গুডনিউজ
জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
কলেজজীবনের একবছরের সিনিয়র অশোকদার সাথে
এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি।দার্জিলিংয়ের ম্যালে ঘোড়ার বর্জ্য কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, দেখি অশোকদা পোড়া ভুট্টায় কামড় দিয়ে হতাশ
দৃষ্টিতে মেঘে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার পানে চেয়ে আছে।অনেকদিন পর হনুমান টুপি পরা দাদাকে
দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি।রোগা, চোখে পুরু
লেন্সের চশমা পরা অশোকদা পনেরো বছরে বেশ মোটাসোটা হয়েছে।চশমাটা দেখেই চিনতে
পারলাম।
দুজনে ম্যালের চায়ের দোকানে বহুদিন পরে আড্ডায় বসলাম।এক
রাউন্ড চায়ের পর দ্বিতীয় রাউন্ড চায়ের অর্ডার দেবার পরই জানতে পারলাম যে বিপত্নীক অশোকদা ওনার
একমাত্র প্রিয়তম সন্তানের পাত্রী খুঁজছেন।এ তো মেঘ না চাইতেই পানি।আমিও সুন্দরী
কন্যার জন্য হন্যে হয়ে সুপাত্রের সন্ধান করছি।অশোকদার মোবাইলে পাত্রের সোনালি রঙা
ছবিটা দেখে
কলকাতায় বউকে হোয়াটস আপ করে দিলাম।একটু পরেই
টিং করে মোবাইলে আওয়াজ হতেই দেখি বউ লিখেছে "আমার দারুণ-ণ-ণ পছন্দ।দারুন
মিষ্টি দেখতে"।ব্যাস 'ডান' বলে ডিল হয়ে গেল।দার্জিলিংয়ের ম্যালে মেঘে ঢাকা কুয়াশাচ্ছন্ন এক সকালে অশোকদা আর
আমার পাকা কথা হয়ে গেল।
" তাহলে সামনের রবিবার ভোরবেলায় শ্যামবাজার
তোদের বাড়িতে আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।একটু গলির মুখটাতে দাঁড়াস।আমি আবার ওদিকটায়
বহুদিন যাইনি।" অশোকদার আমাকে হাত তুলে ভরসা দিয়ে বললো।
" ওকে, আমরা তৈরি থাকবো।" আমার মনটা খুশি হলেও একটু খচখচ করছে।হাজার হোক ঝিনুক যুবতী
হবার পর ওর ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মেনে একটা যুৎসই পাত্রের সন্ধানে গত একবছর আমি আর
আমার স্ত্রী সারা কলকাতা তোলপাড় করে ফেলেছি।যেখানেই উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পাই
সেখানেই পাত্রপক্ষের একেকটা বায়না।অনেক সময় নিপাট শান্তসৌম্য পাত্রটিকে পছন্দ হলেও বাড়ির লোকের
রোয়াব দেখে গায়ে জ্বালা ধরে।আবার বাড়ির লোক আমাদের বেশি খাতির করলে পাত্র
ল্যাংড়া-নুলো বা বুড়ো বেরোয়।চিন্তায় চিন্তায় আমাদের রাতের ঘুম চলে গেল, আমার টাকে যে কয়েকটা চুল কালো ছিল সেগুলোতেও
পাক ধরলো ,
গিন্নির মেজাজ দিনে দিনে তিরিক্কি হতে শুরু
হলো,কিন্তু ঝিনুকের ভাগ্যে আর সুপাত্র জুটলো
না।আমরা আমাদের ভাগ্যকে দোষারোপ করি, ঝিনুকের বড় বড় নিষ্পাপ সুগভীর চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরটা হাহাকার করে
ওঠে। দেশ-বিদেশের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে হোয়াটস আপ,ফেস বুকে ঝিনুকের বিয়ে নিয়ে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যেতে লাগলাম।যদি এর-ওর মাধ্যমে
কোনো ভালো পাত্রের সন্ধান আসে।কিন্তু মনমতো ভালো সম্বন্ধ গত এক বছরে আর এলো না।
রবিবার সকাল থেকে বাড়িতে সাজ সাজ রব।এক হাঁড়ি
রসগোল্লা এসেছে।পাত্রের নাকি রসগোল্লা ভারী পছন্দ।বাড়িতে পা দিয়ে পাত্রীর মুখোমুখি
দাঁড়ানোর আগে পাত্রকে মিষ্টিমুখ না করালে হয়?আমার পাঁচ বছরের মেয়ে, তোতা ; তোড়জোড় দেখে খালি জিজ্ঞাসা করছে " কে আসবে গো আমাদের
বাড়ি?"
অশোকদা ঠিক সকাল আটটায় পাত্রকে বগলদাবা করে
হাজির হলো।আমি গলির মুখ থেকে ওদের পথ চিনিয়ে নিয়ে এলাম।পাত্রর নামটি বড়ো ভালো
লাগলো।"মুক্তো"
বাঃ।ঝিনুক আর মুক্তো একেবারে রাজজোটক।ঝিনুকের
বুকে মুক্তো চিন্তা করেই রোমান্টিকতায় আপ্লুত হলাম।
মুক্তো কিন্তু কিছুতেই আমাদের বাড়ির ভিতর
ঢুকতে চায় না।একিরে বাবা।শ্বশুরবাড়ি হতে চলেছে এটা, আর পাত্র বাড়ি ঢুকতে গররাজি।চিল্লিয়ে-মিল্লিয়ে আমাকে আর অশোকদকে ঘোল খাইয়ে
ছাড়লো।আমি আর অশোকদা অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ওকে প্রায় জোর করেই বাড়িতে ঢুকিয়ে একটা
প্লেটে গোটা দশেক রসগোল্লা দিতেই মুক্তোর মেজাজটা যেন একটু ঠান্ডা হলো।ঝিনুক দেখি
আমার বউয়ের পিছন থেকে ওর ভাবী বরকে দেখে বেশ লজ্জা পাচ্ছে।মুক্তো ওকে পাত্তা না
দিয়েই গপ গপ করে রসগোল্লা খেয়ে চললো।
আমাদের শোবার ঘরটাকেই ওদের একটু নিভৃতে
মেলামেশার জন্য বেছেছি।একটু আদর করে ঝিনুককে আমার বউ বললো" কিরে বর পছন্দ তো?এবার যা তোরা দুজনে ওই ঘরে ঢুকে পড়।নিজেদের
ভিতর বোঝাপড়া করে নে লক্ষ্মী মা আমার।"
মুক্তো আর ঝিনুক দুজনেই কিন্তু একা একা
আমাদের শোবার ঘরে ঢুকতে প্রবল আপত্তি জানালো।কিন্তু বড়দের ইচ্ছেই এখানে সব।তোতা
আবদার ধরলো " আমিও ওদের সাথে ওই ঘরে যাবো?" কিন্তু ওর দাবিও নামঞ্জুর হোলো।
জোর করে একপ্রকার ঠেলেই ওদের দুজনকে শোবার
ঘরে ঢুকিয়ে বাইরের খিল তুলে দেওয়া হতে আমি, অশোকদা আর আমার বউ চা নিয়ে বসলাম, তোতা দরজায় কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
প্রায় আধঘন্টা পরে তোতাকে অন্যঘরে পাঠিয়ে আমি
আর অশোকদা বন্ধ ঘরের দরজা খুললাম।মনে আশঙ্কা কি জানি কি অবস্থায় ওদের দেখবো।দেখি
দরজার ঠিক পিছনেই ঝিনুক বসে। দরজা খুলতেই লাফিয়ে আমার বউয়ের কোলে উঠে পড়ল। কিন্তু
মুক্তোকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।কোথায় গেল মুক্তো?আমরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়লাম।
খাটের তলার উঁকি মেরে দেখা গেল মুক্তো চুপ
করে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে।রাগ আবার কেন হলো?সব কি হয়ে গেছে?নাকি পাত্রী পাত্রকে নাপাসন্দ বলে দূর করে
দিয়েছে।কৌতুহলী তোতা পিছন থেকে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো "বাবা,ওরা কি করছে?"
তিন সপ্তাহ কেটে যেতেও ঝিনুকের আচরণে কোনো
পরিবর্তন নজরে এলো না।আমি দু সপ্তাহ পর ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম যদি কোনো 'গুডনিউজ' পাই।ডাক্তারবাবু পেট টিপে, স্টেথো দিয়ে
দেখে বললেন " নাঃ।কিছু নেই।"
"একটা আল্ট্রাসাউন্ড করে দেখলে হতো না স্যার?" আমার বোকার মতো প্রশ্ন শুনে ডাক্তারবাবু কটমট
করে তাকিয়ে বললেন
" অসময়ে 'মেট'
করালে পেটে বাচ্চা আসে নাকি?এরা মানুষের থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী।অসময়ে মেট
করে না।কি রকম লোক মশাই আপনি।সাধারণ বুদ্ধিটুকু নেই।নাঃ,কোনো মেটিং এর চিহ্নই নেই।"
আমি আকাশ থেকে পড়লাম।মেটিং এর সময়টা
ক্যালকুলেশনে ভীষণ গণ্ডগোল হয়ে গেছে।বউয়ের ওপর ভীষণ রাগ হলো।আরে এসব কি ছেলেদের
জানার ব্যাপার?ঝিনুক কবে ঋতুমতী হচ্ছে সেটাও কি আমাকেই
দেখতে হবে।ঝিনুককে
দেখেশুনে মনে হলো বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে আমার
দিকে তাকাচ্ছে।মনে মনে নিশ্চয়ই ভাবছে ' কেন বাবা এই সব বাচ্ছাকাচ্চার ঝামেলার মধ্যে আমাকে ফেলছ।এই তো দিব্বি
আছি।খাচ্ছি,
দাচ্ছি আর ঘুমোচ্ছি।তোমাদের সাথে ভাব
ভালোবাসা খেলছি।তোমাদের পায়ে পড়ি।আমাকে এসব থেকে খ্যামা দাও।'
ঝিনুককে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।বাড়ির সবাইয়ের মন
খারাপ।'গুডনিউজ'টা এবার আর হলো না।
মাস তিনেক পরের ঘটনা।দুপুরবেলায় বউয়ের ফোন
" ঝিনুক কেমন যেন করছে।এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।"
তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরে দেখি ঝিনুক অসময়ে শুয়ে
আছে।অন্যসময়ে বাড়ি এলে ভীষণ খুশি হয়।কাছে ছুটে এসে চিৎ হয়ে শুয়ে আদর খেতে
চায়।কিন্তু আজ চুপ চাপ শুয়ে রইলো।দুপুরে নাকি বমিও করেছে।সারাদিন মুখে কিচ্ছুটি তোলেনি।
ডাক্তার ঘোষকে কল করে ডাকা হলো।উনি ঝিনুকের
পেট টিপে টিপে দেখলেন।বুকে স্টেথোস্কোপ বসালেন।থার্মোমিটারে জ্বর দেখলেন।তারপর
মাথা নেড়ে হেসে বললেন
" শুভদিন আসছে।আপনারা তৈরি হোন।দিন সাতেক সময়
হাতে পাওয়া যাবে।"
এই রবিবার আমাদের অশোকদার নিউটাউনের ফ্ল্যাটে
নেমন্তন্ন।এবার কনে পক্ষের তরফ থেকে পাত্রের বাড়ি যাওয়া।দুদিন বাজার হলো।মুক্তোর
জন্য বাগবাজারের রসগোল্লা
আর অশোকদার জন্য ভালো এক প্যাকেট দার্জিলিং
চা নিয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে ঝিনুককে সাজিয়ে গুজিয়ে আমরা ট্যাক্সিতে রওনা
দিলাম।ট্যাক্সির পিছনের সিটে তোতা, আমি আর আমার বউ।আমার কোলে আদুরী ঝিনুক চলেছে।আমি ওর গলায় হাতের আঙুলগুলো দিয়ে
সুড়সুড়ি দিতে দিতে কেমন একটা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মনে মনে বললাম
" কিরে বেটি, বাচ্ছা-কাচ্চা হয়ে গেলে আবার আমাকে আদর করতে আসবি তো, না কচি কাচা গুলো নিয়েই পড়ে থাকবি?" ঝিনুক ওর বড় বড় নিষ্পাপ চোখগুলো দিয়ে আমার
মুখের পানে চেয়ে কি বুঝলো কে জানে, মনে হয় আগত 'গুড নিউজ' এর লজ্জায় জিভটা বার করে আমার নাকটা চেটে দিলো।
No comments:
Post a Comment