1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

কাজিরাঙ্গার তৃণভোজী

 

কাজিরাঙ্গার তৃণভোজী

দীপক কুমার মজুমদার

গৌহাটি স্টেশনে কামরুপ এক্সপ্রেসে যখন নামলাম রাত ৪টে। সম্পূর্ণ নতুন জায়গা এত রাত্রে কি করব ভাবছি তখনই একটা রিক্সাওয়ালা সামনে এসে পরিস্কার বাংলায় জানতে চাইলো কোথায় যাবো। আসাম গভর্নমেন্টের প্রশান্তি টুরিস্ট লজ, ওখানেই আমাদের বুক করা ছিল নাম বলাতেই রাজি হয়ে বললো বেশি দুরে নয় তবে ঘুরে যেতে হবে। বুঝলাম নতুন লোক ভাড়া বাড়ানোর চেষ্টা। এত রাত্রে দরাদরি না করে রাজি হয়ে গেলাম। আমরা দুই স্বামীস্ত্রী ও প্রতিবেশী দুই স্বামীস্ত্রী লাগেজ নিয়ে দুটো রিক্সায় বসে মিনিট পনেরোর মধ্যেই টুরিস্ট লজে নামলাম । রিসেপশনে লাগেজ নামিয়েছি  কিন্তু রিসিভ করার কেউ নেই। একমাত্র দারোয়ানের কাছে জানলাম রাত্রে অফিসে কেউ থাকেনা, সকাল ছটায় অফিস খুলবে। অগত্যা সোফায় বসে চারজনে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। সামান্য হতাশ হলেও লাউন্জের দেওয়ালে লাগানো কাজিরাঙ্গা জঙ্গল ও তার মাঝে গন্ডারের বিশাল ফোটোগ্রাফ দেখে মুগ্দ্ধ হয়ে গেলাম ও ভাবতে থাকি আমরা এই জঙ্গলের স্বাদ কতটা গ্রহন করতে পারবো!

লজের লাগোয়া আসাম গভর্নমেন্টের টুরিস্ট অফিস, পরের দিনের কাজিরাঙ্গা ফরেস্টের জন্য বুকিং করা হলো। সকালে বাস ছাড়বে পথে খাওয়া দাওয়া , একদম জঙ্গলের লাগোয়া খুবই মনোরম কটেজে রাত কাটানো, ভোরে এলিফ্যান্ট সাফারী , ব্রেকফাস্ট করে রিটার্ণ ও রাস্তায় কোন হোটেলে লাঞ্চ। সব মিলিয়ে একটা আকর্ষণীয় প্যাকেজ। যতটা সম্ভব সকাল সকাল কামাক্ষ্যা দর্শণ ও পূজো দিয়ে সারা দিনের গৌহাটির উল্লেখযোগ্য স্থান গুলো দেখে ক্লান্ত শরীরে টুরিস্ট লজে ফিরলাম ও আগামীকালের কাজিরাঙ্গা অভিযানের মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। 

কাজিরাঙ্গার কটেজে বেলা ৩টে নগাদ পৌঁছলাম সেখানে জঙ্গল সাফারীর জন্য ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের জীপ অপেক্ষা করছে। আমাদের লাগেজ কটেজের নির্দ্দিষ্ট রুমে রেখে তাড়াতাড়ি একটা হুড খোলা জিপে উঠে পরলাম। একটা জীপে ৬জন যেতে পারবে তাই মাঝবয়সী দুজন স্বামী স্ত্রী ও তাদের চার বছরের ছেলে আমাদের সঙ্গী হলো। বন্ধুকধারী একজন ফরেস্ট গার্ড তথা গাইড নিয়ে শুরু হলো কাজিরাঙ্গা জীপ সাফারী। জীপ সাফারীর সমস্ত খরচটাই অবশ্য প্যাকেজের বাইরে। 

জঙ্গলে ঢোকার আসাম ট্যুরিজমের বিশাল এক গেট তার নিচে কঙ্ক্রিটের দুই বিশাল গন্ডার আমাদের অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। একটু ভেতরে ঢুকেই ঘন জঙ্গল। তারই ফাঁক দিয়ে অনেক দুরে দেখা যাচ্ছে হরিণের দল আর তাই সাথে ২/৩ টে গন্ডার আপন মনে ঘাস খাওয়ায় ব্যস্ত। অনেক দুরে স্পষ্ট না হলেও তাই দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। ঘন জঙ্গলের মাঝে মেঠো রাস্তা দিয়ে একাধিক হুডখোলা জীপ পরপর এগিয়ে চলেছে। জঙ্গলের এক মাদকতা পূর্ণ গন্ধে বুঁদ হয়ে হাতে ক্যামেরা নিয়ে এগোচ্ছি আর তার মাঝেই নানান জাতের পাখির দেখা পাওয়া, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য Great Indian Hornbill, Indian Roller, Red headed Vulture, Hoopie ,Yellow Pegion ও বিভিন্ন প্রজাতির  migratory birds । পাখিদের কলরব সঙ্গে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা শব্দ , রাস্তার দুপাশে বড় বড় ঘাস (এলিফ্যান্ট গ্রাস)  কোথাও ধুসর কোথাও সবুজ , আবার কিছু দুরেই বয়ে চলা নদী তাতে নানা জাতের বকের লাফলাফি, জল থেকে উঠে কচ্ছপের রোদ পোয়ানো  পরিবেশকে আরও মোহময় করে তুলেছে। এতসবের মধ্যে এগিয়ে চললেও আমাদের দৃষ্টি কিন্তু অন্যদিকে কাজিরাঙ্গার তৃণভোজী। দুরে নদীর ওপারে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গায় দুটো গন্ডার নিজেদের খেয়ালে ঘাস খেয়ে চলেছে আর মাঝে মাঝে মুখ তুলে নিজের উপস্থিতি জানাচ্ছে। সারা দেশে এক শৃঙ্গ গন্ডারের সংখ্যা প্রায় ৩০০০ তার মধ্যে ২০০০এর বেশি আসামের কাজিরাঙ্গা অঞ্চলেই পাওয়া যায়। জলা উঁচু তৃণভুমিই গণ্ডারের বিচরন ক্ষেত্র।  

সাধারনত গন্ডার হাতি ও বুনো মোষ এই তিন প্রজাতির আপাত নিরীহ তৃণভোজীরাই কাজিরাঙ্গার মূল আকর্ষণ। এইসব ভাবছি আর এদিকে ওদিকে লুব্দ্ধ দৃষ্টিতে যে কোন জন্তুর আবির্ভাবের আশা করতে করতে এগোচ্ছি। হঠাৎই জীপটা দাঁড়িয়ে গেল আর তার সাথেই ফরেষ্ট গার্ড বন্ধুক উঁচিয়ে ফিসফিসিয়ে আমাদের স্থির হয়ে সামনে দেখতে বলায় দেখি প্রায় ৫০/৫৫ ফুট দুরে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক বিশাল সাইজের হাতি। রাস্তা আগলে শুঁড় নাড়াচ্ছে ও একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচন্ড উৎকণ্ঠার সঙ্গে আমরা সবাই স্থির ভাবে দাড়িয়ে গজরাজের হাবভাব লক্ষ করছি আর তার বিভিন্ন মুহুর্তগুলো ক্যামেরাবন্দি করে চলেছি। আমরা যে মাঝ রাস্তায় তারই জন্য আটকে গেছি সে ব্যাপারে তার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রায় ২০/২৫ মিনিট পর এইভাবেই অপেক্ষা করার পর দেখি নিজের সঙ্গিনীকে দেখতে পেয়ে একটু একটু করে বাঁদিকের ঢাল দিয়ে নামছে আর দয়া করে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিল। এতক্ষণ যে রোমহর্ষক ও উৎকণ্ঠাজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন ছিলাম তার প্রকৃত বর্ণনা করা হয়তো সম্ভব নয় তবে দীর্ঘদিন মনে থাকবে। জীপ থেকে নেমে আস্তে আস্তে বাঁ দিকে নিচে বেশ খানিকটা জলা জায়গা ঠিক সেখানেই দুটো মাদি হাতি শুঁড় নাড়াতে নাড়াতে বড় ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেল। প্রাকৃতিক পরিবেশে জঙ্গলের তথাকথিত রাজা না হলেও রাজসিক চালে চলাফেরা করছে তা সত্যিই আপ্লুত হওয়ারই মতো। আরও বেশি উত্তেজনার সম্মুখিন হতে হবে বুঝতে পারিনি। খসখস শব্দ শুনে ডানদিকে ঘাড় ঘোড়াতেই দেখি রাস্তার পাশেই উঁচু ঘাসের থেকে একটু বেরিয়ে প্রায় ৩০ ফুট দুরেই আমাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে এক পূর্ণ মাপের গণ্ডার। বেশ কয়েকটা ছবি তোলার সুযোগ করে দিয়ে হঠাৎই খুড়ের  আওয়াজ করে খটখটিয়ে উল্টোদিকে লাফিয়ে বিশাল শরীর নিয়ে ছুটতে শুরু করলো। এ এক অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা । এই মোহময় আবেশ কাটতেই আমরা জীপে এগোতে থাকলাম।

বেশ খানিকটা যাওয়ার পর রাস্তার ধারে ফাঁকা মাঠ তারই পাশে জলাভুমিতে বেশ কয়েকটা বুনো মোষের ( Wild Water Buffalo) উপস্থিতি। বড়ো বড়ো শিং নিয়ে ঘাড় নিচু করে আপাত নিরীহ এই বিশাল শক্তিধারী প্রাণীটিকে নিয়ে ভাবছি কত শান্ত ভাবে ঘোরাফেরা করছে। এদের বিশেষত্ব হলো শক্ত লম্বা দুই শিং যা ২ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। পৃথিবীতে এদের সংখ্যার প্রায় ৩৫০০ তার ৯০% ভারতেই পাওয়া যায়। যার অধিকাংশই আসামের কাজিরাঙ্গা অঞ্চলেই অবস্থান। সাধারনত জলে কাদাতেই এরা থাকতে ভালবাসে এবং ঘাসই প্রিয় খাবার।

ধীরে ধীরে দিনের আলো কমে আসছে বাধ্য হয়েই জঙ্গলের নিয়ম অনুযায়ী আমাদের বেরিয়ে আসতে হলো। এই অল্প সময়ের জঙ্গল সাফারী দীর্ঘদিন মনে থাকবে। আজকের মতো ফিরে এলেও আগামীকালের এলিফ্যান্ট সাফারীর জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। 

পরের দিন ভোর ভোর হাতির পিঠে চেপে আবার জঙ্গল ভ্রমণ। একটা বড়ো মাপের পূর্ণ বয়সের হাতিতে আমরা চারজনেই বসে বিশেষ ভঙ্গিমায় এগোচ্ছি। জীপের মতো জঙ্গলের বেশি ভেতরে না গেলেও এর রোমাঞ্চই আলাদা। লম্বা লম্বা ঘাসের ঝোপকে পাশ কাটিয়ে হাতি বা গন্ডারের যতোটা সম্ভব কাছাকাছি যেতে পারছি ও ততোধিক রোমাঞ্চিত হচ্ছি। ভোরবেলা হাতি ও গন্ডার নির্ভয়ে চড়ে বেড়াচ্ছে ও ঘাস খাচ্ছে। সত্যিই জঙ্গলপ্রিয় মানুষদের একবার অন্তত কাজিরাঙ্গায় আসা ও এইভাবে সাফারী খুবই প্রয়োজন, যা সারাজীবনের মূল্যবান স্মৃতি হয়ে থাকবে। এইভাবেই ঘন্টাখানেক হাতির পিঠে চেপে বিশেষ করে কাজিরাঙ্গার তৃণভোজীদের চাক্ষুষ করে ফিরে এলাম। 

dkmajumder2952@gmail.com



No comments:

Post a Comment