1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

অন্তরের কমলিনী

ছবি : ইন্টারনেট 

অন্তরের কমলিনী

মৌসুমী ঘোষ


জীবনে জ্ঞান হওয়া থেকে যে স্বপ্নটা মনের মধ্যে সব থেকে বেশীবার উঁকি দিয়েছে তা হলো কাশ্মীর ভ্রমণ। ভারতের ভূ -স্বর্গ দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা সারাজীবন ধরে বয়ে বেরিয়েছি । এখন বয়েস সাতষট্টি আজ সেই স্বপ্নের ট্রেন ধরার সৌভাগ্যো হলো। আমি রুদ্র প্রসাদ রায় , রিটায়ার্ড ব্যাংক অফিসার । দুই বছর হলো স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে । একমাত্র ছেলে প্রতিষ্ঠিত। বয়েস বাড়লেও অসুখ বিসুখে খুব বেশী কাবু করতে পারেনি  আমাকে।

আর এই বয়েসে একা একা ঘুরতে যাওয়ারও একটা মজা আছে।তাই মনের জোর সাথে করেই জম্মু- তাওয়া তে চেপে বসেছি । গন্তব্য জম্মু ও কাশ্মীর । লোয়ারবার্থ জানালার পাশে কম্পার্টমেন্টের যে পাশে আড়াআড়ি সিট থাকে এবং দুটো জানলা থাকে সেদিকের সিট পেয়েছিলাম এবং এই সিটটা আমার খুব প্রিয়।বেশ লম্বা করে পা ছড়িয়ে বসা যায়, জানালাটাও একার দখলে থাকে আর পুরো কম্পার্টমেন্টটা দেখা যায় ।। 

দুটো স্টেশন পরেই একসাথে তিনজন মহিলা উঠলো ঠিক আমার সামনের তিনটে বার্থে । মাঝবয়সী ই হবে । তিনজন ই প্রায় সমবয়সী । অনেকদিন পর স্টেশন থেকে একটা পত্রিকা কিনেছি, সেটাতেই মনোযোগ দেবার চেষ্টা করছি । কিন্তূ তিনজন মিলে এতো কথা বলছে যে আমার মাথা ধরে যাচ্চে। ওঠার সময় একঝলক দেখেছি , শীতকাল সবার ই মুখের বেশীরভাগ অংশ ঢাকা । আমার নিজের ও মাফলার দিয়ে ঢাকা । এটা পরিস্কার বুঝতে পারলাম যে পুরো রাস্তাটাই এদের অত্যাচার সহ্য করতে হবে ।কারণ গন্তব্য সবার একই । 

সন্ধের পর কম্পার্টমেন্টের দরজা বন্ধ হওয়ার দরুন বেশ গরম অনুভব হতে লাগল । মাফলারটা খুলে ব্যগে ঢোকালাম। হটাৎ দেখলাম উল্টো দিকের তিনজন মহিলার মধ্য একজন বেশ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । একটু পরে নিজের মুখের চাদরটা সরিয়ে এগিয়ে এসে জিগ্গেষ করলো,

" আপনাকে ভীষণ চেনা লাগছে ,কোথায় থাকেন?

আপনি কী কখনো জলঙ্গী তে ছিলেন ? "ট্রেনের আবছা আলোয় জলঙ্গী র কথা বলাতে আমিও একটু খেয়াল করে দেখতেই ভদ্র মহিলাকে চিনতে পারলাম । 

