...উত্তম চক্রবর্তী
এমনিতেই বৃষ্টির দিন। তার উপর দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে
সমানে জল ছাড়ছে। স্বাভাবিক ভাবেই শিলামপুরে ফেরি ঘাটে দামোদরের জলের তোর ভীষণ ভাবে
বেড়ে গেছে। একবার ঐ জলে ডুবে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত। ওর সেলুনের কাঁচের দরজা দিয়ে
বেলা এগারটা নাগাদ হটাত মানস, মানে মানস গড়াই দেখতে পেল এক অচেনা
মহিলা একটা বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সেই ভয়ানক দামোদরের জলের দিকে,
যেখানে এখন যাওয়া একদম বারণ, বোর্ডে লেখা আছে।
মানস হাতের কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে দৌড়ে গেল ঘাটের দিকে। চিৎকার দিয়ে ডাকল ওর পাশের
মুদির দোকানের বলরামকে, আর সেই শুনে বলরামও বেড়িয়ে এলো
রাস্তায়। কিন্তু ততক্ষনে সেই মহিলা তার বাচ্চা মেয়েটার হাত ধরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে
দামোদরের জলে।
বলরাম এবং মানস দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে।
মুহূর্তের মধ্যে অনেক দুরে ভেসে চলে গেল দেহ দুটো। বলরাম অনেক চেষ্টা করেও মহিলাকে
আর বাঁচাতে পারল না। কিন্তু মানস তুলে আনল প্রায় পাঁচ বছরের শিশুটিকে। অনেকটা জল
চলে গিয়েছিল পেটে। কিন্তু ওদের আপ্রাণ চেষ্টায় বেঁচে গেল মেয়েটির জীবন। বেলা
বারোটা নাগাদ দুই মাইল দুরে ভেসে উঠল ওর মায়ের মৃতদেহ। স্থানীয় মানুষরাই দেহ দুটো
নিয়ে এলো শিলামপুর ফেরি ঘাটে মানসের সেলুনের সামনে।
মা মেয়ে দুজনকেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পানাগর গৌরী দেবী
হাসপাতালে। কিন্তু ডাক্তাররা জানিয়েই দিল যে মা আর বেঁচে নেই, জলে ডুবে মারা গেছে শিশুটির মা। আর ক্লান্ত মেয়েটিকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পারিয়ে
দিলেন ওঁরা। মানস আর বলরাম বসে রইল হাসপাতালে, যদি মহিলাটির
কোন খোঁজ পাওয়া যায় আর বাচ্চাটার একটা হিল্লে হয় সেই আশায়। বলরাম অবিবাহিত,
কিন্তু মানসেরও ঐ বাচ্চাটার মতই একটা ছোট মেয়ে আছে ঘরে। শিশুটার মুখ
দেখে ওর নিজের বাচ্চার কথাই মনে হচ্ছিল বারবার।
পুলিশ আসবার অনেকক্ষণ বাদে হাসপাতাল থেকে ওর সেলুনে যখন
ফিরে এলো মানস তখন বিকাল সাড়ে পাঁচটা বাজে। বলরাম দোকান বন্ধ রেখে বাড়ি ফিরে গেছে।
সেলুনের কর্মচারীকে ছেড়ে দিয়ে বসে বসে সকালের ঘটনাটা ভাবছিল মানস। ওর চোখের সামনেই
বেলা দশটা নাগাদ ঐ বছর তিরিশের বিবাহিতা মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে নদীর ঘাটে গিয়ে
দাঁড়ায় আর মুহূর্তে ঐ ভয়ানক দামোদরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভাগ্যিস মানসের চোখে পড়েছিল
ঘটনাটা। সেই সময় নদীর ঘাটে দুই একটা ছাগল আর কুকুর ছাড়া আর কেউই ছিলনা। মানস আর
বলরাম না গেলে হয়ত মেয়েটাকেও বাঁচানো যেত না। কিন্তু কে এই মহিলা, একে আগে তো কোনদিন দেখা যায়নি এই অঞ্চলে !
কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে এসে দাঁড়াল নন্দু। বলরামের
দোকানের ওপাশেই ওর এস টি ডির বুথ। মানসকে জিজ্ঞাসা করল,’ কিরে, ঐ মহিলার কোন খোঁজ পাওয়া গেল ? পুলিশ কি কোন হদিস পেল ওঁর ?’মানস মুখ ব্যাজার করে উত্তর দিল,’ না রে,পুলিশ ওঁর বডি পোষ্ট মর্টেম করতে নিয়ে গেছে।
কিন্তু ঐ মহিলাকে আমার তো মনে পড়ছে না কোনদিন দেখেছি বলে। কে বলতো ঐ মহিলাটি ?’
‘আরে সেই জন্যই তো এলাম তোর কাছে। জলে ঝাপ দেবার একটু আগেই ঐ
মহিলা আর তার মেয়ে আমার বুথে এসেছিল কাকে যেন ফোন করতে। আর ফোন করে তার একটু বাদেই
গিয়ে জলে ঝাপ দেয় জানিস ! তুই আর বলরাম জলে ঝাপ মারলি যখন তখনও আমি জানিনা যে সেই
মহিলাই জলে ঝাপ মেরেছে। পরে যখন ডেড বডি নিয়ে তোরা হাসপাতালের উদ্দেশে বেড়িয়ে
যাচ্ছিস তখন আমি ওঁর ডেড বডি দেখে চমকে উঠেছিলাম। কিন্তু তোদের বলবার সুযোগ পাইনি
আর।‘ নন্দু কথাটা বলে তাকিয়ে রইল মানসের দিকে।
মানস একটা আলোর রেখা দেখতে পেল যেন। ফিরবার সময় পানাগর
থানার ইয়ং সাব ইন্সপেকটার মিস্টার পলাশ সেন ওকে তার নম্বর দিয়ে বলেছিল কোন খোঁজ
পেলে জানাতে। মানস উৎসুক হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’ বাঃ, দারুণ খবর এটা। তুই আমাকে সেই মহিলা যেই নম্বরে
ফোন করেছিল তার নম্বরটা দিতে পারবি নন্দু। মনে হয় নম্বরটা পেলে ঐ বাচ্চাটার বাবা
মার নাম ঠিকানা জানতে আর বেশি দেড়ি হবে না। চল তোর বুথে যাই, নম্বরটা বেড় করে আমাকে দে শিগগীর। পুলিশকে ব্যাপারটা জানাতে হবে আজই।‘
পানাগর দেবীপুরের অনুপম হাজরাকে পুলিশ যখন ফোন করল তখন
বিকাল পাঁচটা বেজে গেছে। অনুপম হাজরা একটা ফার্নিচারের দোকানের মালিক। বয়স চৌত্রিশ
কি পঁয়ত্রিশ হবে ,কালো, লম্বা ও বেশ
ভাল চেহারা। থানার দারোগাকে আগে থেকেই চেনে। থানা থেকে ফোন পেয়ে একটু অবাক হয়ে
জিজ্ঞাসা করে,’কে মিস্টার সেন ? হ্যাঁ
স্যার বলুন, কি ব্যাপার ? হটাত কি মনে
করে স্যার ?’
‘আপনার স্ত্রী এখন কোথায় মিস্টার হাজরা ? উনি কি বাড়িতে না কোথাও গেছেন ?’ পলাশ সেন প্রশ্ন
করল।
‘না স্যার। ও আজ সকালেই দুর্গাপুরে বাপের বাড়ি গেছে। কেন
স্যার, কিছু হয়েছে নাকি ? হটাত এই
প্রশ্ন করছেন কেন স্যার ?‘ অনুপম হাজরা তখনও তার স্ত্রী বা
মেয়ের খবর কিছুই জানেনা। কিন্তু হটাত পুলিশের মুখে এরকম প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেল।
সকালে ওদেরকে স্টেশনের জন্য অটোতে তুলে দিয়েছে ট্রেন ধরে দুর্গাপুর যাবে তাই।
তারপর সারাদিন আর কোন খবর নিতে পারেনি কারণ বৌ বাড়িতে ফোন ফেলে রেখে গেছে। ভাবে
রাতের দিকে স্ত্রী নিশ্চয়ই ফোন করবে ওকে।
সাব ইন্সপেকটার পলাশ সেন অনুপম হাজরাকে জানাল সব ঘটনা।
ওঁর স্ত্রী আজই সকালে মেয়েকে সাথে নিয়ে দামোদরের জলে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
মেয়েটি যদিও বেঁচে গেছে কিন্তু ওর মা গত হয়েছেন। অনুপম হাজরাকে সাব ইন্সপেকটার সেন
ওঁর মেয়েকে পানাগর হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতে বলে বলল যে স্ত্রীর মরদেহ কাল সকালে
পাওয়া যাবে। এখন দুর্গাপুরে পাঠানো হয়েছে পোষ্ট মর্টেম করতে। ওর স্ত্রীর ব্লাউজের
ভিতর থেকে একটা বটুয়া পাওয়া গেছে আর সেখান থেকেই ওঁর আঁধার কার্ড ও কিছু টাকাপয়সা
পেয়েছে পুলিশ। সেই আঁধার কার্ড থেকেই ওরা অনুপমের স্ত্রীর পরিচয় জানতে পারে।
অনুপম হাজরা ওঁর স্ত্রী মিলি জলে ঝাপ দিয়ে ডুবে মারা
গেছে শুনে চমকে উঠল। কাল রাতে দুজনের মধ্যে অশান্তি চরমে পৌঁছেছিল। মিলির সাথে
অনুপমের বিয়ে হয়েছে তাও প্রায় সাত বছর। দুর্গাপুর বিধান নগরের মেয়ে মিলি। বি কম
পাশ করার পড়েই ওঁর বাবা একরকম জোড় করেই মেয়েকে পানাগরের ফার্নিচার ব্যবসায়ি অনুপম
হাজরার সাথে সম্বন্ধ করেই বিয়ে দিয়ে দেন। মিলি কলেজ জীবনে প্রভাস আগরওয়াল নামের
একটি অবাঙ্গালি ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ওঁর বাবা মা বা
দাদা কেউই সেটা মেনে নিতে পারেনি। ফলত মিলিকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই বিয়ের পিঁড়িতে
গিয়ে বসতে হয়।
অনুপম এসবের কিছুই জানত না। বিয়ের পরে স্ত্রীকে ও বাবা
মাকে নিয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছিল অনুপম। ওর মা প্রথমে মারা যান বিয়ের একবছরের মাথায়
আর বাবা গত হয়েছেন এই বছর খানেক আগে। অনুপম বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।
ফার্নিচারের ব্যবসায় বেশ ভাল রোজগার পাতি হয়। মিলি আর মেয়ে সুমিই ওর কাছে সব।
মেয়েকে গত বছর নার্সারিতে ভর্তি করিয়েছে অনুপম। এ বছর মেয়েটা সবে কে জি ওয়ানে
উঠেছে। মিলি নিজেই ওকে স্কুলে নিয়ে যায় নিয়ে আসে।
সপ্তাহ খানেক আগে একদিন অনুপম দুপুরে বাড়িতে লাঞ্চ খেতে
এসে দেখে সদর দরজা খোলা রেখেই মিলি কোথায় যেন বেড়িয়ে গেছে। ডাইনিং টেবিলের উপর ওর
মোবাইলটাও ফেলে রেখে গেছে। মিলি নিশ্চয়ই আসে পাশের কোন বাড়িতে কোন দরকারে গেছে
ভেবে অনুপম হাত মুখ ধুয়ে নিজেই খাবার বেড়ে নিয়ে খেতে বসে পরে, ওকে আবার ফিরতে হবে দোকানে। বিয়ের সিজন চলছে, শুধুমাত্র
কর্মচারীর ভরসায় তো দোকান ছেড়ে রাখলে চলবে
না। ওর খাবার শেষ হবার আগেই অনুপমের স্ত্রী মিলি ফিরে এলো বাড়িতে। মিলি এমনিতেই
বেশি কথা বলে না। কিন্তু মিলির চোখমুখ দেখে ঘাবড়ে গেল অনুপম। মনে হল কোন কারণে
মিলি ভীষণ ভাবে ডিস্টার্বড হয়ে আছে বা ভয় পেয়ে গেছে।
অনুপম খাওয়া থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল,’ কি হল, কোথায় গেছিলে ? আর
তোমাকে এতো গম্ভীর দেখাচ্ছে কেন, কোন খারাপ খবর টবর পেলে
নাকি ?’ মিলি শান্ত গলায় শুধু বলল ’ না
ও এমন কিছু না। তোমায় আরেকটু ভাত দেব ?’ এড়িয়ে গেল অনুপমকে।
অনুপম ‘ না, লাগবে না’
বলে বাকি খাবারটুকু শেষ করে আবার চলে যায় দোকানে। কিন্তু বেশ বুঝতে
পাড়ছিল যে মিলি কিছু একটা লুকিয়ে গেল আর ওর প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে চাইল না।
কিন্তু কেন ? অনুপমের মনের ভিতরে একটা খচখচানি শুরু হয় আর
সেদিন মাঝ রাতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলে উঠে মিলির সেল ফোন নিয়ে চলে যায় বসবার ঘরে। মিলির
ফোনের প্যাটার্ন ওর জানা ছিল। ফোনের কল লিস্টে বা কন্টাক্ট লিস্টে তেমন কোন অচেনা নম্বর দেখতে পেল না
অনুপম। এমনকি ওর হোয়াটস এপ চেক করেও কোন রকমের অচেনা অজানা নম্বর বা সন্দেহের কিছু
খুঁজে পেলনা। কিন্তু তবুও ওর মনের সন্দেহ দুর হল না।
পরের দিন সকাল থেকেই মিলিকে বেশ আনমনা দেখাচ্ছিল। মিলি
দেখতে খুবই সুন্দর। লম্বা, গায়ের রং ফর্সা ও স্বাস্থ্য বেশ ভালই
বলা চলে। এমনিতে মিলি বেশ শান্ত প্রকৃতির মেয়ে, বিশেষ কোন
বন্ধু বান্ধবও নেই ওর। শুধু পাশের বাড়ির গাঙ্গুলি বৌদির সাথেই যা একটু মেলা মেশা
করে। অনুপম লক্ষ করে মিলি মেয়েকে তৈরি করে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসে সোজা রান্না ঘরে
ঢুকে গেল। এমনকি অনুপমের জলখাবার দিতেও ভুলে গেল। শেষে অনুপম চাইতে তাড়াতাড়ি
টেবিলে ওর খাবার রেখে যায়।দুপুরে অনুপমের আজ আর বাড়ি যাওয়া হয়নি। দোকানে খদ্দরদের
ভিড় ছিল খুব আজ। কাজের ছেলেটাকে বাড়িতে পাঠিয়ে ওর লাঞ্চ আনিয়ে নেয় অনুপম। তারপর
বিকাল সাড়ে তিনটার সময় রোজকার অভ্যাস মত ওর সেল ফোন নিয়ে বসে ফেস বুক খুলে বসে। এই
সময়টা দোকানটা খালিই থাকে। অনুপমের হটাত কি খেয়াল হল আজ মিলির টাইম লাইন খুলে চেক
করতে শুরু করল। কিন্তু দেখে মিলির টাইম লাইনে মিলি আর একটা অচেনা ছেলের ঘনিষ্ঠ
কয়েকটা ফটো কোন এক ব্রজেশ সিং পোষ্ট করেছে আজ দ্বিতীয়বার মিলিকে ট্যাগ করে।
ছবিগুলি দেখে বেশ চমকে উঠল অনুপম।ফটোগুলির প্রত্যেকটাতে মিলি ঐ সুন্দর দেখতে ছেলেটার বাহু
বন্ধনে। দুখানা ছবিতে দুজনের চুম্বনরত অবস্থার সেলফি তোলা। বেশ বোঝা যাচ্ছে যে এই
সবকটা ফোটোই মিলির বিয়ের আগের তোলা ছবি। তার মানে ওর এই বন্ধুর সাথে মিলির বেশ
ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল যেটা আজ পর্যন্ত মিলি অনুপমকে জানায় নি। তাহলে এই ব্রজেশ সিঙই
কি বিয়ের আগে মিলির বয়ফ্রেণ্ড ছিল ? কিন্তু এই ফটো গুলি এতদিন বাদে আবার
মিলিকে ট্যাগ করে ফেস বুকে পোষ্ট করবার মানে কি ? তাহলে কি
ওদের মধ্যে এখনো ভালোবাসার সম্পর্ক আছে ? খদ্দের চলে আসায় এই
নিয়ে অনুপম আর বেশি খোঁজ খবর নিতে পারল না।
অনুপম শুধু অবাকই হলনা মনে মনে প্রচণ্ড রেগে গেল মিলির
উপর। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কোন এক জনের মনে একবার সন্দেহ দানা বাধলে তার পরিণতি
সাধারণত খারাপের দিকেই যেতে থাকে। সেই রাতেই মেয়ে ঘুমিয়ে পরবার পর মিলিকে চেপে
ধরলে অনুপম। জিজ্ঞাসা করল, ‘কে এই ব্রজেশ সিং আর তোমার টাইম লাইনে
এই সমস্ত ঘনিষ্ঠ ফটো পোষ্ট করবার মানেই বা কি ?’ কিন্তু মিলি
মাথা নাড়িয়ে দৃঢ় ভাবে শুধু জবাব দিল,’কি জানি ? সত্যি বলছি আমি জানিনা, বিশ্বাস কর। আমি এই ব্রজেশ
সিঙের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছিলাম ও প্রভাসের বন্ধু বলে।‘ কথাটা বলেই কাঁদতে থাকে মিলি। ওর চোখ মুখ দেখে অনুপম বুঝতে পারে মিলি
সত্যি কথাই বলছে হয়ত। আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘এই প্রভাসটাই বা
কে মিলি ? আর এই সব হচ্ছেটা কি তাহলে ? এই ছবি গুলি তো আর মিথ্যা বলছে না। তোমার সাথে এই ছেলেটাই কি প্রভাস ?’
এইবার মিলি সব খুলে বলল অনুপমকে। ‘ বিশ্বাস কর, প্রভাস নামের এই ছেলেটি ছিল আমার বিয়ের
আগের বয়ফ্রেণ্ড। কিন্তু বাবা মা ও দাদা কেউই ও মাড়োয়ারি বলে এই সম্পর্কটা মেনে নেয়
নি আর আমাকে একরকম জোর করেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সত্যি বলছি, বিয়ের পর থেকে আমি আর কোনদিন ওর সাথে কোন যোগাযোগ রাখিনি, বিশ্বাস কর।‘ মিলির দুচোখ দিয়ে বয়ে চলে অশ্রুধারা। অনুপম গভীর চিন্তায় পরে যায়। সত্যিই
মিলি বিয়ের পর এতবছর ওর সাথে সুখে ঘর সংসার করেছে। কিন্তু হটাত এই পুরানো
সম্পর্কের ভুলে যাওয়া চ্যাপটার আবার খুলতে চাইছে কে ? মিলির
মত ও নিজেও ডিস্টার্বড হয়ে গেল এই ঘটনায়।
সেদিনের মত এই নিয়ে আর কোন আলোচনা হয়নি ওদের।
প্রথমবার ফেস বুকে ওর এসব ছবি দেখে সেদিন দুপুরে মিলি
বেড়িয়ে গিয়েছিল বাইরের বুথ থেকে প্রভাসকে ফোন করে এই ব্যাপারে ওর আপত্তির কথা
জানাতে। এবার অনুপমের পরামর্শে সেই রাতেই মিলি ঐ পুরানো সবকটা ছবি ওর টাইম লাইন
থেকে ডিলিট করে দিয়েছিল। কিন্তু আবার গত কাল বিকালে সেই ব্রজেশ সিং প্রভাস আর
মিলির আরও বেশ কয়েকটা রগরগে খোলা মেলা ছবি পোষ্ট করে মিলিকে ট্যাগ করে। রাতে বাড়ি
ফিরেই মিলির কাছ থেকেই জানতে পারে অনুপম আর এবার অনুপম ভীষণ রেগে যায় ছবিগুলি
দেখে। মিলি এরকম খোলা মেলা ড্রেসে ঐ প্রভাসের সাথে এ ভাবে ফটো তুলেছে দেখেই
অনুপমের মাথা গরম হয়ে যায়। দুজনের মধ্যে এবার সত্যি সত্যি ভীষণ ঝগড়া লেগে যায় এবং
অনুপম পরদিন সকালেই মিলিকে দুর্গাপুর পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এখন কিছুদিন দুজন
আলাদা থাকাই ভাল বলে মনে করে অনুপম।
কিন্তু আজ মিলি দুর্গাপুরে বাপের বাড়ি না গিয়ে এই ভাবে
দামোদরের জলে ঝাপ দেবে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি অনুপম। কাল রাতে মিলি ওকে বার বার
বলেছিল যে ও এই সবের মানে নিজেও বুঝতে পাড়ছে না। এই ব্রজেশ সিং কেনই বা ওর আর
প্রভাসের অনেকদিন আগে তোলা এইসব ফটো ফেস বুকে পোষ্ট করছে ? এই ফোটোগুলি সেই লোকটা পেলই বা কিভাবে ? কিছুতেই
সেটা মিলির মাথায় আসছে না। কিন্তু অনুপম এতটাই রেগে ছিল যে মিলির কোন কথাই ওর
বিশ্বাস করবার ইচ্ছাটুকু পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু এই মুহূর্তে আজ অনুপমের আফসোস হচ্ছে,
মনে হচ্ছে মিলি কাল হয়ত ওকে সত্যি কথাই বলেছিল।
প্রভাস আগরওয়াল খুব সৌখিন ছেলে। বাবার বেনাচিটিতে বিশাল
বড় ইলেক্ট্রনিকসের দোকান। দুই ভাই মিলে বাবার সাথে ব্যবসার কাজ সামলায়। মিলির মত
সুন্দরী মেয়ের সাথে ওর প্রেমের সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছেছিল। কিন্তু প্রভাস
কোনদিনই মিলির মত একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করতে চায়নি। ওর ইচ্ছা ছিল
মিলিকে নিয়ে বেশ কিছুদিন মস্তি করে তারপর ওকে ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু আরও বেশিদূর
এগোবার আগেই ওর বাবা মা ওকে জোর করেই পানাগরের এই ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়।
প্রভাস নিজেও হাফ ছেড়ে বাঁচে। দুই বছর বাদেই প্রভাসের বিয়ে হয়ে যায় কলকাতার এক
মাড়োয়ারি পরিবারের মেয়ের সাথে। এদিকে মিলির ভিতর বিরাট এক পরিবর্তন আসে। ও একদম
বদলে যায় ও শান্ত মেয়ের মত সংসারে মন দেয়।
সৌখিন প্রভাসের এপেল আই ফোন কিনবার শখ হয় এবং সে তার
পুরানো স্যামসং সেল ফোন সেকেন্ড হ্যান্ড দামে বেঁচে দেয় ওর এক বন্ধু ওয়ারিয়ার
ব্রজেশ সিঙের কাছে। কিন্তু প্রভাস সেই পুরানো ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট মুছে দিলেও ফটো
গ্যালারি ডিলিট করতে ভুলে যায়। ব্রজেশ সিং ওয়ারিয়ার ডি ভি সির প্ল্যান্টের কয়লার
চোরা কারবারিদের পাণ্ডা। অবিবাহিত বছর তিরিশের ব্রজেশ সিং মেয়েদের সাথে মৌজ মস্তি
করতে অভ্যস্ত। হটাত একদিন ওর নজরে পরে যায় প্রভাসের ওর গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে
ঘনিষ্ঠ পুরানো সেই ছবিগুলি। ব্রজেশ ওর বন্ধুর মাধ্যমে মিলির নাম জানতে পারে আর ফেস
বুকে ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। মিলি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করার পর ব্রজেশ
ওদের সেই সব ছবি বারে বারে পোষ্ট করতে থাকে। ব্রজেশ সিঙের উদ্দেশ্য ছিল একটাই, মিলি যাতে বাধ্য হয়ে ওর সাথে যোগাযোগ করে এবং ওর পাতা ফাঁদে পা দেয়।
মিলি অনেক দিন পর যেদিন ফেস বুকে লগ ইন করে এই সব ফটো
দেখতে পায় সেইদিনই দুপুরে বাইরে এস টি ডি বুথে গিয়ে বিয়ের পর এই প্রথম প্রভাসকে
ফোন করে ওর বন্ধু ব্রজেশ সিঙের ওর টাইম লাইনে ওদের দুজনের এই সব ছবি পোষ্ট করবার
ঘটনা জানায় ও ব্রজেশ সিঙের ফোন নম্বর চেয়ে নেয়। যদিও প্রভাস নিজেও অবাক হয় ও
মিলিকে কথা দেয় যে ও ব্রজেশের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলবে। বিবাহিত প্রভাস নিজের
ভুল বুঝতে পেরে মিলির কাছে ক্ষমা চায় পর্যন্ত।
কিন্তু দ্বিতীয়বার ব্রজেশ আবার আরও কিছু রগরগে ফটো পোষ্ট
করায় এবং রাতে অনুপমের সাথে এই নিয়ে
চূড়ান্ত ঝগড়া হবার পরেই মিলি ওর কর্তব্য ঠিক করে ফেলে । মনে মনে বিধ্বস্ত
মিলি পরদিন সকালে পানাগর স্টেশনে অটো থেকে নেমে ট্রেন ধরবার কোন চেষ্টা না করে
স্টেশনের উল্টো দিকের অটো স্ট্যান্ড থেকে শিলামপুর ফেরিঘাটের অটোতে উঠে বসে ও
শিলামপুর ঘাটে পৌঁছে যায়। মিলির মনের ভিতর তখন ঝড় উঠেছিল । জলে ঝাপ দেবার আগে মিলি
এস টি ডি বুথে ঢুকে ফোন করে ব্রজেশ সিংকে পরিষ্কার বলে দেয়, ’আমার পরিবার ভেঙ্গে দেবার জন্য আপনিই দায়ী থাকবেন ব্রজেশ বাবু। ভগবান
কোনদিন আপনাকে ক্ষমা করবে না। এই পাপের শাস্তি আপনি নিশ্চয়ই পাবেন। কেউ আপনাকে
বাঁচাতে পারবে না বলে রাখলাম।‘
এরপরেই মিলি ফোন করেছিল প্রভাসকে। প্রভাস দোকানেই ছিল
তখন। হটাত মিলির ফোন দেখে প্রভাস বেড়িয়ে এসে ফোন তোলে। ওপার থেকে মিলির গলা ভেসে
আসে। চাঁপা কান্না মেশানো গলায় মিলি বলেছিল , ‘তোমাকে বলেছিলাম ব্রজেশকে মানা করতে,
তুমি করনি। জানিনা কি কারণে তুমি আমাদের ঐ সব ছবি ব্রজেশকে দিয়েছ ?
কাল আবার ও আমাদের আরও কয়েকটা ফটো পোষ্ট করেছে ফেস বুকে। বাড়িতে
চূড়ান্ত অশান্তি হচ্ছে। আমি আর এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিনা প্রভাস। আমি চললাম
এই দুনিয়া ছেড়ে। তুমি তোমার বৌ কে নিয়ে সুখে থেকো......।‘ কথা
গুলি বলে মিলি প্রভাসের কোন জবাবের প্রতীক্ষা না করেই লাইন কেটে দিয়েছিল। আর
তারপরেই মেয়েকে সাথে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে দামোদরের জলে ।
নন্দর দোকানে গিয়ে একটা না দুখানা ফোনের খবর পেল মানস।
দুটো ফোনই করেছিল সেই মহিলা। মানস দুটো নম্বরই টুকে নিয়ে সেখান থেকেই ফোন করল সাব
ইন্সপেকটার পলাশ সেনকে। মানস বলল, ‘স্যর,ঐ মহিলার
ব্যাপারে একটা খবর দেবার ছিল।‘
‘কি খবর মানস ? ওর হাসবেণ্ডের খবর আমরা
পেয়ে গেছি। মহিলার নাম মিলি হাজরা, দেবীপুরে বাড়ি ওদের।
হাসবেণ্ডের একটা বড় ফার্নিচারের দোকান আছে পানাগরে। আমরা খবর করে দিয়েছি ওকে।
তোমার কাছে আরও কোন খবর আছে নাকি ? বলে ফেল, দেড়ি করোনা।‘ মিস্টার সেনের গলায় তখনও উত্তেজনার রেশ । মানস মহিলার পরিচয় জানা গেছে
শুনে নিশ্চিন্ত হল। আর যাই হোক বাচ্চাটা ওর বাবার কাছে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু
তবুও মানস সৌরভ সেনকে জানাল,’স্যর, জলে
ঝাপ দেবার আগে মিসেস হাজরা দুখানা ফোন করেছিল এখানকার একটা এস টি ডি বুথ থেকে।
নম্বর দুটো নোট করে নিন স্যর...।‘
পলাশ সেন নম্বর দুখানা নোট করে ওপার থেকে বলল,’ঠিক আছে আমি খোঁজ নিচ্ছি। অনেক ধন্যবাদ মানস।‘ পলাশ
সেন লাইন কেটে দিয়ে ওর জুনিয়র ঘোষাল বাবুকে ডেকে তক্ষুনি বলে দিল এই নম্বর দুটোর
খবর নিতে। কিছুক্ষণ বাদেই থানায় এসে হাজির হল অনুপম হাজরা। চেহারা দেখেই বোঝা গেল
লোকটা খুব ভেঙ্গে পড়েছে। পলাশ সেন ওকে বসিয়ে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,’
আপনার মেয়েকে কি এখন বাড়ি নিয়ে যেতে চান নাকি কাল নেবেন মিস্টার
হাজরা ? আমার কিন্তু মনে হয় আজ ও হাসপাতালে থাকলেই ভাল। আপনি
বরং গিয়ে ওর সাথেই থেকে যান হাসপাতালে। কাল বরং বাড়ি নিয়ে যাবেন। মায়ের শেষ দেখাটা
অন্তত যাতে দেখতে পারে অভাগিনী।‘ অনুপম হাজরা পলাশ সেনের কথায় যুক্তি দেখতে পায় আর সেই মত
হাসপাতালে গিয়ে মেয়ের কাছে থাকতে রাজি হয়ে যায়। এবার পলাশ সেন কাগজে নোট করা নম্বর
দুটো দেখিয়ে অনুপম হাজরাকে জিজ্ঞাসা করল, ’আচ্ছা, দেখুনতো
এই দুটো ফোন নম্বর আপনি চিনতে পারছেন কিনা। জলে ঝাপ দেবার একটু আগেই আপনার স্ত্রী
এই দুখানা নম্বরে শেষ ফোন করেন। আপনি যদি কিছু জানেন তবে আমাদের সেটা জানালে ভাল
হয়। আমাদের তদন্তের সুবিধা হবে।‘
পলাশ লক্ষ করল অনুপম হাজরার কপালে ভাঁজ ফুটে উঠল। কাগজটা
তুলে ধরে নম্বর দুটো দেখে আবার টেবিলে রেখে দিয়ে বলল,’ না মিস্টার সেন। আমি এই নম্বর দুটোর সাথে পরিচিত নই। আপনি টেলিফোন
কোম্পানি থেকে খোঁজ নিয়ে দেখতে পাড়েন। মনে হয় আমার স্ত্রী মিলির কোন চেনাশুনা কেউ
হবে হয়ত।‘ ওর স্ত্রীর যে বিয়ের আগে অন্য কারো সাথে সম্পর্ক
ছিল সেটা অনুপম হাজরা চেপে গেল। নিজের স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি হোক সে চাইছিল
না। মিলি যখন আর বেঁচেই নেই তখন এসব তদন্ত করে আর কি হবে।
এদিকে প্রভাস মিলির কাছ থেকে ব্রজেশ আবার ওদের ফটো পোষ্ট
করেছে শুনে প্রচণ্ড রেগে যায়। মিলি যেভাবে আজ ওকে ফোনে বলল তার মানে ও নিশ্চয়ই
একটা চূড়ান্ত স্টেপ নিতে চলেছে। সারা দিন ছটফট করে কাটায় প্রভাস। রাত আটটা নাগাদ
পানাগর থেকে সাব ইন্সপেকটার পলাশ সেন ফোন করে প্রভাসকে।পলাশ প্রথমেই বলে,’হ্যালো, আমি পলাশ
সেন বলছি, পানাগর থানা থেকে। আমি কি মিস্টার প্রভাস
আগরওয়ালের সাথে কথা বলছি ?’ থানা থেকে ফোন শুনেই বুকের
ভিতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে প্রভাসের। তার উপর পানাগর থেকে, মানে
নিশ্চয়ই কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। তাহলে কি মিলি ওর নামে কমপ্লেন করে দিয়েছে ? পুলিশ কি এবার ওকে এরেস্ট করতে আসবে। ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো প্রভাসের। বলল,’
হ্যাঁ, প্রভাস বলছি।‘
সাব ইন্সপেকটার সেন সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এলেন।
জিজ্ঞাসা করলেন,’ আচ্ছা মিস্টার প্রভাস, আপনি কি মিসেস মিলি হাজরা নামের কাউকে চেনেন ? আজ
সকালে আপনার সাথে ওর প্রায় দুই মিনিট কথা হয়েছে খবর আছে আমাদের কাছে। আপনার সাথে
ওর পরিচয় কিভাবে আর কত দিনের ?’‘হ্যাঁ, আমি চিনতাম মিলিকে। বিয়ের আগে
ওর সাথে ওর কলেজের সূত্রে আলাপ হয়েছিল। আমরা ভাল বন্ধু ছিলাম একসময়ে। কিন্তু
ইন্সপেকটার হটাত আপনি মিলির কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন বলুন তো ?’ প্রভাস কিছু লুকল না ঠিকই, তবে ধন্দে পরে যায়।
পুলিসটার প্রশ্ন শুনে তো মনে হচ্ছে না যে
মিলি কোন অভিযোগ করেছে ওর ব্যাপারে। ওদিক থেকে পলাশ সেন এবার সেই ভয়ঙ্কর সত্যি
কথাটা জানাল,’ মিস্টার প্রভাস, মিলি
হাজরা আজই সকালে দামোদরের জলে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আমিই ওঁর কেসটা হ্যান্ডল
করছি। আপনার সাথে ওঁর ঠিক কি কথা হয়েছে যদি একটু জানান তাহলে উপকার হয়।‘
প্রভাস একেবারে আকাশ থেকে পড়ল মিলি আর নেই কথাটা শুনে।
আজই সকালে ও ফোনে বলেছিল যে ‘আমি চললাম এই দুনিয়া ছেড়ে…।‘ প্রভাস কিছুতেই বিশ্বাস করতে পাড়ছে না যে মিলি
সত্যি সত্যি ওদের সবাইকে, ওর স্বামী ওর মেয়েকে ছেড়ে জলে ঝাপ
দিয়ে আত্মহত্যা করেছে আজ। বুদ্ধিমান ও হতবাক প্রভাস একটু চুপ থেকে পলাশ সেনকে এবার
একটা মিথ্যা কথা বলে বলল,’দেখুন, আমার
সাথে বিশেষ কোন কথা হয়নি ওর। আনেক দিন বাদে হটাত ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিল আমি কেমন
আছি আমার বৌ কেমন আছে এই সব আর কি। তা ওর মরদেহ কি ওর স্বামীর হাতে তুলে দিয়েছেন
আপনারা ? এমা, আমি তো ভাবতেই পারছিনা
মিলি আর নেই। ইস, আজ সকালেও আমি কথা বলবার সময় কিছুই বুঝতে
পারিনি স্যর, বিশ্বাস করুন।‘ প্রভাসের
গলার স্বরে বেদনার ছোঁয়া শোনা গেল।পলাশ সেন আর বিশেষ কথা না বাড়িয়ে শুধু বলল,’ও কে। যদি দরকার পরে আপনাকে আবার ফোন করব প্রভাস বাবু। বুঝতেই পারছেন।
আত্মহত্যার কেস। আমাদের তো কারণটা খুঁজে বার করতে হবে, তাই
না ?’
প্রভাস ছোট্ট করে শুধু ‘হুম’ বলে লাইন কেটে দিল। কিন্তু ওর মাথায় তখন রক্ত উঠে গেছে। ব্রজেশ সিঙের এই
বদমাইশি প্রভাস কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। আজ ওর জন্যই তো মিলির মত একটা মিষ্টি
মেয়েকে শুধু শুধু আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হল। মিলির সাথে তোলা ওর পার্সোনাল ছবি
গুলি যদি ওর ফোনের সাথে চলে গিয়েও থাকে তাহলেও ব্রজেশ সেগুলি ডিলিট করে দিলো না
কেন ? কেন ও সেগুলি মিলির টাইম লাইনে পোষ্ট করতে গেল ?
কি উদ্দেশ্য ছিল ওর প্রভাসের আর মিলির ব্যক্তিগত ছবিগুলি পাবলিক করে
দেওয়ার ?
