![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
প্রতিদান
বোধিসত্ত্ব ব্যানার্জ্জী
মর্গে গিয়ে সমীরণ লাশটা দেখেও চিনতে পারেনি প্রথমে। পুলিশ অফিসার লাশের কাছ থেকেই পাওয়া আইডি প্রুফ দেখানোর পর সমীরণ চিনতে পারে এটা তারই স্ত্রী নীরা। পাশে আরও একটা লাশ দেখানোই সমীরণের চিনতে আর বাকি থাকেনা এটা কে! তবুও পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখানোই তার আর কোনো সন্দেহ থাকেনা যে এটা তারই বন্ধু আকাশ।
পুলিশ অফিসার সমীরণকে বললেন, " মি: সাহা,
আপনার
স্ত্রীর লাশটা তো আপনি নিয়ে যাবেন কিন্তু আরেকটা যে লাশ আছে তার কী করবো? মানে এঁর
পরিবারের সাথে কীভাবে যোগাযোগ করবো বলতে পারেন?"
"এর তিনকূলে কেউ নেই।", সমীরণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে।
"ওহ! তাহলে তো আমাদেরকেই..."
"না! ওটাও আমিই নিয়ে যেতে চাই... যদি আপনার আপত্তি না থাকে তো!"
"লাশটা যখন আপনি শনাক্ত করছেন এবং এও বলছেন যে এর কেউ নেই তখন ঠিক আছে
নিয়ে যান!"
"ধন্যবাদ অফিসার!" তারপর কতকটা নিজেই নিজেকে বললো, "এভাবেই যদি কিছুটা
পাপস্খলন করতে পারি নিজের!"
"অ্যাঁ! কিছু বললেন?", অফিসার জিজ্ঞেস করলেন।
"না চলুন!", বলে সমীরণ চলে এলো সেই ঘর থেকে।
দশ বছরের বিবাহিত জীবন সমীরণ ও নীরার। একপ্রকার ভালোবেসে বিয়ে করলেও
পরিবারের অমতে বিয়ে করেনি তারা। দশ বছরের বিবাহিত জীবনে একটা সাত বছরের ফুটফুটে
ছেলেও আছে তাদের। জীবন তাদের ভালোই চলছিল কিন্তু হঠাৎ তাদের জীবনে ঘটলো ছন্দপতন।
তাদের এই মধুর জীবনে এলো এক তৃতীয় ব্যক্তি, সমীরণের বন্ধু
আকাশ।
আকাশ যে এর আগে কোনোদিন আসেনি তা নয় কিন্তু হঠাৎ করেই সমীরণের
বাড়িতে তার আনাগোনা বড্ড বেশি বেড়ে যায়। সমীরণ প্রথমে বুঝতে না পারলেও যখন সবটা
বুঝলো ততদিন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে নীরার সাথে কথা বলতেই নীরা ঝাঁঝিয়ে
উঠে বলেছিল, "কী দিতে পেরেছো জীবনে আমায়? দশ বছরে দুটো সোনার হার! সেটা তো আকাশ
আমায় দশ মাসে দিয়েছে!"
"আকাশ তোমায় সোনার হার দিয়েছে? আগে বলোনি তো!",
সমীরণ
অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল।
"জেনে কী করবে তুমি? মুরোদ আছে তোমার?"
"নীরা!", সমীরণ অবাক দৃষ্টিতে নীরার দিকে তাকিয়েছিল। সে
বুঝতে পারছিলনা নীরার মধ্যে এতদিন ধরে এতটা লোভ কোথায় লুকিয়েছিল, তার টের সে
ঘুণাক্ষরেও পায়নি!
"চিৎকার করবেনা। বিয়ের আগে বলেছিলে পাঁচ বছরের মধ্যে প্রমোশন হবে,
তখন
একটা ফ্ল্যাট নেব। ফ্ল্যাট তো দূরে থাক একটা নতুন গাড়ি পর্যন্ত আজ অবধি নিতে
পারলেনা। পুরনো একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি চালাচ্ছ। তুমি একটা failure!"
"নীরা তুমি এটা করার আগে একবারও ভাবলেনা আমাদের একটা সন্তান আছে,
টুকাই
আছে!"
"আছে তো থাক! তোমার কি মনে হয় আমি ওকে ওর এই 'মিডল ক্লাস'
বাবার
কাছে রেখে যাবো?"
"রেখে যাবো মানে?"
"সময় হলেই জানতে পারবে!"
সময় হয়েছিল আজকে ভোরে কিন্তু টুকাই তার 'মিডল ক্লাস'
বাবার
কাছেই ছিল। সকালবেলা উঠে নীরাকে না দেখতে পেয়ে সমীরণ বুঝতে পেরেছিল নীরা চলে
গেছে। তার কিছু করার ছিলোনা, যে মানুষটা নিজে চলে গেছে তাকে কীভাবে ফেরাবে
সমীরণ?
কিন্তু তবুও তার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সে পুলিশে মিসিং ডায়েরি করে আসে তারপর সন্ধ্যেবেলা খবর পেয়ে মর্গে যায়।
পুলিশ অফিসার বলছিলেন, "অ্যাকসিডেন্ট, কোনো ক্যামেরা
ছিলনা স্পটে তাই ধরা একটু মুশকিল এবং স্পটে উপস্থিত কেউই গাড়ীর নম্বর দেখতে
পারেনি, তাই
আরও মুশকিল।"
সমীরণ সবটা শুনে বললো, "অফিসার, বাদ দিন।
অ্যাকসিডেন্ট যখন, আর ধরা মুশকিল বলছেন যখন, বাদ দিন।
"কিন্তু..."
"আমি তো আর ফিরে পাবোনা মানুষটাকে উল্টে আরও অনেক অপ্রীতিকর কথা
বেরিয়ে আসতে পারে। আমি চাইনা এই সমস্ত কিছু আমার ছেলে পর্যন্ত পৌঁছক।"
"বেশ ঠিক আছে।"
সমীরণ বাড়ি পৌঁছতেই টুকাই তাকে চেপে ধরল "মা কোথায়?",
বলতে
বলতে। সমীরণ তাকে বলল, "মা আসছে!"
কিছুক্ষণ পর নীরা ও আকাশের লাশ এসে পৌঁছতেই হতভম্বের মতো টুকাই দেখল অনেকক্ষণ তারপর আবার প্রশ্ন করল, "মায়ের এমন কেনো হলো?"
টুকাই এর সেই প্রশ্নের উত্তর সমীরণ তিনদিন পর দিলো। পন্ডিত মশাই এর বিধান অপঘাতে মৃত্যু তাই তিনদিন পর শ্রাদ্ধ। শ্রাদ্ধের সমস্ত কাজ শেষ করে সমীরণ টুকাইকে জবাব দিয়েছিল, "তোমার মা ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানতোনা তাই এমন হলো!"
ঠিক এই কথাটাই সে ভাবছিল যখন সে মিসিং ডায়েরী করে ফিরছিল থানা থেকে তার পুরনো সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি চেপে। হঠাৎ করেই সে দেখলো রাস্তার ওপারে নীরা ও আকাশ। সামনের ডিভাইডারে ইউ-টার্ন করিয়ে সে যাচ্ছিল তাদের দিকে কিন্তু তার যে কী হলো সে জানেনা। গাড়ীর স্পিড আপনা থেকে কী বাড়তে শুরু করল যেন, তার মনে হলো না নীরাকে ক্ষমা করা যায়না। সে ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানেনা। সে ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানেনা। ভাবতে ভাবতেই হাতে হাত ধরে রাস্তা পার করার চেষ্টা করতে থাকা আকাশ ও নীরাকে সে...
নীরা বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে পড়ার পর আরও একটা গাড়ী ঠিক তার পিঠের
উপর দিয়ে চলে যায় তাকে পিষে দিয়ে। আর আকাশ ছিটকে পড়ে উল্টো দিকে। ফুটপাথের
ব্যারিকেডের হ্যান্ডেল লাগে তার মাথার পিছন দিকে। লোক জড়ো হয়ে যায় প্রায় সঙ্গে
সঙ্গেই। সমীরণ তখনও তড়িৎ গতিতে গাড়ী চালাচ্ছে। লুকিং লুকিং গ্লাসে সে নীরার
পরিণতি দেখলো আর বললো, "নীরা ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানেনা!"
...(সমাপ্ত)...
সত্যিই সবাই পারে না বা চায় না ভালোবাসার প্রতিদান দিতে। কিন্তু তবুও প্রতিদান তো দিতেই হয়।
ReplyDeleteঅসাধারণ লেখনী 👌👌👌