1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, April 15, 2023

আমাদের শরীর মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র সংস্করণ

ছবি : ইন্টারনেট


আমাদের শরীর  মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র সংস্করণ

মৃণাল বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

আমাদের পৃথিবী আমাদের সৌরমণ্ডলের, যার প্রধান নক্ষত্র সূর্য এবং যার ভর সমগ্র সৌরমণ্ডলের প্রায় 98.6 শতাংশ এবং যেটি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির আকাশগঙ্গার বিস্তৃত বিস্তারের একদম বাইরের দিকের একটি প্রলম্বিত বাহুতে প্রায় খুঁজে না পাওয়ার মতো অবস্থানে নিজের উপস্থিতি কে প্রকাশ করে, সেই সূর্য নামক নক্ষত্রের সৌরপরিবারের সূর্যের থেকে প্রায় 15 কোটি কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত সৌরমণ্ডলের তৃতীয় এবং সৌরজগতের বর্তমান স্বীকৃত আটটি গ্রহের মধ্যে পঞ্চম বৃহত্তম গ্রহ। যার উৎপত্তি মহাকাশ বিজ্ঞানীদের হিসেব মতো প্রায় 450 কোটি বছর পূর্বে। যেখানে প্রায় 500 কোটি বছর আগে সূর্যের নক্ষত্র রূপে আত্মপ্রকাশ। আমাদের গ্রহের ঘনত্ব সৌরমণ্ডলের বাকি গ্রহগুলির মধ্যে সর্বাধিক। এর গড় ঘনত্ব প্রায় 5.514 গ্রাম পার সেন্টিমিটার কিউব। এটি প্রায় 23 ঘন্টা 56 মিনিট 4 সেকেন্ডে নিজের অক্ষের চারপাশে একবার প্রদক্ষিণ করে এবং সূর্যের চারপাশে একবার প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় প্রায় 365.26 সৌরদিন (পৃথিবী নিজ অক্ষের চারপাশে ঘুরে এসে একই অবস্থানে ফিরে আসতে যে সময় নেয় তাকে এক সৌর দিন বলা হয় )।

আমাদের পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি প্রায় 300 কোটি বছর আগে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সঙ্গে একযোগে সৌর বিকিরণ এর ক্ষতিকর প্রভাব এর হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে রক্ষাকবচ হিসেবে প্রাণের বিকাশের পথ প্রশস্ত করেছে। পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রায় শতকরা সত্বর ভাগ লবণাক্ত জলের মহাসাগর দ্বারা আবৃত। অবশিষ্টাংশ গঠিত হয়েছে সাতটি মহাদেশ, এখনকার গঠন অনুসারে এবং অজস্র দ্বীপ নিয়ে। পৃথিবীর অভ্যন্তর  ভাগ একটি আপেক্ষিক ভাবে শক্ত ম‍্যান্টেলের মোটা স্তর। একটি লোহা দ্বারা গঠিত মূলকেন্দ্র এবং তার চারপাশের তরল বহির্ভাগ, যা  একটা চৌম্বক কেন্দ্র গঠন করে। পৃথিবীতে মিষ্টি পানীয় জলের পরিমাণ মোট উপস্থিত জলরাশির মাত্র 3%। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে আজ থেকে প্রায় 435 কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করা শুরু করে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও সাগর সমূহ, আগ্নেয়গিরির  অগ্নুৎপাত ও জলীয় বাষ্প সমৃদ্ধ গ্যাসের নির্গমনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। 

