ছবি : ইন্টারনেট |
আকাশের সাধ
মৌমিতা
ব্যানার্জ্জী
“যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা।
নয়নে আধাঁর রবে ধেয়ানে আলোকরেখা”...
একাই যে যেতে হবে
তা মন্টু জানে।সেই কোন ছোটবেলা থেকে একাই তো পথ চলেছে সে।ছোটবেলাতেই বাবা চলে
গেলেন।বাবার খুব ইচ্ছা ছিল মন্টু পড়াশোনা করবে অনেক।কিন্ত সেই পেনখাতা ধরবার বয়সে
সে সব রেখে কারখানার মেশিন ধরতে হয়েছিল।মেশিন টেনে টেনে একসময় মন্টুর হাতে কড়া
পড়ে গিয়েছিল।হাত, পা দুই এতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল যে তার মধ্যে থেকে নরম হাতের
সেই মন্টুকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।তারপর মন্টু একটু বড়ো হতেই মা তার বিয়ে দিলো।আর
এখন সেই বউ তিন সন্তানের জননী।মন্টু ভাবে আর না।এদের মানুষ করতে হবে।ঠিক বাবা
মন্টুকে যেমনটি করতে চেয়েছিলেন।মন্টু তাই মুখবুজে গাধার খাটুনি খেটেছে।কিন্ত
কারখানাটাও হটাৎ বন্ধ হয়ে গেল। নায্য পাওনা ইত্যাদি দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরে সুমিত, অজয়, কমলরা গলার শির তুলে স্লোগান দিচ্ছিল।হটাৎ করে মালিক
কারখানাই বন্ধ করে দিলেন।আর এতগুলো বছর পরে মন্টু দেখল সে রাস্তায় এসে
দাঁড়িয়েছে।সবাই বলল নতুন কোন কাজ খুঁজে নিতে।মন্টু ও কয়েকদিন ঘুরেছিল আর তার
মধ্যেই বিজনদার একটা কথা ওর ভিতরের মন্টু টাকে একটা ঝাঁকুনি দিল।স্বাধীন ব্যাবসা করতে বলেছিল বিজনদা।নিজের মতো বাঁঁচবার
কথা বলেছিল।একটা নতুন দিশা পেয়েছিল মন্টু।তারপর এই ট্রেনে ট্রেনে জিনিস বিক্রি
করবার শুরু।ছোটবেলায় বাবা একটা কথা বলতেন প্রায়ই “মন্টু জানবি কোন কাজ ছোট বা বড়ো
হয়না।কাজ আসলে ঠিক বা ভুল হয়।দরকার শুধু সঠিক
কাজ সঠিক সময়ে মনোযোগ দিয়ে করা। শুধু কোনো ভুল পথে যাবিনা।"লেখাপড়া করে বড়ো
হতে চাওয়া মন্টু যখন কারখানায় ঢুকেছিল তখন ও এই কথাগুলোই ওকে সাহায্য
করেছিল।ব্যবসাতেও তাই। মন্টু তাই মন দিয়ে কাজ করে যায়। কাজই ঈশ্বর,জ্ঞানই ঈশ্বর,সততাই ঈশ্বর।
তারপর থেকে রোজ
সকালে মন্টু চলে আসে স্টেশনে।হাতে থাকে রুমাল,গামছা,আর ঘরকন্নার টুকিটাকি কাঁচি,ছুরি,নখকাটার।প্রথম এ রাখতো না পরে অবশ্য বাচ্চাদের লজেন্স ও রাখতে শুরু করেছিল।স্টেশন এ এলেই এক অবাক বিষ্ময়ে মন ভরে যায় ওর।কত লোক,কত রকমের কাজ।সবাই ছুটছে।কোন এক অজানা শক্তি যেন সবাই কে সচল রেখেছে।এদের
মধ্যেই কেউ হয়তো পেয়েছে আপনজন হারানোর ব্যথা,কেউ গলা অবধি
দারিদ্র্যতে ডুবে আছে।তবুও হাসছে,কথা বলছে।একখন্ড
