1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 12, 2022

কালো ব্যাগটা

ছবি  : ইন্টারনেট 
 

কালো ব্যাগটা 

উত্তম চক্রবর্তী


চেন্নাই স্টেশনে হাওড়া ম্যাড্রাস মেল ট্রেনটা এসে যখন পৌঁছল তখন ভোর সাড়ে চারটা বেজে গেছে। ট্রেনটা একটু লেট করেছে। তবে ইন্ডিয়ান রেলের ক্ষেত্রে আধ ঘণ্টা লেট কোন ব্যাপারই নয়। সাতাশ বছরের দিগন্ত এর আগেও কলকাতা থেকে চেন্নাইতে বেশ কয়েকবার এই ট্রেনে যাতায়াত করেছে। ওর সেকেন্ড ক্লাস স্লিপার কোচ থেকে সবাই একে একে নেমে যাবার পর দিগন্ত ওর সিটের নিচে রাখা সুটকেসটা বের করতে ঝুঁকে পড়ল। আর তখনই ওর চোখে পড়ে কালো রঙের চামড়ার সেই ব্যাগটা। কাল রাত সাড়ে দশটায় ওঙ্গল স্টেশন থেকে একজন মাঝবয়সী লোক উঠেছিল এই ব্যাগটা হাতে নিয়ে। দিগন্তর ঠিক ওপরের মিডল বার্থে শুয়েছিল লোকটা। কিন্তু লোকটা গেল কোথায় ?


দিগন্ত ভাবল লোকটা বোধ হয় বাথরুমে গেছে। ওর কোন তাড়া নেই। কারণ চেন্নাই থেকে ভেলোর যাবার জন্য ওর সকাল সাড়ে ছটার বাসের টিকিট অন লাইনে বুক করা আছে। এই ভোরবেলা স্টেশন থেকে কোয়েম্বাডু বাস স্ট্যান্ড যেতে ট্যাক্সিতে মাত্র কুড়ি পঁচিশ মিনিট লাগবে। এখনো অনেক সময় হাতে আছে। দিগন্ত ট্রেন থেকে সবাই নেমে যাবার পর কিচ্ছুক্ষণ অপেক্ষা করে দুদিকের বাথরুমে গিয়ে উঁকি মেরে দেখল সেই লোকটার দেখা পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু না, কোথাও লোকটার টিকিও দেখা গেলো না। এদিকে এতো সুন্দর দামী চামড়ার ব্যাগটা ছেড়ে যেতেও মন চাইছিল না ওর।


দিগন্ত ভাবল ব্যাগটা নিয়ে গিয়ে গেটের সামনে পুলিশের বুথে জমা দিয়ে বেরিয়ে যাবে। যার ব্যাগ সে নিশ্চয়ই এসে পুলিশের কাছে খোঁজ খবর নেবে। তখন পুলিশই ওকে সেটা দিয়ে দেবে। কিন্তু ট্রেন থেকে নেমে ওর সুটকেস আর কাঁধে সেই কালো ব্যাগটা নিয়ে যাত্রীদের ভিড়ে ঠেলে গেটের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে দিগন্ত দুর থেকেই লক্ষ্য করল একটা পুলিশ অন্য কারো একটা ব্যাগের চেন খুলে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। দিগন্ত চিন্তায় পড়ে গেল। এখন সবাই যে যার সুটকেস ব্যাগ নিয়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, পুলিশ কিছুই দেখছে না। কিন্তু দিগন্তর হাতের কালো ব্যাগটা যদি ওর সামনেই পুলিশ খোলে আর যদি ওরা দিগন্তকে সন্দেহ করে, তাহলেই কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। দিগন্তকে পুলিশ হাজারটা প্রশ্নে জর্জরিত করে ছাড়বে।