জি টি রোডের ধারে ওয়ারিয়া যাবার রাস্তার মোড়ে একটা
পাঞ্জাবী ধাবাতে ব্রজেশ সিঙের সাথে সেদিন রাতে দেখা করেছিল প্রভাস। প্রভাসের
পুরানো মোবাইলের বদলে ব্রজেশের কাছ থেকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা হাতে নিয়ে ও আর ওর
আরেক বন্ধু বিয়ার আর রুটি মাংস খেয়ে ফিরেছিল সেই রাতে প্রভাসের মনে আছে। ঘড়িতে এখন রাত সাড়ে আটটা মাত্র। প্রভাস ব্রজেশ
সিংকে ফোন করে বলল,’ হাই ব্রজেশ। তোর সাথে জি টি রোডের সেই
ধাবায় একটু দেখা করা যাবে আজ এই রাত সাড়ে নটা নাগাদ। একটা বিশেষ দরকার আছে রে।‘ব্রজেশ ভাবল নিশ্চয়ই মিলি ওর এক্স লাভারের মাধ্যমে কোন
খবর পাঠিয়েছে। কালই তো ব্রজেশ ওর টাইম লাইনে সেই রগরগে ছবি গুলি পোষ্ট করেছে। তার
মানে ওর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে, মিলির নিজের পরিবার ভেঙ্গে গেছে,
আজ সকালেই তো মিলি বলল ওকে। এবার পাখি জালে ধরা পড়েছে। ব্রজেশ এক
কথায় প্রভাসের সাথে দেখা করতে রাজি হয়ে গেল। বলল রাত সাড়ে নটা থেকে পৌনে দশটার
মধ্যে ও পৌঁছে যাবে ধাবাতে। হাতের কাজটা শেষ করেই ও বেড়িয়ে পড়বে।
প্রভাস দাদাকে বলে দিল ওর বাড়ি ফিরতে দেড়ি হবে আজ। একটা
জরুরি কাজ আছে ওর। বাড়িতে যেন বৌ আর মাকে বলে দেয় চিন্তা না করতে। দোকান থেকে বেড়
হবার আগে বাথরুমের উপরের তাকে লুকিয়ে রাখা ওর পিস্তলটা কোমরে গুঁজে নিলো প্রভাস।
এই অস্ত্রটা একসময়ে ও সবসময় কাছে রাখতো। তখন প্রভাসের বেশ কয়েকজন বন্ধুর কাছেই
পিস্তল থাকত। অনেকদিন পর আজ ওটা আবার প্রভাসের কাজে লাগবে। মোটর বাইক নিয়ে রাত ন’টার পর রওনা দিল প্রভাস। সামনে লক্ষ্য অপারেশন ব্রজেশ।
ব্রজেশ এলো রাত দশটার ঠিক আগে। ইতিমধ্যে প্রভাস চিকেন
ললি পপের সাথে এক বোতল বিয়ার শেষ করে ফেলেছে। রক্তে একটা হাল্কা আমেজের ছোঁয়া লেগেছে যেন। লিলির সাথে কাটানো ঘনিষ্ঠ
মুহূর্তগুলি চোখের সামনে ভেসে আসছিল তখন। আজ এতদিন বাদে হটাতই মিলি নেই ভেবেই
প্রভাসের ভীষণ কষ্ট হতে লাগল মিলির জন্য। মেয়েটা বেশ শান্ত শিষ্ট ছিল আর প্রভাসকে
ভীষণ ভালবাসত। হারামজাদা ব্রজেশ ওকে একটু শান্তিতে বাঁচতেও দিলো না। প্রভাসের রাগে
গা রি রি করছে এখন।প্রভাস ব্রজেশ এলো পর ওকে ওর কয়লার ব্যবসা কেমন চলছে, প্রভাস যদি এই ব্যবসায় নামতে চায় তাহলে ওকে কি করতে হবে ইত্যাদি আলোচনায়
ব্যস্ত রাখল প্রথমে। রাত বাড়বার সাথে সাথে ধাবাটা অনেকটা খালি হয়ে এলো। ইতি মধ্যে
ওরা বিয়ারের বোতল খালি করতে করতে মাংস রুটি খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। ব্রজেশ এই
পয়সাওয়ালা ছেলেটা ওর ব্যবসায় নামতে চায় শুনে বেশ আগ্রহ সহ প্রভাসকে ব্যবসার কিছু
খুঁটিনাটি বোঝাচ্ছিল। ওদের খাওয়া শেষ হতে হতেই রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেল।
প্রভাস ধাবার টাকা পয়সা মিটিয়ে কিছুদূরে বড় রাস্তার উল্টো দিকে একটু দুরে দাঁড় করে
রাখা ওর মোটর বাইকের দিকে এগিয়ে যায়। ঘটনাক্রমে ব্রজেশ ওর স্কুটারও ঐ একই দিকে
রেখে এসেছিল।
রাস্তার ঐ অঞ্চলটা ছিল ঘন অন্ধকারে ঢাকা, পাশেই কাঁটা ঝোপ। কথা বলতে বলতেই হটাত প্রভাস পিছনের কোমরে গুঁজে রাখা
পিস্তলটা বেড় করে পয়েন্ট ব্ল্যাক রেঞ্জে দাঁড়িয়ে সোজা ব্রজেশের পেটে পর পর দুখানা
গুলি চালিয়ে দিল। পিস্তলের মুখে সাইলেন্সর লাগানো থাকায় কোন আওয়াজ শোনা গেল না।
কিন্তু আচমকা এই আক্রমণের মোকাবিলা করার কোন সুযোগই আর পেল না ব্রজেশ। শুধু অস্ফুট
স্বরে বলে উঠল,’কিন্তু কেন ?’ প্রভাস
ওর শত্রুর দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই ঝুঁকে পরে শুধু বলল,’ আমার
লিলিকে মেরে ফেলবার জন্য তুইই দায়ী শুয়োরের বাচ্চা। আমাদের ফোটোগুলি পোষ্ট করার
সময় খুব মজা পেয়েছিলি না, এবার দেখ তার পরিণাম কি।‘ ব্রজেশের জামার বুক পকেটে রাখা ওর পুরানো সেই স্যামসং ফোনটা নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। আর তারপরেই প্রভাস আরও একটা
গুলি চালাল ওর বুকের দিকে তাক করে।
রাস্তার চলন্ত গাড়ির হেড লাইটের আলো মাঝে মাঝে ছিটকে এসে
পড়ছিল সেখানে। প্রভাস চারিদিকটা দেখে নিয়ে তাড়াতাড়ি মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে
বেড়িয়ে পড়ল ওখান থেকে। রক্তাক্ত ব্রজেশ সিং ততক্ষণে চোখ বুজেছে। পিছন ফিরে একবার
ব্রজেশের সেই নিস্তেজ দেহটার দিকে তাকিয়ে ঘৃণায় এক দলা থুতু ছিটিয়ে প্রভাস গাড়ি
চালিয়ে দিল বাড়ির উদ্দেশ্যে। মনে মনে শুধু বলল ,’মিলি,আজ আমি তোমার অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছি সোনা। পারলে তুমি আমাকে ক্ষমা করে
দিও।‘
uttamchakraborty306@gmail.com
কলকাতা
No comments:
Post a Comment