1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 21, 2020

ভাগীরথী গঙ্গা


ছবি : ইন্টারনেট
                                                                          জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

         টুং টুং করে ঘন্টি বাজার আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল।পরিশ্রান্ত শরীরে তখন চোখটা আর খুলতে ইচ্ছে করছে না।স্লিপিং ব্যাগের ভিতর শুয়ে আবার বেশ গরমও লাগছে।এতো রাত্রে আবার এ কি আপদ এসে জুটলো।কোনো রকমে চোখদুটো একটু ফাঁক করে দেখি ঘরটার দেওয়ালে মোমবাতির আলোতে একটা ভুতুড়ে আলো-আঁধারীর খেলা চলছে।পোড়া মোম আর ধুপকাঠির মিষ্টি গন্ধটা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।বাঁ দিকে দেখি আমার অকস্মাৎ সফরসঙ্গীনি বৈশাখী স্লিপিং ব্যাগে ঘুমিয়ে কাদা, ওর বুক পর্য্যন্ত ব্যাগের ভিতর, কেবল ঘাড় মাথাটা বের করে হাঁ করে ঘুমোচ্ছে।নিশ্চয়ই নাক বন্ধ।সন্ধ্যে বেলায় ওকে নাক টানতে দেখেছি।গরমের থেকে প্রচন্ড ঠান্ডায় পৌছেই ও নিশ্চয়ই সর্দি পাকিয়েছে।

বৈশাখী আমার সাথে একই স্কুলে পড়তো।ক্লাস সেভেনের পর আমি অন্য স্কুলে চলে যেতে ওর সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।তাও কাছাকাছি বাড়ি থাকার সুবাদে ছ মাসে ন মাসে আর পুজোর সময় মুখ দেখাদেখি হতো।উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে আমি যে বছর কলকাতায় পড়তে চলে এলাম  তার পরের বছর ও চলে গেলো দিল্লি, পড়াশোনা করতে। যোগাযোগ আরো ক্ষীণ হয়ে পড়লো।কলকাতায় যাবার পর থেকে  বন্ধুবান্ধবদের সাথে বছরে একবার মানে পুজোর ছুটিতেই দেখা হতো। বৈশাখীও আমাদের সেই শারদীয়া আড্ডায় যোগদান করে হইহট্টগোল করে সবাইকে মাতিয়ে রাখতো।আমি চিরকালই একটু চুপচাপ থাকা অন্তর্মুখী ছেলে।ওর কাজ ছিল আমাদের আড্ডায় কেবল আমার পিছনে লাগা।তারপর কদিন পুজো কাটিয়ে সবাই নিজের নিজের কলেজে বা কাজে ফিরে যেতাম।

        কলকাতায় আসার ছয় বছর পর হটাৎ আমার ভিতর একটা রোমাঞ্চকর ট্রেকের ভাবনা জেগে উঠলো।সেটা বোধহয় একঘেয়ে জীবন থেকে একটা পালানোর প্রয়াস।কিন্তু সেরকম সঙ্গী জুটলো না।ফলে আমার এই প্রথম একদম একা গঙ্গোত্রী- গোমুখ দর্শনে বেরোনো।ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর সরকারি চাকরির পরীক্ষায় পাস করে চাকরির পাকা চিঠি ডাকমাধ্যমে হাতে পাওয়ার আগেই আমার এই সাত দিনের ঝটিকা সফর।ঋষিকেশ থেকে ভোর বেলায় ট্রাকমুখীবাসে উঠে জানালার পাশের সিটে বসে আছি এমন সময় কে যেন মাথার পিছনে চাঁটি মারলো। " কিরে শঙ্কর, কোথায় যাচ্ছিস?" চেনা নারিকণ্ঠ শুনে চমকে আমি পিছনে তাকালাম। দেখি কমলা রঙের একটা সালোয়ার কামিজ আর মাথায় একটা সোলার টুপি পরে বৈশাখী আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে।ওই একই রকম আছে ও।প্রাণোচ্ছল সবাইকে আপন করে নেবার একটা সহজাত ক্ষমতা আছে ওর।দেখতে বিরাট ডানাকাটা সুন্দরী না হলেও একটা  আকর্ষণ আছে ওর চেহারায়।

" কিরে, এতক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে আছিস যে, চিনতে পারছিস না? আমি তোকে কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই ফলো করছি।কিন্তু তুই তো তোর আপন ভাবনায় চলিস বলে অন্য কিছু খেয়াল করিস না।"

" না , মানে তোকে এইখানে, এইভাবে দেখবো সেটা তো আমার কাছে আশাতীত ব্যাপার।"

" কেন আমি বেড়াতে আসতে পারি না?"

" তুই একা, সঙ্গে কেউ নেই?"

" কেন একা থাকলে কি ফ্লার্ট করতে সুবিধে?"

" এই একদম লেগপুলিং করবি না। আচ্ছা তোর সাথে কেউ কি সত্যি নেই? একা ঘুরতে বেরিয়েছিস?"

"  ছেলেরা একা ঘুরতে পারলে মেয়েরা পারবে না কেন শুনি।"

          আমার পাশে একজন অবাঙালি বয়স্ক ভদ্রমহিলা বসে থাকায় ও পাশে বসতে পারলো না।

          বৈশাখী চিরকালই একটু ডাকাবুকো।একটু বেশি সাহসী। শুনলাম দিল্লিতে চাকরি করছে।পাহাড়ে ও আগে বাবা-মার সাথে ঘুরতে গেছে।এবার গঙ্গোত্রীর যমুনেত্রীর পথে সাহসিনী একাই বেরিয়ে পড়েছে।সত্যি বলতে ওর এই একা বেরিয়ে পড়াতে আমি প্রথমে একটু অবাকই হয়েছিলাম।মধ্যবিত্ত বাঙালী তরুণী একদম একা পিঠে একটা রুকস্যাক নিয়ে হিমালয়ের পথে বেরিয়ে পড়েছে চিন্তা করেই আমার ওর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো।একটু পরেই ড্রাইভার বাসের সামনে এসে বসতেই আমাদের বাস ঋষিকেশ ছেড়ে পাকদন্ডী দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দে  হিমালয়ের ওপর ওঠা শুরু করলো।বাসের সামনেটা ট্রাকের মতো আর পিছনটা বাসের রূপ।সরকারী বাসের সঙ্গীন অবস্থা দেখে ঈশ্বরের নাম নিতে নিতে সবাই চললাম।

          ঘরের বাঁ দিকেই জানালার বাইরেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার ।একটু খোলা জানালা দিয়ে একচিলতে চাঁদের আলো যেনো  উৎসাহিত হয়ে উঁকি দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে একটা স্বপ্নময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।মোম পোড়া আর ধূপের গন্ধটা আবার নাকে আসছে।তার সাথে বিড়বিড় করে সংস্কৃতে মন্ত্রোচ্চারণ আর ঘন্টি বাজানোর টিং টিং আওয়াজ।ডান দিক ফিরে দেখি আমার পাশে শোয়া এক বৃদ্ধা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছেন।ওনার টিনের ট্রাঙ্কটার ডালার ওপরে  একটা  ছোট্ট রাধাকৃষ্ণের মূর্তি  লাল সালুর ওপর রাখা।পাশে টিমটিম করে একটা মোমবাতি আর ধুপকাঠি জ্বলছে আর উনি মন্ত্রোচ্চারনে এক মনে ঘন্টি বাজিয়ে পুজো করে চলেছেন।ঘড়িতে দেখি ভোর চারটে দশ।মোমবাতির আলোয় বৃদ্ধার ছায়া পাশের দেওয়ালে পড়েছে আর ভৌতিক ভাবে নড়ছে। ছোট ঘরটিতে আমার মতো আরো প্রায় দশজন মাটিতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।কত রাত্রে বাকিরা ঘরে ঢুকেছে আমরা জানতেও পারিনি।