দিগন্ত সঙ্গে সঙ্গে মত পাল্টে খুব স্মার্ট ভাবে সুটকেস ও ব্যাগ নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলো। যেন এই ব্যাগটাও ওর নিজেরই ব্যাগ। চেন্নাই সেন্ট্রাল ষ্টেশনের সামনের বারান্দা দিয়ে ডান দিকের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে যেতে গিয়ে দিগন্ত হটাত লক্ষ্য করল বেশ কালো মোটা মত দুটো যুবক ওর পিছু নিয়েছে। দিগন্ত দেখল এ তো মহা বিপদে পড়া গেল। সামনে বাঘ তো পিছনে কুমীর ! এখন দুই দিককেই সামলাতে হবে। দিগন্ত হটাত পিছনে ফিরে উল্টোদিকে হাঁটতে থাকে। দেখে ঐ ছেলে দুটোও মুখ ঘুরিয়ে ওর আগে আগে চলতে শুরু করেছে আর মাঝে মাঝে পিছন ফিরে দেখছে ও আসছে কিনা। দিগন্ত কিছুটা এগিয়ে মাঝখানের গাড়ি চলার রাস্তায় নেমে সামনের বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়। ছেলে দুটোকে চকমা দেবার ফন্দি করে।


বড় রাস্তায় এসেই দিগন্ত একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেল। সোজা উঠে বসল তাতে আর ইংরাজিতে বলল,’ চল ভাই,  টি নগর যাব। আসলে দিগন্তর বাস ছাড়বে কোয়েম্বাডু বাস স্ট্যান্ড থেকে। কিন্তু আজ এই ছেলে দুটোকে যেভাবেই হোক চকমা দিতে হবে। কলকাতার ছেলে দিগন্ত, ওকে কি এরা অতো বোকা ভেবেছে নাকি ?  টি নগরে বাস স্ট্যান্ডে ট্যাক্সি থেকে নেমেই দিগন্ত দেখে সেই দুটো ছেলে আরেকটা ট্যাক্সি থেকে নেমে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। দিগন্ত মনে মনে একটু ভয় পেলেও যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব দেখিয়ে ট্যাক্সিওয়ালাকে ভাড়া মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ছেলে দুটো ঠিক দিগন্তর পিছনে এসে দাঁড়ায়। দিগন্তর ট্যাক্সি বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে ওদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে দিগন্তর দিকে তাকিয়ে আধা হিন্দি আধা ইংরাজিতে বলে,’ এই ব্যাগটা আপনার হাতে কেন ?এটা আমাদের বসের ব্যাগ।‘  


দিগন্ত অবাক হয়ে বলে,’ তা আপনাদের বসের ব্যাগ তো উনি গেলেন কোথায় ? আমি তো ওঁকে অনেক খোঁজা খুঁজি করে পাইনি বলেই সাথে করে নিয়ে এসেছি।‘


আরেকজন বলে উঠল,’ বস আগের স্টেশনে একটা জরুরী কাজে নেমে গেছেন। উনি আমাদের ফোন করে এটার ছবি পাঠিয়ে হোয়াটস এপ করে পাঠিয়েছেন আর স্টেশন থেকে কালেক্ট করতে বলেছেন। তাই আমরা স্টেশনে আপনার হাতে এই ব্যাগ দেখে আপনার পিছু নিয়েছি।‘ 


দিগন্তকে ওরা একটা সেল ফোনে এই একই ব্যাগের ফটো দেখাল। সাথে পরের ফটোতে ট্রেনের সেই লোকটার হাতে সেই ব্যাগটা সেটাও দেখাল। দিগন্ত দেখল এখন আর এদের ব্যাগ না দিয়ে কোন উপায় নেই। কালো ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলল,’ তা আপনারা স্টেশনেই আমাকে এই কথাটা বললে পারতেন। ওখানে না চেয়ে ট্যাক্সি করে এই এতদূরে এলেন শুধু ব্যাগটা নিতে ! আশ্চর্য লোক তো আপনারা ?‘


ছেলে দুটো ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘ তখন ওখানে আপনার পিছনেই পুলিশ ছিল তাই বলিনি। যাই হোক, ব্যাগটা আপনি নিজের কাছে রেখেছিলেন বলে ধন্যবাদ।‘ বলেই ছেলে দুটো ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে আরেকটা ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে যায়। দিগন্ত আর দেড়ি করে না। ওদের ট্যাক্সিটা চোখের আড়াল হতেই দিগন্ত আরেকটা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দেয় কোয়েম্বাডুর দিকে। মনে মনে হাসে, যা তোরা ব্যাগ নিয়ে এবার কাঁচকলা খুঁজে পাবি। আমি চললাম ভেলোরে।


দিগন্তর বাবা আজ এক বছর হল ভর্তি আছেন ভেলোরের হাসপাতালে। সুগার এবং কিডনির রোগী। অস্ত্রোপচার করে একটা কিডনি লাগানো হয়েছিল কিন্তু তাতেও উনি এখনো ঠিক হয়ে ওঠেন নি। ইদানীং রক্তে থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ায় অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে। ভেলোরে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে মাকে নিয়ে থাকে দিগন্ত। কলকাতায় একটা ছোট বেসরকারি অফিসে অল্প মায়নার চাকরি করে। এতদিনের ছুটি নিয়েছে যে ওর কোম্পানি দিগন্তকে জানিয়েছিল যে ওকে বরখাস্ত করা হল। এবার বাড়ি গিয়ে দিগন্ত ওর অফিসের হিসাব পত্র মিটিয়ে পাওনা সামান্য টাকা নিয়ে চলে এলো।  


কাল রাতে ট্রেনের সেই লোকটা উঠে যখন ব্যাগটা সিটের নিচে ঢুকিয়ে রাখে দিগন্ত তখনই লক্ষ্য করেছে যে ব্যাগে কোন তালা চাবি নেই। আজ ভোরে চেন্নাই সেন্ট্রালে ট্রেন দাঁড়াবার পর দুদিকের বাথরুম খুঁজেও সেই লোকটাকে না পেয়ে দিগন্ত সিটের নিচ থেকে ব্যাগটা টেনে বের করে চেন খুলে হাত ঢোকায়। কয়েকটা ভালো জামা কাপড় ও বাড়িতে পরার পাজামা, লুঙ্গি ফতুয়া ইত্যাদির নিচে দিগন্তর হাতে আসে একটা মোটা বাইবেল। দিগন্তর কেন যেন সন্দেহ হয়। বাইবেলের কভার পেজ ওলটাতেই দেখে ভিতরে একটা গর্ত আর সেখানে একটা দুই হাজার টাকার পাঁচটা বাণ্ডিল, মানে দশ লাখ টাকা। এক মুহূর্ত ভেবে দিগন্ত সেই বাইবেলের ভিতর থেকে টাকার বান্ডিলগুলি ওর নিজের সুটকেসে ভরে নিজের একটা ছোট তালা মেরে দেয় ঐ কালো ব্যাগটাতে। দিগন্ত সেই তালা মারা ব্যাগটাই তুলে দিয়েছে ছেলে দুটোর হাতে।


ভেলোরে এই এক বছরে দিগন্ত দেখেছে চিকিৎসার জন্য বাঙালিদের প্রচুর যাতায়াত আছে সেখানে। কয়েকটা বাঙ্গালি খাবার হোটেল আছে ঠিকই, কিন্তু দিগন্ত প্ল্যান করে এসেছে যে অফিস থেকে যেই টাকা পাবে সেটা দিয়ে ও ভেলোরে খাবার হোটেলের ব্যবসাই শুরু করবে। ভগবানই ওকে আজ ওর  ব্যাবসার পুঁজির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।     


                --------শেষ-------


 ব্যাঙ্গালোর
uttamchakraborty306@gmail.com


No comments:

Post a Comment