1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Friday, May 1, 2020

বিষবৃক্ষ

(ধারাবাহিক রহস্য কাহিনী )  


(দ্বিতীয় সংখ্যা )
                                                         
                                                                   .....শঙ্খ চৌধুরী ও চিরঞ্জিত ঘোষ 
             
                           ‘ রোনেশন   ব্রীজ পেরিয়ে আমরা চলেছি তরাই জঙ্গলের উদ্দেশে  । আমরা বলতে আমি হিমাংশু , অর্ঘ আর ইন্সপেক্টর রুদ্র । পুলিশের  এই জিপসী গাড়িটা রুদ্রই চালাচ্ছে । এই অঞ্চলের আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথঘাট  তার নখদর্পনে । এক দিকে পাহাড়ের গা ঘেঁসে রাস্তা আর অন্য দিকে গভীর খাদ যেখানে বয়ে চলেছে ভয়ংকর  তৃস্রোতা নদী যাকে তিস্তা নদী নামে আমরা সবাই জানি । রাস্তা সংকীর্ণ,  উল্টো দিক থেকে গাড়ি এলে খুব পটু হাতে রুদ্র পাস  কাটাচ্ছে। গিরিপথ পেরিয়ে আমরা পৌছালাম অরণ্যে ঘেরা পাহাড়ী উপত্যকায়  । গাড়ি যত এগিয়ে চলেছে ততই জঙ্গল যেন আর ঘনীভূত হয়ে চলেছে । শাল,  সেগুন আর শিমুলএর বিশাল গাছ তাদের বহু যুগের শাখা প্রশাখা মেলে ধরে যেন সূর্যকে ঢেকে দিয়েছে। তার ওপর জমে থাকা শীতের কুয়াশার হালকা প্রচ্ছাদন চারিদিকে  যেন এক মায়াময় আলো-আঁধারির  খেলা তৈরি করে রেখেছে।  অগুন্তি  লতানো আগাছা, ফার্ণ আর নিরন্তর পড়তে থাকা পাতা  যেন বন্য ভূমিপৃষ্ঠে কোনো ফাঁকা জমি অবশিষ্ট ছাড়েনি । জঙ্গলের এই নিরিবিলি ভঙ্গ করে একটানা আমাদের জিপসীটা এগিয়ে চলেছে । মাঝেমধেই চোখে পড়ছে ময়ূর, হর্ণবিল, টিয়াপাখির ঝাঁক  আর ম্যাকাও   বাঁদরের পাল ।

              আমি আর অর্ঘ গাড়ির জানলা দিয়ে অরণ্যের এই রুক্ষ অথচ রোমহর্ষক শোভা দেখছি  আর রুদ্রর সাথে টুকিটাকি কথা বলে চলেছি। রুদ্রর সেদিন চলে যাবার পর আমাদের কয়েকটা কাজ সেরে ফেলতে হয়েছে যেমন হাসপাতাল এর পেন্ডিং কেস গুলোকে সেরে ফেলা , আমাদের দিন কতকএর  ছুটির আর্জি অনুমোদন করানো, দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে ঘোরাফেরার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী গুছিয়ে নেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু সবচেয়ে জরুরী কাজ ছিল কলকাতার ‘সরকার’  পরিবারের বিষয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা । এই বিষয়ে ইন্টারনেট আমাদের সহায় ছিল। সেখান থেকে জানা  গেলো যে ‘সরকার এণ্ড সন্স’  এই দেশের একটি নামজাদা হীরক ব্যবসায়ী সংস্থা । এরা প্রধানত  হীরে কাটিং আর প্রক্রিয়াকরণ করে বড়বড় অলংকার প্রস্তুতকারকদের রপ্তানি করে। এদের বেশ কিছু কারখানা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আছে । তাছাড়াও রয়েছে সংস্থার জনক শ্রী শ্যামা প্রসাদ সরকার এর নামে স্কুল আর কলেজ। আর আছে ভারতের ডায়মন্ড এর শহর গুজরাত এ অবস্থিত একটি নামকরা হীরে খনন , শোধন, আর প্রক্রিয়াকরণ বিষয়ক প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী  নেতা, মন্ত্রী, আমলা আর তারকারা এদের সুপরিচিত । তিনপুরুষের ব্যবসার বর্তমান কর্ণধার মিস্টার স্বপন সরকার । বছর দুয়েক আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ষাঠ উর্দ্ধ  স্বপনবাবু পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন ।পরিবারের বড় ছেলে শান্তনুর বিষয়ে খুব বেশি কিছু জানা গেল না। ওর ‘ সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট   থেকে জানলাম যে লোকটির বয়স বছর পয়তাল্লিশ  ।  বোঝা গেলো  যে লোকটি বেশ বন্ধুবত্সল  আর ফূর্তিবাজ ।  আমরা ক্রমশই বুঝতে পারছিলাম যে কলকাতায় গিয়ে সরজমিনে তদন্ত না করলে আমরা যে তিমিরে আছি, সেই তিমিরেই থেকে যাব ।

                    আমরা আমাদের কোয়ার্টার থেকে আজ খুব ভোরে বেরিয়ে পড়েছিলাম । রাস্তায় একটা দোকানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা চা আর ব্রেড-অমলেট সহযোগে প্রাতরাশ সারলাম। প্রথমে আমরা গেলাম লোকাল থানাতে যেখানে কেসটা রেজিস্টার করা । ওখানে আমি আর অর্ঘ পালা করে পুলিশ এর খাতায়  লেখা ‘পঞ্চনামা’ যাকে ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট বলে, সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম । তার পর পুলিশের  তোলা লাশ এর ছবি গুলো ভাল ভাবে দেখলাম। রুদ্র বলেছিল বটে যে লাশের গায়ে জন্তুদের আঁচড় আর কামড়ের দাগ ছিল। কিন্তু ছবি দেখে বুঝলাম যে সেটা অনেকটাই।  এই যেমন  ঊরুর বেশ খানিকটা অংশ আর একটা চোখ নেই। আর পায়ের মাংস তো  এমন ভাবে খুবলেছে যে নিচের ফিমার আর টিবিয়া হাড় দেখা যাচ্ছে । এক হাতের  বাইসেপস্  প্রায় নেই বললেই চলে । পরনের পরিধান  সবই ছিন্নভিন্ন।  কিন্তু কোথাও রক্তক্ষরণ নেই .... তার মানে  এটা স্পষ্ট, যাও হয়েছে তা মৃত্যুর পরেই হয়েছে। আমি আমার মোবাইলে  ফটোগুলোর কটা….  ছবি তুলে নিলাম।  
রুদ্র এর পর আমাদের নিয়ে গেল ফরেস্ট রেঞ্জার এর অফিসে। অফিস বলতে সিমেন্ট এর পিলার  দিয়ে  মাটি থেকে কিছুটা উচ্চতায় তৈরি কাঠের মজবুত একটা বাড়ি।  রেঞ্জার সাহেব ছুটিতে । কিন্তু রুদ্র আগে থেকে আমাদের আসার খবর পাঠিয়ে রেখেছিল । তাই আমাদের জঙ্গলের ভেতর নিয়ে যাবার জন্য গাইড হিসেবে একজন ফরেস্ট এর কর্মী  আগে থেকেই ঠিক করা ছিল ।

               আমাদের গাইড চেতন তামাঙ্গ প্রায় ১২ বছর এই জঙ্গলের  দেখভাল এর দায়িত্বে আছে । ওর বাপ –ঠাকুরদারা অনেকদিন আগেই নেপাল থেকে ভারতে চলে এসেছিল । এখন সে রিশপ এর বাসিন্দা। বেটে খাটো কিন্তু পেটানো তাগড়াই চেহারা আর হাসিখুশি স্বভাব।  রুদ্র জানালো যে আগের একটা চোরা-শিকারীদের কেসে  তামাঙ্গ তাকে খুব সহয়তা করেছিল । জঙ্গলের আনাচ-কানাচ তার খুব ভালো ভাবে  জানা ।  জঙ্গলের কোন পশু-পাখির কি ডাক আর তার কি মানে, মাটিতে কোন পশুর পায়ের ছাপ কেমন, আর টুকিটাকি ভেষজ ওষুধের বিষয়ে জ্ঞান তাকে জঙ্গলে চলাফেরা করার উপযুক্ত সহচর বানিয়ে দিয়েছে । তার ওপর আছে প্রচন্ড সাহস আর বন্দুকের অসাধারন টিপ । তামাঙ্গ  দেখলাম ওর সাথে  একটা উইনচেস্টার রাইফেল নিয়ে এসেছে । তবে কি ও কোনো বিপদের আশঙ্কা করছে? আপাতত   আমাদের জিপসীর সারথী  সেই । গাড়ি এখন পিচ রাস্তা  ছেড়ে মোরাম ফেলা এবড়ো খেবড়ো রাস্তা  ধরেছে । আমাদের সামনে এখন শুধুই অরন্য ।
কেসটার বিষয়ে তোমাদের প্রাথমিক ধারণা কি?’. রুদ্র জিজ্ঞাসা  করল ।
 ‘আমার মতে মূল পান্ডা এক বা একাধিক হলেও তাদের অনুগামীরা অনেক’.. আমি বললাম  । 
‘না না হিমাংশু আমার মনে হয় তুমি ভুল করছো’ .. অর্ঘ বলে চলল .. ‘অনুগামী হয়ত অনেক হবে নইলে কারো একার  পক্ষে এতো  বড় একটা কার্য সিদ্ধি করা সম্ভব নয়।  কিন্তু মাথা একজনেরই । ভাবতো ..  এমন নিপুন ভাবে নরহত্যা করা যে পোস্টমর্টেম এর সময়ে একজন অভিজ্ঞ সিভিল সার্জনকে ও ধোঁকা  দিল আর ফরেনসিক ল্যাব টেস্টও  পার  করে গেল, এমন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি কি সবার ঘটে ধরে ?রুদ্র সম্মতি সূচক একবার ঘাড় নেড়ে যে প্রশ্নটা করল সেটা আমাদেরও  প্রথম থেকেই মনে উঁকি মারছিল যে এতই যদি সুপরিকল্পিত খুন হয় তো বাবা লাশটাকে এমন ভাবে কেন ফেলল যে কদিনের মধেই তা কেউ না কেউ খুঁজে  পাবে?.. কারণ লাশ খুঁজে  না পাওয়া গেলে তো খুনীর মস্ত সুবিধে !উত্তরটা দিল রুদ্রর পাশে বসে থাকা তামাঙ্গ । ও এতক্ষণ গাড়ি চালাছিল  আর আমাদের আলোচনা মন দিয়ে শুনছিলো । হটাৎ ও বলল ‘ সাহেব জানেন কি সামসিং এর জঙ্গলের শেষে একটা খুব গভীর খাদ আছে । খাদটা আরও  ভয়ানক কারণ ওখানে জঙ্গল খুব গভীর আর একটি  নদিশাখা ওখানে তুমুল বেগে জলপ্রপাত হয়ে বয়ে চলেছে  । হিংস্র জন্তু জানোয়ার আর নর্থ- বেঙ্গল এর কুখ্যাত  কিং কোবরা জায়গাটাকে আরো দুর্ভেদ্য করে রেখেছে । একবার যদি কোনো লাশ ওখানে ফেলে দেয়া যায় তো কারো সাধ্যি নেই সেটা জানতে পারবে। যাবেটাই  বা কে ওখানে ?’ ‘কিন্তু তারা  সেটা করল নাই বা কেন?’.. রুদ্রর আবার প্রশ্ন । আমরা এটুকু বুঝছিলাম যে রুদ্র তার কেস টাকে বেশ আঁটোসাটো   করে গোছাতে চাইছে যাতে রুগ্ন ‘সারকামটেন্সিয়াল এভিডেন্স বলে কোর্ট এ বাদী  পক্ষের উকিল তার খিল্লি না করে ।  ‘হয়েতো কোনো বড় বাঁধা  পড়েছিল’.. রুদ্র র প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অর্ঘ নিজেই নিজেকে যেন প্রশ্ন করল .. ‘কিন্তু বাঁধাটা কি ছিল যে এত প্রফেশনাল ক্রিমিনাল দেরও কাজ অসমাপ্ত রাখতে বাধ্য করল?’ ‘হাতি সাহেব হাতি’ তামাঙ্গ আবার গাড়ি চালাতে চালাতে বলতে লাগলো .. ‘পাগলা দাঁতাল হাতিদের দল যখন অন্ধকার রাতে এই গভীর জঙ্গলের  ভিতর থেকে তেড়ে আসে আর তাদের সে ভয়ানক চিৎকার .. সাহেব যেকোনো মানুষ যতই সাহসী হোক না কেনো তার প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবে  । মরার ভয় তো সবারই আছে’ । 
                   
                       এখন আমরা জঙ্গলের অনেকটা ভেতরে চলে এসেছি। আর একটু এগোতেই বুঝলাম যে রাস্তাটা হটাৎ খাড়াই  হয়ে গেছে। এখানে গাড়ি চালানো খুব কষ্টকর। আর কিছুটা যাবার পর তামাঙ্গ বলল যে এর বেশি গাড়ি যাবেনা  । অগত্যা গাড়ি থেকে নেবে ট্রেকিং শুরু করতে হল। ভাগ্য ভাল যে আমরা হান্টার শুজ পরে রয়েছি । নইলে এরম রুক্ষ জায়গায়  হাঁটা  প্রায় অসম্ভব হতো । সবার সামনে তামাঙ্গ আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। বেশ খানিকটা চড়াই ওঠার পর রুদ্র আমাদের কে একটা জায়গা দেখালো  যেখানে লাশটা ফেলা হয়েছিল । কিন্তু বহু খুঁজেও আমরা  ওখানে নতুন কোনো ক্লূ পেলাম না । তার ওপর  পুলিশ আগেই জায়গাটাকে এত আনকোরাদের মতো খানাতল্লাশি করেছে যে কিছু প্রমাণ থাকলেও তা আর অবশিষ্ট নেই। এর পর তামাঙ্গ আমাদের আরো প্রায় আধ কিলোমিটার মত এগিয়ে নিয়ে গেল । জায়গাটা এত গভীর যে পথ প্রায় চলাই যাচ্ছে না । যত এগোচ্ছি ততোই একটা ঝর্ণার আওয়াজ ক্রমশ তীব্র হয়ে উটছে । সব  শেষে আমরা পৌছোলাম একটি খাদের কিনারায় । গভীর অরণ্য আর পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া বড়ো বড়ো পাথর সম্পূর্ণ ভাবে এই খাদের তলদেশকে  ঢেকে রেখেছে । একপাশ দিয়ে একটা ঝর্ণা নিচে পড়ছে আর খাদের অনন্ত গভীরতায়  কোথায়  যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে । পুরো দৃশ্যেটা খুব সুন্দর। হটাৎ আমার ভাবনায়  ছেদ পড়ল অর্ঘর  কথাতে ..‘ তামাঙ্গ এর অনুমান মনে হয় ঠিক বুঝলে । লাশ এখানেই ফেলার উদ্দেশ্য  ছিল বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস । ভাবতো  কত সুন্দর প্রমাণ লোপাটের জায়গা এটা’। বুঝলাম যে মরা পচা লাশেদের সাথে থাকতে থাকতে অর্ঘর সৌন্দর্য প্রীতির মতো সুক্ষ অনুভূতিগুলো লোপ পেয়েছে । আমরা আবার সাবধানে নিচে নেবে গাড়িতে বসলাম আর ফিরতি রাস্তা ধরলাম। কিন্তু কিছুটা এগোতেই তামাঙ্গ এর কোমোরে বাধা ওয়াকি-টকিটা আওয়াজ করে উঠল । ও পাস থেকে ফরেষ্টেরই কোনো লোক তামাঙ্গ কে একটি জরুরী খবর জানালো যে জঙ্গলে আমাদের  বর্তমার অবস্থান থেকে দু-তিন  কিলোমিটার দূরে  একটা মৃত লেপার্ড পাওয়া গেছে । সে যাতে একবার জায়গা টা রেকি করে আসে। অগত্যা তাকে গাড়ির অভিমুখ ঘোরাতে  হল । হটাৎ রুদ্র তামাঙ্গ কে জিজ্ঞেস করল ‘ এই নিয়ে কটা মরলো?’ আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘কি ব্যাপার? জঙ্গলে পশুদের কি হটাৎ কোনো মহামারী হয়েছে যাতে আকস্মিক  অনেক মৃত্যু ঘটছে?’ তামাঙ্গ গাড়ি চালাতে চালাতে গম্ভীর ভাবে বলতে লাগলো ‘ সাহেব আমি এই জঙ্গল কে আমার প্রাণের চাইতেও  বেশি ভালোবাসি । যখনই জঙ্গলে কোনো জন্তুর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়, সে পোচার এর   এর গুলিতে হোক বা জঙ্গলে আগুন লাগার ফলে, আমার মনটা ভেঙে যায় বাবু । এইতো  কদিন আগে অনথ্রাক্স এ কটা গন্ডার মরলো । আবার এই কিছু দিন হলো না জানি কি রোগ শুরু হয়েছে , প্রতিদিনই কিছু না কিছু মরছে । ফরেস্ট এর রেঞ্জার সাহেব আর ভেটেরিনারী ডাক্তার বাবুরা কিছুই বুঝতে পারছেন না । নমুনা সংগ্রহ করে কলকাতায় পাঠানো হয়েছে, কিন্তু এখনও কোনো সঠিক কিনারা করা যায়নি । কথা হতে হতে আমরা এমন একটা জায়গায়  এসে পৌছালাম যেখানে আগে থাকতেই দুটো ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এর জীপ  দাঁড়িয়ে ছিলো । তামাঙ্গ কে দেখে দুজন লোক এগিয়ে এলো । আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে জঙ্গলের আরো কিছুটা ভেতরে এগিয়ে গেলাম । একটা পচা দুর্গন্ধ ক্রমশ প্রবল হয়ে চলেছে ।  অকুস্থলে  পৌঁছে যা দেখলাম তাতে তামাঙ্গ কেন আমাদের সবারই মন টা ভারী হয়ে গেলো । একটা বেশ ঘন ঝোপের আড়ালে একটি মাদা লেপার্ড এর শব আর তার পাশেই একটা ফুট- খানেক গভীর গর্তে কয়েকটা নিষ্প্রাণ লেপার্ড শাবক পড়ে আছে । পাশে দাঁড়ানো  তামাঙ্গ বলে উঠল ‘ মা টা আগেই মরেছে আর  বাচ্চাগুলো মায়ের দুধ না পেয়ে  খিদেতে মরেছে’। আমরা এই সব কথা বলছি আর এই ফাঁকে কখন জানি অর্ঘ মরা লেপার্ডটার কাছে চলে গেছে আর হাঁটু গেড়ে তার ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে  কি যেনো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ।  আমিও তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম ।একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়লো । লেপার্ডটার সারা শরীরে বিভিন্ন জায়গায় যেন খুবলে খুবলে কেউ লোম তুলে নিয়েছে। পরে অর্ঘ হ্যান্ড লেন্স দিয়ে দেখালো যে জায়গাগুলোতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্তক্ষরণ এর দাগ যাকে আমরা বলি পিন পয়েন্ট ব্লিডিং। হটাৎ তামাঙ্গ এর দিকে অর্ঘ একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো ‘ আগের লাশ গুলো কই ?’.... ‘সেতো পুঁতে  ফেলা হয়েছে .... এই তো  কাল দুটো  ওয়াইল্ড ক্যাট পুঁতলাম’। .. ‘ বিশেষ কিছু লক্ষ করেছিলে , এই যেমন তাদের লোম?’ কিছুক্ষণ ভেবে তামাঙ্গ বলল ‘ সাহেব এখনও পর্যন্ত যত গুলো কেস দেখেছি সবকটাতেই অদ্ভুত ভাবে লাসগুলোর লোম জায়গায় জায়গায় ঝরে পড়েছিল । ডাক্তার বাবু নিজের রিপোর্ট এ এটা লিখেছিলেন’ । বলতে বলতেই একটা জিপসী  গাড়ি  কিছুটা দূরে এসে থামল । তামাঙ্গ দৌড়ে গিয়ে একজন আমাদের বয়সী ভদ্রলোক কে সাথে নিয়ে এলো । পরিচয় হতে জানলাম যে ইনি এই ফরেস্ট রেঞ্জের সিনিয়র ভেটেরিনারিয়ান ডক্টর কুণাল দাস । বেশ মজাদার লোক , তার ওপর আমাদের সমবয়েশি । ওনার মোবাইলে  জন্তুদের লাশের কিছু ছবি আর ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট দেখলাম। সব শেষে অর্ঘ রুদ্র কে গতকালের শেই ওয়াইল্ড ক্যাট এর মৃতদেহ গুলো মাটি খুড়ে  বার করে স্টেট ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি এ পাঠাতে বলল । ।ওর নাকি ওখানে কোন সিনিয়র ফরেনসিক এক্সপার্ট চেনা আছে ।          
                                 
               আমরা আবার ফেরার পথ ধরলাম । গাড়িতে   আমরা সবাই  গম্ভীর আলোচনাতে মগ্ন এমন সময়ে  ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত গতিতে চলমান আমাদের গাড়ি হটাৎ জোরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল আর  তার ঝাঁকুনিতে আমরা সবাই  সামনের  দিকে হড়কে  গেলাম । বিরক্ত মেশানো দৃষ্টিতে অর্ঘ আর  রুদ্র তামাঙ্গ এর দিকে তাকাল । কিন্তু তামাঙ্গ এর দৃষ্টি সামনের জঙ্গলের দিকে স্থির হয়ে রয়েছে।  আমি, অর্ঘ ও রুদ্র   তার দৃষ্টি অনুসরণ করে জঙ্গলের দিকে তাকালাম। কিন্তু কই কিছুই তো  নেই। অর্ঘ কিছু বলতে যাবে কি তামাঙ্গ  ইশারায়  তাকে চুপ করতে বলল। প্রথমে সব নিশ্চুপ, তার কিছুক্ষণের মধেই জঙ্গলের মাটিতে পরে থাকা শুকনো পাতার ফসফসানি আর শাল আর শিমুল গাছের  আড়ালে কি যেন কালো কালো ছায়ামূর্তি। ক্ষণিকের মধ্যে জঙ্গলের মাটি কাঁপিয়ে আমাদের গাড়ির থেকে কয়েক হাত দূর থেকে লাফিয়ে  বেরিয়ে এল বিশালকৃতি এক বাইসন । বাইসনটি  মাঝ রাস্তায়  এসে স্থির দাঁড়িয়ে রইল আর রাগত দৃষ্টিতে আমাদের গাড়ির  দিকে তাকিয়ে থাকলো যেন বলছে যে এটা আমার পরিধী  আর এখানে ‘ট্রেস্পাসেরস আর নট এলাউড    বাইসন যাকে ‘ইন্ডিয়ান গউরও বলা হয় এখানকার জঙ্গল দাঁপিয়ে বেড়ায়  । এমনিতে এরা নির্বিবাদি কিন্তু খেপে গিয়ে যদি একবার তেড়ে  আসে তো  ৬০০ -৭০০ কেজির  এই দৈত্য  তার শিং  দিয়ে অনায়াসেই আমাদের জিপসী গাড়ি উল্টে দিতে পারে ।  আর খুব জোরে গাড়ি রিভার্স করলেও গতিতে আমরা এর সাথে পেরে উঠবনা । সবাই পাথরের মতো   গাড়িতে বসে রইলাম। এই শীতেও যেন আমার ঘাম দিচ্ছে । কতক্ষন এভাবে চললো  জানিনা । কিন্তু শেষমেষ শুধু ভয় দেখিয়েই বাইসন বাবাজি রাস্তা পার  করে , ও পারের জঙ্গলের গভীরে উধাও হয়ে গেলেন। ‘যাক বাঁচা গেলো’ ভেবে দম নিয়ে আমরা আবার এগোতে থাকলাম।“মরার ভয় তো সবারই আছে”.. তামাঙ্গ এর শেষের  কথা গুলো হটাৎ মনে পড়ে গেল ।   বুঝতে পারলাম যে অ্যাডভেঞ্চার তো  এই সবে শুরু .... সামনে আরো অনেক পথ বাকি ।...(ক্রমশ)

sankha.chowdhury799@gmail.com/
chiranjit.dr@gmail.com
কলকাতা 

1 comment: