![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
আফটার লাইফ
সুমন সেন
লোকটাকে খুব চেনা মনে হচ্ছে শ্যামলীর। কিন্তু মনে করতে পারছে না কোথায় দেখেছে তাকে। লোকটাও তার মুখের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে এবং একইসাথে হাসছে, যেন কতদিন পর ওর সাথে দেখা হচ্ছে!
কথাটা মনে হতেই যেন মাথার দুপাশের শিরাগুলো দপ্দপ্ শুরু করল শ্যামলীর। তার বুকের ভিতর যেন হাপর টানছে কেউ। ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকল তার। পা দুটো তিরতির করে কাঁপতে শুরু করল।
‘সত্যিই লোকটা আমাকে চেনে নাতো!’, ‘ওখানকার কোনো লোক নয়তো!’ –এসব চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে খেতে তার মনে পড়ে গেল আট বছর আগের সেই দিনটার কথা। যেদিন সে আর স্বরূপ দুজনে একে অপরের হাতের উপর হাত রেখে, শেওড়াফুলি ষ্টেশন থেকে যেতে থাকা একটা থ্রু ট্রেনের উপর ঝাঁপ দিয়েছিল। ট্রেনের চাকার তলায় ঢুকে গিয়ে দুজনেরই শরীর খন্ড-বিখন্ড হয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু কোন এক দৈববলে তারা গিয়ে পড়ে মালগাড়িটার খোলা মেঝের উপর। হাতে পায়ে অল্প কিছু চোট্ লাগে অবশ্য, তবে প্রাণে বেঁচে যায় দুজনেই। তারপর সেই মালগাড়িটাই তাদের টেনে নিয়ে আসে আসানসোলে। এবং তারপর থেকেই ওদের ঠিকানা – এই শহরতলিটা। সাথে আনা কিছু টাকা-পয়সা ও গয়নাগাঠির সাহায্যে এখানেই বসতি স্থাপন করেছিল তারা। তারপর আট বছর কেটে গেল। সুখেই তো ছিল এতদিন! তাদের একটা মিস্টি মেয়ে হয়েছে, তিতলি। কাছেই একটা স্কুলে ক্লাশ থ্রি-তে পড়ে। বাবা-মা-কে গর্বের অনুভূতি দিয়ে, প্রতিবছর স্কুলে ফার্স্ট হয় সে।
আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে তিতলিই লোকটাকে নিয়ে এসেছে বাড়িতে। বলা ভালো – তিতলির সাথেই জোর করে এসেছে লোকটা।
শ্যামলী বুঝতে পারছে না তার এখন কী করা উচিৎ! স্বরূপও কাজের জায়গা থেকে ফেরেনি এখনও। সে এক কাপ চা দিয়ে উঠোনেই চেয়ার পেতে বসতে দিয়েছে লোকটাকে। এই এলাকার লোকজন একে অপরের বাড়ির হাঁড়ির খবর রাখে। লোকটা আসার পর থেকে অনেকেই বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে এদিকে।
লোকটাকে দেখেই কৌতুহল নিরসনের জন্য কিনা জানা নেই – ঝিমলি দিদির মা চলে এল শ্যামলীর কাছে, হলুদ গুঁড়ো চাইতে। এসে একবার লোকটাকে আঁড়চোখে আপাদমস্তক দেখে নিল। লোকটাও ভাবগতিক বুঝতে পেরে একটু আদিখ্যেতা করেই দুই হাত একসাথে করে বলল, “নমস্কার মাসিমা, আমি উত্তম। চামেলিদিরা আগে যেখানে থাকত, সেখানকার পাড়াতুতো ভাই।”
ঝিমলি দিদির মা “অ...” বলে হলুদগুড়ো নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
কিন্তু এইবার শ্যামলীর বুকের ভিতরে হাতুড়িপেটা শুরু হল। অনেকগুলো স্তরের আকাশ যেন একের পর এক তার মাথায় ভেঙ্গে পড়তে শুরু করল! ‘চামেলি!’ –এই নামে তো কেউ তাকে বহুবছর ধরে ডাকেনি। এখানকার সবাই তো তাকে ‘শ্যামলী’ বলেই চেনে। কানে খাটো ঝিমলি দিদির মা হয়ত ‘চামেলি’টাকে ‘শ্যামলী’ শুনেছে, তাই আর কোনোরকম প্রশ্ন না তুলেই বিদায় নিয়েছে।
নিজেকে সামলে শ্যামলী জিজ্ঞেস করল লোকটাকে, “কী চাই আপনার?”
লোকটা যেন খুব রসিয়ে উত্তর দিল, “তেমন কিচ্ছু না... এই একটু গল্পগুজব করতে এলাম আর কী...”
তিতলি হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে এর মধ্যে। তাকে খেতে দিতে হবে।
***
তিতলিকে পাশের ঘরে খাবার বেড়ে দিয়ে আবার রান্নাঘরে আসে শ্যামলী। তার অশান্ত মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না আজ। বারবার ঘড়ি দেখছে সে। ভগবানের কাছে মনে মনে প্রার্থনা করছে যেন স্বরূপ এখনই ফিরে আসে। এমন সময় হঠাৎ সে শুনতে পায় দরজায় খট্ করে একটা আওয়াজ। পিছন ঘুরে তাকাতেই দেখে লোকটা রান্নাঘরে ঢুকে দরজার ছিট্কিনি তুলে দিয়েছে। শ্যামলী প্রচন্ড আতঙ্কিত হয়ে চীৎকার করতেই যাবে এমন সময় লোকটা এসে তার মুখ চেপে ধরে। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস্ফিস্ করে বলে, “চীৎকার-চেঁচামেচি করলেই কিন্তু আমি তোর আসল রহস্য ফাঁস করে দেব এলাকার লোকজনের কাছে। এবার বল... তোকে বিশ্বাস করে মুখ থেকে হাত সরাব... নাকি...?”
প্রমাদ গুনল শ্যামলী। এখানে সম্মান নিয়েই বেঁচে আছে সে। মেয়ের কারণে এখন সে একজন গর্বিত মা। সবকিছু নিমেষে শেষ হয়ে যাবে একটা মাত্র ভুল পদক্ষেপে।
আস্তে আস্তে উপর নিচে ঘাড় নাড়াল শ্যামলী। লোকটাও আস্তে আস্তে চেপে ধরে রাখা হাতটা শ্যামলীর মুখের উপর থেকে সরিয়ে নিল। তারপর ধীর পায়ে শ্যামলীর থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়াল।
“তুই আমাকে সত্যিই চিনতে পারিসনি, নাকি না চেনার ভান করছিস?” –সরাসরি প্রশ্ন এল এবার শ্যামলীর উদ্দেশ্যে।
শ্যামলীর মুখ থেকে কথা বেরোলো না, শুধু দুপাশে মাথা নাড়াল সে।
“আরে আমি উত্তম... উত্তম চৌবে। তুই যখন শেওড়াফুলির পতিতালয় আলো করে ছিলি, তখন আমি সেখানেই প্রথম দেখি তোকে। তোকে প্রথম দেখেই তো আমি পাগল হয়ে গেছিলাম একেবারে। তারপর দুবার সুযোগ হয়েছিল তোর সাথে বন্ধ ঘরে কয়েকঘন্টা কাটানোর। এভাবে ভুলে যেতে পারলি আমায়?” –লোকটা ছদ্মরাগ দেখাল।
কিন্তু শ্যামলী দেখল - কিছুক্ষণ আগে যেই লোকটা বাইরে বসেছিল, আর এখন যেই লোকটা তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে, এই দুজনের মধ্যে যেন বিস্তর ফারাক! এই লোকটা যেন নরকজাত কোনো এক ভয়ঙ্কর পশু, যার নির্লজ্জ স্ত্রী-মাংশ-লোলুপ দৃষ্টি থেকে কামের লালা ঝরছে অনবরত। সেও আর কোনোরকম ভনিতা না করে সরাসরি বলল, “এখন আমি সেসব থেকে অনেক দূরে... এখন আমার সংসার আছে...”
“‘দূরে’ বলেলেই তো হবে না জানেমন... জানিস তুই চলে যাবার পর থেকে একটুও মন ভালো নেই আমার। খুব মিস্ করেছি তোকে এতবছর। এখন যখন তোকে খুঁজে পেয়েই গেছি, তখন আমি তোকে ছেড়ে আর যাচ্ছি না। আর বেশি বেয়াদপি করেলে... ভেবে দেখ্ যদি তোর আসল রহস্য এই এলাকার লোকের কাছে ফাঁস করে দিই – তাহলে কী হবে? এমনকি তোর খবর আমি ওইখানে পৌঁছে দিলেও আমি মোটা টাকা ইনাম বাগাতে পারব। তোর কী হবে ভাব! বড় হয়ে তোর মেয়েটাও তোকে ঘেন্না করবে রে... আর তোর সংসার, মান-সম্মান কোথায় যাবে? তবে... তুই চাইলে আমার সাথে একটা সম্ঝোতা করতেই পারিস...” –বলেই লোকটা হিংস্র পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্যামলীর শরীর লক্ষ্য করে।
ভগবানকে ডাকলে সবসময় তাঁর আসা সম্ভব হয়ে ওঠে না, তাই তিনি মানুষকে বানানোর সময় শরীরে অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি তৈরী করেই পাঠিয়েছেন সমস্ত বিপদের মোকাবিলা করার জন্য। শ্যামলী বুঝে গেছে - এই মুহূর্তে যা করার তাকেই করতে হবে। তার হাত আপনা থেকেই চলে আসে রান্নার টেবিলের দিকে। হাতড়ে হাতড়ে কিছু একটা খুঁজতে থাকে সেই হাত। তারপর যেটা হাতে আসে সেটা সজোরে বসিয়ে দেয় লোকটার মাথা লক্ষ্য করে। একটা সরু কিচেন-নাইফের অগ্রভাগ সোজা লোকটার ডান চোখ থেকে ঢুকে মাথার পিছন থেকে বেরিয়ে আসে। দড়াম্ করে একটা আওয়াজ করে মেঝেতে পড়ে যায় লোকটা। তারপর কিছুক্ষণ খাবি খেতে খেতে, পা দুটো দুবার সামান্য কেঁপে জড় বস্তুতে পরিণত হয় লোকটা।
***
“এ কী সর্বনাশ করলে তুমি? এটাতো খুনের মামলা হবে!” –স্বরূপ মাথায় হাত দিয়ে রান্নাঘরের মেঝেতে বসে পড়ে।
আজ শনিবার। অন্যান্য দিনের থেকে তাড়াতাড়িই ফিরেছে সে। কিন্তু ফেরার পর থেকে আর তার দিনটা অন্যান্য কোনো দিনের মতই রইল না। সে ফেরা পর্যন্ত শ্যামলী রান্নাঘরের দরজা বন্ধই করে রেখেছিল। তিতলিও জানে না যে তাদের বাড়িতে ইতিমধ্যে কী কান্ড ঘটে গেছে! স্বরূপ ফেরার পর তাকে সবটাই বলেছে শ্যামলী।
“আমি তো সেল্ফ-ডিফেন্সে...” –শ্যামলি ভয়ে ভয়ে কথাটা উচ্চারন করল।
- “সেটা কীভাবে প্রমাণ করবে? আশেপাশে আর কেউ ছিল? বা তোমার শরীরে কোনো আঘাত পেয়েছ লোকটার দ্বারা?”
- “না তো...”
- “তাছাড়া পুলিশি মামলায় জড়ালে কী হবে ভাবতে পারছ? আমাদের পুরোনো কথা উঠে আসবে... যেই শান্তিতে এতদিন ছিলাম সেই শান্তি নিমেষে উবে যাবে...”
- “দাঁড়াও... ভাবতে দাও... আচ্ছা, কী যেন নাম বললে লোকটার?”
- “উত্তম – নাম বলল তো... চৌবে...”
নামটা শুনে স্বরূপের মাথায় একটা অপবুদ্ধি প্রবেশ করল। পুরোনো ডায়েরী থেকে খুঁজে বের করল তার খুব ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত বন্ধু উত্তম দাসের ফোন নাম্বার। তারপর ফোন করল তাতে। আট বছরে এই প্রথম সে তার কোনো কাছের মানুষের সাথে যোগাযোগ করল।
***
উত্তম দাস যখন তাদের বাড়ি এসে পৌঁছোল, তখন অনেক রাত হয়ে গেছে। তাকে আগে থেকেই বলে রাখা ছিল যে গাড়ি স্বরূপদের বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে রাখতে। এতবছর পরে প্রিয় বন্ধুকে জীবিত অবস্থায় চোখের সামনে দেখে আবেগে ভেসে গেল উত্তম।
উত্তম আসার মধ্যেই স্বরূপ অনেকগুলো কাজ মিটিয়ে নিয়েছে। তাদের এলাকার বাইরে মোট বারোটা আলাদা আলাদা দোকান ঘুরে সে দশ কেজি নুন এবং বারোটা বড় ন্যাপথালিনের প্যাকেট কিনে এনেছে। তারপর ডেড-বডিটাকে রান্নাঘরের একপাশে সরিয়ে, তার শরীর থেকে জামা-কাপড়গুলো সাবধানে খুলে নেয়। এবং শ্যামলীকে বলে, “জামা-কাপড়গুলো সার্ফ গোলা গরম জলে ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে নাও তো। কাল এগুলোর একটা বিরাট ভূমিকা আছে। তবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কেস্ গড়াতে থাকলে পুলিশের কুকুর আসবে। তখন ওই লোকটার গায়ের গন্ধ এগুলোতে লেগে থাকলে আমরা ধরা পড়ে যাব।”
তারপর সে প্রায় নিরাবরন মৃতদেহটা উপর বেশ কিছু নুন আর ন্যাপথালিনের প্যাকেট ছিঁড়ে ছড়িয়ে দিল।
শ্যামলী স্বামীর দিকে তাকিয়ে অবাক হচ্ছিল শুধু। মনে পড়ে যাচ্ছিল শেওড়াফুলির সেই বোকাসোকা ছেলেটার কথা। যে এতগুলো বছরের লড়াই পেরিয়ে এখন অনেক পরিণত হয়ে উঠেছে এবং প্রাণপনে নিজের ভালোবাসার সংসারকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে!
তবে, সবকিছুই তারা করছে তাদের মেয়ে তিতিলির অলক্ষ্যে। বাড়িতে কী মহাযজ্ঞ হয়ে চলেছে – তা যেন ঘুণাক্ষরেও তিতলি টের না পায় এমনটাই সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। সমস্তকিছুই ভাবনা মত ধাপে ধাপে হচ্ছে। একসময়ের ‘অ্যাস্পায়ারিং ফিল্মমেকার’ স্বরূপ যেন নিজেদের জীবনের উপরেই একটা চিত্রনাট্য সাজিয়ে ফেলেছে!
এরপর থেকে সমস্ত কাজ পরিকল্পনা মাফিক হয়ে চলেছে।
***
পরের দিন রবিবার। আগের রাত থেকে স্বরূপের বন্ধু উত্তম ওই বাড়িতেই রয়েছে। সে ঘুমোতে গিয়েছে প্রায় ভোর-রাতে। তার আগে পর্যন্ত স্বরূপ, শ্যামলি ও তার মধ্যে চলেছে প্রবল আলোচনা। তিতলি ন’টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। বাকিদের স্বরূপ ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তাদের পরবর্তী কার্যক্রম কী হবে।
উত্তম সেদিন স্বাভাবিকভাবেই দেরী করে ঘুম থেকে ওঠে। উঠেই তিতলির সামনাসামনি হয়ে বলে, “গুড মর্নিং তিতলি!”
তিতলি তখন সকালের টিফিন খাচ্ছিল। সে মুখে অবশ্য বলে, “গুড মর্নিং!”, তবে অপরিচিত একটা লোককে তাদের একটা ঘর থেকে বেরোতে দেখে খানিক অবাকই হয়। উত্তম বাথরুমের দিকে চলে যেতে সে মায়ের দিকে ঘুরে বলে, “এটা কে, মা?”
শ্যামলী যেন তিতলির কথা শুনে হেসেই ফেটে পড়ল। সে তিতলিকে বলে, “সে কি... তুমি ভুলে গেলে উত্তম আঙ্কেলকে? কাল তো তুমিই স্কুল থেকে ফেরার সময় ওকে আমাদের বাড়ি নিয়ে এলে... এত ভুলো মন হলে চলবে সোনা?”
এবার তিতলির আরো অবাক হবার পালা। তার ঠিক মনে আছে – আগের দিনের আঙ্কেলটার মুখটা অন্যরকম দেখতে ছিল! এই আঙ্কেলটা সেই আঙ্কেল নয়! সে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, “কিন্তু...”
এমন সময় সেইস্থানে স্বরূপের আগমন হল। সে দুজনের দিকে তাকিয়ে কৌতুহলী হয়ে বলল, “কী গল্প হচ্ছে মা-মেয়েতে... বাবা কিছু জানতে পারে নাকি?” -বলে তিতলিকে জড়িয়ে ধরল।
তিতলি বলে, “দেখো না বাবা, মা বলছে ওই আঙ্কেলটা নাকি কাল আমার সাথে এসেছে... কিন্তু...”
তিতলিকে পুরো কথা বলতে না দিয়েই স্বরূপ বলল, “হ্যাঁ, আমি জানি তো... তোমার মা আমাকেও বলেছে যে, তুমি নাকি তোমার বাবার বেস্ট ফ্রেন্ড উত্তম আঙ্কেলকে কাল পথ দেখিয়ে আমাদের বাড়ি নিয়ে এসেছ...”
এমন সময় উত্তমও ওদের মাঝখানে উপস্থিত হয়। তিতলি দেখে – আগের দিনের আঙ্কেলটার জামা-প্যান্টটাই পরে আছে এই আঙ্কেলটা। এবার খানিকটা দমে যায় তিতলি। বাবা-মা দুজনেই যখন একই কথা বলছে... তাহলে হয়ত তাই হবে! হয়ত আগের দিন সে-ই ঠিক করে লক্ষ্য করেনি আঙ্কেলটার মুখ, তাই আঙ্কেলটাকে কাল একরকম দেখতে লাগছিল আর আজ আরেকরকম লাগেছে!
***
উত্তম সকালের খাবার খেয়ে নিতেই, শ্যামলী তিতলকে ডেকে বলে, “যাওতো মা... উত্তম আঙ্কেলকে একটু আমাদের এলাকাটা ঘুরিয়ে আনো তো...”
“ঠিক আছে মা।” –বলে তিতলি উত্তমের হাত ধরে বেড়িয়েই যাচ্ছিল, এমন সময় শ্যামলী আবার তাকে ডাক দিয়ে বলল, “একবার ঝিমলি মাসিদের বাড়িতেও নিয়ে যেও।”
“আচ্ছা মা।” –বলে বেড়িয়ে গেল তিতলি উত্তমের হাত ধরে।
ওরা বেড়িয়ে যেতেই কাজে লেগে গেল স্বরূপ আর শ্যামলী। শ্যামলীর কাজ বেশি না, শুধু চারিদিকে কড়া নজর রাখা। কিন্তু স্বরূপ যেই কাজের দায়িত্ব নিল তা একইসাথে অমানুষিক এবং ভয়ঙ্কর।
চপার দিয়ে মৃতদেহটার থেকে হাত-পা-গুলো আলাদা করে ফেলল স্বরূপ। তারপর চারটে হাত-পায়ের টুকরো ভালো করে বেঁধে চারটে আলাদা আলাদা ব্যাগে ভরল সে। তারপর মুন্ডুটাকে ধর থেকে আলাদা করে নিল।
তারপর খুব সাবধানে একটা হাত ও একটা পা দামোদরের জলে ভাসিয়ে দিল। আরেকটা হাত ও আরেকটা পা ভাগাড়ে ফেলে এল। এবং মুন্ডুটাকে দূরে একটা জঙ্গলে পুঁতে রেখে এল।
সে বুঝল – সবকিছু একদিনেই হবে না, বাকি শরীরটাকে নিকেশ করতে আরো কয়েকদিন লেগে যাবে। একদিনে এতকিছু করাটাও বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ছুটির দিনে বারবার ব্যস্ত হয়ে রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা লোকের সন্দেহের কারণ হতে পারে।
অন্যদিকে, উত্তম আর তিতলি মহা আনন্দে এলাকা ঘুরে বেড়াতে থাকল। তিতলিকে চকোলেট কিনে দেবার বাহানায় কাছের একটা মুদির দোকানে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গল্প করে নিল উত্তম। রাস্তায় বহু অপরিচিত লোকের সাথে আলাপ জমাল। এমনকি ঝিমলিদের বাড়িতে গিয়ে ঝিমলির মায়ের সাথেও বেশ খানিক্ষণ আড্ডা দিল। ঝিমলির মা আবার মনে মনে হয়ত ভেবেছে – আগের দিনের হলুদ ফেরত চাইতে মেয়েকে পাঠিয়েছে শ্যামলী! তাই খানিকটা হলুদগুড়ো প্যাকেটে ভরে তিতলির হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি।
***
চারদিন পর পুলিশ এল ওদের এলাকায়। কোনো এক উত্তম চৌবে নিখোঁজ হয়েছে পাঁচদিন আগে। গোপন সূত্র থেকে পুলিশ জানতে পেয়েছে – লোকটা নাকি এই এলাকাতেই এসেছে! এই কারণেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এলাকার বেশ কয়েকজনের কাছে।
নতুন লোকের আগমন এবং নাম উত্তম শুনে এলাকার সকলেই শ্যামলীদের বাড়ি দেখিয়ে দেয়। শ্যামলীদের বাড়ি এসে উত্তম দাসের সাথে কথাও বলে পুলিশ। তার পরিচয়পত্রও দেখে। এমনকি বাড়ি সার্চ করেও সন্দেহজনক কিছুই পায়না। সুতরাং কোনোরকম কেস্ও তৈরী হয়না শ্যামলীদের বিরুদ্ধে। পুলিশ যাকে খুঁজছে সে উত্তম চৌবে, উত্তম দাস নয় – এটা জানিয়ে পুলিশ বিদায় নেয় ওদের বাড়ি থেকে।
পুলিশ চলে গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সকলে। স্বরূপ ফিস্ফিস্ করে শ্যামলীর কানের কাছে বলে, “কি... বলেছিলাম না – একঝলকের দেখায় কেউ নিশ্চিত হতে পারবে না কোনটা আসল উত্তম আর কোনটা নকল...?”
ভালো লাগল
ReplyDelete