এই পৃথিবীতে শত সহস্র প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে একমাত্র মানুষই  সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান এবং স্বতন্ত্র। আপাত গবেষণা থেকে এখনো পর্যন্ত যেটুকু বোধগম্য তাতে করে মানুষের প্রত্যক্ষ পূর্বসূরী প্রাইমেট বা  বানর বর্গের কোন প্রাণী নয়। প্রাইমেটদের বিভিন্ন শারীরিক ও আচার-আচরণ গত বৈশিষ্ট্য পরিবেশের বৈচিত্র, কাজকর্মের ভিন্নতা এবং পুষ্টিগত বৈচিত্র্য দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। প্রাইমেট ও মানুষের মধ্যে বিভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহারগত মিল থাকলেও মানুষ সম্পূর্ণভাবেই একটা ব্যতিক্রম। মানুষেরা সম্পূর্ণভাবে দ্বিপদী। এরা চলাচলের জন্য হাতের সাহায্য নেয় না। একমাত্র ছোটবেলায় বেড়ে ওঠার সময় কিছুটা সময় ছাড়া। মানুষের মগজ সমস্ত প্রাইমেটদের চাইতে আকারে বড় ও জটিল, বিশেষত সেরিব্রাল কর্টেক্স ( সেরিব্রাম এর বাইরের দিক )। এটি যত বেশী ভাজ যুক্ত  হবে আমাদের বুদ্ধি তত বেশি হবে। মানুষের মধ্যে যৌন মিলনের কোন নির্দিষ্ট সময়কাল নেই। মানুষের শৈশব অন্যান্য প্রাইমেটদের তুলনায় অনেক বেশী দীর্ঘস্থায়ী ওপর পরনির্ভরশীল। মানুষের আচরণের ওপর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রভাব অন্যান্য প্রাইমেটদের তুলনায় অনেক বেশি। মানুষই একমাত্র লজ্জা বস্ত্র পরিধান করে, বাসস্থান এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। আগুনের ব্যবহার কে কাজে লাগিয়ে অন্যান্য প্রাণীদের থেকে নিজেদেরকে পুরোপুরি আলাদা মর্যাদায় উন্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। মানুষেরই একমাত্র জ্ঞানপিপাসা রয়েছে। নিজেকে আরও উন্নত করার দৃঢ় মানসিকতা ও প্রচেষ্টা রয়েছে। এবং এই মানসিকতাই  তাকে দৈনন্দিন চাহিদাগুলোর পরিপূরণ ও তার পুনঃউন্নতিকরণ  ঘটাতে সাহায্য করছে। একমাত্র মানুষই তার সন্তানের উন্নত ভবিষ্যতের চিন্তা করে। তার খাদ্যাভ্যাসে নিত্যনতুন পরিবর্তন ঘটায় এবং শুধুমাত্র এই পৃথিবীকেই নয়, এই পৃথিবীর বাইরের জগতকেও তাঁর জ্ঞান চক্ষু দিয়ে দেখতে চায়। তার হাত দিয়ে স্পর্শ করতে চায়। তার সত্তা দিয়ে অনুভব করতে চায়। ভালো ও মন্দের ফারাক একমাত্র মানুষই অনুভব করে এবং প্রয়োজনে আত্ম সমালোচনাও করতে পারে। অন্যের ভালটাকে ভাল, মন্দ টাকে মন্দ বলার সৎ সাহস দেখাতে পারে। একমাত্র মানুষেরই লিখিত ইতিহাস এবং লিখিত আইন আছে, যার দ্বারা বিভিন্ন অন্যায় এর সঠিক এবং নিরপেক্ষ শাস্তিবিধান সম্ভব। অর্থাৎ নিজের উন্নতির পাশাপাশি নিজেকে একটা আচরণগত গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখার প্রয়োজনীয়তাও মানুষই একমাত্র ব্যতিক্রম, যে অনুভব করেছে। অর্থাৎ মানুষের জীবনটা প্রচন্ড শৃংখলাবদ্ধ,  ঠিক যে শৃঙ্খলা বিশ্বজুড়ে সমস্ত প্রকার মহাজাগতিক বস্তুর জীবনচক্রে পরিলক্ষিত হয়।

আমাদের পৃথিবীতে এই মুহূর্তে প্রায় 780 কোটি মানুষ রয়েছে। জনবসতির ঘনত্বে সবচেয়ে বেশি ঘনত্বের দেশ ম‍্যাকাও। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে 21,055 জন। বম্বে শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে 22,937 জন। কোলকাতায় যেটা 22,000 প্রতি বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু এত সংখ্যক মানুষ পাশাপাশি বসবাস এবং চলাফেরা করা সত্বেও একে অপরের সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে সচরাচর দৈনিক সংঘর্ষ ঘটে না। ভিড়  ট্রেনে,বাসে বা অন্য যে কোন যানবাহনের ভেতরের ব্যাপারটা আলাদা, কারণ ওটা অনিচ্ছাকৃত এবং কিছুটা বাধ্য হয়েই। এই মহাকাশেও প্রতিটি গ্যালাক্সিতে সহস্র কোটি নক্ষত্র এবং তাদের আরো সহস্র কোটি সৌরজগৎ ও বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু কণা থাকা সত্ত্বেও সচরাচর কোনরকম সংঘর্ষ ঘটে না। কারণ একটাই। নির্দিষ্ট সময় ধরে, সূত্র মেনে পারস্পরিক সহাবস্থান। আমাদের মানব শরীরের মূল গঠন গত একক কোষ যার সংখ্যা পরিণত অবস্থায় গড়ে প্রায় 37.2 ট্রিলিয়ন। আমাদের শরীরে মোট এগারো টি তন্ত্র, যথাঃ সংবহন তন্ত্র, পরিপাক ও রেচন তন্ত্র, অন্তক্ষরা গ্রন্থি তন্ত্র, আচ্ছাদন তন্ত্র- চুল, ত্বক এবং নখ দ্বারা গঠিত, অনাক্রম্য তন্ত্র ও লসিকা তন্ত্র, পেশিতন্ত্র,  স্নায়ুতন্ত্র, বৃক্ক ও মূত্রতন্ত্র, প্রজননতন্ত্র, শ্বসনতন্ত্র এবং কঙ্কালতন্ত্র। আমাদের শরীরের অঙ্গ বলতে বুঝি, একগুচ্ছ কলা, যা নির্দিষ্ট একটি বা অনেকগুলো কাজ সম্পন্ন করে- যেমন স্নায়ু কলা, রক্ত কলা, যোজক কলা প্রভৃতি। অঙ্গগুলো যথাক্রমে হৃদপিন্ড, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, চোখ, পাকস্থলী, প্লীহা,অস্থি, অগ্নাশয়, বৃক্ক, যকৃত, অন্ত্র সমুহ, ত্বক ( সর্ব বৃহৎ অঙ্গ ), গর্ভাশয় ও মূত্রথলি। প্রতিটি তন্ত্র নিজস্ব ও অন্যান্য অঙ্গতন্ত্র এবং সমগ্র শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে যৌথভাবে কাজ করে। প্রতিটি তন্ত্রের দুই বা ততোধিক অঙ্গ রয়েছে যেগুলো কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক কোষ- কলার কার্যগত সহাবস্থান। তন্ত্র গুলো বিচ্ছিন্নভাবে কোন কাজ করে না এবং ব্যক্তির ভালো থাকা, সমস্ত শরীরের পারস্পরিক সম্পর্ক যুক্ত  তন্ত্র সমূহের ভালো থাকার উপর নির্ভর করে। আমাদের মহাবিশ্বের প্রত্যেকটি মহাজাগতিক বস্তু একে অপরের সাথে পারস্পরিক ভাবে সম্পর্কযুক্ত। যেমন পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি ও তার বিকাশ সূর্যের ভেতরে প্রতি মুহূর্তে ঘটে যাওয়া পারমাণবিক সংযুক্তিকরণ বিক্রিয়া দ্বারা উৎপন্ন তাপ ও আলোর ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। আবার পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রচুর উল্কাপিণ্ড কে ঢুকতে বাধা দেয় বৃহস্পতির অবস্থান। বৃহস্পতি আকারে অনেক বড় হওয়ায় তার দ্বারা পৃথিবী মুখী আগত বিভিন্ন আকৃতির গ্রহাণু বিচ্যুত হয়। আমরা জানি আমাদের শরীরের শতকরা 60 ভাগ জল এবং আমাদের শরীরে উপস্থিত মৌল গুলির মধ্যে প্রধান মৌল হল যথাক্রমে অক্সিজেন- শতকরা 65 ভাগ, কার্বন-  শতকরা 18.5 ভাগ, হাইড্রোজেন- শতকরা 9.5 ভাগ, নাইট্রোজেন- শতকরা 3.2 ভাগ। আমাদের মহাবিশ্বের উপস্থিত পদার্থের মধ্যে, যার ওজন মাত্র শতকরা 5 ভাগ এবং বাকিটা কৃষ্ণবস্তু- যে সমস্ত তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ কে শোষণ করে, আবার একে উত্তপ্ত করলে সমস্ত শোষিত তরঙ্গ কে মুক্ত করে দেয়, এবং কৃষ্ণশক্তি ; শতকরা 70 ভাগ হাইড্রোজেন,  শতকরা 26 ভাগ হিলিয়াম,1 ভাগ অক্সিজেন - যেটি উৎপন্ন হয়েছে বিপুল ওজনের নক্ষত্রের ক্রম বিবর্তনে সুপারনোভা  পর্যায় প্রাপ্তির মুহূর্তে, সামান্য পরিমাণে কার্বন-  যেটি লোহিত দানব পর্যায়ে থাকে,  সামান্য পরিমাণে নিয়ন- কার্বন ও অক্সিজেনের উৎপত্তির মধ্যবর্তী পর্যায়ের সুপারনোভা বিস্ফোরণের পূর্ব-মুহূর্তে সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, নাইট্রোজেন- যেটি আমাদের সূর্যের মতো ভরবিশিষ্ট তারাদের পারমাণবিক সংযুক্তিকরণের পর্যায়ে যেখানে কার্বন ও অক্সিজেনর উপস্থিতি থাকে, ম্যাগনেসিয়াম- যেটি  খুব বৃহৎ নক্ষত্রের সংযুক্তিকরণ পর্যায়ে  উৎপন্ন হয়, সিলিকন যেটি প্রাক সুপারনোভা পর্যায়ে অবশেষ হিসেবে পাওয়া যায়, লোহা- যেটা শ্বেত বামন নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অংশের সংকোচন থেকে সৃষ্টি হয় এবং সালফার- যেটিও শ্বেত বামন নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অংশের সংকোচনের ফলে উৎপন্ন হয়।

 আমাদের মহাবিশ্বের একাধিক গ্রুপ বা ক্লাস্টার আছে। প্রতিটি গ্যালাক্সিতে কোটি কোটি নক্ষত্র আছে এবং প্রায় প্রতিটি নক্ষত্রেরও নিজস্ব পরিবার বা সৌরমন্ডল রয়েছে আবার প্রতিটি গ্রহের ও নিজস্ব গ্রুপ রয়েছে, যেখানে উপগ্রহ গুলি তাদের নিজস্ব গ্রহ গুলিকে ক্রমাগত তাদের নির্দিষ্ট কক্ষপথে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে পরিভ্রমণ করে চলেছে এবং সেটা খুবই সুষ্ঠুভাবে,কেউ কারো কোনো রকম অসুবিধা না ঘটিয়ে প্রচন্ড রকমের একটা নিয়মানুবর্তিতা বজায় রেখে। ঠিক আমাদের শরীরের বিভিন্ন কোষ, কলা, অঙ্গ এবং তন্ত্রের মতো। এবং সবটা মিলেই একটা গ্যালাক্সি। আবার প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটা বিপুল ভরের  কৃষ্ণ গহ্বর আছে, আমাদের শরীরের মস্তিষ্কের মতো। এবং পারস্পরিক মহাকর্ষ বল, যেটা আমাদের নার্ভ তন্ত্রের গঠন ও কার্যগত একক নিউরনের অ‍্যাক্সন ও  ডেনড্রন- এর মত পারস্পরিক বিভিন্ন অঙ্গগুলোর মধ্যে বৈদ্যুতিক সিগন্যাল বা অনুভূতির আদানপ্রদান ঘটাচ্ছে। আমাদের শরীর  যেমন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত ঠিক তেমনি প্রতিটি নক্ষত্রের জীবনেও বিভিন্ন পর্যায় আছে। আমাদের সূর্যের মতো নক্ষত্রদের শুরুটা হয় বিশাল আকার নীহারিকার মধ্যে অবস্থিত হাইড্রোজেন পরমাণুর মধ্যে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় যার পরিমাণ 10^7 থেকে 10^8 ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এবং যেটা নীহারিকার মধ্যে অবস্থিত কোটি কোটি হাইড্রোজেনের অনুর মধ্যকার সংঘর্ষের ফলে উৎপন্ন হয়, যখন পারস্পরিক মহাকর্ষ বলের আকর্ষণে ঘন সন্নিবিষ্ট অবস্থায় হাইড্রোজেনের গ্যাসীয় অনুগুলি একে অপরের উপর গিয়ে পরে। পারমাণবিক সংযুক্তিকরণ বিক্রিয়ায়, যার মাধ্যমে চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু পরস্পর মিলিত হয়ে পরবর্তী ভারী মৌল হিলিয়ামের দুটি পরমাণু এবং একটি নিউট্রন কণার জন্ম দেয় এবং প্রচুর পরিমাণে শক্তি প্রায় 17.59 MeV তাপ ও আলো আকারে উৎপন্ন হয়। এই ঘটনা ততক্ষণই চলতে থাকে যতক্ষণ না সেই নক্ষত্রের কেন্দ্রে উপস্থিত সমস্ত হাইড্রোজেন পরমাণু সম্পূর্ণভাবে হিলিয়ামে পরিণত হচ্ছে এবং এই অবস্থায় নক্ষত্রটির কেন্দ্র বা  কোর  অঞ্চল বিপুল পরিমাণ আভ‍্যন্তরিণ  কেন্দ্র অভিমুখী আকর্ষণে ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে এবং পাশাপাশি তার বাইরের গ্যাসীয় আবরণ ক্রমাগত স্ফীত হয়ে ধীরে ধীরে মহাকাশে বিলীন হওয়ার মাধ্যমে লোহিত দানবে পরিণত হয় এবং ক্রমাগত তাপ বিকিরণ করে তার উষ্ণতা হারিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে এসে শ্বেত  দানবে পরিণত হয় এবং আরও লক্ষ কোটি বছর ধরে তাপ শক্তি হারিয়ে ক্রম সংকোচনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যায়। ভারী নক্ষত্র গুলিতে, যেগুলির লোহিত দানব