের ডিভোর্সটা তো মেটেনি এখনও, তাই দুজনে লিভ ইন করবে! সাথে লটবহরের মধ্যে চোখে পড়ার মত বছর ছয়েকের একটি বাচ্চা ছেলে, বেশ ফর্সা টুকটুকে, ছোট ছোট চোখে কুত কুত করে তাকাচ্ছিল সুশীলের দিকে। তা সেই বাছুরটিই আপাতত তার মা-বাবার অনুপস্থিতিতে গোটা ফ্ল্যাট জুড়ে অবাধ ‘গোচারণ’ করে বেড়াচ্ছেন! এমনিতে সন্তানের যৌন স্বাধীনতা নিয়ে কোনোদিন কোন কথা না বললেও ছেলের এই ডিসিশনটা কেন জানিনা মন থেকে ঠিক মেনে নিতে পারেননি সুশীল। হতে পারে এটা সুশীলের ‘অবসেস্ড মেল ইগো!’ তবু ছেলেকে ডেকে একদিন তিনি শুধোলেন, হয়তো আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে সেটা বাপ-ছেলের গরমাগরম তরজা শোনালো, তবু,
“এটা কি হল বাবান? তুই কাউকে কিছু না জানিয়ে বাচ্চা সমেত ওই মেয়েটাকে এই বাড়িতে এনে তুললি? কত কষ্ট করে, তিল তিল করে আমি আর তোর মা মিলে এই ‘কবিতাবাড়ি’ তৈরী করেছিলাম! আমি কিছুতেই সেখানে এইসব শিট ছড়াতে দেব না! তোর চারপাশে যাঁরা এক্সিস্ট করে তাদের মতামতের কোন ভ্যালু নেই তোর কাছে!?”
ততদিনে এইখবরটা কলমির কানেও তুলে দিয়েছেন তিনি ফোন করে। সেদিন তাঁকেও ডেকে নিয়েছিলেন। কিন্তু রোহন যেন এই কবছরে আমূল পাল্টে গেছে! আরো বেশী একরোখা হয়ে গেছে! বাড়ি ফিরলে মেজাজ চড়ে থাকে সপ্তমে। জীবনে এই প্রথম বোধহয় আদরের পিসির সামনে, বাবার মুখের ওপর ঝাঁঝ মেরে উত্তর দিল,
“আঃ বাবা চেঁচিও না! ও ঘরে লীমা আছে, শুনতে পাবে। এটা আমারও বাড়ি! তুমি যখন দিনের পর দিন যার সাথে যা ইচ্ছে কর, কই আমি কিছু বলতে যাই? এ বাড়িতে বসেই তো কর!? আমিও লিমার সাথে লিভ ইন করছি এবং বেশ করছি! এটা আমার বাড়ি!”
শেষের কথাটা বেশ কয়েকবার বলতে বলতে ওদের বেডরুমে ঢুকে গেল রোহন। “এটা আমার বাড়ি”, কথাগুলো যেন দক্ষিণ আর উত্তরের মাঝে মাইলের পর মাইল জুড়ে, অলীক চিত্রনাট্য হয়ে পড়ে রইলো। বাবা ছেলে ওরা দুজনে যে স্বভাবের দোষে গুণে, একই আকরিকে তৈরী হওয়া যমজ খনিজ! রক্ত যে কথা বলে! অবশ্য ‘লিভ ইন’ও তো এক রকমের বিয়ে, ‘গান্ধর্বমতে’! সৃজিতের সিনেমায় তো তাই বলে নাকি! বিয়ে নামক ইনস্টিটিউশন ছেড়ে বেরিয়ে আসা দুটো শরীর, হতে পারে তারা বিপরীত কিংবা উভ লিঙ্গের যৌনতার পিয়াসী, এক ছাতের তলায় রাত কাটাবে। কোন আধুনিক শিক্ষিত মনের মানুষের তো এতে আপত্তি থাকার কথা নয়! সুশীলের হয়তো বোধোদয় হত সেইদিনই যদি না তারপর থেকে প্রতিরাতে নবদম্পতির ঘর থেকে ভেসে আসা আওয়াজে রীতিমত ভাষার সন্ত্রাস চলতো! রোজ রাতে ডিনার সেরে সুশীল নিজের ঘরে চলে আসেন। লিমা পারতপক্ষে ওঁকে এড়িয়েই চলে! এক টেবিলে বসে খাবার খাওয়ার তো প্রশ্নই নেই! তারপর বেশ রাত অবধি টেবিলে বসে সুরাপান চলে মিঞা বিবিতে মিলে। ঘরে বসে পত্রিকায় মুখ গুঁজে, বাইরে সজাগ কান পেতে থাকেন সুশীল। আস্তে আস্তে ডাইনিংয়ের লাইট নেভে। লিমার ছেলেটা সোফায় বসে মোবাইলে ভিডিও গেম খেলে। বারান্দা থেকে উড়ে আসা একটা ভবঘুরে হাওয়া ছেলেটার আশ্রয়হীন দুচোখ ঘুরে ঘুমোনোর জায়গা খোঁজে! বর্ণাঢ্য যান্ত্রিকতার পাশ থেকে তখন থেকে ভেসে আসে তীব্র হিন্দিভাষী যৌনস্বর,
“তেরি মা কি! তেরি বেহেন কি! অউর জোর সে চো*, চো* মুঝে! ফাক মি হার্ডার, বেবি! ইয়েস! ইয়েস!”
“ইতনা দম! ব্লাডি কাউগার! ইয়ে লে! অউর লে!”
প্রতিরোধহীন মোক্ষম এই রতিক্রিয়ার অপেরা, চড়া অ্যালকোহলের গন্ধে গা জড়াজড়ি করে, বাচ্চাটার ব্যস্ত দুটো কর্ণগহ্বর অতিক্রম করে মিশে যায় মহাশূন্যে! বাচ্চা ছেলেটা হয়তো অনেক রাত অবধি একা জেগে থাকে অপেক্ষায়! তারপর সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। বাচ্চাটাকে দেখে মায়া হয় সুশীলের কিন্তু আদর করে কাছে ডেকে নিতে সংকোচ হয় কোথাও। বাচ্চাটা এমনিতে বেশ মিষ্টি আর চটপটে। ওর নাম ‘অঙ্কিত তেওয়ারী’। এইটুকু বয়সেই নিজের সব কাজ প্রায় নিজেই করতে পারে। রোহন-লিমা ওকে কাছাকাছি কোন স্কুলে ভর্তি করবে শিগগিরই । ততদিন অবধি মা বাবা অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর সারাদিন ফাঁকা ফ্ল্যাটে হুড়োহুড়ি করে অঙ্কিত। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে, ফিসফিসিয়ে কথা বলে নিজে নিজে। মাঝে মাঝে লক্ষ্মীর সাথে বসে টিভি দেখে । মাঝে মাঝে আবার গুটি গুটি পায়ে সুশীলের ঘরে ঢুকে, লেখার টেবিলের কাছে এসে, গোল গোল চোখ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
“আপ কেয়া লিখতে হো, ইতনা সারা কাগজ পর!?”
সুশীল আলতো করে ওঁর হাতটা ছেলেটির মাথায় বুলিয়ে দেন, “স্টোরি, পোয়েম, নভেল! ম্যায় রাইটার হু না!”
“আপ রাইটার হো? স্টোরিটেলর? কাহানি শুনাতে হো? মুঝে ভি শুনাও না!”
সুশীল লেখা থামিয়ে ওর দিকে ঘুরে তাকাতেই পাঁই করে এক ছুট্টে বারান্দায় চলে যায় অঙ্কিত। সেখান থেকে তখন অনেকখানি আকাশ দেখা যায়। মুক্তিহীন, অবসরহীন, ইট বালির কংক্রিটের ফাঁক দিয়ে, সেই আকাশটার গা থেকে একটা পেটকাটি ঘুড়ি খসে এসে, খালপোল পেরিয়ে ভাসতে থাকে, যেন এক দাড়িওয়ালা মহিলা বা গাছের পুকুরে রঙিন রাজঁহাস! সকালে লিমা বেরোবার আগে ওর খাবার করে, হটপটে রেখে যায়। ফিল্টার থেকে জল ভরে ফ্লাস্কে রাখা থাকে। আর বাকি কোনটা কি হবে সব বুঝিয়ে দিয়ে যায় লক্ষ্মীকে। অঙ্কিত বাবু দুপুরে সুশীলের সাথে খেতে বসে প্লেট থেকে ছোট ছোট হাতে নিজেই ভাত মেখে, গ্রোস মুখে পোড়ে। জল তেষ্টা পেলে এঁটো হাতে নিজেই ফ্লাস্কটার মুখ খুলতে চেষ্টা করে। শেষমেশ না পেরে ছোট ছোট দুটো হাত নেড়ে সুশীলকে বলে, “আংকেল মেরে বটল থোৱা ওপেন কর দিজিয়ে না! মে কর নেহি সাক্তা! খানা খা রাহা হু না!” সুশীল লক্ষ্য করেছেন, সাইজে ও বয়সে ছোট হলেও কিন্তু বাচ্চাটা হেল্প চায়না কারোর কাছ থেকে। আসলে এই অল্প বয়সেই দুনিয়ার অনেকখানি চড়াই উৎরাই দেখেছে তো! সেদিন ঘরে বসে ওর জন্য একটা কাগজের প্লেন বানাচ্ছিলেন সুশীল। বানানো শেষ হলে সেটাকে উড়িয়ে দিলেন দরজার দিকে। গোত্তা খেয়ে গিয়ে সেটা পড়ল অঙ্কিতের পায়ের গোড়ায়। ভারী অবাক হয়ে ও হাতে করে প্লেনটাকে তুলে নিয়ে সুশীলের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো।
“ইয়ে আপনে ক্যায়সে বানায়া? মুঝে ভি শিখা দো আংকেল!”
সুশীল মনে মনে বলেন, “ব্যাটাচ্ছেলে, আমি হলাম গিয়ে তোর বাপের, মানে ইয়ে, স্টেপ ড্যাডির বাপ! আর তুই কিনা আমাকে আংকেল বলিস! কি দিনকাল পড়লো মাইরি!”
আসলে বাচ্চারা তো যা শোনে তাই শেখে। সেদিন রাতে খাবার টেবিলে সুশীলকে খাবার সার্ভ করে দিচ্ছিল লিমা, বলছিল, “আংকেলজী রোটি অউর লেঙ্গে আপ?” সেই শুনেই বাচ্চাটা শিখেছে আর কি! আসলে কেউ তো আর ওকে বলে দেয়নি সুশীলকে কি বলে ডাকতে হবে! এ বাড়িতে তো ও এসেছিল অনেকটা অবাঞ্ছিতের মত, এক জীবন অশুচি নিয়ে! রোহনও কি ওকে মন থেকে পুরো মেনে নিতে পেরেছে এখনও!? এই ভালো বরং! বৌমা অথচ আইনসম্মত বৌমা নয়! নাতি অথচ রক্তের কোন সম্পর্ক নেই! ওই আংকেলই ঠিক আছে, ‘বাবা’ বা ‘দাদু’ ডাকগুলো বড্ডো বেমানান হয়ে যাবে!
রোহন আর লিমা যখন ফিরলো তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা। নাঃ! কারেন্ট এখনও আসেনি। ওরা ঢুকেই ঘরে চলে যাচ্ছিল। সুশীল রোহনকে ডাক দিলেন, “বাবান!” রোহন পিছনদিকে মুখটা ফিরিয়ে তাকাল একবার ওর বাবার দিকে। সে দৃষ্টিতে প্রতিবর্ত ক্রিয়ার সাথে এখন ক্লান্তিও মিশে আছে বেশ খানিকটা।
“আজ সুইগিতে অর্ডার করে, ‘ওয়াও চাও’ থেকে একটু চাইনিজ আনিয়েছি। তোরা হাত মুখ ধুয়ে যায়। আমি খাবার বাড়ছি। আজ আমরা চারজন একসাথে ডিনার করবো। বেশ মোমবাতি জ্বেলে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার হবে!”
রোহন অবাক হলো একটু, কিন্তু অখুশী নয়। ডিনার শেষ করে রোহনকে আরো অবাক করে দিয়ে, বারান্দায় নিয়ে গিয়ে সিগারেট অফার করলেন সুশীল।
“লিমাকে বল তিনটে পেগ বানাতে। আমারটায় জল কম দেয় যেন! বরফ তো আর পাওয়া যাবে না!”
মনের মধ্যে জমে থাকা, ধূসর রঙের রুক্ষ সংকোচের স্তূপ একেবারে মুছে দিতে চাইলে, মানুষ হয়তো ঠিক এইভাবেই এগিয়ে আসে। বিদেশে থাকতে রোহন প্রায়ই ড্রিংক করতো, ‘যস্মিন দেশে যদাচার!’ যদিও ছোটখাট নিব বা শট ও নিতে শুরু করেছিল হোস্টেল লাইফ থেকেই। গরমের মধ্যে হোস্টেলের নোনা ধরা ঘরে বসে বন্ধুবান্ধবেরা মিলে মাল খাওয়া, সে এক আলাদা লেভেলের এনজয়মেন্ট ছিল। চূড়ান্তভাবে নিশ্চিন্তির একটা বোধ, উপস্থিত মুহূর্তটায় জীবন্ত হয়ে উঠে, রোহনকে যেন ফিরিয়ে নিয়ে যায় ফেলে আসা যৌবনের নস্টালজিয়ায়! চারিদিকে সব কিছুকে যেন ভীষণ রকমের বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য মনে হয় রোহনের!
আজও দু পেগের বেশী খেলেই বেহেড হয়ে যায় রোহন! সহ্য ক্ষমতা, নিজেকে ধরে রাখার ক্ষমতা এসব চিরটাকালই একটু কম ওর! এ ব্যাপারে সুশীল কিন্তু ওর ছেলের মত নন। পাঁচ ছটা পেগ টানার পরও দিব্যি স্টেডি থাকতে পারেন এই বয়সেও! ‘আরে বাপ আখির বাপ হোতা হ্যায়’, ওদিকে লিমাও সোফায় ছড়িয়ে বসে, নিজের চার নম্বর পেগটা শেষ করলো। ওর মোটা করে কাজল লেপা, আপাত শান্ত দুটো চোখে যেন অনিবার্য্য এক আগুনমাখা সুর, খেলা করে যাচ্ছে এই মুহূর্তে! সাথে তীব্র জীবনের আকাঙ্খা! একটা নাম না জানা নেশা আছে যেন মেয়েটার ভেতর! যেন আঠালো ছাই রঙের মেঘের মত একটা আসক্তি আর উন্মাদনা একইসাথে, নিজের নিজের কাজ করে যায় ওকে ঘিরে! জ্বলে পুড়ে প্রায় শেষ হতে বসা মোমবাতির আলোয়, লিমার ফর্সা চামড়ার পেলবতা এই মুহূর্তে, যে কোন মহর্ষিকেও কামনার চরমে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারে! সেখানে সুশীল তো কোন ছাড়! রোহন ততক্ষনে চেয়ারে হেলান দিয়ে গা হাত পা ছেড়ে ভুল বকা শুরু করে দিয়েছে! স্কচ-হুইস্কির কণাগুলো যেন সিস্টেমে প্রবেশ করে লিমার ত্বকের জেল্লা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুন! আড়ষ্ট চোখে জড়ানো গলায় লিমা সুশীলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিউ শ্বশুরজী! অউর এক পেগ বানাউন?”
সুশীলের চোখ যেন তখন লিমার দিকে ধীময়, স্থির! হাফ স্লিভ টপ আর হট প্যান্টে তখন লিমাকে অপার্থিব জ্যোৎস্নাময় মনে হচ্ছে! আস্তে আস্তে সুশীল নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। সারা শরীরে ব্যাক্তিত্ত্বের আবেদন তুলে সোফায় এসে বসলেন লিমার ঠিক পাশটাতে। চঞ্চল ঘূর্ণির মধ্যে পরেও যেন নিয়ন্ত্রণ হারান না সুশীল! লিমার গা ঘেঁষে বসে নিজের একটা হাত আস্তে করে লিমার মাথার নিচে গলিয়ে দিলেন। দারুন উষ্ণতায় গলে যাওয়া কোন বেগুনী গুলমোহরের সুগন্ধ ভেসে আসছে এই মুহূর্তে লিমার শরীর থেকে!
“চলো লিমা, তুমহে ঘর ছোড় আতে হ্যায়!”, সুশীলের আহবানে সাড়া দিয়ে লিমা নিজের গোলগাল মুখটা ফেরাল সুশীলের দিকে। পারদর্শী সুশীল এবার নিজের মুখটা লিমার মুখের খুব কাছে নিয়ে এসে, ওর পুরু ঠোঁটের ওপর গরম নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন। ছটফটিয়ে উঠলো লিমা! এই তো আদর্শ সময়! আর দেরী না করে নিজের কাঁধে ভর দিয়ে লিমার ভারী শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে, ওদের বেডরুমের দিকে নিয়ে চললেন সুশীল। নেশায় তখন লিমার পা টলছে! ঘরময় তখন আঁশটে আসক্তির অন্ধকার! তার থেকেও বেশী অন্ধকার অবশ্য জমাট বাঁধছে সুশীলের মনের প্রতিটি অজানা প্রকোষ্ঠ জুড়ে! তার নিজের হৃৎপিন্ডটা এখন দৌড়াচ্ছে সময়ের চেয়েও জোরে! বারান্দাটাময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সিগারেটের ছাই আর পরিত্যক্ত প্ল্যাটফর্মে ঢোকা শেষ ট্রেনের ইঞ্জিনের ঘড়ঘরে আওয়াজের সাথে চাগার দিয়ে ওঠা পুরোনো স্মৃতির অঞ্চল থেকে উঁকি দিচ্ছে, যে এক জোড়া নিষ্পাপ চোখ, তাতে কিন্তু কোন ভণ্ডামি নেই! অঙ্কিত তেওয়ারী, বয়স ছয়, কলকাতার নামী কোন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়তো! নিজের বায়োলজিক্যাল পেরেন্টসের মধ্যে একসময় নিয়মিত অশান্তি দেখেছে সে! নিজের বাবা তাকে আর তার মাকে রাস্তায় বার করে দিয়ে, এক আন্টির সাথে থাকে সে কথা জানে ও। নতুন বাড়িতে আসার আগে ওকে ওর মা বলেছিল, “আজ সে নয়া ঘর মে রহেঙ্গে হাম! অঙ্কিত অউর মাম্মি! নয়া ওয়ালা আংকেল বহুত আচ্ছা হেয়! দেখনা উস ঘর পে সব লোগ ঠিক সে খেয়াল রাখেঙ্গে তুমহারা। ঢের সারি পেয়ার মিলেগা।” ওর গোল গোল দুটো ছোট ছোট চোখ এই ঝুরো ছাই রঙের দৃশ্যের কবলে পরে, ওর অবুঝ মস্তিষ্কে কি সংকেত পাঠায় জানা যায় না! তবে বাস্তবের অদৃশ্য জাদুবলে ওর স্টেপ ড্যাডির ড্যাডি আর কিছুক্ষন পর হয়তো ওর মায়ের ‘সুগার ড্যাডি’ হয়ে যাবে! ধীরে অতি ধীরে প্রায় মাকড়সার মত অজস্র আঁকিবুকি আঁকা ওর এই বুদ্বুদের মত ফেনিয়ে ওঠা জীবনটা জুড়ে জন্ম নেবে, এক দুরন্ত অবাধ স্বাধীনতা! ঠিক ধুলোকাদাহীন সাদা পাতার মতই সম্পূর্ণ বিবস্ত্র সে জীবনে, ক্রমশঃ ভোঁতা হতে থাকবে ‘ভন্ড’, ‘প্রতারক’ এই অভিযোগগুলো! সে জীবন তখন পাখির পালকের মতোই অগভীর, ওজনহীন! জীবন হয়তো এমনও হয়!
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment