1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, April 17, 2022

অমলতাস

ছবি : ইন্টারনেট 

অমলতাস  

দীপক কুমার মজুমদার

একরাশ ফুলের গোছা এনে সুবিমল ধরিয়ে দিল তমসার হাতে। লাজুক ভাব নিয়ে তমশা জানতে চাইল,       'হঠাৎ আবার ফুল কেন, তাও আবার হলুদ!'  'তাতে কি , নাম জানো এটার! অমলতাস, কি রোমান্টিক নাম তাই না!'

 'ওমা তাই! তবে ভ‍্যালেনটাইন ডে তো অনেক আগেই পেড়িয়ে গেছে এখন আবার....'

সুবিমল আবেগ নিয়ে বলে ' ফেব্রুয়ারিতো এখনো শেষ হয়নি আমরা না হয় এই লাল গোলাপের বদলে হলুদ অমলতাস দিয়েই সেলিব্রেট করি।'

এবার তমসা যেন আরও একটু রোমান্টিক হয়ে উঠে আর সেটা তার চোখ মুখের চাওনিতে বুঝিয়ে দিয়ে ফুলের গোছাটাকে বুকে চেপে ধরলো। 

         তমসা আগেই পার্কে পৌঁছে গেছিল, সুবিমলের অপেক্ষায় হয়তো একটু বিরক্ত বোধ করচ্ছিল। সুবিমলের একটু দেরি হয়ে গেছে। রাস্তায় আমায় দেখতে পেয়ে পাকড়াও করলো। অনেক দিনের বন্ধু সব কথা খুলেই বললো ,  

        'দেরি হচ্ছে তাই তমসা রেগে ফায়ার হয়ে গেছে নিশ্চয়, তুই সঙ্গে থাকলে ম‍্যানেজ হয়ে যাবে। প্লিজ আমায় একটু হেল্প কর' ।

যদিও আমি কাবাবমে হাড্ডি, তাও রাজি হয়ে গেলাম।

          এতক্ষণ ওরা নিজেদের মধ্যে ব‍্যস্ত থেকে মন দেওয়া নেওয়া করছিল হঠাৎ খেয়াল হয়েছে আমি কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। সুবিমল‌ই  নিরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠলো,

          ' তমসা এই হচ্ছে দ্বীপায়ন, এর কথা তোমাকে আগেই বলেছি। আমাদের দুজনের সম্পর্ক ও সব‌ই জানে।'

তমসা একটু যেন অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে বলে,

          'ও হ‍্যাঁ দ্বীপায়নদা, আপনার কথা আগেই শুনেছি। তা একা কেন, মানে কতদিন আর এইভাবে একা থাকবেন!'

          'এই বেশ ভালো আছি।'

          'ওটা আক্ষেপের কথা। প্রেম ছাড়া জীবনের কোনো মানেই হয়না।'

          ' কি জানি, জোগাড় করতে তো পারলাম না এখনো।'

সুবিমলকে কোনো রকম সুযোগ না দিয়ে তমসাই বলে উঠলো 

          'সামনেই তো দোল - কি করছেন, কোনো প্রোগ্ৰাম নেই নিশ্চয়।'

          'না তা নেই'।

হঠাৎই সুবিমলকে জড়িয়ে ধরে তমসা আরও রোমান্টিক হয়ে আব্দার করে, 'আ্য‌ই সামনেই তো দোল, শান্তিনিকেতন যাবে, ওখানে বসন্ত উৎসবে খুবই মজা করা যাবে। আর দ্বীপায়নদাকেও নিয়ে যাবো, ওনার একটা প্রেমিকা জোগাড় করে দেবো।'

বুঝলাম আমাকে উপলক্ষ করে নিজেদের একটু বাইরে ঘুরে আসার ইচ্ছে তাই বললাম, 'তোমরা যাবে যাও, আমায় কেন।'

কিছুটা গাঁইগুঁই করে সুবিমল রাজি হলেও কন্ডিশন দেয়

         'যেতে পারি তবে দ্বীপায়নকেও যেতে হবে। বাড়িতেও কিছু বলতে তো হবে, কিরে যাবিতো!'