         গতকাল প্রায় সন্ধ্যে বেলায় আমি আর বৈশাখী ঋষিকেশ থেকে বাসে করে গঙ্গোত্রী এসেছি।প্রায় তেরো ঘন্টা বাস যাত্রার পর কোমর তখন আর নাড়ানো যাচ্ছে না।কোনো রকমে বাসের মাথায় চড়ে আমাদের রুকস্যাক নামিয়ে সোজা শর্মাজীর ছোট্ট হোটেলে এসে দেখি শর্মাজীও নেই আর হোটেলের চারটি রুমের সবকটি ভর্তি।শর্মাজি গঙ্গোত্রীর একমাত্র নামকরা কোয়াক ডাক্তার আবার ওনার একটি চার কামরার ছোট হোটেলও আছে। ঠিক যেখানে ভাগীরথী গঙ্গা একটা বিশাল পাথরের ওপর থেকে প্রায় দশ ফুট নীচে ভীষণ শব্দ করে লাফিয়ে পড়েছে তারই লাগোয়া শর্মাজীর চার কামরার হোটেল।হোটেলটির বাড়ানো বারান্দায় শর্মাজির একটি টেবিল আর স্টুল নিয়ে চেম্বার, যেখান থেকেই  ভাগীরথীর রুদ্ররূপে নীচে ঝাঁপ দেওয়া দেখা যায়। হোটেলের সবকটি ঘর থেকেই সেই ভীষণ গর্জন  কানে আসে।গঙ্গার কুলুকুলু শব্দে পাথরের ফাঁক দিয়ে বয়ে চলার সাথে এই ভয়ঙ্কর রূপটার কেমন যেন খাপ খাওয়াতে পারা যায় না।

          শর্মাজী এখানকার সম্মানীয় এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি।এক বন্ধুর মাধ্যমে ওনার সাথে চিঠি চালাচালি হয়েছিল এবং উনি আমাকে ওনার হোটেলে আসতে আমন্ত্রিত করেছিলেন।এখানে এসে শুনলাম উনি নাকি কিছু জরুরি কাজে আজই হরিদ্বার গেছেন , কাল ফিরবেন।এখন ওনার অনুপস্থিতি আর চারটি কামরাই ভর্তি থাকা আমাদের সমস্যায় ফেলে দিলো।ওদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে।গঙ্গোত্রীর চারিদিকে সুউচ্চ পর্বতশ্রেণী থাকায় সন্ধ্যেটা কেমন যেন ঝট করে নেমে গেল।যে সময়ের কথা বলছি বিদ্যুৎ তখনও গঙ্গোত্রীতে এসে পৌঁছায়নি।যে কটি ভাগ্যবান লোক থাকার বন্দোবস্ত করে এসেছে তারা ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে কেমন যেন অদৃশ্য হতে লাগলো।বাস থামার পর কুলি, ঘোড়ার সহিসের চিৎকার চেঁচামেচি যেটা ছিল সেটা থেমে এক অদ্ভুত নির্জনতা যেন আমাদের আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরলো।কেবল একটু দূরে গঙ্গার নিচে লাফিয়ে পড়ার আওয়াজ ব্যতিরেকে জনমানবশুন্য জায়গাটা একটা কেমন যেন ভীতিপ্রদ  পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।সরকারি লজ একটু দূরে।তীরচিহ্ন দিয়ে সেটার পথনির্দেশিকা দেওয়া আছে।আমি আর বৈশাখী সেদিক পানে দৌড় মারলাম।লজের ছয়টি রুম আগে থেকেই বুক হয়ে গেছে।সরকারি লজের গেটে দাঁড়িয়ে আমরা নিরাশ্রয় হয়ে কোথায় যাবো ভাবতে লাগলাম।আমাদের সাথে স্লিপিং ব্যাগ আছে। খরস্রোতা গঙ্গার পাড়ে ফাঁকা জায়গাতেও শুয়ে পড়তে পারি।কিন্তু দশ হাজার ফিট উচ্চতায় হাড় কাঁপানো শীতটাই  খোলা আকাশের নিচে শোয়ার প্রধান অন্তরায়।আমরা আবার টেন্টও আনিনি।অবশ্য শুনেছিলাম ওগুলো খুব একটা দরকার পড়ে না।পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে সেটা নিয়ে বৈশাখীর সাথে আলোচনা করছি তখনই শর্মাজীর হোটেলের একটি ছেলেই ধর্মশালার সন্ধানটা দিলো।

          গঙ্গোত্রীর মন্দিরের সামনে একটা সোলার বাতি টিমটিম করে জ্বলছে।একটু এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে যেখানে ভাগীরথী গঙ্গা ভীষণ শব্দে নিচের পাথরে আছড়ে পড়ছে সেখানে আমরা দাঁড়ালাম।বেশ ভয় ভয় লাগে এই জায়গাটায় দাঁড়ালে।কেউ পা হড়কে পড়ে গেলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।রেলিংগুলো জলের ছিটেতে ভিজে আর লোহার রেলিংয়ের পুরোটাতেই জং ধরে গেছে।ঠিক করলাম একেবারে  রাত্রের খাবার খেয়েই ধর্মশালায় যাবো।এখানে রাত আটটা বাজলেই সবাই শুয়ে পড়ে।দুটো দোকানে হ্যাজাক জ্বলছে।সেই দোকানগুলোতে  বিদেশিদের ভিড়।প্রচুর বিদেশি এই সময়ে গোমুখ,তপবন বা আরো উঁচুতে কোনো পর্বতশীর্ষ সামিট করতে যায়।দোকান গুলিতে উনুনের আর সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রায়োন্ধকার জায়গাটা কেমন যেন বেমানান লাগছে।চটুল হাসি ঠাট্টার আওয়াজও ভেসে আসছে।একটু রাত বাড়তে বিদেশিদেরই বেশি রাস্তায় দেখা মেলে।কালকে যে যার লক্ষ্যে রওয়ানা দেবে।শেষ বাস আসতে নাকি আরো আধঘন্টা দেরি।বাসস্ট্যান্ডের সামনের রাস্তাটায় একটু এগোলেই বাঁ দিকে পাহাড়ের গায়ে গর্ত কেটে গুহার মতো বানানো।তাতে দেখি গোটা দুয়েক গেরুয়াধারী সাধু গাঁজার কল্কে হাতে চুপ করে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।ধ্যান করছে না বুঁদ হয়ে আছে তা বোঝা দুঃসাধ্য।কারুর মুখে কোনো কথা নেই।গোটা দুয়েক লোমশ কুকুর গুহার একপাশে আলসেমি করে  শুয়ে  মাঝে মাঝে গা চুলকোচ্ছে।গুহায় জ্বালানো ধুনি থেকে পোড়া কাঠের সাদা ধোঁয়া সোজা ওপরে উঠে যাচ্ছে  অন্ধকার পাহাড়ের সাথে মিতালি করতে।

সন্ধ্যে সাতটায় রাতের খাবার খেয়ে টর্চ হাতে অন্ধকার ধর্মশালায় হাজির হলাম।বাইরে কোনো দারোয়ান নেই।কাঠের টেবিলে একটা লণ্ঠন টিমটিম করে জ্বলে যেন পাহারাদারের কাজ করছে।লণ্ঠনের পাশে একটা রুলটানা মোটা খাতা খোলা পড়ে।যাত্রীরা নিজেদের নাম আর ঠিকানা লিখে যে কোনো একটা ঘরে সুবিধা মতো ঢুকে পড়তে পারে।তখনও পরিচয়পত্র দেখানোর নিয়ম চালু হয়নি।ধর্মশালা অবারিত দ্বার , যদি জায়গা থাকে যে পারো এসে কম্বল নিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়।একপাশে ডাঁই করে কম্বল  আর মেঝেতে বিরাট শতরঞ্জি পাতা , কতকাল যে সেটা ধোয়া হয়নি কে জানে।ঘরে ঢুকতেই একটা বোটকা গন্ধ নাকে এলো।ধর্মশালায় কেবল দুটি বড় বড় ঘর।প্রতিটি ঘরে একটা পর্দাবিহীন ভেজানো দরজা আর একেকটি ঘরে দুটো কাঠের জানালা যেগুলো কেউ কোনোদিন খুলেছে কিনা সন্দেহ।বৈশাখী ছিটকিনি খুলে একটা জানালা ধাক্কা মেরে  ফাঁক করাতে একরাশ ঠান্ডা হাওয়া আর কিছুটা বাইরের চাঁদের আলো ঘরের ভিতর প্রবেশ করলো। সেই আলোয় পরিষ্কার কিছু দেখা যায় না।টর্চের আলোতে দেখা গেল একটা ইঁদুর ঘরের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে।কুতকুতে দুটো চোখকে টর্চের আলোয় জ্বলজ্বল করতে দেখে বৈশাখী একটু ঘাবড়ে গেল।আলো চোখে পড়তেই চোখ দুটির মালিক কোথাও লুকিয়ে পড়লো।আজ রাত্রে আমার আর বৈশাখীর এটাই আপাতত থাকার জায়গা।

" কিরে আজ কিন্তু এই অন্ধকার ঘরে আমাদের পাশাপাশি শুতে হবে।আমার সঙ্গে রাত্রি কাটাতে তোর আপত্তি নেই তো।"আমি হেসে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম।

