1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 12, 2022

পিছুটানে বকখালি

১১ মাথার খেজুর গাছ  ছবি : সৌমিক ঘোষ

পিছুটানে বকখালি

সৌমিক ঘোষ


জীবনের ব্যস্ততা যেন থমকে যায় বঙ্গোপসাগরের পূর্ব পাড়ে , পশ্চিম বাংলার এক সমুদ্রতটে এসে ;- যার নাম ‘বকখালি’ । এখানে নেই শহরের কলতান , হারিয়ে যায় রোজকার জীবনের শব্দ ও কথার মায়াজাল । বেলাভূমির ছোট ছোট ঢেউয়ের আলপনায় , বালিয়াড়ির উঁচু নীচু রাস্তায় অচেনা পাখির ডাকে , অজানা জলাশয়ের শালুকের বাহারে ,- মাতোয়ারা মনে নিরালা সবুজের মাঝে শুধু অবসর উপভোগ করা যায় । ছোট্ট জঙ্গলের কালচে বাদামী গাছের গুঁড়ির ফাঁকে ফাঁকে ঝাউবনের ঝিরঝিরে হাওয়ায় একটু আলগা ভালোলাগার সঙ্গসুখ বেশ লাগে । পীচের রাস্তা ছেড়ে মোরাম ও বালির পথে নিঃস্তব্ধ , নির্জন পরিসরে বা পাইনের জঙ্গলের মাঝে প্রকৃতি যেন শান্ত ও সমাহিত ।


কলকাতা থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে এই আন্তরিক বিরামের আঙ্গিনায় ১১৭ নং জাতীয় সড়কপথে পৌঁছানো যায় । রিমঝিম বৃষ্টির মাঝে বা আদুরে শীতের ছোঁয়ায় বেড়ানোর নির্ভেজাল আনন্দের খোঁজে এখানে একবার আসা যায় ।

বাসস্ট্যান্ডের সামনে বন দফতরের বাগানে অবহেলার ইঁটের রাস্তা ধরে বেড়ানো যায় । তিনটি জালের পরিসরে সবুজ ঘাসজমি আর কাদার মাঝে অলস কুমির নিশ্চল । ঘাসবিহীন ধূসর জমিতে হরিণের দল ঘোরাফেরা করে । সবুজ পাতার ফাঁকে হঠাৎই উড়ে আসে রঙিন কোন প্রজাপতি । বাগানের কেয়া ,সুন্দরী , হেতালের ঝোপে চোখে পড়ে মাটি ফুঁড়ে ওঠা শ্বাসমূলের ঝাঁক । গাছপালার ফাঁকে কালচে লাল কুসুম ফল বা অচেনা কোন রঙিন ফুলের সমারোহ বেশ ভালোই লাগে । বাগানের ফাঁকা জায়গায় বন দফতরের সুন্দর দোতলা কটেজে থাকার ব্যবস্থা আছে । কখনও বাগানে ঢোকার জীর্ণ সাঁকোর পাশে মজে যাওয়া খালে রঙিন জাল সমেত মাছধরা নৌকা চোখে পড়ে ।

সমুদ্রতটের কাছে সরকারী ট্যুরিস্ট লজ বা রেস্ট হাউসে এবং অনেক হলিডে হোমে বুকিং করে থাকা যায় । এছাড়া বাস স্ট্যান্ডের কাছাকাছি পীচ রাস্তার দুপাশে কয়েকটি হোটেলের আস্তানা ভালোই । সীজনে আগে থেকে বুক করা থাকলে ভালো ; নাহলে একটু বেশি টাকায় ব্যবস্থা হয়েই যায় । এখানেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছোট ছোট কয়েকটি খাবারের হোটেল আছে । দেশীয় বাঙালী রেসিপিতে সকালের ঘুম জাগানি চা ,প্রাতরাশ , জলখাবার , দুপুরের গুরুভোজ , সন্ধ্যার টিফিন আর রাতের হালকা মেনুতে রসনা তৃপ্ত হবেই । আবার বাজার থেকে টাটকা যে কোন মাছ বা মাংস কিনে কেজি প্রতি ৩০ বা ৩৫ টাকা দিলেই , মনপসন্দ ডিসে লাঞ্চ বা ডিনার সেরে ফেলা যায় । সন্ধ্যেবেলায় হালকা আলো আঁধারীতে বড় ছাতার তলায় বসে , সামনে সাজানো টাটকা মাছ কিনে , বেছে , পরিষ্কার করে গরম ফ্রাইয়ের সঙ্গে চা বা কফির মৌতাতই আলাদা । মেজাজটাই যেন জমিদারী আমলে পিছিয়ে যায় । কত গল্প , আড্ডা , মান-অভিমানে আর চাওয়া-পাওয়ার শব্দজালে বিভিন্ন বয়সের মানুষ-মানুষীরা বকখালির নিঃঝুম আঁধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ,- নতুন ভালোবাসার খোঁজে ।


সকালে মনোরম বকখালির নিরালা সমুদ্রতটে কিছুক্ষণ হাঁটতে ভালোই লাগে । ছোট চায়ের দোকানে গলা ভিজিয়ে , বিশেষ করে শীতের নরম রোদ গায়ে মেখে , হাঁটু জল পেরিয়ে , নৌকায় দূরের চড়ায় যাওয়া যায় । চারিদিকে নীল জলের মাঝে , ভিজে বালিতে পায়ের নকশা এঁকে দিতে মন চায় । মাঝির ডাকে সম্বিত ফেরে । আবার ফেরার পথে ,- উজানে – বকখালিতে ।

হেতাল , সুন্দরী , গেঁওয়া গাছের জঙ্গলের মাঝে অমরাবতী গ্রাম । বাস স্ট্যান্ডের ডানদিকে ইঁটের রাস্তায় , গ্রামে ঢোকার শুরুতেই , বাঁদিকে বিধ্বংসী ‘আয়লা’ ঝড়ের আগে , এক অদ্ভুত ১১ শাখার খেজুর গাছ ছিল । ‘আয়লা’-এর আগে বেড়ানোর সময় এই গাছটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ।


বিকালের হালকা রোদে ভ্যান রিক্সায় প্রায় ৮ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে হেনরি আইল্যান্ডে যাওয়া যায় ।ইঁট , পাথরে তৈরি রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ । দুপাশের ঢালু জমিতে রহস্যময় আঁধারে ঘেরা জঙ্গল । নরম কাদা মাটিতে তীক্ষ্ণ শ্বাসমূলের বিস্তৃতি । হেনরি আইল্যান্ডে রাজ্য মৎস্য উন্নয়ন নিগমের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষের প্রকল্প চলে । এখানকার বিস্তীর্ণ এলাকায় চিংড়ি এবং অন্যান্য স্বাদু ও নোনা জলের মাছের প্রতিপালন নানা আকারের ভেড়িতে করা হয় ।

                                                                                                         সমুদ্রের কাছেই ঘন জঙ্গলের সীমানায় নির্জন প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য সুসজ্জিত রঙিন তাঁবু ছাড়াও ‘গরান’ , ‘হেতাল’ , ‘গেঁওয়া’ নামের কটেজ এবং ‘সুন্দরী’ নামের তিনতলা গেস্ট হাউসে থাকা

যায় । জঙ্গলের মাঝে মজে যাওয়া খালের পাশে , সরু পায়ে চলা পথে এগোলেই গাছপালার ফাঁকে উত্তাল সমুদ্রের এক ঝলক নজরে পড়ে ।

হেনরি আইল্যান্ড থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ‘বেনফিস’ নিয়ন্ত্রানাধীনে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম ব্যস্ত মৎস্য বন্দর ‘ফ্রেজারগঞ্জ’ যাওয়া যায় । কখনও জল কাদায় ভরা কোন চাষের জমিতে , বিকালের রোদে পোকামাকড় যোগাড়ে ব্যস্ত এক ঝাঁক বক দেখা যায় । এরা যখন উড়ে যায় , তখনই সবুজের মাঝে ‘বকখালি’ নামের সার্থকতা । মাছের গন্ধ , ইতস্তত ঝাউগাছে বাতাসের স্পন্দন , কাদা জলের পাড়ে , নানা ধরনের নৌকার অলস আস্তানায় ঘেরা ফ্রেজারগঞ্জের শান্ত , নির্জনতার সৌন্দর্যটাই অন্যরকম । এখানে সারাদিনই ছোট বড় ট্রলারের ব্যস্ততা , মাছধরা জালের পরিচর্যা , নৌকা মেরামতি , ধরে আনা মাছের সংরক্ষণ , বরফ এবং নৌকা চালানোর তেলের যোগান ইত্যাদি কর্মব্যস্ততা লেগেই থাকে ।


ফ্রেজারগঞ্জের পুরোনো নাম ছিল ‘নারায়ণতলা’ । এক সময় এখানেই ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীনে বাংলার ছোটলাট এন্ড্রু ফ্রেজার সাহেবের বাগান বাড়ি । সেই বাড়ি বহুদিন আগে বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়েছে । ফ্রেজার সাহেবের স্মৃতিতে প্রায় ৭৫ বর্গ কিলোমিটারের এই বিস্তীর্ণ এলাকা ফ্রেজারগঞ্জ নামে পরিচিত । আলো আঁধারীর মাঝে কাদা জল বাঁচিয়ে , টাটকা মাছ দেখতে দেখতে কখনও চোখে পড়ে যায় , নীচের ঢালাই কংক্রিটের থামগুলোতে শামুক , ঝিনুক আর অজানা জলজ প্রাণীর বাদামী খোলকের আলপনা । ১৯৯৫ সালের ২২শে এপ্রিল এই মৎস বন্দর চালু হয়েছিল ।

মাছ ধরার এই বন্দর এলাকা ছাড়িয়ে , সোজা পথ ধরে ঝাউগাছে ঘেরা ফ্রেজারগঞ্জের নিরালা সমুদ্রতীরে সূর্যাস্তের স্মৃতি সততই সুখের । এখানে বিকেল থেকে ডিজেল পুড়িয়ে বিশাল আগুনের ঝলকানিতে কাঠকে ‘সিজন’ করে , আলকাতরা মাখিয়ে নৌকা মেরামতির কাজ চলে । দূরে কখনও কোন নৌকা ঘিরে মাছ দেখার ভীড়ও চোখে পড়ে । গোধুলীর হালকা আলোয় দিগন্তে নীল , কমলা , লাল , কালোর কত নকশা ।

ফ্রেজারগঞ্জের ঝাউবনে ঘেরা প্রাকৃতিক নিসর্গে পশ্চিমবঙ্গের অচিরাচরিত শক্তি দপ্তর “WEBREDA”-এর দায়িত্বে থাকা বিশালাকার হাওয়াকলগুলি থেকে প্রায় ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব । শীতকাল ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে চাহিদানুযায়ী এগুলি চালু থাকে ।

ফ্রেজারগঞ্জ থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে আণুমানিক ১৬ বর্গ কিলোমিটার পরিসরে জম্বুদ্বীপের বিস্তৃত বালির তটভূমিতে লাল কাঁকড়ার মঝে ও ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে বেড়ানো এখন পুলিশ ও অন্যান্য দপ্তরের নির্দেশে নিষিদ্ধ ।

বর্ষাকালে বকখালির আকর্ষণ হলো – রসনা তৃপ্তির জন্য নানা আকারের ইলিশ মাছ । আবার শীতকালে ভোরবেলায় চারিদিক খেজুর গুড়ের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে থাকে । খড় বা শুকনো ঝাউপাতার মিহি আঁচে চওড়া অ্যালুমিনিয়ামের আয়তাকার পাত্রে খেজুর রস ক্রমাগত ফুটিয়ে পাতলা নলেন গুড় , পাটালি তৈরি হয় । এই গুড়ের স্বাদ , গন্ধ , স্থায়িত্ব অসাধারণ ও দামেও বেশ সস্তা । বর্ষাকাল ছাড়া অন্যান্য সময়ে বকখালির সমুদ্রে স্নান করে আনন্দ পাওয়া যায় না । কারণ সমুদ্রতট থেকে অনেকদূর পর্যন্ত জলের গভীরতা খুবই কম । ঢেউয়ের উত্তাল রূপও সেইকারণে দেখা যায় না ।

সমুদ্রতীর থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে জঙ্গলের মাঝে দেবী বিশালাক্ষি , বন দেবী ও গঙ্গা মায়েরমন্দির দেখে নেওয়া যায় । যাতায়াতের পথে কখনও চোখে পড়ে ছোট জলায় শালুক ফুলের সৌন্দর্য , বিশাল গাছের গুঁড়ির অদ্ভুত আকার ।

ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর পাখির কিচির মিচির শব্দের পিছুটানে বকখালির প্রকৃতিতে চেনা ছোট্ট অবসরটা আনন্দের ক্যানভাসে রঙিন হয়ে ওঠে ।

 হুগলী 

 soumikghosh57@gmail.com

No comments:

Post a Comment