" ক.. ম.. লিনী ! কেমন আছো ?" কতদিন পর দেখছি। 

নাহ ! সেই আগের মত বুকের ভিতর কোনো শিহরন আজ আর হচ্ছে না । বরং ভালো লাগছে,

এটা ভেবে যে ও আমাকে দেখে চিনতে পেরেছে।

সেই কতদিন আগে দেখেছি ওকে, প্রায় চল্লিশ বছর পেরিয়ে গেলো । 

শেষ দেখা হয়েছিল জলঙ্গীর চরে, মিত্রদের আমবাগানে । তখন আমি সাতাশ, কমলিনীর

বছর বাইশ হবে। চাকরির পরীক্ষার জন্যে প্রিপারেশন নিচ্ছি , সারাদিন টিউশনি করি। একটু সময় পেলেই ছুটে যাই কমলিনীর কাছে। সপ্তাহের কোনো একটা দিন সময় বের করতাম দুজনেই । তবে যোগাযোগ করা মাঝে মাঝেই দু: সাধ্য হয়ে উঠতো।তখন এতো মোবাইল এর রমরমা ছিলনা তাই সব সপ্তাহ না হলেও দশ দিনে একবার কিংবা পনেরো দিনে একবার দেখা হতই । 

সেদিন ছিল দোল । কমলিনী সকালেই ডেকে পাঠিয়েছিল জলঙ্গীর চরে, "পড়ি মরি করে ছুটে

গিয়েছিলাম, গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে দু মুঠো আবীর মাখিয়ে দিয়েছিল দুই গালে। আমিও লাল

আবীরে ভরিয়ে দিয়েছিলাম ওর দুই গাল । লজ্জায় আরো লাল হয়ে গিয়েছিল । তারপরই কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বুকের ওপর "। বলেছিল, "কালকে আমাকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। চলো আমরা পালিয়ে যাই।পাত্র, বাবার বন্ধুর ছেলে। তাই বাবা এ বিয়েতে আপত্তি করবে না। আমার বিয়ে দিয়ে দেবে।" 

জলঙ্গীর চরকে সাক্ষী রেখে সেদিন আমরা দুজন পালিয়ে যাওয়ার সত্যিই প্ল্যান করেছিলাম । পরেরদিন বেলা বারোটায় ছিল ট্রেন। স্টেশনে দেখা হবে বলে কথা ছিল । কিন্তূ বাড়ি ফেরার পর মা ভাইভা পরীক্ষার লেটার ধরিয়ে দিয়েছিল বলেছিল, "কাল ভোরের ট্রেনেই তোকে কোলকাতা যেতে হবে "। একদিকে চাকরি অন্যদিকে প্রেমিকার কথা রাখা সে এক ভয়ংকর দোটানা । সারারাত ভাবার পর চাকরির পরীক্ষার ইন্টারভিউ প্রাধান্য পেয়েছিল। ভোরেই কোলকাতার ট্রেন ধরেছিলাম । 

পরের দিন খোঁজ নিয়ে জেনে ছিলাম কমলিনীর বাবা জেনে গিয়েছেন আমাদের সম্পর্কের কথা , পালানোর কথা । তাই আর রিস্ক নেয় নি । বন্ধুর ছেলের সথেই কমলিনীর বিয়ের সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছেন । কমলিনীর সাথে দেখা করার কোনো সুযোগ আর হয় নি। ওর বাবা পনেরো দিনের মধ্যেই ওর বিয়ে দিয়েছিলেন। বন্ধুর বাড়ির ছাদ থেকে লুকিয়ে দেখে ছিলাম কমলিনীর  কনকাঞ্জলি । 

আমার ইন্টারভিউ ,চাকরি এসব কোনো কথাই আর ওকে নিজের মুখে বলা হয় নি। কিংবা সব জেনেও ওর পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব হয় নি । মোটকথা আমার আর কমলিনীর প্রেম ওখানেই সমাপ্তি ঘোষনা করেছিল । তারপর আমার ব্যাঙ্কের চাকরি ,ট্রান্সফার , প্রমোশন এসবের মাঝে কমলিনী চাপা পড়ে গিয়েছিল। কোনো কোনো বৃষ্টির দুপুরে কিংবা দোলের দিন কমলিনী আসতো আমার স্মৃতিতে । ভীষণ মনখারাপে, ভীষণ আনন্দে , চরম একাকীত্বে তুমুল ভাবে কমলিনী ছুঁয়েছিল অনেক বছর । 

তারপর কবেই যেন কমলিনী লুকিয়ে পড়েছিলো আমার স্ত্রী, সুলগ্না নামের আয়নার পিছনে । সংসার, সন্তান , ব্যস্ততার চাপে পিষ্ট হয়েছিল কমলিনী। সুলগ্নার প্রতি কর্তব্যর কোনো ত্রুটি করিনি । চেষ্টা করেছি আন্তরিকতার বন্ধনে বাঁধার । তবে জীবনের প্রথম ভালবাসা যে ভুলতে পারিনি সেটা বুঝেছিলাম আমার নাতনী হওয়ার পর।কারণ আমার নাতনীর নাম রেখেছি কমলিনী।

ও জন্মাবার পর যখন নাম ঠিক করা হচ্ছিল তখন আমার মুখ ফসকে এই নামটাই বেরিয়েছিল ।

সবেমাত্র দুই বছরে পড়েছে । যদিও সুলগ্না কখনো কমলিনীকেই দেখে যেতে পারেনি । 

কমলিনী বলেছিল , "আমি ভালো আছি রুদ্র দা"।

" তুমি কেমন আছো? চুল গুলো তো সবই পাকিয়ে ফেলেছ ।তবে চেহারার খুব একটা পরিবর্তন হয় নি"। অল্প সময় পরেই, কমলিনী আমার পাশে

এসে বসায় দুজনের স্মৃতিচারনায় জমে উঠেছিল আমাদের যাত্রাপথ। একসময় জলঙ্গীর চরে

বসে দুইজন স্বপ্ন দেখেছিলাম একসাথে আসমুদ্রহিমাচল ঘুরবো । আজ বুঝি সেই স্বপ্ন পূরণের দিন। মাঝখানে শুধু বদলে যাওয়া চল্লিশবছর । 

আজ আর কোনো অনুভূতিই সেভাবে বোধ হয় না। নতুন কোনো স্বপ্নও দেখি না। প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির হিসেবের খাতাটায় হালখাতা করা হয় না নতুন করে । জম্মু কাশ্মীর ঘুরলাম ওদের সাথে । তিন থেকে চারজন হয়ে একসাথে ঘুরতে সবারই ভালো লেগেছিল । 

কমলিনীরা তিনজন মিলে একটা কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে । কিছু সমাজসেবার কাজও করে আর বছরে একবার ঘুরতে যায় একসাথে ।

কমলিনীর একটি মেয়ে, বিদেশে থাকে ।

বছর পাঁচেক হলো কমলিনীর স্বামী মারা গেছে।একাকীত্ব যাতে গ্রাস করতে না পারে। সেই জন্যে সবাই সবার মত আনন্দ করে কাজ করে।

কমলিনীর মেয়ের একটি ছেলে আছে ওকে কমলিনী রুদ্র বলে ডাকে । 

কমলিনী বলেছিল , " জীবনে এই একটি নাম ই বোধহয় সবথেকে বেশী আমার মুখে উচ্চারিত হয়েছে। " দুজনের নাতি নাতনির নাম শুনে খুব হেসেছিলাম । এক অসীম শান্তিও পেয়েছিলাম। দুজনে এটা ভেবে যে, কেউ কাউকে আপন করে পায়নি ঠিকই কিন্তূ কেউ কাউকে ভুলতেও পারিনি । দুজনেই দুজনার মনের কোণে কোথাও না কোথাও আজও আছি । 

কমলিনী আমাকে অফার দিয়েছে ওদের সাথে কাজ করার জন্যে । আমি কমলিনীর অফার সাদরে গ্রহণ করেছি । আজ কোনো বাঁধা নেই,ধরা পড়ার ভয় নেই , পরীক্ষার ইন্টারভিউ এর টেনশন নেই । শুধু আছে একে অপরের জন্যে

শুভ কামনা ।

mghoshsrp94@gmail.com
কলকাতা 

No comments:

Post a Comment