![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
বিয়োগ
সন্দীপ ঘোষ
লালুর যখন পাঁচ বছর বয়স, দুরের নলকূপ থেকে জল আনতে গিয়ে গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে হিটস্ট্রোকে মারা
যায় তার মা | সেদিন কড়া রোদের জন্যই ছেলেকে নিয়ে যায়নি মা বন্দনা | ওদের বাড়িতে
নলকূপ কিম্বা কুয়ো কোনটাই নেই | স্নানের জন্য আশেপাশে কোন পুকুরও নেই | এক কিমির বেশি
দুরে জমির আল বেয়ে পৌঁছতে হয় জমির মাঝে অবস্থিত পুকুরে | আর মাত্র বিঘা
কয়েক জমিই তাদের সংসারের মূল চালিকাশক্তি |
কখনো-সখনো
নুন আনতে পান্তা ফুরনোর মতো অবস্থা হয় | সেখানে নিজস্ব নলকূপ বা কুয়ো মানে তো
বিলাসিতা |
যাইহোক ছোট্টলালুর কচিমনে এইসব জটিল ভাবনা না আসাই স্বাভাবিক | মা মা গন্ধে ভরে থাকত ছোট্ট একচিলতে ঘরটা | মা যখন অন্য কাজে বা রান্না ঘরে ব্যস্ত থাকত তখন সেই গন্ধের আমেজ নিয়ে নানাপ্রকার খেলায় মেতে থাকত | দুপুরে কড়া রোদ আর প্রচন্ড গরম | ঘন কালো মেঘ করে উঠত কালবৈশাখীর ঝড় | সেই ঝড়ে আম পড়ত, আর সমস্ত বাচ্চারা আম কুড়োনের নেশায় ছুট লাগাত গ্রামের আমবাগানে | ছেলেকে নিয়ে যেতে চাইত না বন্দনা | তা ছেলে শুনবে কেন ? কাঁদতে কাঁদতে মায়ের পেছন পেছন ছুটত আম কুড়োতে | শেষে মনে হোত কালবৈশাখী যেন কিছু আম পেড়ে দেবার জন্যই এসেছিল | বৃষ্টি হত না | যদি বা হত, কয়েক ফোঁটা প'ড়ে গরমকে আরো অসহিষ্ণু করে তুলত |
চাষীবাসী মানুষ লালুর বাবা পরিমল | তার মাথায় হাত !! সব্জি লাগিয়েছে ক্ষেতে , কিন্তু গরম আর খরার জন্য জলের অভাবে সব্জি নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে | তার হাহাকার লেগেছে জলের জন্য | প্রতিবেশি বনিকদের কাছে পাম্পের জল চেয়েছিল | ইলেকট্রিকের দামও দেবে বলেছিল | তবুও দেয় নি | লালুর বাবা তো গরীব, কি জানি কোত্থেকে টাকা দেবে এই ভয়ে ওরা জল দিতে চায় নি | তাই কালবৈশাখীর ঘন কুচকুচে কালো মেঘ দেখে পরিমলের খুব আনন্দ হয়েছিল | এক দৌড়ে বাড়ি এসেছিল ক্ষেত থেকে | বাড়ি ফিরে মা-ছেলেকে দেখতে না পেয়ে মাথায় ভীষণ রাগ উঠেছিল পরিমলের | আসলে ওদেরও দিতে চেয়েছিল এই আনন্দের ভাগ | কিছুক্ষণ পরেই ফিরেছিল মা-ছেলে, সঙ্গে এক ঝুড়ি কাঁচা আম | কমতে শুরু করেছিল ঝড়ের গতি | কিন্তু শান্ত পরিমল হঠাত্ কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল | আছড়ে দিয়েছিল দড়ির খাট আর আমের ঝুড়িটাকে | তারপর রাগের ঝাঁজ ছাড়তে ছাড়তে বলেছিল; -----"ছেলেকে লিয়ে ঝড়ের মইধ্যে আম খেতে গেইছলে ? আম খেলেই হবেক আর ঘরে কোন কাজ নাই ?" ছোট্ট লালু ফ্যাল ফ্যাল করে দেখতে থাকে একবার বাবা, একবার মাকে | তার আমকুড়ানোর আনন্দটা ভিতর থেকে কেউ যেন চিমটে দিয়ে টেনে বের করে নেয় | তার মা বন্দনা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে সমানে কাঁদতে থাকে | আকাশে মেঘ কেটে গিয়ে গোধুলীবেলার বিকেল যেন আরোও সুন্দর করে সেজে উঠল | মনের ইচ্ছে, আশা সবসময় তো পূরণ হয় না | পরিমলের ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্ৰম নয় | তার রাগের পারদ চড়চড়িয়ে বেড়ে চলেছে | স্বামীর অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে কান্না থামিয়ে নম্রভাবে বন্দনা বলেছে ; ------ "কাইলকে আমগুলা বাজারে লিয়ে যাবে, দেইখবে ভালো দাম পাবে | শুভার মা বইলছিল কাঁচা আমের দাম এখন পায় চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা কেজি |" কথাটা যে মন্দ বলেনি বউ, বাজারে গিয়ে বুঝতে পারে পরিমল | দশকেজি আমের পুরোটাই বিক্রি ক'রে ,সেই পয়সা থেকে বনিকদের বিদ্যুতের দাম দিয়ে সব্জিক্ষেতে সেচের কাজ সম্পন্ন করেছিল | গরমে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ক্রমশঃ শরীর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল পরিমলের |
বন্দনার চাপে একপ্রকার বাধ্য হয়ে ডাক্তার দেখায় পরিমল । প্রখর রোদে কাজ করতে বারণ করেছিলেন ডাক্তারবাবু। কিন্তু গরমের প্রাবল্য থাকলেও কাজ না করলে খাবার জুটবে কি করে ! লালুকে বড় করে তুলবে কিভাবে ! মাথার যন্ত্রণা সহ ঘর্মাক্ত - ক্লান্ত শরীরে চাষের কাজে সময় দিতেই হয় | যাইহোক বর্ষার আগমনে নিজেকে সামলে নিয়েছিল । তবে সেবারের গরমে যে বউটাকে হারাতে হবে স্বপ্নেও ভাবেনি সে ।
লালু জানে-- মা ঐ নীল আকাশের দেশে ঘুমিয়ে আছে । ঘুম ভাঙলেই কাছে আসবে, তার সঙ্গে কথা বলবে , নতুন নতুন গল্প বলবে । আর নিয়ে যাবে আমবাগানে । জীবন মৃত্যুর জটিল চক্রব্যুহ তার শিশুমনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি । দিন একটু একটু করে এগোতেই মায়ের অনুপস্থিতির কারণ উপলব্ধি করেছিল । মায়ের গন্ধ মায়ের স্পর্শের অভাবে হঠাৎ হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠতো ছোট্ট লালু । ও চোখের সামনে ছবির মতো দেখতে পায় মাতৃ আনন্দের সুখের মুহূৰ্ত | ------"মা, ওমা তালগাছে ঐ হাড়িগুলা টাঙ্গানো কেনে মা ?" মা এর আন্তরিক সরল উত্তর ; ------ "এখন ত গরমের সময় বাবা, তাই মহল মোক্তার চাচা তালরসের জন্যি হাড়িগুলা টেঙ্গেচে | তারপরে রসের হাড়িগুলা পেড়ে বড় ডেকে করে ফুটিয়ে তালপাটালি বানাবেক |" পরেরদিন লালু তার বাবার সঙ্গে গিয়েছিল মহল মোক্তার চাচার বাড়ি | তালপাটালি, তালের গুড়, তালের রস খেয়ে এসেছে | মায়ের জন্য আনতে ভোলেনি সে | বাবাকে বলেছিল কচি গলায় মিষ্টি সুরে ; ---- "বাবা-বাবা মায়ের জন্যি লিতে হবেক কিন্তু |" ও!! সে যে কি আনন্দ !! সেই সব ঘটনা লালুর স্মৃতির পাতায় আজও অঙ্কিত |
আজ আট বছরের লালু | অনেকটাই জ্ঞান হয়েছে তার | মায়ের বিয়োগব্যাথা পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেনি | মনে হলেই অদৃশ্য এক চাবুক যেন তার সারাশরীরে বসিয়ে যায় | মায়ের অভাব তার পড়াশোনাতেও থাবা বসিয়েছে | মায়ের শুনে শুনে দশ-এর ঘর অব্দি ঝরঝরে নামতা মুখস্ত করে ফেলেছিল | বাবার তো সকাল হলেই দুমুঠো অন্নের চিন্তা | পড়াশোনাটা অল্প জানলেও ছেলেকে নিয়ে বসার তেমন ফুরসত্ মেলেনা | গ্রামেরই বেকার ছেলে জয়দেব স্নাতক হওয়ার পর গ্রামেরই প্রাইমারী পর্যায়ের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনায় সাহায্য করে | বিনিময় অতি যত্সামান্য অর্থে | মা বন্দনা চলে যাবার পর ওখানেই পড়াশোনার ঠাই হয়েছে লালুর |
এবারে বসন্ত এখনও
বিদায় নেয় নি | ভরা বসন্তেও রোদের যে তাপ তাতে অস্বস্তি বেড়েছে সকলের | বাদ যায়নি লালু
ও বিশেষ করে লালু'র বাবা | গরম সহ্য করতেই পারে না | বসন্তের বিদায়বেলায় এল সেই সুসংবাদ |
লালুর
মামা এসেছে লালুদের নিতে | মামা বাড়ির গ্রামে যে গাজন পরব | পরদিন সকালবেলা
মামার হাত ধরে লালু পাড়ি দিল মামার বাড়ি গাজন পরবের আনন্দ নিতে | বাবাকেও নিয়ে
যাবার চেষ্টা করেছিল সে | ক্ষেতের কিছু কাজ পড়ে আছে , সেগুলো তো না
সারলেই নয় | পরিমল নববর্ষের দিন যাওয়ার কথা বলে শান্ত করে লালুকে | গাজন উত্সব আর
হৈ-হুল্লোড়ে মেতে বেশ কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিল লালু
তার মামাতো ভাইবোনেদের সঙ্গে | তবুও কোথায় যেন একটা, এক এক সময় কি
যেন নেই--- মনটাকে ব্যাকুল করে তোলে | আর তার পরমুহূর্তেই মায়ের ছবিটা চোখের
সামনে ভেসে ওঠে | ছোট্ট ছেলেটা ঝরঝর করে কাঁদে
আড়ালে | মাঝে মঝে এই চাপা কষ্টটা যেন ভেতরটাকে মুচড়ে দেয় |
ভীষণ কড়া রোদ উপেক্ষা করে তাকে নিতে আসে তার বাবা | মামাবাড়ির প্রচুর আনন্দ , মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে খেলাধুলা করে যে আনন্দ , এসবই তার কাছে ম্লান | মায়ের কোল, মায়ের আদর, সবটাজুড়ে যে জগত্ তার ছিল, আজ মায়ের অভাবে মনটা সর্বক্ষণ খাঁ খাঁ করতে থাকে |
বেলার দিকে রোদের তাপ বেড়ে যাবে , তাই লালু ও তার বাবা ভোর পাঁচটার বাস ধরে বেরিয়ে পড়েছে বাড়ির উদ্দেশ্যে | এত ভোরেও বসার কোনো সিট নেই | বাসে খুব ভীড় আর তেমনি ভ্যাপসা গরম | ভিড়ের চাপে একপ্রকার পেষাই হওয়ার অবস্থা | লালু সিটের রড শক্ত করে চেপে ধরে উপরের দিকে তাকায় | দেখে বাবা কেমন যেন করছে | অনুভূতিটা তার কচিমনে বিদ্যুত তরঙ্গের মতো হৃদয়ে পৌঁছে মনটাকে ব্যকুল করে তোলে | যে সিটের পাশে ওরা দাঁড়িয়েছিল ঐ সিটের জানলার পাশে বসা ভদ্রলোক লালুর বাবা পরিমলকে বলে ওঠেন ; -------" মনে হচ্ছে আপনার শরীর অসুস্থ, আপনি এই সিটে বসুন | আমি পরের স্টপেজে নামব |" ভদ্রলোক সিট ছেড়ে উঠে পড়েন | পরিমলকে জানলার পাশে বসিয়ে দেন | পরিমল ছেলেকে কোলে বসার জন্য হাত ধরে টানতেই , লালু কেঁদে ওঠে | কাঁদতে কাঁদতে বলে ; ------" ও বাবা-- তুমি একাই বসিয়, তুমার শরীর খারাপ, আমি দাড়ায় যেতে পারব |" অগত্যা পরিমল সিটে হেলান দিয়ে শরীরটাকে এলিয়ে দেয় | সকালের ঠান্ডা হাওয়ায় পরিমলের দেহ-মন চাঙা হয়েছে অনেকটা | পাশের জন সিট ছাড়তেই ছেলেকে কাছে বসিয়ে নেয় | কিন্তু এই সুখ তাদের সইল না বেশিক্ষণ | কিছুদুর যাওয়ার পর বাস খারাপ হয়ে যায় |
বাস সারাই হতে হতে
ঘন্টা দুই-আড়াই লেগে গেল | তারপর বাস যখন ওদের স্টপেজে নামিয়ে দিয়ে গেল
তখন ঘড়ির কাটা প্রায় দশটা ছুঁই ছুঁই |
রোদঝলমলে
পরিস্কার আকাশ | রোদের তাপ চড়চড়িয়ে বেড়ে চলেছে | স্টপেজ থেকে
ওদের বাড়ি হাঁটাপথ প্রায় চার কিলোমিটারেরও বেশি | কিছুটা হাঁটার
পর পরিমল আবার অসুস্থ বোধ করতে শুরু করে | এইভাবে কিছুদর চলার পর বাবা-ছেলে বিশ্রাম নেবার জন্য বসে পড়ে রাস্তার ধারে থাকা বটগাছের নীচে | লালুর মামীর
দেওয়া দু'বোতল
জলের কিছুটা ছিল, পুরোটাই শেষ করে ফেলে বাবা-ছেলে | তারপর গামছা
মেলে শুয়ে পড়ে পরিমল | বেশ খানিকক্ষণ কেটে যায় | পরিমলের শারীরিক অবস্থার ক্রমশঃ অবনতির
দিকে | ছোট্ট
লালু বাবাকে ডাকে | কি যেন বলতে চায় পরিমল, পারছে না জড়িয়ে যাচ্ছে | বাবার গোঙানি
ছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারে না লালু | বাস থেকে নেমে আসার পথে যদিবা দু'একজন লোকের দেখা
মিলেছিল, এখন
এই তপ্তরোদে পথঘাট একেবারে জনশুন্য | কি করবে লালু ! ছোট্ট লালু অসহায় | একবার বাবার
কাছে যায়, আবার
অস্থির হয়ে রাস্তার এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে কেউ আসছে কিনা ! তীব্র ব্যাকুল হয়ে ওঠে,
এরপর
কেঁদে ওঠে হাউ হাউ করে | বাবা বাবা বলে চিত্কার করে ডাকতে থাকে |
পরিমল
ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলের ডাকে সাড়া দেবার চেষ্টা করে | কিন্তু ব্যৰ্থ
হয় | মুখটা
হা করে পরিমল, হয়ত কিছু বলতে চায় | লালু মাথা ঝুঁকিয়ে বুঝবার চেষ্টা করে | অতিকষ্টে বাবার
মুখে উচ্চারিত "জ---অ----অ----অ---ল"
শব্দটি শুনে সঙ্গে সঙ্গে জলের বোতল দুটোকে তুলে ধরে | নাহ ! কোনটাতেই
তো জল নেই | লালু জলের জন্য ছটপট করতে থাকে | দেখতে পায় প্রায়
এক কিমি দুরে জমিতে জলসেচের জন্য পাম্পমেশিনে
করে জল তোলা হচ্ছে | লালু দৌড়ে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই জল নিয়ে ফিরে
আসে | ততক্ষণে
পরিমল জলের কষ্ট থেকে নিজেকে মুক্ত করে ছেলেকে ছেড়ে অন্যলোকে পাড়ি দিয়েছে |"
----- "ও-বাবা,বাবা গো বাবা জল
লিয়াইচি ,এই
লাউ জল খাও |" বাবার কোন আওয়াজ
না পেয়ে লালু আরও অস্থির হয়ে ওঠে | ----- " ঘুমি গ্যালে ?
জল
খাবেনি ?" ছোট্ট দু'হাতে সযত্নে ধরা জলের বোতল তুলে বলে; এই ত জলের বতুল ,
লাউ
জল খাও |" চির ঘুমের দেশ থেকে তার বাবার আর যে কোন ফেরার পথ নেই , সদ্য অনাথ লালুর
কচি মনে জাগতে জাগতে হয়ত অনেকটা সময় পার হয়ে যাবে |
No comments:
Post a Comment