অগত্যা ঠিক হয়ে গেল বসন্ত উৎসবে শান্তিনিকেতন।

           সময় মতো বসন্ত উৎসবে যোগ দেওয়া ও নিজের মনের সুপ্ত বাসনা আজানা প্রেমিকার সন্ধানে শান্তিনিকেতনে আমরা তিনজনেই উপস্থিত হলাম। ফুলে ফুলে বনে বনে আজি লাগলো যে দোল। সত্যিই পলাশের লাল রঙ আর আবীরের লাল রঙ সব মিলে মিশে এখানের আকাশ আজ রঙ্গিন। আর এর সাথে যোগ হয়েছে আবিরে রাঙ্গানো শতাধিক যুবক যুবতী। এ যেন সত্যি প্রেমের নিকেতন। কিন্তু শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা আর আফসোস করা ছাড়া আমার তো আর কিছু করার নেই।  সুবিমল ও তমসা দুজনে ঠিক ভিড়ের মধ‍্যে নাচ গানে যোগ দিয়েছে। আমার হাতের আবির কি হাতেই থেকে যাবে। একপাশে দাঁড়িয়ে এই সব‌ই যখন ভাবছি ঠিক সেই মুহুর্তে দেখি আমার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিপছিপে ফর্সা চেহারার এক সুন্দরী আমার দিকে তাকিয়ে বলছে,

           'কি ব‍্যপার আজ দোলের দিন রঙ খেলছেন না!'

           ' নিশ্চয় রঙ খেলব, তাই জন‍্যেইতো এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম।'

এই বলে এক মুহুর্ত নষ্ট না করে অতর্কিতে তার গালটা ও সারা মুখটা রাঙিয়ে দিলাম। হঠাৎ ঘটে যাওয়া ব‍্যাপারটায় একটু অপ্রস্তুত হলেও আধো আধো লাজুক মুখে তার হাতের একটা প‍্যাকেট থেকে খানিকটা আবির নিয়ে এবার আমার মুখে লাগিয়ে দিয়ে নিজের কাপড়টা সামলে নিয়ে একটু এগিয়ে গেল। তারপর আমরা দুজনেই হাসতে হাসতে আরও কাছে এগিয়ে বললাম, 'চলুন ঐ সামনে যেখানে সবাই নাচ করছে আর গাইছে ওখানে যাই।'

চোখের ঈশারায় নিজেকে রাজি বুঝিয়ে একসঙ্গে এগোলাম।

     "ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান- 

     তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান- 

     আমার আপনহারা প্রাণ আমার বাঁধন-ছেড়া প্রাণ॥ ..."

আমার ও আজ বাঁধন-ছেড়া প্রাণ, এতো মানুষের নাচ গানের আনন্দে আমার মনের ভেতরটাও গুন গুন করে উঠেছে। উনাকে বললাম, 'কি গান গাইলেন না!'

সপ্রতিভ হয়ে জবাব দেয় , 'না বাবা আমি পারবো না'।'

          'তাহলে চলুন ঐখানে একটু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসি' বলেই সাহস করে হাতটা চেপে ধরে কোনরকম অবকাশ না দিয়েই টেনে নিয়ে ঘাসের ওপর বসলাম।

একথা সেকথা হ‌ওয়ার পর আমিই জানতে চাইলাম,                         

          'আপনি কি কোলকাতা থেকেই এসেছেন, কদিন থাকার প্ল‍্যান!'

         'কালকের দিনটাও আছি, আপনি?'

        ' কাল সকালে চলে যাওয়ার প্ল‍্যান ছিল কিন্তু এখন ঠিক করলাম কালকের দিনটা থেকেই যাবো।'

        ' হঠাৎ প্ল্যান চেঞ্জের কারণ!'

        'কিছুটা এখানকার পরিবেশ আর বাকিটা আপনি।'

কাঁধের উপর হালকা ধাক্কা দিয়ে ' কি যে বলেন, আর কিই বা দেখলেন আমার মধ্যে।'

         'ঐ আবির রাঙ্গা মুখে কাজল কালো চোখ'।'

লজ্জায় মুখটা আরও লাল হয়ে ওঠে, ' আপনি দেখছি খুব দুষ্টু, এত কিছু লক্ষ করেছেন।'

         'হয়ে যায়, আর সুন্দর কার না ভালো লাগে বলুন!'

এরপর দুজনেই হাসতে হাসতে মনের আরও কাছাকাছি চলে এলাম।

        'আমি দ্বীপায়ন, আপনি!' বলে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম।'

        'নন্দিনী'।

        'ঠিক যেমনটা ভেবেছিলাম।'

        'মানে!'

        'এই পরিবেশে এই নাম‌ই মানায়।'

        'প্রশংসা কার না ভালো লাগে!'

এই ভাবে নানারকম কথা হাসিঠাট্টা চলতে চলতে বেলা কখন পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি, নন্দিনীই তাগাদা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বুকের কাছে অগোছালো শাড়িটা ঠিক করে, ' চলুন এবার যাওয়া যাক।'  

         ' অগত্যা, কাল আবার দেখা হবে নিশ্চয়।'

         'আগেও দেখা হতে পারে, এখানেই যখন আছি।'

উত্তরের অপেক্ষা না করে একটু একটু করে ভীড়ের মধ্যে আড়ালে চলে গেল। হঠাৎ পিঠে একটা আলতো থাপ্পড় খেয়ে সচকিত হয়ে গেলাম।

         'কি কিছু এগোলো,সব দেখেছি?' তমসা জানতে চাইলো।

        ' আগে কিছু খাওয়ার ব‍্যবস্থা হোক, পরে সব বলছি।'

খাওয়া দাওয়া সেরে একটু নিরিবিলিতে সাম্প্রতিক প্রেমের কথা ভাবছি। তমসা ও সুবিমলের চাপাচাপিতে কম বেশি অনেকটাই বলতে বাধ‍্য হলাম। ওদের উৎসাহ‌ও কম নয়।

সন্ধ্যার পর আবার বেরোলাম। এ দোকান ও দোকান করে তমসারা কেনাকাটা করছে , আমি তাদের সঙ্গ দিচ্ছি তবে আমার চোখ কিন্তু অন্য একজনকে খুঁজে চলেছে, নন্দিনীকে। না অনেক চেষ্টা করেও দেখা পেলামনা। একবার একটু চোখের দেখা, না দেখতে পেলেই মন খারাপ হ‌ওয়া এটাই বোধহয় প্রেমে পড়া।

        পরদিন আবার বেরলাম, আম্রকুঞ্জের পাশ দিয়ে এগিয়ে  যাচ্ছি। শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবের রেশ এখনো কাটেনি

        "একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি-

          তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনি ।।

          কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা

          তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি।।....."

আমিও সেই প্রেমের জাল বুনতে শুরু করেছি। হলুদ রঙটা আমার প্রিয় রঙ তাই আমিও একগুচ্ছ অমলতাস নিয়েছি, যদি দেখা হয়, যদি কথা হয়.... । এই সব কথা ভাবতে ভাবতে বাঁদিকে বড় ঘন্টাটার বেদির কাছে নজর পড়তেই দেখি নন্দিনী বসে আছে। প্রেমের প্লাবন যেন বাঁধ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমার হাতের অমলতাসের গোছাটা যেই দিতে যাবো বলে এগিয়ে যাচ্ছি ঠিক সেই মুহুর্তেই 'মাম্মি' বলে বছর পাঁচেকের মেয়েটা নন্দিনীকে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েকে জড়িয়ে রেখে আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে নন্দিনী এগিয়ে চলে গেল।

          অন্য কিছু ভাবার আগেই হোঁচট লেগে হাতের অমলতাসের গোছাটা মাটিতে পড়ে গিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল আর আমার জীবনের প্রথম প্রেমেও হোঁচট খেলাম।


...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment