1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, August 15, 2022

জ্যোছন কুমারী

ছবি : ইন্টারনেট
জ্যোছন কুমারী
শ্যামশ্রী সরদার

-"নাম কি? "
-"সুখেন বিশ্বাস।"
-"কাল রাতে মাঠের ধারে পড়ে ছিল যে মেয়ে, চেন তাকে?"
" চিনি, সার"
" নাম কী?"
" নাম তো বলেনি সার কোনও দিন। আমি জ্যোছন কুমারী বলতাম"
মেঝেতে জড়োসড়ো হয়ে বসা সুখেনের দিকে তাকিয়ে হাসে বীজপুর থানার ও.সি, সুনীল সেন। চোখ মটকে মেজবাবুকে বলে,
" শালা ভয়েই মরছে।সব সত্যি বেরিয়ে আসবে। বয়ান রেকর্ড করে নিন"
কঠিন গলায় বড়বাবু বলেন, " এ কাজ করলে কেন? জানো এর শাস্তি কী?"
ঘোলা চোখে তাকায় সুখেন।
-" কী কাজ সার?"
"শালা ন্যাকা, টং এর ঘরে থেকে রাত দুপুরে ছেনালি? জলজ্যান্ত মেয়েটাকে ভোগ করলি আবার মেরেও ফেললি? হাগল পাগল সেজে থাকা ঘুচিয়ে দেব"
ধাক্কা মেরে সুখেনকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল গারদে।
আধো অন্ধকারে চুপ করে বসে সুখেন। চোখে জল। তার জ্যোছন কুমারী, আর আসবে না। শরীরটা উল্টে পড়েছিল কাদায়। ভোরবেলা দেখে সুখেন। তাও কাদায়, রক্তে বীভৎস।  সাড়া দেয় না।  বেলা একটু বাড়তেই সজনেগাছির লোক দেখল এক অর্ধনগ্ন মৃতদেহের সামনে  সুখেন,  এ জমির টুঙি ঘরের বর্তমান বাসিন্দা। 
বত্রিশ বছরের লোকটাকে লোকে বলে পাগলা সুখেন। বিয়ে থা করে ওঠা হয়নি। কে আর বিয়ে করবে তাকে। একলা জীবন,  মাঠেই তার ঘর। ফসলের সময় ক্ষেতের ধারে টুঙির ভিতর থাকে সে। টুঙি ঘরে জল মাটির সোঁদা গন্ধে যেন নেশা লাগে সুখেনের। চার পাশের সবুজ ধানের শিশু গাছের গায়ে যেন দুধ দুধ গন্ধ। বাপ তো সেই। এতো শিশুর বাপ সে। সেই শিশুকন্যা চোখের সামনে বড় হয়, কান পাতলে সুখেন বাপ ডাক শুনতে পায়। সুখেনকে নিয়ে টানাটানি পড়ে যায় জমির মালিকদের মধ্যে। সুখেনের হাতে সোনা ফলে, টাকা নামমাত্র দিলেই সুখেন খুশি। গতর খাটিয়ে, জান প্রাণ দিয়ে যে ধান ওঠে তার দাবি সুখেনের নেই, থাকার কথাও না। এমন মানুষকে দিয়ে কাজ করাতে কে না চায়। শর্ত একটাই, রাতে তাকে থাকতে দিতেই হবে টুঙি ঘরে। তাতে জমি মালিকের ভালোই, রাত পাহারাও হয়ে যায়। রাতে সুখেন চেয়ে থাকে জমির দিকে। ভরা জ্যোৎস্নায় নেমে আসে আর একজন। জমির মখমল ধানচারার গন্ধ নেয় সে। সুখেনের দিকে তাকিয়ে হাসে সেই সাদা মেয়ে। যে জমিতে সে আসে না, সে জমির ফসলে যেন সেই ভর ভরন্ত রূপ দেখা যায় না। সুখেন টুঙি ঘর থেকে নেমে এসে মাঠের আলের ধারে বসে। সে মেয়ে কথা বলে না, তার মুখও সুখেন দেখে না। শুধু পাশে বসতেই নরম গন্ধ পায় । সারারাতের কতক্ষণ যে কেটে যায়। প্রতি পূর্ণিমায় আসে সে। পূর্ণিমার পর দিন থেকে আকাশ দেখে সুখেন। সুগোল চাঁদের আকাশে আসার সময় পিছোয়, গোল চাঁদে কামড় বসায় কে যেন। গলে যাওয়া আলো কমে অন্ধকার নামে, ঘন হয় ক্রমে নিখাদ কালো অন্ধকার।
দিনের আলোয় সুখেনের ঘোর কাটে। খুব খাটে সে। এই যে চারা গাছ, ক্রমে গর্ভবতী হয়। ধানের শীষে দুধ জমে।
সুখেনের শিশু কন্যা আজ পূর্ণ যৌবনা। সুখেন অপেক্ষায় থাকে পূর্ণিমার। জ্যোছন কুমারীকে বলতে হবে।
জ্যোছন কুমারীর সাথে একলা বলে যায় সুখেন। এ মেয়েদের এখন কড়া দেখভাল প্র‍য়োজন। পোকা ধরলে মুশকিল। জ্যোছন কি হাসে? সুখেন মুখ দেখতে পায় না। এই যে সাদা সরের  জ্যোৎস্না মাখে গাছগুলো, তাই তো এত জেল্লা তাদের। সাত সকালে শিশিরে মুখ ধুয়ে সবুজ গাছে আলো ঠিকরায়। ক্রমে ক্রমে শীষ ভারি হয়, রঙ বদলায়। সোনার মলে তাল ঠুকে ছুটে চলে বাতাস। এসময় টুঙি ঘরে শুয়েও শোনা যায় হলদে অর্ধনত ধানের শীষে বেজে চলা নিক্কন। সুখেনের এ বড় সুখের সময়। 
দুপুরের সূর্য মাঝ আকাশে উঠলে খাবার আনে মাধু। খাবার নিয়ে এসে বসে গাছতলায়। মাধু এই জমির মালিকের বাড়ির কাজের মেয়ে, মা বাপ নেই, এই বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে। চাষের বাড়ির কাজ অনেক।  তার মধ্যে মুনিষদের খাবার দেওয়াও একটা কাজ। এই জমির মালিকের অনেক জমি। নানা জায়গায়। সব মুনিষদের খাবার দিয়ে শেষে এখানে আসে মাধু। পান্তা আর পেঁয়াজ। গাছের তলায় জিরিয়ে লবণ দেওয়া ভাত চটকায় সুখেন আর আতাউর। মাধু গাছের নীচে পা ছড়িয়ে বসে, বকে যায় নিজের মতো। সক্কাল থেকে কাজের ঝক্কি থেকে সেই গল্প পাড়ি দেয় মাধুর ছোট বেলায়। এরা মাঝে মাঝে সায় দেয়, নাহলেই মুশকিল।খাওয়া শেষ করে বিড়ি ধরায় সুখেন। গায়ের ঘাম একটু শুকিয়েছে। আতাউর সুখেনের সাথে কাজ করে। সুখেনের সাথে সবাই কাজ করতে পারে না, জমির জন্য ভূতের মতো খাটে সুখেন। সময় হিসেব করে না। আতাউর বলে, " এত খাটো কেন দা? চল এট্টু বসে আসি। একেনে কেডা দেখবে?'
সুখেন বলে, " ছি ছি, পুলাপান চারা এখন, জল না ছেঁচি দিলি তেষ্টায় মরবে যে"
আতাউর হাসে। পাগল লোক বটে!এই ধান, মালিকের। এ লোক তা বোঝে না। তবে সুখেনকে ছেড়ে অন্য কারোর সাথে কাজ করে সুখ পায় না আতাউর। চারিদিকে হিসেব, সুখেন হিসেব বোঝে না। আতাউরের মায়ের অসুখের সময় সে কাজে আসতে পারে নি। সরকারি হাসপাতালে সব সময় রুগীর বাড়ির লোক থাকতে হয়, কখন কি দরকার পড়ে। কাজ বন্ধ দিয়ে হাসপাতালে পড়ে থেকেছে। তখন সুখেন এসে নিজের তিরিশ দিনের রোজের টাকা দিয়ে গেছে আতাউর কে।
এমন বেহিসেবি আর কে? আতাউর এই লোকটাকে দেখে আর অবাক হয়। লোকে পাগল বলে একে, আতাউরের মনে হয় কোন ফেরেস্তা বুঝি ঘুরতে ঘুরতে এই  পৃথিবীতে চলে এসেছে। এ পৃথিবীর কোনো হিসেবে একে ধরা যায় না। লোকটার গা দিয়ে মাটির সোঁদা গন্ধ, জমির ফসলের বাপ সে।
আতাউরের ভালো লাগে এই মাঝ দুপুরটাকে। ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর আর এক বক বকুমে মেয়ে। গায়ের মাজা রঙে, অতি সাধারণ মুখশ্রীতে দুটো ভ্রমর চোখ। আতাউর জানে ভালো লাগলেও সব কিছুকে স্পর্শ করা যায় না, পাওয়া যায় না।  আতাউর ঘুমের আগে, দুচোখ বন্ধের আগে ভ্রমর চোখের মালকিনকে মনে করে, সমানে বকে যাওয়া শব্দ গুলো তার পাশে যেন গুণ গুণ করতে থাকে। ঘুম ভালো হয় তার।
এক একদিন সুখেন সন্ধ্যায় আলের ধারে বসে থাকে । বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যে নেমেছে। সবুজ আর হলুদ মেশানো ধান গাছ, উপচানো ধানে পরিপূর্ণ।  সুখেন ভাবে সে কি সত্যিই পাগল? সাধারণ মানুষের মতো ঘর সংসার তার ভালো লাগে না। ভালো লাগে জমির ভিজে মাটি আর ধান চারা। আতাউর ছেলেটা বড় সহজ। বেশিরভাগ লোক তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, সুখেন জানে। আতাউর হাসে না। সুখেন যে ধান গাছের সাথে কথা বলে.. এ গাঁয়ের লোক জানে সেকথা। সুখেন বোঝাতে পারে না লোককে, এই ধান গাছ আসলেই সব বোঝে। হাসে, কাঁদে। ধান উঠে গেলে খাঁ খাঁ মাঠে দাঁড়িয়ে সুখেনের শ্মশানের কথা মনে পড়ে। মা শুয়ে আছে, মায়ের লাল টুকটুকে পা দুখানা। সুখেনের বুক হু হু করে ওঠে।
  এ সময় মাধুর কাজ বেশি, ধান উঠলে ধান ঝাড়া, রোদে দেওয়া। মাঠের জনদের কিছু, বাড়ির উঠোনে কাজে আসে, আতাউর ও। মাথায় গামছা বেঁধে ধান ঝাড়ে সে। আতাউর এই সময় করুণ মুখে দেখে এ মেয়ের পরিশ্রম। আতাউর দেখে আর ভাবে, এমন মেয়ের এত পরিশ্রম সাজে না। দিব্যি যেন দেখতে পায়,  তার ঘরের উঠোনে চাটাই পেতে সে আর মাধু বসে আছে। সামনে সানকির ভিতর গরম ভাত...এক পাতেই খাবে তারা আজ। চমক ভাঙে। মাধু আর তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, পাহাড়ের মতো। তবু সে পাহাড়ের গা দিয়েই যে নদী নামছে,  তা আতাউরের
পক্ষে আটকানো কঠিন হয়ে পড়ছে। ভ্রমর চোখের
আরশিতে আতাউর মাঝে মাঝে নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছে। এ যেন এক অন্য খুশি। আম্মা এখন অনেকটা সুস্থ, বলে দেখবে একবার?
সেই ছোট থেকে বড় হল মাধু। এ বাড়ির ছেলেদের বড় বাবু, ছোট বাবু বলা রেওয়াজ। আজকাল ছোট বাবুর ভাব ভালো লাগে না। মাধু বোঝে, তার বড় হওয়া শরীরে কিসের যেন ছোঁওয়া লেগেছে। মাধু এখন পুরুষ মানুষের চোখের ভাষা বোঝে। এই যে আতাউর,  তার দিকে তাকায়...মুগ্ধ দৃষ্টিটা দূর থেকে ছুঁয়ে গেলেও তার মধ্যে লোভ থাকে না। ছোট বাবুর তাকানোতে লোভ।মাধুর পালাতে ইচ্ছে করে এই বাড়ি ছেড়ে। এ কথা কাকে বলবে সে?
আতাউরের সাথে ধীরে ধীরে একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। অনেক ছোট ছোট সমস্যার মুশকিল আসান সে। সুখেন দা বিড়ি টানে, আতাউরের সাথে কথা সেরে নেয় মাধু। প্রতিটাই দরকারি কথা। মাধুর পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করা বিড়াল টুনির গায়ে ঘা থেকে বুড়ি ঝি মুক্ত মাসির বাতের সমস্যার সমাধান করে দেয় আতাউর। এমনকি যেদিন টুনি হারিয়ে গেল, সেই সাত সকালে মাঠে এসে কেঁদে কেটে একাকার করে খবর দিল মাধু। সুখেনদা পাঠিয়ে দিল আতাউর কে, দুপুর নাগাদ ঘেমে নেয়ে টুনি কে খুঁজে আনল সে। দুপুরে খাবার দিতে এসে মাধু দেখে সুখেনদার টুঙি ঘরে ঝুড়ি চাপা দেওয়া টুনি। সেদিন, মাধুর মনে হল আতাউর পারে না এমন কাজ নেই। আতাউর ছাড়া জীবনটা বিবর্ণ। ইচ্ছা করছিল একবার কাছে ডেকে ঘামটা মুছিয়ে দেয়, নিজের আঁচলে।এমন টুঙি ঘরে সে আর আতাউর, সাথে টুনি।
মাধুর এমন স্বপ্ন দিনের মাঝে কত সেজে গুজেই না আসে আজকাল। স্বপ্ন বুনতে বুনতে নক্সী কাঁথা হয়ে যায়, মায়ের হাতের সেই কাঁথাটার মতো,  যেটা স্পর্শ করলেই মাধু মাকে ছুঁয়ে ফেলে।
সেই যে কোন ছোট বেলায় মা মরে গেল, বাপ চলে গেল অন্য কোথায়...,এই রায় বাড়িই হয়ে উঠল মাধুর ঠিকানা। মাধুর তখন দশ বছর বয়েস, সবে হাইস্কুলে যাওয়ার কথা চলছে। মা মরে যাওয়ার পর উল্টে গেল সব। মাধুর পড়তে ভালো লাগত। পড়তে পারে তো সে, পড়ে থাকা খবরের কাগজ পড়ে সে। এই বাড়ির বড় গিন্নিকে সে বড়মা ডাকে। আসা থেকে কাজ শিখেছে মাধু। জমির ধান উঠলে সে ধান সিদ্ধ,  চাটাইয়ে মেলে শুকনো আরও কত কি যে করতে হয় তাকে।
আচ্ছা, এই যে আতাউর,  টাকা জমিয়ে একটু জমি তো কিনতে পারে! সুখেনদা আর আতাউর মিলে ধান ফলাবে....তারপর ছেড়ে দাও মাধুর উপর। ঘুমোনোর আগে চুলে ফিতে দিয়ে বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে মাধুর চোখে ভেসে ওঠে আর এক মাধু। আতাউরের উঠোনে যে ধান সিদ্ধ করে, মাথায় ঘোমটা, হাতে চুড়ি, পায়ে মল। 
কদিন থেকেই মাধুর ভালো লাগছিল না ছোট বাবুর ভাব সাব। কেমন যেন বেপরোয়া।  এ বাড়িতে কিছু বলে লাভ হবে না। সেদিন দুপুরে বাড়ির মেজ গিন্নি ডেকে পাঠান।
"শোন মাধু, তোর লজ্জা করে না? মোছলমানের ছেলের সাথে আশনাই করছিস? আর যদি দেখি আরেকবার, রাস্তায় বসিয়ে দিয়ে আসব"
মাধু জানে এখানে প্রতিবাদ করে লাভ নেই। বাড়িতে এ কথা ছড়িয়েছে।  যা করার আজ রাতেই করবে মাধু।
রাজি হতে দ্বিধাগ্রস্ত আতাউরকে বোঝায় মাধু। সেদিন ভরা পূর্ণিমা। টুঙিঘরে সুখেন ছোটজানলায় চোখ রাখে, ছায়া মূর্তি দুটো।  বেরিয়ে এসে কাউকেই দেখতে পায় না। ভরা জ্যোৎস্নায় ভাসছে পৃথিবী। ঠান্ডা হাওয়ায় চোখ জুড়িয়ে আসে। বসে থাকতে থাকতে দেখে জ্যোছনকুমারীকে। ঘুম আসছে তার।
ভোররাতে ফিরে আসে মাধু। কাদার উপর বীভৎস মুখে
পরে থাকে সারারাত, নগ্ন শরীরে ভোরের নরম আলো।
পাশবিক অত্যাচারে চেনা যায় না আর।ভোরে উঠে সুখেন ভাবে এই বুঝি তার জ্যোছন কুমারী। থ্যাৎলানো ফুলের মতো শরীরের পাশে কাঁদে সে।আতাউর রহমানের হবু স্ত্রী।  নিখোঁজ তালিকায় নাম উঠবে আতাউরের, অনেক দিন পর। অসহায় আতায়ুর রহমান কোন গভীর মাটির অন্ধকারে মৃতদেহ হয়ে ঘুমিয়ে থাকবে।
...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment