1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Friday, May 1, 2020

নন্দিনীর প্রেম

                                                                                                   ...পিনাকী চক্রবর্তী
         ড়িয়াহাটার  মোড়ে  দাঁড়িয়ে  নন্দিনী বসু বালিগঞ্জের  দিকে  মুখ করে  অপেক্ষা  করছিল। উদত্ত এখান দিয়েই আসবে,বিকেলটা থেমে  আছে। আকাশে  শীতের  রোদ  কমছে। বেলা   ভেঙে , বিকেল  নেমে আসবে।ডুবে যাওয়া  সূর্যের আলোয় , আকাশের  বুকে   থেথলানো কমলালেবুর মতন  লাগছে। রাস্তায় গাড়ি  চলছে। মানুষেরা  হেঁটে  হেঁটে যাচ্ছে।মানুষের  চোখে  মুখে প্রত্যাশার ছায়া দেখা যায়। নন্দিনী বসু  সেই ছায়ার নিচে মানুষের  স্বপ্নের  আঁচ পাচ্ছে। অনেক মানুষ   নিজের  মতন  হাঁটছে। অনেকেই  হিসেব  কষছে। কেউ কেউ  নিজের  সারাদিনে  না-পাওয়া  হিসেবের  মধ্যে  বুঁদ হয়ে  রয়েছে। সকলের  মুখের দিকে  তাকিয়ে  নন্দিনী  ,টের পায় ধীরে – ধীরে হিসেব  না  করা  মানুষের সংখ্যা  কমছে ! চারদিকে  অন্ধকার নামছে। নন্দিনীর  দম বন্ধ  হয়ে আসে।মানুষের   চোখে সে  ইদানীং  স্বপ্ন   দেখতে  পায় না। দশ বছর আগেও  কলকাতা  এমন ছিলও না ! খুব তাড়াতাড়ি  সব  পাল্টে  যাচ্ছে। নন্দিনী অপেক্ষা  করছে। উদত্ত  আসবে। তাঁকে  নিয়ে  যাবে।  এই  যে  উদত্ত আসবে, তাঁকে  নিয়ে  যাবে,  দু’জনেই সংসার করবে; একসাথে  থাকবে। সে    আগের  জীবন  ভুলতে  পারবে  ? নিজের  জীবনের তিরিশটা  বছরের  মধ্যে   দশ  বছর  মনে  না  রাখাটাই  ভালো।
নন্দিনীর  বয়স এখন   তিরিশ।আজ  থেকে  দশ  বছর  আগে  কুড়ি  ছিলও। কোমর অব্দি  ঘন কালো  চুল, লম্বা মুখ , টিকালো নাক, সরু  ঠোঁট , গভীর দুটো   চোখ  দেখে  প্রেমে  পড়েছে  ,এমন লোক  অনেক আছে।তাঁদের কাছে   নন্দিনী  স্বপ্নে  ভেসে  থাকা সুন্দরি  মানবী।নারী  হলে  তাঁকে ছুঁয়ে ফেলা  যেতো, মানবী যে স্বপ্নেই  থাকে। অনেক পুরুষই নন্দিনীর  স্বপ্ন  দেখেছে। নন্দিনী  ধরা দিয়েছে, বিকাশ সোম  বড়ুয়াকে।দু’জনেই একে  অপরের  প্রতি  আকর্ষিত হয়  কলামন্দিরে। প্রথম দেখা। নন্দিনীর   শরীরের  ভাঁজে ভাঁজে ,নৃত্যের  তালে  তালে   , বিকাশ সোম  মদিরার নেশা খুঁজে  পেয়েছিলো। প্রেমিক  হলে  নন্দিনীর  চোখে  স্বপ্ন  খুঁজে পেতো। বিকাশ সোম  ব্যবসায়ী ; তার  কাছে  স্বপ্ন  থেকেও সম্ভাবনার   গুরুত্ব  আগে। স্বপ্নে   বেঁচে থাকাটাই আসল , সম্ভাবনায়  লাভের  দিকে  চোখ  থাকে। বিকাশ সোমের  রাজারহাটে  বেশ  বড় রিয়েলএস্টেটের  ব্যবসা আছে। নন্দিনীর  বাবার  উত্তর কলকাতায় রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা রয়েছে। দুজনের  একসাথে মিশে  গেলে, নতুন সম্ভাবনা! নন্দিনীর  নাচের  সাথে   ,বাবার  ব্যবসায়িক  দিকটাও  বেশ  দরকারি হয়ে  উঠেছে।
নন্দিনীর  ভালো  লেগেছিলও । প্রথম  প্রেম  যে কোন   মেয়ের কাছেই দামী। এই  প্রথম  কেউ  নিজের  হলও। বিকাশ সোম   একজন  প্রতিষ্ঠিত  ব্যবসায়ী , মোটামুটি  দেখতে  সুন্দর, অর্থবান  মানুষ  এমনিতেই  দেখতে  সুন্দর  লাগে। প্রথম যখন  দেখা  হয়েছিলো, নন্দিনীর  চোখের  দিকে  তাকিয়ে   বলল- তুমি  এতোটাই  সুন্দর?
নন্দিনীর  ফরসা  মুখে  , আপেলের দাগ! লাজুক মেয়েরা  বেশ সুন্দর  হয়ে  ওঠে। গোলাপের  রূপ  পাগল করে , কেননা গোলাপ  লাজুক। বিকাশ সোম  বলল- আমি  অনেক  মেয়ে দেখেছি, তোমার  মতন  কেউ  নেই। দুটো দিন  আমরা একে  অপরকে  সময়  দিতে পারি ?  
-দুটো দিন , কোথায়  যাবো  আমরা ?
-কলকাতায়   ঘুরবার  জায়গার  অভাব  নেই।
-নিজেদের  বুঝতে  হলে  নিরিবিলি   , নির্জনতা  চাই।   একা একা   দু’জনেই   দুজনকে  চিনবার চেষ্টা  করা  যায়।
-বাঁকুড়ায়  আমাদের  একটা রিসোর্ট আছে। সেখানেই আমরা   যেতে  পারি। আপনার  অসুবিধা  আছে?
নন্দিনী  কিছুক্ষণ চুপ  করে  থাকলো। এর আগে  বন্ধুদের  সাথে অনেক জায়গায় ঘুরেছে  ,একা একা  যাওয়া অসুবিধার নেই। এখানে   বন্ধুরাও  থাকবেনা ,  জীবনে  এই প্রথম  একা প্রেমিকের  সাথে  যাবে! বাড়িতে আপত্তি থাকতে পারে।বাঙালি  শিক্ষিত উর্চ্চ মধ্যবিত্ত ঘরে , বেশ  কিছু  অলিখিত  নিয়ম আছে। বাড়ির  লোকের  সাথে  কথা  না  বলে, এমন ভাবে বিকাশ সোমকে হ্যাঁ বলাটা ঠিক  হয়নি।
নন্দিনী বুঝতে  পেরে  বলল-আমরা দু’জনে একা একা  বিয়ের  পর  গেলে  হতনা ?
বিকাশ সোম  হেসে  বলল-আমাকে  বিশ্বাস  করতে  পাচ্ছো না ?
মাথা  নামিয়ে  , নিজের   ভিতরের অস্বস্থিটা ঢাকবার  চেষ্টা করছিলো। বলল-বাড়িতে  না  বলে  , আমি  কেমন ভাবে  কথা  দেবো। বাবা যদি  রাগ  করে।
বিকাশ সোম  হেসে  বলল- নন্দিনী  আমি  অনেক  ভেবেই  , তুমি  বলেছি। আমি   প্রথম দেখাতেই  মেয়েদের  তুমি বলিনা।  আমার   বয়েস  তোমার  থেকে  বেশি। আমি  জানি পারিবারিক  মূল্যবোধ। তোমার বাড়ির লোকের  সাথে  আমার বাড়ির  লোক  অনেক আগেই  কথা  বলে নিয়েছে।
নন্দিনী কিছুটা  ভারী  গলায়  বলল- আমাকে  একবারের  জন্যও  জানানোর  প্রয়োজন  মনে  করেনি !
বিকাশ সোম  বলল- এতে  তোমার  বাড়ির  লোকের  দোষ নেই। আমি চাইনি , আমাদের  বিয়েতে  তোমার  উপর  কোনও  রকমের  জোর   করা  হোক।
-জোর ! 
-দেখো , এমনও  হতে  পারে  তুমি  অন্য  কোনও  ছেলেকে  ভালোবাসে। বাড়ির  চাপে  আমাকে  বিয়ে  করলে। আমি তাই  নিজেই আগের দিন  তোমাকে  ফোন  করেছিলাম। অনেক  রাত অব্দি  কথা  হলও। তোমার নাচ দেখতে  আসবো। সব  কথাই  ঠিক  ছিলও।
-নন্দিনী  চোখ দিয়ে  তাকিয়ে  বলল- আমাকে  ঘুরতে  যাওয়ার  প্রস্তাব  দেবেন,তা কিন্তু  বলেননি।   
-নন্দিনী  আমাকে  বিয়ে  করতে  অসুবিধা  নেই  তো।
- যদি আপনি  আমাকে  বিয়ের  পর এমন ভাবে  ঘুরতে  নিয়ে  যাওয়ার  কথা  না  দেন,তবে  অসুবিধা  আছে।
-তার আগে  তোমাকে  এই  আপনি  বলাটা  ছাড়তে  হবে।  

বিকাশ সোম   নিজে  গাড়ি  চালাচ্ছে। পাশের   সীটে বসে নন্দিনী। গাড়ির  বাইরে ,  রাতের কলকাতা। ঘড়িতে  দশটা। এই  অভিজ্ঞতা   নন্দিনীর  জীবনে  প্রথম। সে  একা  গাড়িতে বসে ,অচেনা  মানুষের  পাশে । প্রতিটা  মেয়ের  নিজের আলাদা  পৃথিবী  থাকে, সেখানে  নিজের  ভালবাসার  মানুষের  সাথে   স্বপ্নে  ভেসে  থাকে।  নন্দিনী  তেমনই  স্বপ্নে  ভেসে  আছে। গাড়ি  চালিয়ে  নিয়ে  যাচ্ছে  বছর   তিরিশের যুবক  , সেই  স্বপ্নে  আছে। এই   পথে  আগেও  গিয়েছে। আজকের  মতন এতো ভালো লাগেনি।  নন্দিনী  পাশের  মানুষটাকে মনে  মনে   ভালোবেসে  ফেলেছে।  প্রথম  ভালোবাসা।
এরপর   তাঁদের  ভিতরে  সম্পর্ক  চলেছে   ছয়মাস। নিজেদের  বুঝবার  মতন  সময়   অনেক  কম। বিয়ের  পর  নিজেদের   একে  অন্যের  প্রতি আকর্ষণ  আরও  বেড়েছে। যতদিন  টান ,ততদিনই  জীবন আকর্ষণীয়। প্রেমের  পরিমাণ  বিয়ের একবছর অব্দি   ছিলও।তারপর  একদিন  আচমকাই   সব   কিছু  ছেড়ে , নন্দিনী  চলে  এলো ! বিকাশ সোম কে  ছেড়ে  চলে  আসবার  ঘটনা  আচমকা ছিলও না, অনেক দিন  ধরেই  তাঁদের  ভিতরের  সম্পর্ক   নষ্ট  হয়ে গিয়েছিল। যে  কোন   বিয়ের  ভিতরে  আসল  কথা  হচ্ছে  ভরসা। সেইটুকু  নষ্ট  হয়ে  গেলে, সব  কিছু   শেষ  হয়ে  যায়। বিকাশ সোমের  তরফ থেকেই  বিয়ের একবছর  পরেই  কেমন একটা  অনীহা  তৈরি হয়েছে। নন্দিনী যেনও  এখন  তাঁদের  পরিবারের  বাড়তি মানুষ। ঘরে আসবাবপত্র  অতিরিক্ত  হলে  বিক্রি  করে মালিক। মানুষ  বাড়তি হলে, তাঁকে  গুরুত্বহীন  করে  দেয়। নন্দিনী   নিজেকে  বিকাশ   সোমের  পরিবারে  নিজের  প্রতি  অবজ্ঞার  ভার  নিতে  পারছিলো  না। অনেক  রাত  অব্দি  কেঁদেছে।দু’চোখের  জল গাল  বেয়ে  নেমে এসেছে। রাতে  বারান্দায়  বসে  , মাথার  উপর  বহুদূরের  তারাদের আত্মীয়  মনে  করেছে। নিজের  যন্ত্রণার কথা   কাকেই বা  বলবে ! বাড়ির  বাবা আর  মা  ,এইসব  কিছু  ভুলে  বিকাশ সোমের  সাথে  থাকতে  বলেছে। সে  বেরিয়ে  আসবে।আগের নন্দিনী  আর  বিয়ের  পরের  নন্দিনীর   অনেক  পরিবর্তন হয়েছে। এখন  সে  বুঝতে  পেরেছে, নিজের  আলাদা  জগত  আছে, সেই  পৃথিবীর  মালিক  সে  নিজে  হবে। কলকাতার  বেসরকারি  স্কুলে   পরিবারের  নিষেধ  থাকা  সত্ত্বেও , চাকরী  নিয়েছে। নিজের  নাচকে  জীবিকা  বানিয়েছে। সে  নিজের  জন্য  আলাদা বাড়ি  ভাড়া  করে। একদিন  বিকাশ সোম  বড়ুয়ার  সাথে  তার   ডিভোর্স হয়ে  গেলো। বিয়ের  তিনবছরের মধ্যে নন্দিনী  বিবাহ বিচ্ছিন্না! অবশ্য   এরই  মধ্যে  , তার  জীবনে  এসেছে  স্মরণ  বসু।
স্কুলেই   স্মরণের  সাথে  দেখা । সেই দিনের  কথা  মনে  পড়ছিলও নন্দিনীর। মানুষ ভাবে  অতীত   তাড়া করে। নন্দিনী  অতীতেই  বেঁচে আছে। নিজের  জীবনের   অনেক  কিছু সে  আগের  জীবনে  ফেলে  এসেছে। সেখানে স্মরণ অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিলও।ছেলেটা নন্দিনীর  সমবয়সী ,প্রায় কাছাকাছি তাঁদের বয়স। নিজেদের  মধ্যে  সম্পর্ক  খুব দ্রুতই  এগিয়ে চলেছে।
স্কুলের  সরস্বতী পুজোর  বিচিত্রা অনুষ্ঠানের  আয়োজন  করা  হয়েছে।স্কুলের  ভিতরে  অনেক  বড়  মাঠ  আছে। সেখানেই অনুষ্ঠান হচ্ছিলো। নন্দিনী  সেই দিন  গোলাপি  পাড় দেওয়া  হলুদ শাড়ি , সবুজ রঙের  ব্লাউজ  পড়েছিলো। নীল  রঙের  সিল্কের  পাঞ্জাবি পড়ে  ছিলও  স্মরণ। পাতলা চেহারার , হাস্যময়  মুখ।  স্টেজে রবীন্দ্র নাথের গান  খোলা  গলায় গাইছিলও। আবারো  প্রেমে  পড়ে গেলো । নন্দিনী অনেক দিন বাদে  পুরুষের  গলার  খোঁজ  পেয়েছে। সেই যে  স্বপ্ন  বিকাশ সোমের  পাশে  বসে  দেখেছিলো ,সেই স্বপ্নে  আজ  সামনের ছেলেটি  এসেছে! মেয়েরা যেমন ভাবে  ছেলেদের  থেকে  নিজের  অনুভূতি  লুকিয়ে  রাখে, নন্দিনীও  প্রথম দেখায়   স্মরণকে   বুঝতে  দেয়নি  নিজের  অনুভূতি।
ঘড়িতে  রাত  আটটা । স্কুলের  মহিলারা খেতে বসেছে। সাদা থারমোকলের প্লেটে  কাজু কিসমিস  দেওয়া বাসমতী  চালের  খিচুরি।বেগুনি। আলুরদম। ছেলেরা খাবার  পরিবেশনের  দায়িত্ব  নিয়েছে। মেয়েরা খাচ্ছিল। সেই সময়  নন্দিনীর  চোখে  চোখ  পড়ে ছেলেটির। সবটাই  খুব আচমকা  ঘটেছিলও। যা  ঘটে  হঠাৎ  করেই  ঘটে। নন্দিনীর পাশে  বসে  খাচ্ছিলও  মাল্বিকা মিত্র। মধ্য বয়সী মাল্বিকা এখনো  বিয়ে  করেনি। এখনো  প্রেমিক  পুরুষের  সন্ধানে  আছে। কানে কানে  ফিস ফিস  করে  বলল- ছেলেটার  নাম   স্মরণ বসু। আমাদের স্কুলের বার্ষিক  খরচ এর  হিসেব দেখে। অডিট করে।
স্মরণের  দিকে  তাকিয়ে  মাল্বিকা বলল-   স্মরণ , ও  হচ্ছে নন্দিনী বসু। স্মরণে  নন্দিনী ।
বলেই  হেসে  ফেলল। এই  হাসিতে  স্মরণ  বিব্রতই  বোধ করল। খানিক  লজ্জা  পেলও। নন্দিনী  বলল- এই মাল্বিকা দি ।
মাল্বিকা হাসতে  হাসতে  বলল- নন্দিনী  তোমার  নামটাইতো  নন্দিনী  বসু। এখন  ও  যদি   স্মরণ  বসু  হয়  আমার কিছু  করবার  নেই।আমি শুধু  বলেছি - স্মরণে  যেনও  নন্দিনী থাকে।    
স্মরণ  হেসে  বলল- এমন  অবস্থায় মাল্বিকা দি, পরিচয়  করালেন , আমি  যে  ওনাকে  একহাতা বেশি বোঁদে  দেবো  সেই  উপায় নেই। যদি  একহাতা  বেশি  দিই ,  বলবেন আমি  লোক দেখে  খাতির  করি।
 হাসির ফোয়ারা  ছুটছে। ছেলেটার  রসবোধ  নন্দিনীকেও  হাসিয়েছে।
সেই রাতে  ফিরতে  দেরী  হয়েছিলো। শনিবার , পরের  দিন   ছুটি । নন্দিনীর  ফিরবার  তাড়া  ছিলও না।
স্মরণ  নিজের  পরিচয়  দিলও। খুব  অল্প সময়ের  মধ্যেই   দু’জনের  ভিতরে  বেশ  সুন্দর সম্পর্ক  তৈরি  হয়ে  গেলো। সম্পর্ক  সবসময় দু’জনের  ভরসার  উপরেই  নির্ভর  করে। সেই রাতে  দু’জনেই রাতের আকাশের  নিচে  পাশাপাশি  হাঁটছিলও। স্কুল  থেকে  মেইন রাস্তায় আসতে ,মিনিট  পাঁচেকের  রাস্তা। পরিচিত  জায়গা , মুহূর্তে অপরিচিত  হয়ে  গিয়েছে! এই যে  থেমে  থাকা  রাত, ঝোপ , ঝোপের   শরীরের  মেখে  থাকা চাঁদের  আলো-  সব  কিছুই  নতুন  লাগছে।
স্মরণের  ফোন  সেই  রাতে  অনেকক্ষণ  জাগিয়ে  রেখেছিলও।
তাঁদের ভিতরের   প্রেম  জমতে  জমতে  প্রায়   চারমাস। একদিন স্মরণ  আচমকাই  বলে  বসলও- নন্দিনী  আমরা বিয়ে  করতে  পারিনা ?
দিনের বেলা। রবিবার। বাগবাজারের  ঘাত।থেমে থাকা  গঙ্গা।প্রায় ফাঁকা। স্মরণের  কথা   শুনে  নন্দিনী অবাকই  হয়ে  গিয়েছে!
-আমাদের  দু’জনের  প্রতি  ভালোবাসা নিয়ে  আমাদের  মনে  সন্দেহ  নেই। কিন্তু  আমরা একে  অপরের  সম্বন্ধে  অনেক  কিছুই  জানিনা। আমার আগে  একবার  বিয়ে  হয়েছিলো।
স্মরণ  বলল- আমার হয়নি। আমি  তোমাকে  বিয়ে  করতে  চাই।
-আমার  জীবনে  বেশ  কিছু  অন্ধকার   আছে।  তোমাকে বলতে  চাইছি। আমার   সব   শুনে , তারপর  না  হয়  ঠিক  করবে।
-দেখো , সব  মানুষের  জীবনেই অন্ধকার  থাকে। তা নিয়ে  জীবন চলেনা। আমরা অন্ধকারে  থাকতে পছন্দ  করিনা। তাহলে  অন্ধকারকে  নিয়ে  এতো মাথা ব্যাথা কেন? তোমার  অতীত  তোমার  থাকুক। বিয়েটা  কবে  করবে?
নন্দিনী  বলল- বিয়ে  কেন  করবে তুমি?
স্মরণ  বলল- সংসার , সন্তান , পরিবার  পাওয়ার  জন্য।
নন্দিনী  বলল- আমার  জীবনের  রহস্য  তোমাকে  জানাবো। একদিন  সময়  নিয়ে  শুনতে  হবে।

নন্দিনী  টের  পেল , এখন  ঘড়িতে  সন্ধ্যা সাতটা। যার  জন্য  অপেক্ষা  করছে  এখনই  চলে আসবে। চারপাশে  গড়িয়াহাঁটের ফুটপাথ   সেজে  উঠেছে। হাতের  তালু ফর্সা  গালে  ছুঁয়ে  টের  পেলও, গাল ভিজে  গিয়েছে! চোখের  জল  মুছে  ফেলতে  হবে। স্মরণের  মাঝপথে  ছেড়ে  চলে  যাওয়ার  জন্য   নন্দিনী  দায়ী  নয়। সে  নিজের  জীবনের সত্যি  কথা  বলেছে। স্মরণ নিজের  কথা  রাখতে  পারেনি। তাও  স্মরণ  যেই দিন  জানিয়েছিলও – তাঁদের   দু’জনের  বিয়েতে  বাড়ির  লোকের  মত  নেই। সে  তাই সময় চাইছে। নন্দিনী  নিজেই   স্মরণকে  মুক্তি দিয়েছিলো। তাঁদের  সম্পর্ক  এখানেই থেমে  গেলো।
সময়  এগিয়ে চলেছে। অতীতে  মানুষ  থেমে  থাকে  না। যে  থাকে  সে  হারিয়ে  যায়। নন্দিনী  জীবনে  যা  চেয়েছিলও  , পেয়েছে  কিনা নিজেও জানেনা! চাওয়া আর  পাওয়ার  হিসেব  খুব  শক্ত। স্মরণের  সাথে  নিজের  সম্পর্ক  ভেঙে  যাবে, ভাবতেও পারেনি। সারা রাত নিজেকে  প্রশ্ন  করে গিয়েছে , ভালোবাসার  থেকেও  বড়  কিছু  আছে? আছে  হয়তো। নন্দিনী ভালোবেসেছিলও।  স্মরণকে নিজের  সবটুকু  দিয়েছে, বিকাশ সোমের  কাছে, সে  যতটা  অধরা  রয়েছে; সবটুকুই  ছুঁয়েছে ।
চোখ বন্ধ  করে  , হাতের  তালু দিয়ে  জল মুছল। চোখ  খুলতেই  দেখল  মাঝ বয়সী  , ফর্সা , নাতিদীর্ঘ  উর্চ্চতার  পুরুষ। নন্দিনীর দিকে  তাকিয়ে  হাসছে। উদত্ত সেন। ট্যুর  এন্ড ট্রাভেলের  ব্যবসা।  একবছর  তারা  একসাথে  আছে। লিভ ইন  সম্পর্কে  রয়েছে।স্মরণের  সাথে  সম্পর্ক   চুকে  যায়, উদত্তের  সাথে  পরিচয়  হওয়ার এক বছর  আগে। উদত্তের সাথে বন্ধু  হিসেবেই প্রথম একবছর সম্পর্ক  এগিয়েছে। একদিন   গড়িয়াহাঁটার  শীততাপ  নিয়ন্ত্রিত  ক্যাফেতে   দু’জনে  মুখোমুখি  বসে।উদত্তই প্রথম  বলে ,তাঁদের  উচিত এখন   এই সম্পর্কের একটা পরিচয় দেওয়া।যেই  নন্দিনী  নিজের বাড়ির  বাইরে একসময়   পা রাখতে  ভয়  পেতো। দুটো  সম্পর্কের অগ্নি পরীক্ষা দিয়ে , সে  আজ  এই  সময়ে  আত্মবিশ্বাসী।
উদত্ত আগের  পুরুষদের  থেকে  আলাদা। নন্দিনীর  জীবনের  রহস্য  আজ তার সামনে  বলবে। নন্দিনী  জানে, উদত্ত সেই  পুরুষ  যে , নন্দিনীকে  ফেলে  পালাবেনা। ওরা  ঠিক  করেছে  সামনের মাসে   বিয়েটা কমপ্লিট করবে। হানিমুনে  উত্তরাখণ্ড  যাবে। সেই নিয়েই আজ  আলোচনা  হবে।  গড়িয়াহাঁটা  থেকে  রাজডাঙ্গার  অটো  ধরে যোগেন্দ্র গার্ডেন। উদত্ত বলল  
-চলো ।
নন্দিনী  বলল- এতো  দেরী?
উদত্ত বলল- টিকিট  বুকিং করতে  সময়  গেলো। শুধু আমরা  নই, শর্মারাও  যাবে। চলো  আগে  ফ্ল্যাটে  যাওয়া  যাক।
ওরা অটো  ধরল ।

এখন  রাত এগারোটা। ফ্ল্যাটের  বারান্দায়  দাঁড়ালে , সামনে  যে  ছোট্ট রাস্তা  আছে, সেখানে  অটো  চলে। বিছানায়   শুয়ে  আছে উদত্ত। শরীরে  জামা  কাপড় পড়া  নেই। নন্দিনী  শুধু  পাতলা  নাইটি পড়েছে। চুল  খোলা। আকাশের  চাঁদের  আলো   , নন্দিনীর  গভীর  স্তনের  খাঁজে  আটকে  আছে। সে  খাদ  গভীর।কিছুক্ষণ  আগে  উদত্ত  ওই পথে  হারিয়ে গিয়েছিলো। নারীদের  বুক  আকাশের  মতন  হয়। সীমা হীন  অসীম অনন্ত। এতো  উদারতা  নারীর  কাছেই  থাকে।
সিগারেটের  ধোঁয়া  ছাড়তে  ছাড়তে  উদত্ত  বলল-এতো  রাতে কী  শুরু  করলে ! কাল সকালে  আমাকে  যেতে  হবে।
নন্দিনী বলল-  উদত্ত , মানুষের  জীবনে  অনেক  অন্ধকার  থাকে, যা দিনের  আলোয়  সে  বলতে  পারেনা।
-তুমি  আবার এই সব   শুরু  করলে! এগুলো  তোমার  খেয়াল।
-আমি  আমার  অন্ধকারের   কথা  তোমাকে  বলছি।
-নন্দিনী  , এসো  শুয়ে   পড়ি। আলো  অন্ধকার  কাল  খেলা  যাবে।
-কাল  আমরা এমন  রাত নাও  পেতে  পারি।
-দেখো  কবিতা  ভালো  লাগেনা আমার  পড়তে। আমি  খুব  সোজা ভাবেই  বলছি, যদি  তোমার  কিছু  বলবার  থাকে  বলও। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
- উদত্ত, এখন রাত অনেক  হয়েছে। সবাই  ঘুমিয়ে  পড়েছে। আমার এই  রহস্য   না  শোনা অব্দি  তুমি  ঘুমিও না। এইসময়  চারিদিকে শব্দরা থেমে যায়। আমরা দু’জনেই  দুজনকে  বুঝতে পারবো । শুনতে পারবো।
উদত্ত বুঝতে  পাচ্ছে , নন্দিনী  এমন  কিছু এখন  জানাবে, এর আগে  যা সে  শোনেনি। ভারী গলায় বলল- বলও।
নন্দিনী  বলল- উদত্ত, আমার আগের  দুটো  সম্পর্ক ভেঙেছে , তার  জন্য  ওদের  কাছে  আমার  অক্ষমতা  দায়ী।
উদত্ত  বলল- অক্ষমতা!  একটু  খোলসা করে  বলও। নন্দিনী  আজ তোমার  কী হয়েছে! অটোতেও চুপ ছিলে। বিছানায় অন্যান্য দিনের  মতন   তোমাকে  পেলাম না! মনে  হচ্ছিলো  সবই  অভ্যাস। আমি  যেনও  নিজের  তাগিদটাই  তোমার  মধ্যে  পাচ্ছিলাম। নিজেকে  খুব একা  মনে  হলও!
একা , আমরা সবাই একা উদত্ত। আজ  তোমার  কাছে  আমার একাকীত্বের কথা  বলবো।আমি জানি আমার আরও  আগে  বলা  উচিত ছিলও। বিশ্বাস  করও তোমার  মধ্যে  যে   আগুন  দেখেছি, আমি জানি তোমার কাছে  আমিই  গুরুত্বপূর্ণ ।
উদত্ত  আচমকাই  খুব  জোরে হেসে  উঠল। প্রায়শই  সিনেমার  কোনও  নাটকীয় মুহূর্তে অভিনেতা এমন ভাবে হেসে  অথে।উদত্ত  বলল- আমার জীবনে  তোমার  উপস্থিতির   গুরুত্ব  নিয়ে  কোন  সন্দেহ  আছে?আমরা  দুজনেই  প্রাপ্তবয়স্ক। তাই না?
উদত্ত আমার  কথা   শুনবার  পরে  তুমি এমনই  বলবে  আমি জানি। তাও আমাকে  বলতে দাও।
আচ্ছা  বলও।
উদত্ত আমরা  বিয়ে  করবো। তুমি নিশ্চই কয়েক বছর  পর   আমাদের সন্তান চাইবে?
উদত্ত  বলল- হ্যাঁ। আমি না  চাইলেও , আমার  পরিবার তো চাইবেই। কেন  তুমি চাওনা?
নন্দিনী  বারান্দা  থেকে  বিছানার দিকে এগিয়ে  আসছে। মনে  হচ্ছে  এক মায়াময়  চাঁদের  আলো  মাখা  প্রায়  নগ্ন  নারী  এগিয়ে  আসছে। রাতে  মেয়েদের  নগ্ন দেহ, দেবী  মূর্তির মতনই  পবিত্র  হয়ে  ওঠে।উদত্তের বুকে  কামনা আর শ্রদ্ধা , একসাথে  জড়ো হয়ে  ঝড় তোলে।  নারীরা  আকাশের  মতন স্নেহময় । আবার  রহস্যময়। পৃথিবীতে  নারী  দেহ, পুরানো  ভাস্কর্যের  মতনই দামী।উদত্ত  দেশের  বিভিন্ন  প্রান্তে  ঘুরেছে। প্রাচীন ইমারত , স্তম্ভ ,মূর্তির  দিকে  চেয়ে ভেবেছে ,মানুষ  অনেক  যত্ন  নিয়ে  সভ্যতা  গড়ে। মানুষ  হারিয়ে  যায়। স্মৃতি  রয়ে  গিয়েছে। প্রজন্মের  পর  প্রজন্ম  বয়ে চলে স্মৃতি।
নন্দিনীর বুকের দিকে তাকিয়ে উদত্ত বলল -তুমি এমন ভাবে  কথা  বলছও কেন?
বুকের  খাঁজের দুদিকে  নিটোল  স্তন  ঝুলছে।খুব পাতলা  নাইটি। বুকে  চুমু  খাওয়ার  সময়, দুকাঁধে  হাত  রেখে  নাইটির হাতা সরিয়ে  দিলেই  , নাইটি  বুক বেয়ে  নাভি অব্দি  খুলে নেমে আসে।কিছুক্ষণ  আগেই  এখানেই  ,এই খাটের উপরই খোলা নাইটি ছিলও। নন্দিনী পড়ে  নিয়েছে। বারান্দায় যাওয়ার আগে পড়ে নিয়েছে।
নন্দিনী  বলল- উদত্ত আমার আগের সম্পর্ক  গুলো  ভেঙে গিয়েছে। এর  পিছনে কারণ আছে। তুমি  কখনও  জানতে চাওনি কেন?
উদত্ত  বিছানার পাশে ,টেবিলের উপর  রাখা মালবোরো  এডভ্যান্সের  প্যাকেট থেকে একটা  সিগারেট নিয়ে মুখে ধরিয়ে ,ধোঁয়া ছেড়ে দিলও। বলল- তোমার ব্যাক্তিগত  যন্ত্রণার  জায়গায় আমি হাত রাখতে  চাইনি। আমরা দুজনেই   যথেষ্ট পরিণত। এখানে অন্তত নিজেদের  সম্পর্কের প্রতি এতটুকু সম্মাণ  থাকুক।
নন্দিনী  এসে  বিছানার  উপর  বসল। যেই দিকে  উদত্ত  বসে  আছে, উল্টো দিকে  মুখোমুখি বসেছে নন্দিনী। ঘরে  আলো নেই। বারান্দা  থেকে  চাঁদের  আলো  ঘরের  মেঝেতে  এসে  ছড়িয়ে  আছে। মনে  হচ্ছে,কেউ  রুপো গোলা জল ছড়িয়েছে! অন্ধকারে  পুরুষ আর  নারী মুখোমুখী বসেছে।
নন্দিনী  বলল-উদত্ত, আমি   সারাজীবনে মা  হতে  পারবো না।
-মানে?
উদত্ত, বিয়ের পর  আমার একটা অপারেশন  হয়েছিলো। তাতে জরায়ু   বাদ যায়। এরপর আমি ডিপ্রেশনে  চলে  যাই।একটা মেয়ের মাসিক হবেনা।সে  নিজের  জীবনে  , ঋতুচক্রের আনন্দ নেবে না ! নারীর  এ এক  যন্ত্রণা। আমাকে সেই  সময়  অনেক  কথা শুনতে  হয়েছে। যে  মাসিকের  জন্য  নারী  অপবিত্র। আবার সেই  মাসিক  হবেনা  বলে, পরিবারে  তার  প্রয়োজন  নেই । এক  সময়  মনে  হলও, নারী  জীবন  মানে  শুধুই সন্তান  উৎপাদন ! আমি শিশু  খুব ভালবাসি।এই যে মা  হতে  পারবো  না, তার যন্ত্রণা আমকে সবসময় যন্ত্রণা দেয়।আমি নিজে নিজেকে বলেছি ,আমার অক্ষমতা কখনই  আমার স্বাধীনতা  কেড়ে নিতে পারেনা! সেই সব দিন গুলোতে  চারপাশে , আমার  পরিচিত  মুখ  গুলো পাল্টে  যাচ্ছিল।তাদের কাছে পরিবারের  বাড়তি  ফার্নিচার।
এখনকার দিনে এইসব  কেউ ভাবেনা।নিজের  বাচ্চা জন্ম দেওয়ার  সমস্যা  অনেকেরই থাকে।এইসব  নিয়ে  ভেবো না।
উদত্ত আমার দ্বিতীয়   সম্পর্কটাও  এই কারণেই  ভেঙে  যায়।
এইবার  ভাঙবে না।  আমি আছি।
নন্দিনীর  চোখের  পাতা দুটো  ভরে এসেছে।উদত্ত মাথায় হাত বুলিয়ে  বলল-নন্দিনী ,আমরা  অন্য ভাবে সন্তান  নিতে পারি?
নন্দিনী  তাকালও, চোখে  যন্ত্রণা  – উদত্ত, আমি    সন্তান চাইছি না।আমার জীবনের উদ্দেশ্য   শুধু সন্তানের  জন্ম  হতে পারেনা। যদি  অনাথ  শিশুকে  দত্তক  নিই , সেটা  আলাদা…

উদত্ত দেখল, কথা  গুলো  বলেই  , নন্দিনী  ঘর   থেকে  বেরিয়ে   যাচ্ছে। বারান্দায় এসে উদত্ত দেখলও , সামনে রাস্তার  উপর  দাঁড়িয়ে। কলকাতা  শহরে  অনেক  রাতেও এখন  , বাইক বুকিং  করা  যায়। নন্দিনী  বাইক ভাড়া  করেছে। উদত্ত জানে, নন্দিনী  ফিরবেনা।এই  গল্প এখানেই  থেমে  নেই।  
উদত্ত বারান্দায় এসে  দাঁড়িয়েছে। বারান্দার রেলিঙয়ে হাত রেখে দেখল, নন্দিনী আলো থেকে, রাস্তার ওধারে ,অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে।
 নন্দিনীকে  অনেকবার ডাকল , আওয়াজ নিজের  কানে এসেই ঝাপটা মারছে। নন্দিনী ফিরল না!  



chakrabortypinaki50@gmail.com
কলকাতা 



      

No comments:

Post a Comment