সচল জীবন। এদের সবার আকাশ হয়তো এক নয়,আলাদা।কারুর আকাশ গাঢ় নীল,কারুর কোমল আসমানি, কারুর হয়তো মেঘলা ধূসর। এরপর একসময় এসে যায় ট্রেন।এঁকেবেঁকে যখন আসে বেশ মজা লাগে মন্টুর।ট্রেন এ চড়ার কতো শখ ছিল ওর।এখন সে রোজ ট্রেন এ
যায়।সবাই ট্রেনে ওঠার জন্য ছুটছে।নামছে যত উঠছে ততো।মন্টু দাঁড়িয়ে থাকে
কিছুক্ষণ।তারপর উঠে পড়ে এক ধারের কামরায়।এরপর ওকে প্রতি স্টেশনে কামরা পাল্টাতে
হবে।প্রথম প্রথম বেশ ভয় পেত ।যদি পা পিছলে পড়ে যায়?এখন অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছে।বেশ দক্ষতার সাথে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এক
কামরা থেকে অন্য কামরায় চলে যায়।ট্রেনে উঠেই দেখে চা নিয়ে পলাশ,পাঁপর, চিপস নিয়ে গনেশ দাও হাজির।ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসে।খদ্দের নিয়ে ওরা রেসারেসি ও করে আবার একদিন না এলে খোঁজখবর ও নেয়।মন্টু গলাটা এক
বিশেষ কায়দায় চেঞ্জ করে নেয়।এএএএএ রুমাআল চায়য়য়,গামছা চায়য়।এটাও
বিজন দার কাছে শেখা।সাধারণ ভাবে বলে নাকি জিনিস ফিরি করা যায় না।গলা এমন হতে হবে
যাতে সামনের মানুষ যতো ব্যস্তই থাকুক না কেন একবার চোখ তুলে তাকাবেই।ভাগ্য ভালো
থাকলে হয়তো বলবে 'দেখি ওই লাল রুমালটা'।তারপর একটু দরাদরি করে কিনে ফেলবে।বিজন দাও চা ফিরি করে তবে
ট্রেন এ নয়, বাসে আর বাসস্টান্ডে।বিজন দার একটা পায়ে সমস্যা।ট্রেনে
চটজলদি উঠতে নামতে পারেনা।মন্টু কামরার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত
ঘুরতে থাকে।একধারে কতগুলি স্কুলের মেয়ে।মন্টুর ভারি ভালো লাগে।ওর যদি একটা মেয়ে থাকতো।পরক্ষণেই সামলে নেয়।বৌ এর মুখটা মনে
পড়ে।বৌ ভালো কিন্তু অভাবের সংসার।তিনটে ছেলে।ওর বুক এখন মরুভূমি।মন্টু জানে মন্টু
মেয়ের কথা বললেও মুখে কিছু বলবেনা কিন্তু তাকাবে।সেই তাকানোতে ক্ষোভ আছে,অবজ্ঞা আছে,আছে নীরব কান্না।মন্টু সেই তাকানোর জবাব দিতে পারবেনা।কথার ওপর কথা দিয়ে
প্রতিবাদ চলে কিন্তু নীরবতার কোনো উত্তর হয় না।পাড়ার রকে যখন সন্ধ্যায় বসে আড্ডা
দেয় তখন রাজু,বিল্টু,দিপু ওকে ঘিরে
ধরে।রাজু বলে"গুরু তুমি তো লাকি।"এই ইংরেজি শব্দটা কোথা থেকে না জানি
শিখে এসেছিল।ওরা সবাই বলে ও খুব লাকি।ওর তিনটেই ছেলে।বিয়ে দেবার ঝামেলা
নেই।নিরাপত্তার চিন্তা নেই।মন্টু হাসে।গর্বে বুক ফুলে ওঠে।একটা ব্যাপারে তো মন্টু
হেলাফেলার নয়। হ্যাঁ এক একবার বুকটা চিনচিন করে।একটা লাল ফ্রক পরা, লাল ঝুঁটি বাঁধা কার মুখ মনে পড়ে? রুনার কি?অনেক দূর পড়তে
চেয়েছিল।বড়ো হতে চেয়েছিল।আকাশ ছুঁতে চেয়েছিল,আজ আকাশেই মিশে
গেছে।পণের দাবি মেনে বোনটার বিয়ে না দিলে হয়তো।এই হয়তো শব্দটা মন্টুকে মাঝে মাঝেই
অস্থির করে তোলে।মন্টু ভাবতে চায়না।হটাৎ ঘোর কাটে।গণেশদা ডাকছে।স্টেশন এসে গেছে
অন্য কামরায় উঠতে হবে।গণেশদার কাজ এই স্টেশন পর্যন্ত।এরপর পাঁপর,চিপস নিয়ে উঠবে হরিকাকা।ওদের নিজেদের মধ্যে জায়গা ভাগ করা থাকে।মন্টু আরো দুটি
স্টেশন যাবে।এই কামরাতে কতকগুলি কলেজের মেয়ে বসে আছে।ওদের মুখের সামনে ফোন।মাঝে
মাঝেই হেসে গড়িয়ে পড়ছে।ওদের একজন মন্টুকে দেখে আর একজনকে কিছু বলে।ওদের হাসি
ফাজলামোতে মন্টু বেশ একটা শিরশিরে অনূভুতি পায়।তখন মন্টু আরো অনেক অল্পবয়সী।সবে
রকে বসে শিসটানা শিখেছে।এরকমই একঝাঁক মেয়ের দল যেত।তাদেরই একজনকে...ওই যে কালো
চোখের জাদু বলে...তারপর তো ফুলে সাজানো গাড়িটা চলে গেল।মন্টু কেঁদেছিল।বালিশ আঁকড়ে
ধরে...তারপর সে কতকালের কথা।কাজল কালো চোখ এখন অতীত।ভাঙা বাড়ি,ভাঙা স্বপ্ন,উদয়াস্ত খাটুনি এখন অনেক বেশি জ্যান্ত।এই কামরাতে মন্টুর
কিছু বিক্রি হয়ে গেল।পরের স্টেশন আসতে এখন ও কিছুটা সময় আছে।দরজা দিয়ে বেশ ঠান্ডা
হাওয়া আসছে।মন্টু বুক ভরে হাওয়া নিল।তারপাশে বসে আছে পিলু।পিলু পুরো ট্রেন বসে বসে
ভিক্ষা করে।একদিন অবশ্য তাকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ট্রেন থেকে নেমে যেতে দেখেছিল।পিলু
কে বলতে পিলু হেসেছিল।বঁাচার এটাও এক রাস্তা।একদিন এক পুলিশের সাথে কথা বলতে দেখে
অবাক হয়েছিল মন্টু।পুলিশটিও সব জানে দেখা গেল।কারণ তার সামনে পিলুকে সোজা হয়ে
হাঁটতে দেখা গেছে।পিলু পরে বলেছিল পুলিশের নানা সময় নানারকম খবরের দরকার হয়।পিলুর মতোন কিছুজনকে তারা হাতে রাখে।পিলু মন্টুর সাথেও
ব্যবস্থা করে দিয়েছে।মন্টুকে দেখে কেন যেন তার ভালো লেগেছিল।এখন মন্টু কান খোলা
রাখে।কোনো অপরাধের কথা শুনলে বা কোন গোপন কথা জানলে জানায়।অবশ্য সবকিছুই যে জানাতে
হয় বা জানাবার পরও ব্যবস্থা নেওয়া হয় তেমনটা নয়।মন্টু এই কদিনে বুঝেছে সাধারণ কথার
থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে কি কথা হচ্ছে জানবার উৎসাহ বেশি থাকে।
কামরার মধ্যে একটা
বাচ্চা ও বাচ্চাটির মা খেলা দেখাচ্ছে।মা ঢোল বাজাচ্ছে আর বাচ্চাটি অদ্ভূত কায়দায়
একটা বৃত্তাকার রিঙের মধ্যে খেলা দেখাচ্ছে।খেলা দেখানো হয়ে গেলে বাচ্চাটা টাকা
চাইছে।পরের কামরায় মন্টু সকালের সেই গায়ককে পেলো।যে গাইছিল "যে পথে যেতে
হবে।" দুজন বৃদ্ধার সাথে বেশ ভাব হয়েছে দেখা গেল।গান শোনাচ্ছে।মন্টুর কাজের শেষ
স্টেশন এসে গেছে।নেমে পড়লো।আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে।দুপুরে দুটো খেতে হবে।দেরি করা
যাবে না।তারপর আবার বিকালের ট্রেন।লাইনের ধার দিয়ে হাঁটবার সময় একটা অস্পষ্ট শব্দ
প্রথমে তার কানে আসে।মনের ভুল ভেবে এগিয়ে চলে সে।কিন্তু না আবার একই শব্দ।জিনিসটার
দিকে এবার মনোযোগ দেয়।একটা সাদা কাপড়ে মোড়া বস্তু চোখে পড়ে।অস্পষ্ট শব্দ ওর মধ্যে
থেকেই আসছে।স্টেশনে ঘোষণা হয়ে গেছে ওই লাইন দিয়ে ট্রেন আসবে।মন্টু দেরি করলো না।
ট্রেনটা চলে
গেল।মন্টুর হাতে লাল টুকটুকে একটা সদ্যজাত মেয়ে।ওঁয়া ওঁয়া ধ্বনিতে জন্মেই তার ওপর
হওয়া অবিচারের প্রতিবাদ জানাচ্ছে অথবা অনুযোগ করছে।হয়তো এমন এক মায়ের সন্তান যার
ভালোবাসার সাহস আছে কিন্তু শিশুটিকে বাঁচানোর সাহস নেই।এমন বাবার সন্তান যার
দায়িত্ব নেওয়ার মন নেই।হয়তো এমন বাবা মায়ের সন্তান যেখানে সব আছে শুধু
কন্যাসন্তানের জায়গা নেই।মন্টু মুহুর্তের জন্য জড়িয়ে ধরে শিশুটিকে।কিন্তু মন্টুই
বা কী করবে? ও কিই বা করতে পারে?মন্টু বাচ্চাটাকে
নামিয়ে রাখবে বা স্টেশনে কাউকে গিয়ে বলবে?সেটাই তো সহজ
উপায়।মন্টু কেন অন্যের বোঝা নেবে?কিন্তু মন্টুর
হাতটা যেন পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে।ভয়ে ভয়েই বাড়ি ফেরে মন্টু।হাজার চেষ্টাতেও
বাচ্চাটাকে ফেলে দিতে পারেনি।বৌয়ের মুখটা মনে পড়ছে।মায়ের মুখটাও।কী বলবে ওরা
মন্টুকে?গালি দেবে?পাড়ার আড্ডার রাজু,বিল্টুদের কথাও মনে পড়ে।আর ওরা মন্টুকে লাকি বলবে না।কিন্তু মন্টু যেন পাথর
হয়ে গেছে।হঠাৎ বুকটা খালি হয়ে যায়।মা আর সুলতা দাঁড়িয়ে।মন্টু মন্ত্রপড়ার মতো করে
বলে সব বৃত্তান্ত।কিন্তু মন্টুকে অবাক করে তার হাত থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে সুলতা ঘরে
ঢুকে যায়।মন্টু কাতর ভাবে বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে।ভিতরে যেতে সাহস হয়না।
কিছুক্ষণ পরে ঘনঘন শঙখধবনি শুনে ঘরে এসে দেখে এক পরম মমতায় দুধ গরম করে সুলতা খাইয়ে দিচ্ছে আর মা শাঁখ বাজাচ্ছে আবিরাম।শিশুটিও এই পৃথিবীর বিষ্ময়কে দুচোখ ভরে দেখছে।জন্ম নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অনেক কিছু দেখেছে।চরম অনাদরের পর এই চরম অভ্যর্থনা।তার কান্না থেমে গেছে।বিল্টু,রাজুরা এসে গিয়েছিল।মন্টু মুখ নামিয়ে চলে যাচ্ছিল কিন্তু রাজু এসে পিঠে হাত রেখে হাসিমুখে বললো "গুরু তুমি খুব লাকি"।
অদ্ভুত রহস্যময় এই
পৃথিবী।কোথাও ভাঙে কোথাও গড়ে।কারুর আকাশ হয় একটুকরো, কারুর হয়তো থাকে অনন্ত আকাশের সাধ।যোগ্যতা সেখানে বাধা হয় না।ভালোবাসা এক
সূতোয় বেঁধে রাখে।মুক্তি খুঁজেও মুক্তি পাওয়া যায় না।মুক্তির থেকেও বড়ো হয়ে ওঠে
বন্ধন।এই জগৎ হৃদয়ের টানাপোড়েন দেখে মুচকি হাসে।
---------------------------
No comments:
Post a Comment