1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, March 31, 2021

অন্তরালে

 

ছবি  : ইন্টারনেট 
অন্তরালে 
বিবেক বাউলিয়া

 

এক জীবদ্দশার মধ্যে দিয়ে কোনো কোনো বাস্তবতাকে মেনে নিতে হয়। ভাগ্য হয়তো সব ক্ষেত্রে সহায় হয় না। তেমনই ঠিক এমন ভাবেই মধ্যবিত্ত পরিবারের সমস্ত রকমের মনোমত আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গিয়ে কিছু কিছু সময় তাকে বাস্তবতার কাছে সময়ের বাতাবরণে নতজানু হতে হয়।

জন্মের পর থেকে তেমন ভাবেই হয়তো কিছুটা সেইরকম বাস্তবতাকে মেনে নিতে হয়েছিল অহনা কে।আধুনিকতার প্রলেপ তার উপর পড়লেও নিজের জগৎকে সে নিজের মতো করে তৈরি করে নিয়েছিল। আর পাঁচটা মানুষের মতো তার জীবনে শখ আহ্লাদ সবই ছিল। তবুও কালের বিবর্তনে তাকে সে অবচেতন মনে বন্দক রেখেছিল। সামান্য আয়ের মধ্যে দিয়ে তাদের সংসার অতিবাহিত হয়ে যেত। বাবার অল্প আয়ের উৎস দিয়েই দুই বোন আর মায়ের সংসার চলে যায়। এত কিছু সত্ত্বেও দুই মেয়ের কাছে অভাবের প্রতিবন্ধকতা কখনই বোধগম্য হতে দেয়নি তার বাবা। অহনাকে স্কুলের গন্ডি পার করিয়ে কলেজে পড়াশুনা করতে পাঠান হয়। এইরকম একটা সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সংসারে নেমে আসে এক অযাচিত ঘটনা। সমস্ত আশা নিরাশার মাঝে এমন বিপত্তি যে তার জীবনে এসে করাল ছায়ার মতো গ্রাসিত করবে তার কোনো প্রকার আভাস টুকু তার কাছে বিন্দু মাত্র সাড়া জাগায়নি। হঠাৎ করে বাবার অসুস্থতা তার কাছে এক প্রাচীরের মতো হয়ে উঠল। এত বড়ো অসুস্থতা তার কাছে একটা বার্তা নিয়ে এল যেন সে শেষ দেখার ইচ্ছা টুকুতে তার বাবার কথায় তার বিয়েটা যেন হয়ে যায়। এই প্রশ্ন তাকে দিবারাত্র যেন উৎপাটিত করে তুলতে থাকে। নিজের কথা, আশা আকাঙ্ক্ষা সমস্ত কিছুকে সিন্দুকে বন্দক রেখে বাকি মানুষের কথা ভেবে নিমগ্ন হয়ে উঠতে লাগল। মেয়ে হয়েও পরিবারের সমস্ত বোঝা তাকে নিজে হাতে তুলে নিতে হয়। বোন সাবালিকা না হলেও তার দিকে তাকিয়ে তার বিচার বিবেচনা করে তাকে এগিয়ে যেতে হয়। মা ঘর সংসার সামলানোর পাশাপাশি দু'একটা সেলাই করে দিন গুজরান করে। যা হোক করে নুন আনতে পান্তা যাতে না ফুরিয়ে যায় তার অভাব বোধটুকু অন্তত পরিলক্ষিত হয় না।

অহনা নিজের পড়াশুনা করার পাশাপাশি ছেলে মেয়ে পড়িয়ে অর্থের জোগান দেয়। সব কিছুর পর যে টুকু তার জন্য অবশিষ্টাংশ হিসেবে থাকে তা দিয়ে তার সাধের ইচ্ছাটা কিছু ক্ষেত্রে পূরণ হয়ে যায়। রূপ লাবণ্য সব তার কাছে আছে ঠিকই কিন্তু সময়ের করতালিতে তা আগের মতো আর দীপ্তিয়মান নেই। মেয়ে হয়ে তাকে এত বড়ো আশাতীত ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে তাকে তা সেটা ভেবে দেখলেও হাসি মুখে তাকে তা বরণ করে নিতে হয়। রাতের অন্ধকার আকাশে তাঁরা থাকলেও সে আকাশ তার কাছে মেঘাচ্ছন্ন মনে হতে চায়। প্রতিদিনের জীবন তাকে যেন এক নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চার করে দিয়ে যায়। নানা প্রকারের ভাবনা চিন্তা তার মধ্যে ত্বরান্বিত হতে থাকে। আর না হোক বাবার ইচ্ছা তার বড়ো মেয়ের বিয়েটা অন্তত দেখে যাওয়ার; শারীরিক অবস্থা যেমন ভাবে দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হয় আর বেশি দিন এগিয়ে যাওয়া একেবারে দুঃসাধ্য ব্যাপার। চিন্তায় চিন্তায় মাঝে মাঝে যেন তার দু'চোখের পাতা এক হতে চায় না। বাবার চিকিৎসার খরচ, ওষুধ, বোনের খরচ, নিজের জন্য এসব সব দিকের চিন্তায় তাকে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। এত ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে হঠাৎই বাবার মৃত্যু তাকে নাড়িয়ে দেয়। সমস্ত আকাশ তার কাছে যেন মেঘাচ্ছন্ন হতে থাকে। রুঢ় বাস্তবতার পরিপন্থী হয়ে উঠে নতুন করে যেন অন্য এক জগৎকে চিনতে থাকে। সংসারে বড়ো কিছু হাল ধরার দায়িত্ব ভার তার কাছে এসে অর্পিত হয়। মনে হয় যেন এক নতুন জীবনের অধ্যায় শুরু হতে থাকে। জীবন নামক বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় যেন নতুন এক অভিজ্ঞতা দিয়ে যায়। এরই মধ্যে দিয়ে দিন চলতে চলতে থাকে। নিয়মের বেড়াজালের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে সে যেন বেরিয়ে আসতে চায়। তার সেই প্রতিদিনের জীবন যাত্রার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে আর পাঁচটা মানুষের মতো তাদের সেই জীবনের মতো অংশীদার হতে চায়। কিন্তু সারাদিনের পর বাড়িতে ফিরে এসে যেন সেই পুরাতনের সাথে পরিচিত হতে হয়। চাইলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা যায় না জেনেও তাই সে সবের সাথে আবার বোঝাপড়া করে নিতে হয়। এই ভাবে সময় অতিবাহিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে তার মায়ের  ইচ্ছা হয় এসবের মধ্যে থেকে তাকে অন্তত নিষ্কৃতি দেওয়া উচিত।

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে তার জন্য এক বিয়ের সম্বন্ধ দেখা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু তার ইচ্ছা নিজে পায়ে সে আগে না হয় দাঁড়িয়ে নিক তার পর সে সকল হয়তো ভেবে নেওয়া যাবে। কারণ তার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরতে থাকবে তার অনুপস্থিতিতে বাকি দুজনকে কেই বা দেখবে। কারণ সে নিজেকে মনে করে বর্তমান সমাজে নিজের সাবলম্বীতা তার কাছে অতন্ত্য মূল্যবান। তা না হলে শিক্ষিত হওয়ার কোনো মানে তার কাছে থাকে না। কিন্তু এমতাবস্থায় সে যেন দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার মতো অবস্থা। এভাবে নিজের পড়াশুনা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে কোনোপ্রকারের

একটা চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিল এই ভেবে যে পর গৃহে যাওয়ার পরও কিছু টাকা পয়সা মা বোনের জন্য পাঠাতে পারে। এত চেষ্টার পরেও সে একটা কথা ভাবতে থাকলো নিজের জন্য তো এত কিছু করছে নিজের ভবিষ্যতের জন্য, বিয়ের পর তারা কি মেনে নেবে। নাকি শুধু বাড়ির বউই করে রাখবে। তবুও তো হাল ছাড়া যায় না, চলতে তাকে হবেই।

