1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 1, 2020

পরিণতি


        
                                             ...মৌসুমী ঘোষ


          মুম্বাই শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত অধ্যাপিকা ইন্দিরাদেবী । সাইকলজিতে মাষ্টার ডিগ্রী, কলেজে যথেষ্ট সুনাম ছিল একজন শিক্ষিকা হিসাবে । গত ছয় মাস আগে তিনি অবসর নিয়েছেন । বর্তমানে দুই ছেলেকে নিয়ে সুখেই আছেন । তবে বড় ছেলে শুভ্রর কথা মনে করে মাঝে মধ্যেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে যান । অকালেই সবাইকে ছেড়ে চলে গেল ছেলেটা । তবু অন্য দুই ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার কাজ শুরু করেন ।
            খুব শক্ত মনের মানুষ ইন্দিরাদেবী । মাত্র ২৪ বছর বয়সে, পছন্দের মানুষের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা । বাড়ির সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করে (বর্তমানে) মুম্বাইতে পাড়ি দেওয়া । তারপর কয়েকটা বছর স্বামীর সাথে খুব আনন্দেই কেটেছিল । বিয়ের তিন বছরের মধ্যেই কলেজের চাকরী, যমজ দুই সন্তানের জন্ম, বড় সখ করে ওর বাবা নাম রেখেছিল শুভ্র আর অভ্র । তারও দুই বছর পর ছোটো ছেলে অঙ্কিতের জন্ম হয় । এই কয়েকটা বছ্র যে কেমন স্বপ্নের মতো কেটে গিয়েছিল বুঝতেই পারেননি তিনি ।
        কিন্তু ভাগ্য বড়ই নিষ্ঠুর, স্বামীর সাথে সুখের সংসারে মাত্র আট বছর পূরণ হতে না হতেই একদিন বাড়ী ফেরার সময় রাস্তায় গাড়ী দুর্ঘটনায় মারা গেলেন তিনি । নিজে পেশায় সাধারণ ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও ছেলেদেরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষের মত মানুষ করে তোলার স্বপ্ন দেখতেন ।সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই তিনি চলে গেলেন । ইন্দিরাদেবীর বয়স তখন কত হবে, তেত্রিশ ছুঁই ছুঁই । অত অল্প বয়সেও তিন তিনটে শিশুর দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না । তিনটে শিশু তারই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত । জীবনের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে নিজের আত্মসন্মান বজায় রেখে ছেলেদের মানুষ করার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অবিচল । অকালবৈধব্য,ছত্রছায়াহীন একটা মেয়ের একা পথচলা, মুম্বাইয়ের মতো শহরে খুব একটা নিরাপদ ছিল না । তবু নিজের লক্ষ্যে তিনি ছিলেন বদ্ধ পরিকর, বাবার অভাব কোনোদিন ছেলেদেরকে বুঝতে দেননি, সব সুখ দুঃখের বাহক তিনি একাই ।
        আস্তে আস্তে ছেলেরা বড় হয়ে উঠল, বড় দুজন কলেজে পড়ছে, ছোটোটাও মাধ্যমিক দেবে । তিনজনই পড়াশোনায় বেশ ভালো । তবে বড় ছেলের একটু সংসারের দিকে লক্ষ্য বেশী । আর তাই কলেজে ঢুকেই চাকরীর চেষ্টা করতে থাকে । এদিক ওদিক দরখাস্ত করতে করতে চাকরি একটা জুটেও যায় । গুজরাটের ভুজ শহরে একটা বোর্ডিং স্কুলে পড়ানোর চাকরি । এই সুযোগ শুভ্র হাতছাড়া করেনি । মাকে বলেছিল, ওখানে থেকেই চাকরীর সাথে সাথে পড়াশুনাও করতে পারবে । মায়ের সকল আপত্তি অগ্রাহ্য করেই চলে গিয়েছিল গুজরাটে । কিন্তু সেখান থেকে বাড়ীতে আর ফেরা হয়নি শুভ্রর । ১৯৯৮ সালের ভুমিক্মপে ভুজ শহরের সাথে ধ্বংসস্তূপের তলায় তলিয়ে গিয়েছিল ২২ বছরের সরল, সদা হাস্যময় শুভ্র, চিরকালের মতো মা ও দুই ভাইকে ছেড়ে বিদায় নিয়েছিল সে ।
 দুঃস্বপ্নের মধ্যে কয়েকটা দিন কেটেছিল ইন্দিরাদেবীর । তবু নিজের মনকে বুঝিয়েছিলেন, তিনি শুধু একা নন, হাজার হাজার মায়ের কোল খালি হয়ে গিয়েছে । স্বামীর মৃত্যুশোক ভুলে সবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন আবার একটা ঝড় সব শেষ করে দিয়ে গেল । এই জীবনের উপর দিয়ে এত ঝড়, তুফান সহ্য করেও নিজের মনকে শক্ত করে তৈরী করেছিলেন অন্য দুই ছেলের জন্য । ওদেরকে স্বপ্ন দেখাতেন জীবনে বড় হওয়ার আর তাই আজ ওরা জীবনে প্রতিষ্ঠিত । মেজ ছেলে অভ্র বিদেশে যাবে রিসার্চ করতে । ছোট ছেলে অঙ্কিত বড় হার্ট স্পেশালিষ্ট, শহরের সবথেকে বড় হাসপাতালে চাকরী করে ।এখন আর কোনো কষ্ট নেই ইন্দিরাদেবীর । এবার ছেলেদের বিয়ে দেবেন ভাবছেন ।
            কিন্তু ভাগ্য যার প্রতি বিরূপ তার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায় । রোজকার মতো সেদিনও ইন্দিরাদেবী সন্ধ্যাবেলা টিভিতে খবর দেখছিলেন । হঠাৎ একটা খবর শুনে তিনি বাক‌্হীন হয়ে যান । খবরটা ছিল মুম্বাইয়ে মাটুঙ্গা রেলস্টেশনে ৬টা ২৩-এর লোকাল ট্রেনে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে । ইন্দিরাদেবীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে । অভ্র আর অঙ্কিত তো ঐ ট্রেনেই বাড়ী ফেরে । ইন্দিরাদেবীর হাত পা কাঁপতে থাকে, মাথার ভিতর সবকিছু বিবর্ণ হয়ে যায় । এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ শুনে তিনি কোনোরকমে দরজা খুলে অভ্রকে দেখে আশ্বস্ত হন । কিন্তু অঙ্কিত কোথায় ? সে তো ফেরেনি । অজানা আশঙ্কায় শুরু হয় মা ছেলের অপেক্ষার পালা । কয়েককঘন্টা কেটে গেলেও অঙ্কিত ফেরে না। খোঁজখবর নিয়ে জানা যায় অঙ্কিত ঐ ট্রেনেই বাড়ী ফিরছিল ।  
            অভ্র মাকে ভরসা দিয়ে প্রতিবেশীদের কাছে রেখে অঙ্কিতের খোঁজে ছুটে যায় । থানা, পুলিশ, হাসপাতাল অনেক খোঁজাখুঁজির পর নিহতদের তালিকায় অঙ্কিতের নাম খুঁজে পায় । কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে অভ্র । কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বাড়ী ফেরে অভ্র । অভ্র ভাবে মাকে খবরটা এখনি দেবে না কিন্তু অভ্রর মুখ দেখে ইন্দিরাদেবীর বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না যে, কী ঘটনা ঘটেছে । অভ্র কিছু বলার আগেই ইন্দিরাদেবী মেঝেতে পড়ে যান । প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় মাথায় । সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে । সকালবেলা ডাক্তারবাবু এসে অভ্রকে বলেন ইন্দিরাদেবী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন । পুরানো সবকথা তিনি ভুলে গেছেন । শুধু মনে আছে ৬টা ২৩-এর ট্রেনে তার ছেলেরা বাড়ী আসবে ।
          অভ্র একেবারে একা হয়ে যায় । সবথেকে কাছের মানুষরা এভাবে হারিয়ে যাবে কোনোদিন ভাবতেও পারেনি সে । শুভ্রর কথাও খুব মনে পড়ছিল । এসব দুঃশ্চিন্তার মধ্যেই রাতটা কেটে যায়। মায়ের যা হবার তাতো হয়েছেই । এখন অঙ্কিতের দেহ খোঁজ করতে যেতে হবে । কোথায় পাবে কে জানে । এই সব ভাবতে ভাবতে হাসপাতাল থেকে নিচে নামছে ঠিক সেই সময় অভ্রর সেলফোনটা বেজে ওঠে । খবরটা শুনে অভ্র আনন্দে কেঁদে ফেলে । থানা থেকে বড়বাবু ফোন করে বলে আপনার ভাই বেঁচে আছে । উনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন । নিহতদের তালিকায় যে নামটা ‘অঙ্কিতা’ হওয়ার কথা ছিল সেটা ‘অঙ্কিত’ হয়ে গেছে । আর তাতেই যত সব বিড়ম্বনা । বড়বাবু বলেন যে উনি এখন ভাল আছেন । ওনার বন্ধুরাই দেখভাল করছেন । অভ্র উদ্ভ্রান্তের  মতো ছুটে যায় অঙ্কিতের সাথে দেখা করতে । সারা শরীরে পোড়ার চিহ্ন । মুখটা কালো হয়ে গেছে চেনার উপায় নেই । সবথেকে বেশী ক্ষতি হয়েছে ওর হাতটার । যাইহোক ও যে প্রাণে বেঁচে আছে তাই-ই অনেক ।
      কিন্তু এত বড় সুসংবাদটা কাকে শোনাবে অভ্ । এই খবরে যে সবথেকে আনন্দিত হতো, সে এইসব অনুভূতির ঊর্দ্ধে চলে গেছে । একদিকে মা অন্যদিকে ভাই, কাকে ছেড়ে কার কথা ভাববে অভ্র ।
            একটা একটা করে পনেরটা দিন পার হয়ে গেছে । অঙ্কিত কিছুটা সুস্থ হলেও ইন্দিরাদেবীর বিশেষ কোনো পরিবর্তন নেই। মানসিক অ্যাসাইলাম এখন তার ঠিকানা । সারাদিন আসাইলামের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন কখন তার ছেলেরা ফিরে আসবে সেই আশায় । যে মাকে সারা জীবন জীবনের সাথে লড়াই করতে দেখেছে, আজ সেই মায়ের অবস্থা দেখে কান্নায় বুক ফেটে যায় অভ্রর । যে ভাই সারাজীবন মানুষের প্রাণ বাঁচানোর শপথ নিয়েছিল ভগবান তার হাতের তিনটে আঙ্গুল কেড়ে নিয়েছেন । নিজের বিদেশ যাবার স্বপ্ন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে । অভ্র ভেবেই পায় না, তাদের পরিবারের এই পরিণতির জন্য কে দায়ী ? তাদের ভাগ্য, প্রকৃতি, না আমাদের এই সমাজ ?
            প্রায় একমাস পর অঙ্কিতের হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়ে যায়। কিন্তু ওর হাতটা পুরোপুরি সারে নি । ডাক্তাররা জানায় অঙ্কিতের হাতের চিকিৎসার জন্য তাদের আর কিছু করার নেই । তবে বিদেশে গেলে হয়তো কিছু সুফল পাওয়া যেতে পারে । অভ্র ঠিক করে অঙ্কিতকে বিদেশে পাঠাবে । কিন্তু মনের মধ্যে একটা ভয়, আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা অভ্রকে ঘিরে ধরে। অভ্র ভাবে – যদি অঙ্কিতের প্লেনটা ভেঙ্গে পড়ে ভারতমহাসাগরে, যদি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মতো সন্ত্রাসের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে যায় চিকিৎসাধীন হাসপাতালটি, কিংবা কোনো সুনামি যদি ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় । তাহলে সে তো একদম একা হয়ে যাবে, এক্কেবারে একা ।
            এইসব ভাবতে ভাবতে দুই ভাই পৌঁছে যায় মায়ের আসাইলামে । অঙ্কিত কক্ষনো এতদিন মাকে ছেড়ে থাকেনি ওর মনের ভিতর খুব আনন্দ, কিন্তু অভ্র জানে মাকে দেখলে ওর সব আনন্দ নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে যাবে । দুই ভাই মায়ের কাছে যায়, অঙ্কিত মাকে প্রণাম করে, ইন্দিরাদেবী আশীর্বাদ করে বলেন “ দীর্ঘজীবী হও ” কিন্তু চিনতে পারে না । শুধু অঙ্কিতের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে আর দুচোখ দিয়ে নেমে আসে অফুরন্ত জলস্রোত।


mghoshsrp94@gmail.com
কলকাতা


1 comment:

  1. সমীর কুমার মজুমদার

    একমুখী রিপোর্টের আকারে গল্পের গঠন।
    আধুনিক গল্পের ফরম্যাট খুঁজে পেলাম না।
    গল্পটা নিয়ে আরও ভাবার দরকার ছিল।

    ReplyDelete