1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, April 17, 2022

টেলিপ্যাথি

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

 টেলিপ্যাথি

সন্দীপ মুখোপাধ্যায়


আপনার ঠিক কবে থেকে হচ্ছে এই সমস্যাটা?

তা প্রায় সপ্তাহ দুয়েক তো হবেই ডাক্তার বাবু”।

প্রথম কবে বুঝলেন”?

আমি বাজার যাবো বলে ব্যাগ নিলাম, মানিব্যাগ নিলাম, নীচে নামলাম, তারপর বেমালুম ভুলে গেলাম বাজারটা কোন দিকে। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানেন? বাড়িতে কাউকে বলিনি। বিশ্বাস করবে না”।

তারপর”?

তারপর আবার দিন তিনেক পর হল। বাড়ি থেকে বেরলাম ব্যাঙ্ক যাবো বলে। ব্যাঙ্কের বই আপডেট করাবো। ঠিক অটোতে উঠে অটোআলা যখন জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবো, আমি ব্যাঙ্ক এর নাম ভুলে গেলাম। কিছুতেই মনে পড়লো না। বাড়ি ফিরে এলাম। পরে ভাবলাম সাথে তো ব্যাঙ্কের বই ছিল। দেখে নিলাম না কেন?”

এই অবধি বলে একটু জল চাইলেন সুনন্দ বাবু। সুনন্দ সান্যাল। অবসর প্রাপ্ত সরকারী অফিসার।বাড়িতে স্ত্রী আর কন্যা। কন্যা একটি বহুজাতিক সংস্থাতে চাকরী করছে। স্ত্রী গৃহবধূ। ছোট সংসার। যোধপুর পার্কে ছোট দু কামরার ফ্ল্যাট। গত কয়েকদিন ধরেই খুব অদ্ভুত কিছু জিনিষ ভুলে যাচ্ছেন সুনন্দ বাবু। প্রথম প্রথম খুব একটা গুরুত্ব দেন নি, কিন্তু ক্রমে এটা বাড়তে থাকছে। তাই আজ বাধ্য হয়ে ডাক্তার এর কাছে এলেন। ডাক্তার খুব বেশী কিছু বললেন না যদিও। কিছু বেসিক ওষুধ দিলেন এবং কিছু কিছু কথা বলে দিলেন।ঠিক দু সপ্তাহ পর আবার আসতে বললেন। তবে কি তাঁর Alzheimer হল? এই রোগ নাকি একবার ধরলে সারেনা আর? এসব ভাবতে ভাবতে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হলেন সুনন্দ বাবু।

দিন তিনেক ঠিক চলল সব। মনে হচ্ছে ওষুধে কাজ হচ্ছে। গিন্নি জিজ্ঞেস করাতে সুনন্দ বাবু বললেন ঘুমের সমস্যা হচ্ছে, ডাক্তার কিছু হাল্কা ওষুধ দিয়েছেন।

সেদিন শনিবার। বাড়িতে সবাই রয়েছে। মেয়ের ছুটি। আড্ডা দিচ্ছিলেন সুনন্দ বাবু।

আমার অফিস থেকে একটা বাইরে যাওয়ার কথা চলছে বাবা। যদি যাই বছর খানেক এর জন্য পাঠাবে। তুমি আর মা পারবে তো থাকতে আমায় ছেড়ে? তোমরা যা বাচ্চা দুজনেই”। এই বলে খুব হেসেছিল শ্রেয়া। সুনন্দ বাবু মুহূর্তের মধ্যে বুঝলেন ওনার মেয়ে কোথায় চাকরী করেন এবং কি প্রোফাইল এ চাকরী করেন উনি সম্পূর্ণ ভুলে গেছেন।হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারছেন না।মেয়ের কথায় খালি অট্টহাসি দিয়ে কোনভাবে তিনি সেই যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলেন। বাড়িতে কি এবার বলে দেওয়া উচিত? অনেকদিন হল কিন্তু। কি করবেন ভেবে উঠতে পারছেন না সুনন্দ বাবু।

আমরা একটু বেরোচ্ছি বুঝলে? দরজাটা দিয়ে দাও। ফিরতে একটু রাত হবে”।

প্রিয়াঙ্কা, সুনন্দ বাবুর স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে বেরোল কোথাও। তাঁদের বিয়ে হয়েছে পঁয়ত্রিশ বছর হল প্রায়। প্রিয়াঙ্কা কে নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই। দিব্যি সংসারের হাল ধরে রেখেছেন এতো গুলো বছর। মেয়ে মানুষ করা, মেয়ের পড়াশুনোর দায়িত্ব সবটাই সে করেছে। সুনন্দ বাবুর বদলির চাকরী ছিল। কোথাও থিতু হতে পারলেন কই? তাই সব ঝক্কি পোহাতে হয়েছে স্ত্রীকেই। চাপা মহিলা খুব। বেশী কথা বলে না প্রয়োজন ছাড়া।

একটু কোথাও থেকে হেঁটে আসবেন কিনা ভাবছেন সুনন্দ বাবু। মাথাটা কয়েকদিন হল কিরকম থম মেরে আছে। একটু নিজেকে হাল্কা করতে হবে। এই বলে পাঞ্জাবীটা গায়ে চড়ালেন। বাইরে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে আজকে। চমৎকার পরিবেশ। একটু লেক এর দিকে ঘুরে এলে মন্দ হয় না। বাড়ির চাবি পকেটে পুরলেন। হেঁটে খুব দূর নয় লেক। সুনন্দ বাবুর স্পিড এ মিনিট দশেক। যে কোন কারণেই হোক আজ রাস্তাঘাট একটু ফাঁকা ফাঁকা। কলকাতা শহরের সেই চেনা দুরন্তপনা নেই। একটা ধার ধরে হাঁটতে লাগলেন। মন্দ লাগছে না। এতো বছর বয়স হল, এখনো সেরকম কোনও রোগ আক্রমণ করেনি। মাঝে মাঝে একটু আধটু ভুলে যাওয়া এমন কিছু চিন্তার বিষয় নয়। ডাক্তার তো বললেন সব ঠিক হয়ে যাবে।

সুনন্দ কাকু ও সুনন্দ কাকু”।

লেক এর দিকে চূড়ান্ত টার্নটা নিতে যাওয়ার সময় গলাটা কানে এলো। পেছন ঘুরে তাকালেন সুনন্দ বাবু। একটি অল্পবয়সী মেয়ে। চিনতে পারলেন না ঠিক ।

আমায় কিছু বলছেন?” মেয়েটির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন সুনন্দ বাবু।

আপনি আমায় চিনতে পারছেন না কাকু? অবশ্য চিনতে পারবেন যে সেরকম দাবী করে বলতে পারি না। আমি পরিতোষ পাল এর মেয়ে কাকু।আপনাদের বাড়ি বাবার সাথে দু এক বার গিয়েছিলাম।ভুলে গেছেন আপনি”। বেশ বোঝা গেলো মেয়েটি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে একটু।

পরিতোষ সুনন্দর স্কুল এর বন্ধু। মাঝে মধ্যে আসে সুনন্দর বাড়ি। তবে মেয়েটিকে মনে না পড়ার সাথে তাঁর এই বর্তমানের রোগের কোনও সম্পর্ক নেই। সেটা তো মেয়েটির ভার্সন শুনলেই বোঝা যাচ্ছে। একটু স্বস্তি পেলেন যেন সুনন্দ বাবু।

তুমি পরিতোষ এর মেয়ে? দেখেছ কি কাণ্ড !! একদম ভুলে মেরেছি তোমার মুখ খানা।আসলে পরিতোষ নিজেই আসে না প্রায় মাস আটেক হল।“

প্রায় বছর দেড়েক আগে এসেছিলাম আপনাদের বাড়ি কাকু। অনেক আড্ডা হয়েছিলো সেদিন। আপনি, কাকিমা আর শ্রেয়া সবাই ছিলেন। কাকিমা দারুণ চিলি চিকেন বানিয়েছিলেন। সেইসব ভুলিনি এখনো”।

সুনন্দ বাবু এতক্ষণ খুব স্বচ্ছন্দে কথা বলছিলেন। এইবার বেশ বুঝতে পারলেন ওনার এই গোটা বিষয়টা মাথা থেকে মুছে গেছে। আর ঠিক এই সময়টাই একটা চূড়ান্ত অস্বস্তি হতে থাকে। মনে হয় উল্টো দিকের মানুষটি তাঁকে চূড়ান্ত ভুল বুঝছেন। মনে না পড়ার জন্য মুখের মধ্যে একটা সহজাত প্রশ্ন চিহ্ন এসে ভিড় করে আর অবধারিত ভাবে অন্য পক্ষ তা বুঝতে পারে। একটু মুচকি হাসলেন সুনন্দ বাবু। “পরিতোষ কেমন আছে?” কথা ঘোরানোর জন্যই এই প্রশ্ন।

বাবা ভালো আছে কাকু। একদিন এসো আমাদের বাড়ি। কাকিমা আর শ্রেয়াকে নিয়ে এসো প্লিস। আড্ডা হবে খুব।" এই বলে মেয়েটি হাঁটা দিলো অন্য দিকে। সেই সময় এর মতো রক্ষা পেলেন সুনন্দ বাবু।

যা অল্প ছিল, তা এখন ক্রমেই বিস্তর হতে শুরু করেছে। খুব ঘন ঘন সব ভুলে যাচ্ছেন তিনি। কিছু একটা করতে হবে। সুনন্দ বাবু ঠিক করলেন আজ বাড়িতে গোটা বিষয়টা বলবেন। বাড়ির লোকের সবটা জানা উচিত।এইভাবে চলতে দেওয়া যায়না বিষয়টা।

সান্ধ্য ভ্রমণ সেরে যখন বাড়ি ফিরলেন তখন কোনভাবে পাওয়ার কাট হয়েছে এপার্টমেন্টে। আজকাল লোডশেডিং হয়না বলে হাতের কাছে কিছুই থাকেনা। খুব কষ্ট করে একটা মোমবাতি পেলেন খুঁজে। বাহ!! মাঝে মাঝে অন্ধকার ভারী ভালো লাগে তো। একটা চূড়ান্ত নীরবতা অন্ধকারের সমার্থক যেন। পাড়াটা চুপ করে বসে আছে। মোমবাতিটা জ্বালিয়ে বাইরের ঘরে রেখে বারান্দায় এসে বসলেন সুনন্দ বাবু। খুব ভালো লাগছে। খুব। এই সুযোগে একটু গুনগুন করে গান ধরলেন। গান তিনি মন্দ গাইতেন না, কিন্তু সেরকম সিরিয়াসলি নিলেন না কোনদিন। চোখটা একটু বুজে এসেছিল। দরজা ধাক্কানোর শব্দ। নির্ঘাত গিন্নি আর মেয়ে ফিরল। প্রচুর প্রচুর বাজার করে ফিরেছে দুজনেই। বাইরে খুব সুন্দর একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আমেজ বলে আলো না থাকার আক্ষেপ করলেন না কেউ। হাতের ব্যাগ গুলো কে একটা দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সোফায় ধপ করে বসে পড়লো প্রিয়াঙ্কা। শ্রেয়া, " খুব tired লাগছে বাবা" বলে সুনন্দ বাবুর কোলে মাথা রেখে আধ শোয়া হয়ে রইল। এই ক্ষণিকের অন্ধকার স্বামী, স্ত্রী আর কন্যাকে এক করে দিলো।

মনে মনে একটা পরিকল্পনা করছেন সুনন্দ বাবু। এই মোক্ষম সুযোগ। আজকে উনি গিন্নি কে বলবেন বিষয়টা। কি ভাবে বলবেন তাই ভাবছেন। ইচ্ছে করেই নীরবতা ভাঙলেন সুনন্দ বাবু নিজেই। “ আরে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম জানো? দেখি একজন কাকু কাকু বলে ডাকছে। পরিতোষ এর মেয়ে। নামটা ভুলে গেছি যদিও। কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না জানো? ও বলল একবার এসেছিল নাকি আমাদের বাড়ি। তোমার আর শ্রেয়ার কথা জিজ্ঞেস করলো। বলল তোমাদের নিয়ে যেতে একবার”। এইটুকু বলে সুনন্দ বাবু প্রিয়াঙ্কার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রইলেন।

পরিতোষ বাবু? তাঁর মেয়ে? আমাদের বাড়ি এসেছিল? কি বলছ কি তুমি? পরিতোষ বাবু কে?” আকাশ থেকে পড়লো প্রিয়াঙ্কা। সুনন্দ হকচকিয়ে গেলো কিছুটা। সেকি তবে পরিতোষ নামটাও ভুল করছে নাকি? ধুর এই ভুল হবে না। একটু গলা ওঠালেন সুনন্দ বাবু এবার। “ পরিতোষ, আমার স্কুলের বন্ধু পরিতোষ। আরে? একি? পরিতোষ কে ভুলে গেলে? ওর মেয়ে এলো। তুমি রান্না করে খাওয়ালে। ধুর ইয়ার্কি কর না তো”। একটু জোরেই হাসলেন সুনন্দ বাবু।

প্রিয়াঙ্কা চুপ। শ্রেয়া কখন অন্ধকারে পাশের ঘরে চলে গেছে খেয়াল করেনি কেউ। আজ একটু বেশী সময় ধরেই পাওয়ার কাট হয়েছে। হয়না তো একদম। এই অন্ধকারের মধ্যেই সুনন্দ বাবু খুব বুঝতে পারছেন প্রিয়াঙ্কা খুব উদ্বিগ্ন। প্রিয়াঙ্কা পরিতোষ কে ভুলে গেছে? হতেই পারে না। তাহলে কি? কিন্তু উনি তো পরিতোষ নামটা ভুলে জাননি। দিব্য মনে আছে পরিতোষ কে। আর ওনার মেয়ে তো বলল আমি পরিতোষ এর মেয়ে। মাথা আবার জট পাকাচ্ছে, বেশ বুঝলেন সুনন্দ বাবু। কিছু গণ্ডগোল হচ্ছে নিশ্চয়ই।

অল্প সময় সব চুপ।

আমার তোমাকে কিছু বলার আছে গো।“ খুব নিচু গলায় বললেন প্রিয়াঙ্কা।

সচরাচর এই ধরনের কণ্ঠস্বর শুনতে অভ্যস্ত নয় সুনন্দ বাবু তাঁর গিন্নির থেকে।

কি হয়েছে? কোনও সমস্যা?"

আরও পাশে এলেন প্রিয়াঙ্কা। শ্রেয়ার ঘরের দরজা বন্ধ। মোমবাতির আলোতে হাল্কা দেখা যাচ্ছে ঘরটা। রাস্তার আলোটাও এসে পড়েছে সুনন্দর মুখে।

আমি প্রায় মাস পাঁচেক হল একটা সমস্যায় ভুগছি জানো? কাউকে বলতে পারছিনা। ভাবছি এটা অসুখ না অন্য কিছু।"

" কি হয়েছে? কি সমস্যা? নির্দ্বিধায় বলো আমাকে"। স্ত্রী এর হাতটা চেপে ধরলেন সুনন্দ বাবু। উনি জানেন ভয়ানক চাপা স্বভাবের প্রিয়াঙ্কা। কিচ্ছু বলে না।

"আমার বহু ঘটনা মনে থাকছে না গো। আমি past recollect করতে পারছিনা একদম। এমন কিছু জিনিষ ভুলে যাচ্ছি যা কখনো ভুলবার কথাই নয়। এটা অনেকদিন হচ্ছে। বলতে পারছিনা কাউকে। খুব দম বন্ধ লাগছে। এই মুহূর্তে পরিতোষ এর প্রসঙ্গ উঠতেই আমি ধরা পড়ে গেলাম তোমার কাছে, তাই বলতে পারো বলে ফেললাম আজকে।" প্রিয়াঙ্কার গলা কাঁপছে ভীষণ। খুব ভেঙ্গে পড়েছে।

"আমার কি কোনও রোগ হয়েছে ? ডাক্তার দেখানো উচিত? মা কে খুব casually বলেছিলাম সেদিন এই ব্যাপারটা জানো? কাউকে তো বলতে হতো।“। একটু চুপ করে গেলো প্রিয়াঙ্কা।

মা কি বললেন? “ সুনন্দ যেন পাথর হয়ে আছে। তাও মুখ থেকে বের করলেন প্রশ্নটা।

"মা বললেন বয়স হচ্ছে তোর। এত চাপ নিশ না তো। এসব মনের ভুল। ঠিক হয়ে যাবে। এখুনি সুনন্দকে কিছু বলতে যাস না। কিছু দিন দেখ আরো। ও তোকে পাগল ভাববে। কিন্তু আজকেই তোমায় বলে ফেললাম। একটু হলেও হাল্কা লাগছে জানো?" সুনন্দ বাবু বেশ বুঝলেন যে তাঁর স্ত্রী খুব জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছেন।গলা কাঁপছে।

ঝপ করে আলো চলে এলো। আর সুনন্দ বাবু স্পষ্ট দেখতে পেলেন বারান্দার সামনে দিয়ে একটা সাদা রঙের পেঁচা উড়ে গেলো। লক্ষ্মী পেঁচা ছিল। আজো লক্ষ্মী পেঁচা দেখলে উনি প্রণাম করেন। শুভ নাকি।

...(সমাপ্ত)...


No comments:

Post a Comment