কিছু দিনের মধ্যেই তার কোন এক দূরসম্পর্কের কোন এক পিসি না মাসি এসে ভালো সম্বন্ধের কথা দিয়ে গেল। একমাত্র ছেলে। মাস গেলে ভালো মতো মোটা টাকার মাইনে পায়। তাই সেই মতো এমন একটা সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে। অনেক চেষ্টার পর অহনা একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি পেয়েছে। এত কিছু শোনার পর সে দেখল বর্তমানকে তো মেনে নিতে হবে। তার পর বিয়ের পরে না হয় যদি আরও পড়াশুনা করা যায়। যদি তাদের মত থাকে। আপাতত ভাবে নিজে কিছুটা তো দাঁড় করিয়ে নিতে পেরেছে তাতেই নিশ্চিত হওয়া যায় অন্তত মা বোনের সংসার চালিয়ে নেওয়ার জন্য। বিয়ের পর ওখান থেকে না হয় টাকা পয়সা যা লাগবে তা না হয় পাঠানো যাবে।

                           অবশেষে সমস্ত দেখাশোনা আলাপ আলোচনার পর বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে থাকল। এমন সময় দাঁড়িয়ে থেকে এই রকম পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিতে হল। ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো প্রশ্ন হয়তো এখানে ওঠে না তার কাছে। শুধু একটা আক্ষেপ তার ভিতরে যেন অসম্পূর্ণ করে রাখে। আর তা হল তার তার বিয়েটা তার বাবার না দেখতে পাওয়া। এটা হয়তো তাকে বাকি জীবনটায় ভিতর ভিতর কুরে কুরে খাবে। যথারীতি ভাবে অহনার বিয়ে সম্পন্ন হল। যে টুকু সে অনুমান করেছিল তার বিপরীতটা হল। তাদের কথায় ও ভালোবাসায় সে পড়াশুনা করতে শুরু করল সংসার সামলানোর পাশাপাশি। তার কোনো কিছুরই অভাব তারা রাখেনি। নিজের মতো করে তারা তাকে পথ চলতে শিখিয়েছে। নিজের চিন্তার পাশাপাশি তার আর বাকি দুজন মানুষের কথা তার চিন্তাও আছে। মাসে মাসে নিজের খরচের থেকে কিছু টাকা পয়সা তাদের কে পাঠায়।

শ্বশুরবাড়ির ভালোবাসা তাকে পূর্ব ঘটনার ইতিহাস হয়তো ভুলিয়ে দিয়েছে তার এবং তাদের ভালবাসায়। যা সে এতটাও আশা করেনি। কিছু অপ্রাপ্য বস্তুও নিজের অজান্তে কখনো কখনো নিজের চাওয়া পাওয়ার যে কখন পাত্র হয়ে ওঠে তা সে নিজের অন্তর আত্মাও কখনো কখনো জানতে পারে না। কিছু ক্ষেত্রে তা হয়তো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তখন আর তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। এক সন্তান হওয়ার পর তাকে মানুষ করার পাশাপাশি তার স্বাভাবিক জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। কোনো অভাব তার স্বামী তাকে হয়তো বুঝতে দেয়না। ভালোলাগা ভালোবাসা তার কাছে শুধু রূপের মহিমাই নয়, তা হল ভালোবাসার কোনো মানুষ যেন ভালোবাসার মানুষকে নিজের মতো করে নিজের অন্তরে রাখতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার ভিতরে ভিতরে যেন অসম্পূর্ণতার অভাব প্রস্ফুটিত হতে থাকে। সব কিছুই তার কাছে আছে ঠিকই কিন্তু তবুও নিজের মধ্যে যেন একাকিত্বতা উদ্ভাসিত হতে থাকে। নিজের অন্তরালে যেন কিছু চাওয়া পাওয়া উঁকি দিয়ে ওঠে। সব কিছুই তার কাছে আপন মনে হলেও কোনো কিছু একটার অভাব তাকে যেন বাস্তবের পুরাতন রাস্তায় নামিয়ে আনতে বাধ্য করায়।

bibekbawlia2000@gmail.com

উত্তর চব্বিশ পরগণা




No comments:

Post a Comment