" শোন, নিজেকে তুই আর হিরো মনে করিস না।"ফোঁস ফোঁস করে বৈশাখী বললো।

আমরা পাশাপাশি দুটো জায়গা নিলাম। স্লিপিং ব্যাগ বার করার সময় অনুভব করলাম যে আমার অন্য পাশেও কেউ যেন শুয়ে আছে।টর্চ মেরে দেখি এক ছোটখাটো চেহারা, মাথা পর্য্যন্ত কম্বলমুড়ি দিয়ে কুঁকড়ে শুয়ে আছেন।বাচ্ছাও হতে পারে, বয়স্ক ক্ষয়িষ্ণু লোকও হতে পারে।মনে হলো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওনার ঠিক পাশেই একটা মাঝারি সাইজের জংধরা টিনের ট্রাঙ্ক।আমাদের পায়ের কাছে আরো তিনজন শুয়ে ,যারা আমাদের আগমনে আর কথায় অখুশি হয়ে মুখ দিয়ে চুক চাক আওয়াজ করছে।সারাদিনের মারাত্মক ধকলের পর শরীর আর তখন বইছে না।শোবার কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।

ঘণ্টির আওয়াজে ঘুম ভাঙতে উঠে চোখ রোগড়ে  খুলে দেখি জোর কদমে ঘন্টাধনি আর মন্ত্রোচ্চারনে দিয়ে পুজো চলছে।মোমবাতির আলোয় দেখলাম সাদা শাড়ি পরিহিতা এক ছোটখাটো ভদ্রমহিলা, দেখে মনে হয়  বয়েস সত্তরের আশেপাশে হবে গভীর ভক্তিভাবে পূজা সারছেন।দারিদ্রের এবং বয়সের ছাপ স্পষ্ট ওনার মুখে, শরীরে।উনি বোধহয় আঁচ করলেন যে কেউ ওনাকে লক্ষ্য করছে।আসন করে বসা অবস্থায় আমার দিকে পিছন ফিরলেন।মনে হলো যেন হাসলেন।আমি প্রত্যুত্তরে হাত জড়ো করে নমস্কার করলাম।ওনি আবার ফিরে পুজোয় মন দিলেন।

কাঁচা ঘুমটা অসময়ে ভেঙে যেতে আমি উঠে পড়লাম।সোয়েটার, উইন্ড চিটার, মাফলার আর জুতো পরে ঘরের বাইরে বারান্দায় বেরিয়ে দেখি প্রায় পঞ্চাশ ফিট দূর দিয়ে গঙ্গা পাথরের নুড়ির ওপর দিয়ে কলকল শব্দে বয়ে যাচ্ছে।আর কদিন বাদেই পূর্ণিমা।রুপালি জ্যোৎস্নায় পারাপার ভেসে যাচ্ছে।অন্ধকার আকাশে এখনো তারারা টিমটিম করে জ্বলে তাদের উপস্থিতির কথা জানান দিচ্ছে।বেশ কয়েকজন লোক এবং কিছু ঘোড়া দেখলাম সেই ভোররাতে গঙ্গার পাড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে।

ক্যাঁচ করে দরজার একটা আওয়াজ হতে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি সেই বৃদ্ধা আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন।

" লো বেটা প্রসাদ।" আমার হাতে কয়েকটা চিনির দানা দিতেই আমি মুখে পুরে কথাবার্তা শুরু করলাম।

লাচমি দেবী সুদূর সুরাতের পাশে এক গ্রাম থেকে গোমুখ দর্শনে সম্পূর্ণ একা এসেছেন।স্বামী কুড়ি বছর আগে আর একমাত্র ছেলে দশ বছর আগে ইহলোক ত্যাগ করেছেন।বাড়িতে বৌমা আর নাতিকে রেখে উনি প্রতিবছর একাই তীর্থদর্শনে বেরিয়ে পড়েন।আমি বাঙালি বলাতে বললেন গঙ্গাসাগর দুবার গেছেন।আরো বললেন গঙ্গার সাগরে মিলন দেখেছেন কিন্তু উৎপত্তি স্থলটা দেখা হয়নি বলে এবার এখানে চলে এসেছেন।

একা একা বেরিয়ে পড়তে ভয় করে না জিজ্ঞাসা করাতে উনি কেমন যেন একটু ভাবুক হয়ে গেলেন।আকাশের চাঁদ আর তারাদের দিকে তাকিয়ে তারপর আমার দিকে ফিরে হেসে বললেন," আমার আর হারানোর কি আছে বেটা যে ভয় পাবো?"

বৃদ্ধার মনের জোরের বাহবা দিতে হয়।একটি ট্রাঙ্ক নিয়ে সুদূর গুজরাট থেকে সম্পূর্ণ একা গোমুখ দর্শনে বেরিয়ে পড়েছেন।ওনার পাড়াতুতো দেওর নাকি হরিদ্বারের ট্রেনে ওনাকে তুলে দিয়েছিলেন।ওনার পাশের গ্রামের আরো একটি পরিবার হরিদ্বারের ধর্মশালায় রয়ে গেছেন।এখান থেকে ফিরে উনি আবার সেই ধর্মশালায় উঠবেন।

লাচমি দেবীর সাথে কথা বলে জানলাম ঘোড়াওয়ালার সাথে  গতকালই বিকেলে উনি কথা সেরে রেখেছেন।ভোর পাঁচটায় অন্ধকার থাকতেই রওয়ানা হয়ে গোমুখ দর্শন করে সেদিনই সন্ধ্যে বেলায় ফিরে আসবেন। আবার এই ধর্মশালায় একরাত থেকে পরের দিন হরিদ্বার রওনা দেবেন।কথা বলতে বলতে দেখি গঙ্গার পাড় থেকে একটি লোক একটি ঘোড়া নিয়ে আমাদের ধর্মশালার দিকে এগিয়ে আসছে।চারিদিকে এখনো অন্ধকার।টর্চ জ্বালিয়ে লোকটির মুখে ফেলে দেখি একটি কম বয়সী ছেলে ঘোড়াটা নিয়ে ধর্মশালার উঁচু বারান্দার একপাশে দাঁড় করালো।লাচমি দেবী  আর আমি ঘরের ভিতর ঢুকে ট্রাঙ্কটি নিয়ে এলাম।সেটিকে দড়ি দিয়ে ঘোড়ার সাথে আষ্টে পিষ্টে বাঁধা হতে লাচমি দেবী শাড়ি পরেই ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হলেন।ওনার চোখ আর নাক বাদ দিয়ে মাথা, কান,মুখ চাদরে আর মাফলারে ঢাকা।আরেকটি দড়ি দিয়ে হালকা করে ওনাকেও ঘোড়ার সাথে আর ট্যাংকের সাথে সহিস বাঁধলো যাতে ঝাঁকুনিতে উনি পড়ে না যান।

পূর্বপ্রান্তে সুউচ্চ পাহাড়ের পিছনে হালকা লাল আর হলুদের আভা ভোরের আগমনী বার্তা দিচ্ছে।গঙ্গা মাইয়ার সাথে দেখা করতে সুদূর সুরাতের গ্রাম থেকে এক নিরক্ষর বিধবা মহিলা কেবল ঈশ্বর ভরসা আর মনের জোরে এতদূর পথ পাড়ি দিয়েছেন।

" আবার দেখা হবে বেটা" বলে উনি গোমুখের উদ্দেশে রওনা দিলেন।সামনেই একটা প্রায় তিরিশ ফিটের  পাথুরে খাড়াই রাস্তা।সহিসের ঘোড়াকে হ্যাট হ্যাট করে শাসন করা , গঙ্গার বয়ে যাবার ছলাৎ ছলাৎ  শব্দ, আর পাহাড়ের পিছন থেকে পুবের আকাশ লাল হয়ে ওঠা আমার মনে এক অদ্ভুত আনন্দ ও সুখানুভূতির সৃষ্টি করলো।কয়েকটি দাঁড়কাক কা কা শব্দে আকাশে উড়ে ভোরের আগমনে গান জুড়েছে।গঙ্গার ওপর একটা হালকা কুয়াশার চাদর যেন হাড় কাঁপানো শীত থেকে মমতাময়ীর মতো ভাগীরথী গঙ্গাকে ঢেকে রেখেছে।দূরের পাহাড়ের গায়ে কিছু বাড়ী থেকে উনান জ্বালানোর সাদা ধোঁয়া সোজা আকাশের পানে পাড়ি দিয়েছে।কিছুটা উঠেই আবার হালকা হয়ে এঁকে বেঁকে ভেঙে চুরে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।ঘোড়ার ওপর সওয়ার লাচমি দেবী ও পাশে হাঁটা সহিস আস্তে আস্তে দূরে যেতে যেতে বিন্দুর মতো হয়ে একসময় বাঁকের মুখে হারিয়ে গেল।

কাশির শব্দ শুনে দেখি পোশাক পরিচ্ছদ দিয়ে নিজেকে মুড়ে বৈশাখী আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। 

"গুড মর্নিং। তুই এই ঠান্ডায় এখানে কেন একা একা দাঁড়িয়ে আছিস ?"

" না ওই আমার পাশে শোয়া বৃদ্ধাকে গোমুখের পথে যেতে ঘোড়ায় চড়িয়ে দিলাম।"

" চল, চল রেডি হয়ে আমাদেরও তো বেরোতে হবে।" ও তাড়া লাগায়।

ছবি : ইন্টারনেট

‌আজ আমাদের লক্ষ্য ভুজবাসা হয়ে গোমুখ দর্শন।পিঠে রুকস্যাক নিয়ে প্রথমেই আমরা গঙ্গোত্রীর মন্দির দর্শনে গেলাম।গতকাল যখন আমরা গঙ্গোত্রীতে পা দিয়েছিলাম তখন মন্দিরের মুখ্যদ্বার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজ আমাদের চোদ্দো কিলোমিটারের ভুজবাসা যাত্রা প্রথমে মন্দির দর্শন দিয়েই শুভারম্ভ করবো।বাইরে ঝোলানো ঘন্টা বাজিয়ে মন্দিরে খালি পায়ে ঢোকাটা একটা রীতিমতো কষ্টকর অভিজ্ঞতা।পা যেন ঠান্ডায় ছিড়ে যাচ্ছে।মন্দির চত্বর ভিজে থাকায় মোজাটাও খুলতে হলো।দেখি আমাদের আগেই প্রায় জন্য দশেক লোক সেখানে ভিড় করেছে।দু একজন বিদেশিকেও সেই ভিড়ে দেখা গেল।পুরোহিত আমাদের কপালে সিঁদুরের ফোঁটা এঁকে দিয়ে মা গঙ্গার মর্ত্যে আগমন নিয়ে এক অজানা গল্প শোনাতে শুরু করলেন।

"রামায়ন থেকে আমরা মা গঙ্গার মর্ত্যে আগমনের  ইতিহাস জানতে পারি।" পুরোহিত মশাই হলুদ চাদরটাকে নিজের শরীরের চারিদিকে বেশ করে জড়িয়ে গল্পটা বলা শুরু করলেন।শ্রোতা আমরা জনা বারো পুরুষ ও মহিলা। "রঘুবংশের রাজা সাগরের ছিল ষাট হাজার পুত্র।  সবদিকে চূড়ান্ত সফল রাজা একদিন ভাবলেন অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন।কিন্তু এ যজ্ঞ হলে দেবতারা বিপদে পড়ে যাবেন। দেবরাজ ইন্দ্র রাতের আঁধারে যজ্ঞের অশ্বটি চুরি করে পাতালে তপস্যারত কপিলমুনির ঘরে তাঁর অজান্তেই লুকিয়ে রাখলেন। কপিলমুনি এসবের কিছুই জানতে পারলেন না। এদিকে সকালে উঠে রাজা দেখলেন  যজ্ঞের অশ্ব স্বস্থানে নেই।অমঙ্গলের আশঙ্কায় ভীষণ চিন্তিত হয়ে উনি পুত্রদের সেই অশ্বই খুঁজে আনতে আদেশ দিলেন। সারা পৃথিবীতে খুঁজে না পেয়ে পুত্ররা পাতাল খুঁড়তে শুরু করলো। পাতালে কপিলমুনির ঘরে  সেই হারানো অশ্ব খুঁজে পাওয়া গেলো। মহর্ষিকে চোর সন্দেহ করে সাগর রাজার পুত্রেরা তাঁর বহু বছরের ধ্যান ভঙ্গ করলে ক্রুদ্ধ মহর্ষির দৃষ্টিপাত মাত্র ষাট হাজার পুত্র ভস্মীভূত হয়ে গেলেন। সাগর রাজার ষাট হাজার সন্তানের আত্মা পারলৌকিক ক্রিয়ার অভাবে প্রেতরূপে সেইস্থানেই আবদ্ধ হয়ে থাকলেন। রাজা জানতে পারলেন পুত্ররা তখনই অভিশাপ মুক্ত হবে যদি স্বয়ং মা গঙ্গা স্বর্গ থেকে নেমে এসে পুত্রদের আত্মাকে ভেজাতে পাতালে আসতে রাজি হন।" এ পর্যন্ত বলে পুরোহিত মশাই একটু থামলেন।বৈশাখি আমার হাতে একটা চিমটি কেটে বললো" কিরে বেরোবি, না এই সব ফালতু গল্প শুনবি?"

" দাঁড়া, পৌরাণিক গল্পটা পুরোটা শুনতে দে।তুইও মন দিয়ে শোন, ইন্টারেস্টিং।"

ও অন্য দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

"গঙ্গা দেবী ভীষন অহংকারী। রাজা সাগর ত্রিশ হাজার বছর ওনার তপস্যা করেও গঙ্গা কে ধরায় আনতে পারলেন না। তাঁর মৃত্যুর পর তার   প্রপৌত্র ভগীরথ তপস্যা করতে বসলেন। তিনি তপস্যা করতে করতে ব্রক্ষ্মাকে খুশি করে ফেলে মা গঙ্গাকে বর হিসেবে চাইলেন । ব্রক্ষ্মা বলেন  আগে মহাদেবকে খুশি করতে হবে তবেই ওনার মাধ্যমে গঙ্গা ধরাত্রিতে আসবেন। তপস্যায় মহাদেবকেও সন্তুষ্ট করেন ভগীরথ। এদিকে অহংকারী গঙ্গা বললেন আমি নামবো তবে মহাদেবকে স্রোতে ভাসিয়ে তবে নামবো।"

পুরোহিত মশাই একটু থেমে বাইরে বেরিয়ে মন্দিরের প্রবেশদ্বারের স্থিত ওপর থেকে ঝোলা ঘন্টাটিকে ঝোলানো দড়ির সাহায্যে তিনবার বাজালেন। তারপর পুনরায় ঘরের ভিতর ঢুকে গল্পটি আবার শুরু করলেন।

"কৈলাসের চূড়ায় থাকা মহাদেব মুচকি হাসেন আর গঙ্গাকে বলেন " তবু তুমি নামো ।" অহংকারী মা গঙ্গা স্বর্গ থেকে নেমে মহাদেবকে ভাসাতে গিয়ে নিজেই মহাদেবের মাথার জটায় আটকে গেলেন। ভগীরথ মহাদেব কে হাত জোড় করে অনুরোধ করলেন গঙ্গাকে মুক্ত করে দেবার জন্য। মহাদেব ধীরে ধীরে জটা খুললে সাত ভাগ হয়ে গঙ্গা ধরায় ছড়িয়ে গেলেন। যেহেতু ভগীরথ গঙ্গার মর্ত্যাবতরণের প্রধান কারণ, সেই হেতু গঙ্গার অপর নাম ভাগীরথী। আর এক ভাগ যায় ভগীরথের পিছু পিছু মর্ত্যলোকে আর পাতাললোকে।

কথিত আছে, মর্ত্যে ভগীরথকে অনুসরণ করার সময় গঙ্গা ঋষি জাহ্নুর আশ্রম প্লাবিত করেন। মুনিও প্রতিশোধ নিতে গঙ্গার সব জল চুমুক দিয়ে গিলে ফেললেন। ফলস্বরূপ মর্ত্যলোকে  জল নিয়ে হাহাকার পড়ে গেলো। দেবতারা জাহ্নমুনিকে অনেক কষ্টে তুষ্ট করে গঙ্গাকে মুক্তি দিতে বলেন। জাহ্ন তখন গঙ্গাকে বের করেন কানের ভেতর দিয়ে। একারনে গঙ্গাকে জাহ্নর কন্যাও বলা হয় আর তাই গঙ্গার আরেক নাম তাই জাহ্নবী।

শেষে ভগীরথের  পিছন পিছন এসে পাতালে কপিল মুনির আশ্রমে  মা গঙ্গা ষাট হাজার রাজপুত্রের অস্থি  নিজের স্রোতে ভাসিয়ে দিলেন। গঙ্গার পবিত্র স্পর্শে ষাট হাজার প্রেতাত্মার সদ্গতি হল। সেখানেই তিনি সাগরে বিলীন হলেন।"

 আমি পরিষ্কার দেখছি বৈশাখীর মুখটা বেশ কঠোর আর গম্ভীর হয়ে পড়ছে।ও যাত্রা শুরুর জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে।

" তুই  সায়েন্সের স্টুডেন্ট হয়ে এই সব  বিশ্বাস করিস।"

" বিশ্বাস করা আর না করাতে কার কি এসে যায় বল তো?শুনতে কি অসুবিধা ।এটা ধর আজ থেকে তিন চার হাজার বছর আগে কোনো ভীষণ  বুদ্ধিমান গল্পবলিয়ে অন্য লোকেদের শুনিয়েছিলো।জনগণের মনে ধরেছিল বলেই না এতদিন গল্পটা চলে আসছে।গল্পটা ঠিকঠাক বলাতেই আসল কৃতিত্ব।বিশ্বাস, অবিশ্বাস পরে আসছে।"

বৈশাখীর আমার কথাগুলো ঠিক পছন্দ হলো না।আমরা মন্দির চত্বর ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম।আজ বৈশাখী একটা জিন্স আর টপ পরে তার ওপর খয়েরি মোটা চামড়ার জ্যাকেট পরেছে।ভারী সুন্দর লাগছে ওকে। মন রাখতে সেটা ওকে বলতে ও মুখ ঝামটা দিয়ে বললো

" চল চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।"

কলকাতা থেকে আনা কিছু হালকা খাবার ভাগ করে খেয়ে এক লিটারের জলের বোতলে গ্লুকোজের প্যাকেট গুলে,হাতে লাঠি আর পিঠে রুকস্যাক নিয়ে আমরা গোমুখের পথে রওনা দিলাম। সূর্যের আলো তির্যকভাবে গায়ে এসে পড়ছে।এ এমন এক রোদ যাতে একটা মোলায়েম  তেজ আছে কিন্তু কলকাতার গরমের ক্রোধ নেই।স্নেহময় একটা তাপ আছে কিন্তু ঝলসানি নেই যেটা হরিদ্বারে পেয়েছি।হালকা শিরশিরানী একটা বাতাস পাহাড়ের গা বেয়ে নীচে নেমে এসে মুখে চোখে শীতল আমেজ ধরাচ্ছে। বহুদূরে নীল আকাশ আজ ঝকঝকে পরিষ্কার।কোনো মেঘের চিহ্নই নেই।এ আকাশ আমার দেখা, পরিচিত শহুরে আকাশ থেকে অনেক বেশি নীল আর মেঘমুক্ত।সামনে বহু দূরে কিছু শ্বেতশুভ্র পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছে।ওগুলো নাকি মাউন্ট শিবলিঙ্গ আর ভাগীরথীর দুটি চূড়া।

অনেক লোক দেখি গোমুখের পথে পাড়ি দিয়েছে। বয়স্ক লোক ঘোড়ার পিঠে তবে অধিকাংশ লোকই পদব্রজে চলেছে।দু একজন বয়স্ক লোক ডুলি নিয়েছে।কম বয়সী বিদেশি ছেলেমেয়েরা রুকস্যাক পিঠে তরতর করে সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে।ওদের চলার ভঙ্গিতে কেমন যেন একটা দীপ্ততা আছে যেটা আমাকে মুগ্ধ করে।

পিঠে রুকস্যাক নিয়ে কিছুদূর যাবার পরেই আমাদের জিভ প্রায় বেরিয়ে গেল।এতদিন কেবল পড়াশোনাই করে গেছি, শরীর স্বাস্থ্যের দিকে তেমন নজর দেওয়া হয়নি।তারই এই কুফল।গঙ্গোত্রী থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পর আমরা দুজনেই পথের পাশে রাখা পাথরের ওপর বসে পড়লাম।ভুজবাসা আরো তেরো কিলোমিটার।নিজেদের মনেই সন্দেহ দেখা দিল যে আমরা আদৌ আর এগোতে পারবো কিনা।

" আমি আর যেতে পারবো না রে।তুই চলে যা।আমি গঙ্গোত্রীতে তোর জন্য অপেক্ষা করবো।" বৈশাখী হাঁপাতে হাঁপাতে বললো।

" এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন হবে । সেরকম হলে আমিও যাবো না।এক কাজ করি।দুজনে দুটো ঘোড়া নেওয়া যাক।" আমি আশ্বাস আর সমাধান দুটোই দিলাম।

বৈশাখী একটা দুস্টুমির হাসি দিল।" তোকে দেখে মনে হচ্ছে একটা ঘোড়ায় দুজন গেলেই তুই বেশি খুশি হবি।"

" তুই আবার শুরু করেছিস।" আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম।

" তুই একটু তোর গঙ্গামাইয়া কে মনপ্রাণ দিয়ে ডাক না, যাতে আমাদের কিছু বন্দোবস্ত হয়।" বৈশাখী আবার আমাকে খোঁচা দিলো।

" বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়।" আমি উত্তর দিলাম।

" আচ্ছা তুই কি আস্তিক?" একটু দম নিয়ে বৈশাখী আমাকে প্রশ্নটা করলো।আসলে পাহাড়ি  অনভ্যস্ত চড়াইপথে চলতে চলতে কথা বলা যায় না , হাঁফ ধরে যায়।আবার কথা না বললেও কেমন একটা একাকিত্ত্ব গ্রাস করে।সুতরাং হাঁফ নিতে থামতেই বৈশাখী আমার দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো। এর কি জবাব আমি দেব।আসলে আস্তিক আর নাস্তিকের মধ্যে মূল প্রভেদ তো হলো চিন্তার ভিন্নতা।এক পক্ষ পরম শক্তির কাছে অন্ধভাবে বিশ্বস্ত আর অনুগত।অন্য পক্ষ তথ্য ও যুক্তি নির্ভর।যে জায়গাটিতে উভয় পক্ষেরই মিল রয়েছে তা হলো নির্ভরতা।যে নির্ভরতা ব্যক্তিজীবন ছাড়িয়ে শক্তির কাছে গিয়ে ঠেকেছে।আস্তিকের ঈশ্বর নামে শক্তির ওপর নির্ভরতা আর নাস্তিকের যুক্তি বা বিজ্ঞানের শক্তির নির্ভরতা।

আস্তিক - নাস্তিক এর দ্বন্দ্বটা মানব সভ্যতার চিরাচরিত সত্য-মিথ্যারই এক ভিন্নতর দ্বন্দ্ব।সত্য-মিথ্যার এই দ্বন্দ্বের সাথে কিছু আধ্যাত্মিক উপাদান যুক্ত হয়ে তা আস্তিক-নাস্তিক দ্বন্দ্বে উপনীত হয়েছে। আমি কি সত্যি আস্তিক না নাস্তিক তা নিয়ে আমার নিজেরই সংশয় আছে।নিজেকে মধ্যপন্থী বললেই যেন ভালো হতো।কিন্তু যুক্তির দিক দিয়ে যেমন "হা" আর "না" এর মাঝে কিছুরই অবস্থান থাকতে পারে না তেমনই সত্য আর মিথ্যার মধ্যবর্তী যে পরাবাস্তবরূপ শূন্য অবস্থান তা বুঝিয়ে দেবার দরকার পড়ে না।মধ্যপন্থা যে সুযোগ সন্ধানী সুবিধাবাদী একটা দল সেটা অস্বীকার করার কোনো রাস্তাই নেই।আমি ঈশ্বররূপী অবয়বহীন এক অকল্পনীয় শক্তির আধারকে  মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি কিন্তু ধর্মের আড়ম্বরকে অস্বীকার করি।এতে আমি আস্তিক না নাস্তিক বোঝানো কঠিন।সেই কথাই বৈশাখীকে বলাতে ও হো হো করে হেসে উঠলো" তুই দেখছি দিন দিন দার্শনিক হয়ে যাচ্ছিস।"

পথচলতি এক পাঞ্জাবি ভদ্রলোক আমাদের অবস্থা দেখে হেসে একজন পোর্টার নিতে উপদেশ দিলেন।পোর্টারের অপেক্ষায় কিছুক্ষন পাথরের ওপর বসে থাকার পর দেখি নিচ থেকে একটি ছিপছিপে ছেলে শতছিন্ন সোয়েটার পরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।কিকরে যে ও এই দুটি অশক্ত ছেলে মেয়ের খবর পেলো সেটা আমাদের কাছে রহস্য।সাইদুল নামে সেই পোর্টারটি এসে আমাদের রুকস্যাক দুটি দুহাত দিয়ে অনায়াসে  নিজের পিঠের ওপরে তুলে বৈশাখী কে বললো

"পিছে পিছে আইয়ে ম্যাডাম।" আমার মতো বলহীন পুরুষকে, যে নিজের রুকস্যাক নিয়ে পাহাড়ে উঠতে পারে না তাকে বোধহয় ইচ্ছে করেই সম্মোধন করলো না।

 ছেলেটি আমাদের জিনিস বইতে শুরু করাতে হতদ্দম অবস্থা কিছুটা হলেও কাটলো।পোর্টার ছেলেটি আমাদের থেকে কম বয়সী কিন্তু পাহাড়ি রুক্ষতা ওকে জীবনযুদ্ধে এক লড়াকু সেনানী রূপে তৈরি করেছে।ওর দুটো রুকস্যাক পিঠে নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আমাদের আগে আগে যাওয়া আমাদের  লজ্জিত করলেও আমাদের আবার নতুন উদ্যমে হাঁটাতে উৎসাহিত করলো।

উচ্চতা জনিত সমস্যা না শারীরিক অপটুতা সেটা গবেষণার বিষয়, কিন্তু এবার আমরা সত্যিই সাইদুলের পিছন পিছন বেশ দ্রুতগতিতে হাঁটছি।চারিদিক গাছপালাবিহীন শুষ্ক রুক্ষ প্রকৃতি। সরু চলার রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে উঁচুতে উঠতে লাগলাম।

রাস্তাটা একটু চড়াই উঠেই আবার কিছুটা সমতল চলেছে, তারপর আবার অনেকটা নীচে নেমে প্রায় ভাগীরথী গঙ্গার গা দিয়ে বানানো হয়েছে।আসলে মাঝে মাঝে পাহাড়ের উপর থেকে নাম ধস প্রতিবছরই রাস্তার গতিপ্রকৃতি কিছুটা পরিবর্তন করে।আমাদের সামনে বাঁ দিকে ওপর থেকে একটা ছোট্ট পাহাড়ি ঝর্ণা নিচের চলার পথে এসে পড়েছে।কয়েকটি ছেলেমেয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে।বৈশাখী একটা  ক্যামেরা নিয়ে এসেছে।ও আমার হাত ধরে ঝর্নার কাছে টেনে নিয়ে গেল।ক্যামেরাটি আমার হাতে দিয়ে নিজে ঝর্ণার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো" নে, ভালো করে কয়েকটা ছবি তোল তো।"

ছবি তোলা হতে ওর পাশে দাঁড়াতেই দেখি ও গুন গুন করে গান গাইছে

" ও ঝর ঝর ঝর্ণা,

ও রুপালি বর্ণা,

ওরে হারায়েছে প্রাণ-মন আমার-

একটুকু সর না, তুই একটুকু সর না!

ও ঝর ঝর ঝরণা।"

লতার এই বহুল প্রচলিত গানটি যে বৈশাখী এত ভালো গাইতে পারে তা জানতাম না।

আমরা চলার গতিবেগ বাড়ালাম কারণ পোর্টার ছেলেটিকে সামনে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।অনেকটা নীচে নেমে এসেছি।একদম নদীর পাশাপাশি হাঁটছি আমরা।তফাৎ যে নদী ও আমরা পরস্পরের উল্টো দিকে যাচ্ছি।আমরা চলেছি নদীর উৎসমুখে আর নদী চলেছে পাহাড়ের বুক চিরে সমতলের দিকে যেখানে হাজার হাজার বছর ধরে কোটি কোটি মানুষ তাকে অবলম্বন করে বেঁচেবর্তে আছে।উৎসমুখ থেকে নির্গত হয়ে নির্জন পাহাড়ের গিরিখাতে, কখনো ছোট জনপদ বা বনের ভিতর দিয়ে রূপসী নদীটি উপলমুখরিত পথে  নাচুনির মতো পদে পদে বেঁকে চুরে চটুল নৃত্যে বয়ে চলেছে।

এখানে বরফগলা জল বলে জল একটু ঘোলাটে।নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে পাথরের বড়ো বোল্ডার পেরিয়ে নদীর জলে হাত দিতেই তার শীতল স্পর্শে পথের ক্লান্তি যেন অনেকটা জুড়িয়ে গেল।হাতে করে জল মুখে চোখে ছিটিয়ে নিয়ে আবার যাবার রাস্তায় ফিরে এলাম।

 কিছুটা যাবার পর সামনেই শ্বেত শুভ্র শিবলিঙ্গ আর ভাগীরথী সিস্টার আরো পরিষ্কার রূপে আমাদের সামনে ধরা দিলো।আমরা প্রায় ওর পাদদেশে অব্দি যাবো।নীল আকাশের নিচে পাহাড়ের শৃঙ্গে সাদা মেঘের আনাগোনা এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করেছে।সেই নৈসর্গিক দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চললাম।পুরো চলার পথে ডান দিকে নদী ও বাম দিকে পাহাড় ।মাঝে মাঝে আমরা এতটাই উঁচু পথে উঠে পড়ছি যে গভীর গিরিখাতে গঙ্গাকে দূর থেকে দেখা যাচ্ছে।

হটাৎ হেলিকপ্টারের আওয়াজ কানে এলো।ফাঁকা জায়গায় পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে আওয়াজটা আরো জোরে আমাদের কানে এসে লাগছে।হেলিকপ্টারটি উত্তর থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে উড়ে চলে যাবার কিছুক্ষন পর দেখি উল্টো দিকে থেকে গোটা পাঁচেক ছেলেমেয়ে পিঠে রুকসাক নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে গঙ্গোত্রীর দিকে এগিয়ে চলেছে।সেই দলের দুটি যুবতী অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে চলেছে।বৈশাখী একজনকে জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে।মেয়েটি যা বললো তার সারমর্ম হলো ওদের দিল্লি থেকে দশ জনের দল আর্মির লোকেদের সাথে ভাগীরথী সামিট করতে চারদিন আগে এসেছিল, কিন্তু সামিটের আগেই দলনেতা হটাৎ অসুস্থবোধ করায় সবাই থামতে বাধ্য হয়।দলনেতা কিছুক্ষনের মধ্যেই ইহলোক ত্যাগ করেন।ওনাদের অভিযান বন্ধ করে মৃতদেহ বেস ক্যাম্পে নামিয়ে আনতে হয়।স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে হরিদ্বারে খবর দেওয়াতে হেলিকপ্টার এসে মৃতদেহ তুলে নিয়ে গেল আর বাকিরা দুটি দলে ভাগ হয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।কতদিনের পরিশ্রমে একটা অভিযান শুরু করা যায় সেটা দুর্ভাগ্যের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে যারা ভুক্তভোগী তাদের তো মন খারাপ হবেই।

সামনে হাঁটার পথে একটা সাইনবোর্ড নজরে এলো। দেখি লেখা " সাবধান, ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে পড়তে পারে।"

বৈশাখীকে বললাম " চল এই পাঁচশো মিটার তোকে রুকসাকের মতো পিঠে নিয়ে যাই।"

" ইল্লি, মজা দেখাচ্ছি।পাথর পড়লে আমার গায়েই পড়ুক আর কি।"

আমরা দুজনেই হাসতে লাগলাম।

জায়গাটা খুব সাবধানে অথচ তাড়াতাড়ি না দৌড়ে পেরোতে হবে।বাঁ দিকে পাহাড়ের অনেকটা ওপরে দেখি বেশ কয়েকটা পাহাড়ি ছাগল টপাটপ পাথরে পা দিয়ে ওপরে উঠছে। ওদের পায়ের চাপে একটা মাঝারি সাইজের পাথর প্রায় একশো ফিট ওপর থেকে আরো কিছু পাথর নিয়ে গড়িয়ে রাস্তার ওপর পড়লো।খুব অল্পের জন্য আমরা আহত হতে হতে বাঁচলাম।সামনে চেয়ে দেখি আমাদের পোর্টার বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে হাত নাড়িয়ে কিছু ইশারা করছে। তাড়াতাড়ি জায়গাটা পেরিয়ে ওর কাছে পৌঁছলে ও বললো হাত নাড়িয়ে পাথর পড়া থেকে সাবধান করছিল।

আরো কিছুটা যাবার পর দেখি সামনে একটা সবুজ বনভূমি।চারিদিকে রুক্ষতার মাঝে মরুদানের মতো এই বনভূমি আমাদের খুব অবাক করলো।কিন্তু ওটা পৌঁছনোর আগে আমাদের একটা ভয়ঙ্কর একহাত সমান সরু রাস্তা পেরোতে হবে।রাস্তাটা হয়তো বর্ষায় ভেঙে গিয়ে সরু হয়ে গেছে।ডান দিকে গভীর গিরিখাত, একটু বেচাল হলেই প্রায় পাঁচশ ফিট নীচে পড়ে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী।বৈশাখী খুব ভয় পেয়ে গেল।পোর্টার সাইদুল সামনে দাঁড়িয়ে  আমাদের সাহস জোগাচ্ছে।ও জায়গাটা পেরিয়ে আবার ফিরে এসে আমাদের দেখালো।কিন্তু বৈশাখীর ভয় আর ভাঙ্গে না।শেষে আমার হাতখানা শক্তভাবে ধরে ও জায়গাটা পেরিয়ে এলো।সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে সবুজের সমারোহ আর ঠিক তার সামনেই নীল আকাশের নিচে শ্বেত শুভ্র গিরিশিখর মনে এক অদ্ভুত সুখানুভূতির পরশ আনলো।এর জন্যই তো সবাই বছরের পর বছর হিমালয়ের দুর্গমে প্রকৃতির কোলে শান্তির খোঁজে বেরিয়ে পড়ে।

" এখানে আমার একটা বাড়ি থাকলে কি ভালো হতো।" বৈশাখী আক্ষেপ করে।

" আমার সঙ্গে তুই থাকতে চাইলে আমি বাড়ি বানানোর চেষ্টা করতে পারি।"  বলেই  আমি তাড়াতাড়ি সামনে পা বাড়িয়ে সাইদুলের পাশে পাশে হাঁটতে লাগলাম।

দুপুর প্রায় সাড়ে এগারোটা।ভুজবাসা পৌঁছতে আরো এক ঘন্টা লাগবে।জঙ্গলটা আমরা প্রায় আধঘন্টা আগেই পেরিয়ে এসেছি।জায়গাটা যে বেশ উঁচু তা  আমাদের সামনের দিকে নীচে নেমে যাওয়া রাস্তা দেখে বুঝলাম।দূর থেকে কয়েকটা রঙিন বিন্দু বিন্দু বাড়ি সমেত ভুজবাসা দেখা যাচ্ছে।

বহুদূরে গোমুখ গ্লেসিয়ারও কিছুটা আবছা নজরে এলো।আমরা দুজনে রাস্তার পাশে একটা বড় পাথরের তৈরি বেদিতে বসলাম।বৈশাখীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।ও উদাসী চোখে নীচে ভাগীরথীর দিকে চেয়ে আছে।কেমন যেন একটু দুঃখী দুঃখী ভাব।মাথার টুপিটা অনেক আগেই ও খুলে ফেলেছিল।ঘামে ভেজা মুখের ওপর ওর মাথার অনেকগুলো চুল এসে পড়াতে ওকে আরো সুন্দর লাগছে।দুপুরের গরমে আর হাঁটার পরিশ্রমে ও জ্যাকেটের জিপটা অনেকটা নামিয়ে রাখায় ওর লাল টপটা দেখা যাচ্ছে।

" আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যে তুই একা একা আমার সাথে এই দুর্গম পাহাড়ে চলেছিস।তুই কি ঝগড়া ঝাটি করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিস?"আমি বৈশাকীকে জিজ্ঞাসা করি।

" দিল্লিতে চাকরি করতে করতে একদম হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।বাবা মা প্রতিদিন সকাল থেকে রাত্রি অবধি বিয়ে বিয়ে করে পাগল করে দিচ্ছে।শেষে দুত্তোরি বলে মেজাজটা ঠান্ডা করতে একাই বেরিয়ে পড়লাম।"

" মাসীমারা খারাপ কি বলেছে?মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছে।বিয়ে তো করতেই হবে।তা সে আমায় কর বা রাম,শ্যাম,যদু যাকেই কর, কিন্তু বিয়ে করাটা তো একটা তোর অবশ্য কর্তব্য এর মধ্যে পড়ে।"

"তুই আবার বাজে বকা শুরু করেছিস।তুই তো এখনো একটা ভালোমতো চাকরিও জোটাতে পারলি না আবার আমাকে বিয়ের কথা ভাবছিস।"

" করবি, করবি আমাকে বিয়ে করবি।ঠিক বলছিস তো।চাকরি আমার হয়ে যাবে। মেয়েদের ঠিক বিশ্বাস করা যায় না।"

" চল ওঠা যাক।যতক্ষন বসবো তুই আমাকে বিরক্ত করে যাবি।" বৈশাখী আমায় তাড়া লাগলো।আমরা এগোতে শুরু করতেই পোর্টার ছেলেটি কোন পাহাড়ের খাঁজ থেকে বেরিয়ে আমাদের সাথে হাঁটায় যোগ দিল।আর কিছুক্ষন হাঁটলেই ভুজবাসা তারপর আরো চার কিলোমিটার দূরে গোমুখ। কিছুক্ষন আগের দেখা প্রায় মেঘহীন নীল আকাশটা হটাৎ যেন মেঘে ঢাকতে শুরু করেছে। সাইদুল আকাশ পানে চেয়ে বললো " বারিষ আয়েগা।"

আমরা তাড়াতাড়ি পা চালালাম।প্রায় হনহন করে হেঁটে অনেকটা ওপর থেকে নেমে ভুজবাসা পৌঁছতে হবে।ওখানেও থাকার কোনো বন্দোবস্ত করিনি।

আর প্রায় মিনিট পনেরো পরই ভুজবাসা পৌঁছব, দেখি দূর থেকে একটি ঘোড়ায় চড়ে এক চেনা মহিলা আমাদের রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছেন।আরে লাচমি দেবী না।উনি গোমুখ দর্শন করে ফিরে আসছেন।পাশে পাশে সহিস ছেলেটি হাঁটছে।আমাদের সামনে আসতেই লাচমি দেবী ফোকলা দাঁতে আকর্ণবিস্তৃত হাসি হাসলেন।

" সাপনা পুরা হো  গিয়া বেটা।গঙ্গা মাইজি কা ধরতি পর আনা আউর সাগর মে মিলনা ময় দোনোই দেখ লিয়া।" 

লাচমি দেবীর নজর এবার বৈশাখীর ওপর গেল।গতকাল রাতে উনি বৈশাখী কে দেখতে পাননি।তাই একরাস প্রশ্ন নিয়ে একবার আমার দিকে আর একবার বৈশাখীর দিকে তাকিয়ে একটু সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন " বহু হায় তুমাহরা?"

" নাহি নাহি।" বৈশাখী প্রতিবাদ করে" দোস্ত হায়।" আমার মনে সকালের প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিল।দুই মহিলার মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি।মনে মনে ভাবলাম একজন পরম আস্তিক।ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস নিয়েই একা বেরিয়ে পড়েছেন ভারতের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত।ঈশ্বর বিশ্বাসে উনি খুশি ও সুখী।আর একজন চরম নাস্তিক।কিন্তু কেমন যেন একাকীত্বে ভোগে।আস্তিক ভাবে তার সাথে ঈশ্বর আছে।নাস্তিকের যুক্তি ও বিজ্ঞানভাবনা  ঈশ্বর অবিশ্বাসী করার সাথে সাথে তাকে বড় একাকী করে দেয়।নাস্তিক পথে বেরোয় জগৎ উপভোগ করতে।লাচমি দেবীও বেরিয়েছেন জগৎ দেখতে কিন্তু ঈশ্বরের তৈরি জগৎ দেখতে যেখানে প্রতিটি জিনিসে উনি ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি করেন।

লাচমি দেবীকে নমস্কার করে আমরা দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললাম।আকাশ প্রায় কালো হয়ে এসেছে।মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকের সাথে বাজ পড়ছে।বাজ পড়ার কড়কড় আওয়াজ পাহাড়ের চূড়ায় প্রতিধ্বনিত হয়ে হৃদয়ে একটা কম্পন সৃষ্টি করলো।একটা সাঁ সাঁ আওয়াজ দিয়ে জোরে হওয়া বইতে শুরু করেছে।এক দু ফোঁটা বৃষ্টির জল মাথায় পড়লো।আমাদের সাথে প্লাস্টিকের কভার আছে রুকস্যাকে, যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে বার করবো।

দ্রুতপায়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির মধ্যেই আমরা ভুজবাসায় হাজির হলাম।লালবাবার আশ্রমে গিয়ে দেখি কয়েকজন এদিকে ওদিকে বসে আছেন।দুপুরে বিনাপয়সায় খিচুড়িভোগ যে কেউ পেতে পারে।আর রাত্রে থাকতে গেলে লম্বা দালানে চারটে কম্বল নিয়ে শুয়ে পড়তে পারা যায়। সামনেই প্রায় একশো মিটার দূরে সরকারি লজ।আমরা সেখানে হাজির হয়ে দেখলাম সাকুল্যে দুটো ডরমিটারি  আর দুটো রুম আছে।ছেলেদের আর মেয়েদের আলাদা ডরমিটারি।আমরা দুটো বেড বুক করলাম।আকাশ তখনও কালো হয়ে আছে, তবে তেমন বৃষ্টির দেখা নেই।দুপুরের খাবার খেয়ে চার কিলোমিটার দূরে গোমুখ যাবার জন্য তৈরি হলাম।সাইদুল আর আমাদের সাথে যাবে না।ছেলেটি লালবাবার আশ্রমের দিকে চলে গেল।ডরমিটারিতেই রুকসাক রেখে দুটো প্লাস্টিকের কভার আর একটা ছাতা সাথে নিয়ে দুর্যোগের মধ্যেই রওনা দিলাম।সরকারি টুরিস্ট লজ থেকে বেরিয়েই একটা বিরাট চড়াই ভাঙতে হবে।সবে ভরপেট দুপুরের খাওয়ার পর সেই চড়াই ভাঙতে আমাদের তখন প্রাণান্তকর অবস্থা।চড়াইটা পার হতেই দূরে গোমুখ দেখা গেল। পাকদন্ডি রাস্তা দিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার যাবার পর শেষ এক কিলোমিটার পাথরের বোল্ডার পেরিয়ে গোমুখের সামনে পৌঁছতে হয়।অনেকে দেখি গোমুখ দর্শন করে ফিরে আসছে।

আমরা লাঠি হাতে আস্তে আস্তে এগোতে শুরু করতেই  আকাশের পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে শুরু করলো।প্রথমে বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি তারপর মুষলধারে শুরু হলো।আমরা দুজনেই প্লাস্টিকের কভার পরে পাহাড়ের খাঁজে পাশাপাশি উবু হয়ে বসে পড়লাম।প্রায় মিনিট পনেরো বৃষ্টির পর  বৃষ্টি থামলেও একটু পরেই আবার শিলাবৃষ্টি শুরু হতে আমরা ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম।বাইরের ঠান্ডা আমাদের গরমের মোটা কাপড়, জ্যাকেট ভেদ করে যেনো ভিতরে প্রবেশ করলো।এমনিতেই বৃষ্টিতে শরীরের নিম্নাঙ্গ জলে ভিজে গেছে তার ওপর শিলাবৃষ্টি পরিস্থিতি যেন অসহ্য করে তুলল।

" আজ আর আমাদের গোমুখ দর্শন বোধহয় হলো না।" আমি হতাশ হয়ে বৈশাখীকে বললাম।

" কি করবি? এতটা এসে আবার ভুজবাসা ফিরে যাবি? আরেকটু ওয়েট করি বরং।"

পুরো প্রান্তর, রাস্তা, ভাগীরথীর ধার অব্দি শিলাবৃষ্টিতে সাদা হয়ে গেছে।পিছন দিকে তাকিয়ে দেখি শিলাবৃষ্টির জন্য দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছে না।মনে হয় ভুজবাসাতেও খুব বৃষ্টি পড়ছে।

বেশ অনেকক্ষন অপেক্ষা করার পর বৃষ্টি থামল ও প্রায় মিনিট দশেকের মধ্যেই রোদ দেখা দিল।সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিমাকাশে গমন শুরু করেছে।আমরা আবার লাঠিহাতে দ্রুত রওনা দিলাম।শিলাবৃষ্টির পর সমতলে বরফের টুকরোগুলো গলতে থাকে কিন্তু এখানে প্রচন্ড ঠান্ডায় সেগুলো জমাট হতে শুরু করেছে এবং ওর ওপর একটা পিচ্ছিল স্তর তৈরি হয়েছে যেটাতে স্লিপ খেয়ে পড়ে যাবার প্রভূত সম্ভাবনা।একটাই ভালো দিক যে এখানে ডান দিকে কোনো গিরিখাত নেই।আমরা চলার গতি কমাতে বাধ্য হলাম।

আর এক কিলোমিটার দূরেই আমাদের গন্তব্য স্থল।মূল রাস্তা থেকে এবার পাথুরে নদীর ধারে নামতে হলো।প্রতি পদক্ষেপেই পা মচকে যেতে পারে।বৈশাখী এগিয়ে এসে আমার হাত ধরলো।

আমাদের সামনেই গোমুখ গ্লেসিয়ার।একটা গুহার মতো মুখ দিয়ে অবিরত বরফগলা জল বেরিয়ে আসছে।মাঝে মাঝে কড় কড় শব্দে গ্লেসিয়ারের বরফের চাঁই ভেঙে পড়ছে।অজস্র বরফের টুকরো ভাগীরথী গঙ্গার জলে ভেসে ভেসে বয়ে চলেছে।বেশ বড় বড় বরফের টুকরো এদিক ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।এমনিই একটা বিশাল বরফের টুকরোর ওপর আমরা দুজনে বসলাম।আমাদের মুখ গোমুখের দিকে। সামনেই ওপর দিকে তাকালে আকাশচুম্বী শিবলিঙ্গ পর্বত আর ঠিক তার ডানদিকে তিনটি ভাগীরথী সিস্টার শৃঙ্গ।পড়ন্ত সূর্যের আলোয় সুউচ্চ বরফ ঢাকা  শৃঙ্গগুলির চকচক করছে।সামনের গ্লেসিয়ারের বরফগুলি ঠিক সাদা নয় বরং মেঠো রঙের।ধুলোমিশ্রিত বরফের জন্যই বোধহয় ওগুলি সাদা নয়।আকাশ আবার পরিষ্কার হয়ে তার পুরোনো গাঢ় নীল রঙে ফিরে গেছে।

গোমুখ কে বিদায় জানিয়ে আবার আমরা ফেরার পথে রওনা দিলাম।শিলাবৃষ্টির জন্য বরফ ঢাকা পিচ্ছিল পথ খুব সাবধানে পেরিয়ে যখন আমরা ভুজবাসা পৌঁছলাম তখন সূর্য পাহাড়ের পিছনে ঢলে পড়েছে।বরফঢাকা শৃঙ্গগুলির আলোর খেলা একটু আগেই শেষ হয়েছে।সোনা রং থেকে আগুনে রং ও সবশেষে রুপালি রঙে ওরা যখন হোলিখেলা করছে তখন মনে হলো সেই হোলির রং যেন বৈশাখীর মনকেও রাঙিয়ে দিয়েছে।

সন্ধ্যা আটটা নাগাদ রাত্রের খাওয়া শেষ হয়ে গেল।বাইরে খোলা জায়গায় বনফায়ার শুরু হয়েছে।শুকনো কাঠগুলো চিট পিট করে জ্বলছে আর আগুনের ফুলকি অনেক অনেক উঁচুতে ঘুরতে ঘুরতে উঠে যাচ্ছে।আমি আর বৈশাখী বারান্দায় পাশাপাশি বসে আছি।আরও কিছু বসে থাকা লোকজন আগুন নিভে যেতেই নিজেদের বিছানার আরামের আশ্রয়ে ফিরে গেল।চারিদিকে আর কোথাও কেউ নেই।কেবল একটি লোমশ কুকুর বৈশাখীর পায়ের কাছে ঘুমোচ্ছে।চাঁদের আলোয় শিবলিঙ্গ আর ভাগীরথী শৃঙ্গগুলিকে আবছা দেখা যাচ্ছে।পরিষ্কার আকাশে নক্ষত্রের ভিড়।মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।ধরিত্রীর গঙ্গা তার পাথুরে পথে কলকল শব্দে বয়ে চলেছে। বৈশাখী আমার একখানা হাতকে জোরে চেপে ধরলো। আমার এমন এক মোহ উপস্থিত হলো যেন এই অন্ধকার , এই জোৎস্নামণ্ডিত পর্বতশৃঙ্গ,এই নক্ষত্ররাজি, এই মায়াময় পরিবেশ  জগতের একমাত্র সত্যি, আর নিজেদের স্বত্তাকেও কেমন কেন মিথ্যা বলে মনে হতে লাগলো।

ছবি : ইন্টারনেট

আমার সামনে খোলা আকাশের নিচে কিছুটা দূরে ভাগীরথীর কলকল শব্দে বয়ে চলেছে। ওপরে অন্ধকার পর্বত শিখরের পিছন থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরের   অত্যুজ্জ্বল  তারা ও অগুনতি নক্ষত্ররা যেন অবাক বিস্ময়ে অতি সাধারণ নিতান্ত অকিঞ্চিতকর আমিকে লক্ষ্য করে মুচকি মুচকি হাসতে থাকলো।আমার ক্ষুদ্রতায় আমি শিহরিত হলাম।

আমি আর বৈশাখী তারা-নক্ষত্রদের সেই ভুবনমহিনী মুচকি হাসিতে  বিস্ময় ও কৌতূক অনুভব করতে করতে কখন যে হাত ধরাধরি করে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা বুঝতে পারিনি।

mukhopadhyayjaydip@ymail.com
কলকাতা





No comments:

Post a Comment