অবস্থায় কেন্দ্রের ওজন আমাদের সূর্যের ভরের 1.4 গুণের বেশি হয়, যাকে ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখর এর নামানুসারে চন্দ্রশেখর লিমিট বলা হয় এবং যার জন্য 1983 খ্রিস্টাব্দে তিনি পদার্থ বিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, তবে সেই তারাটি শ্বেত বামনে  পরিণত না হয়ে আভ্যন্তরীণ কেন্দ্র অভিমুখী  মহাকর্ষ বল কে উপেক্ষা করতে না পারার দরুন মহাজাগতিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হয়। এরা সাধারণত শুধুমাত্র নিউট্রন দিয়ে তৈরি, যার ব‍্যাস  প্রায় কুড়ি কিলোমিটার এবং ওজন 1.18 থেকে  1,97 গুণ আমাদের সূর্যের ভরের সমান হয় এবং এদের ঘনত্ব জলের ঘনত্বের প্রায় 10^14 গুণ। আবার যদি লোহিত দানব নক্ষত্রের সংকুচিত কেন্দ্রের ওজন সূর্যের ভরের তিন গুণের বেশি হয় সে ক্ষেত্রে নিউট্রন নক্ষত্র উৎপন্ন হওয়ার পরিবর্তে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হয়। এই অবস্থায় এর ভেতর  ঘটনা দিগন্তকে  অতিক্রম করে প্রবেশ করা আলোও এর বিপুল আকর্ষণ  বলকে  উপেক্ষা করে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না এবং কৃষ্ণ গহ্বরগুলি ক্রমাগত তাদের আশেপাশের মহাজাগতিক বস্তু কে তার বিপুল আকর্ষণ শক্তি দ্বারা তার ঘটনা  দিগন্তের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে নেয় এবং এর ফলে তার মধ্যে থেকে ক্রমাগত শক্তির উভমুখী বিকিরণ  ঘটে যা, বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্টিফেন হকিং এর ধারণা অনুযায়ী হকিং বিকিরণ। এর বিশেষত্ব হলো যে মহা বিশ্বের সর্ব ধরনের মৌলিক কনাই বিকিরিত  হতে থাকে এই রশ্মির মাধ্যমে। এবং এর কেন্দ্র অঞ্চলটি আরো ভারী ও সংকুচিত হয় এবং এক সময়ে পয়েন্ট অফ সিঙ্গুলারিটি বা একক বিন্দুতে পরিণত হয় এবং পরবর্তী আরো কয়েক বিলিয়ন বছর বাদে সমস্ত মহাজাগতিক শক্তি একটি অসীম ভর ও ঘনত্ব  এবং তাপমাত্রা বিশিষ্ট  চরম  একক বিন্দুতে (পয়েন্ট অফ এক্সট্রিম সিমিলারিটি ) পরিণত হবে, যে অবস্থা থেকে আজ থেকে প্রায় 13.8 বিলিয়ন বছর পূর্বে আমাদের মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল বেশিরভাগ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মত অনুযায়ী, মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে।

তারাদের ক্রম বিবর্তণ বা ক্ষয় আমাদের সূর্যের ন্যায় ভরযুক্ত তারাদের তুলনায় যাদের ভর যত গুণ ভারী ঠিক ততগুণ দ্রুততার সাথে ঘটে অর্থাৎ বেশী  ভরযুক্ত নক্ষত্রদের আয়ুষ্কাল তুলনামূলক ভাবে কম ওজন যুক্ত তারাদের থেকে কম। এইজন্যই প্রাণের বিকাশ খুঁজতে গেলে আমাদের সূর্যের মতো ভরযুক্ত তারাদের সৌরমন্ডলেই  সেই সম্ভাবনা বেশি কারণ এই তারাগুলি বহু বছর ধরে ধীরে ধীরে তাদের শ্বেত-বামন দশায় যাওয়া পর্যন্ত সেখানে প্রাণের বিকাশ লাভ করার পর্যাপ্ত সময় পায় বা প্রাণের পরিপূর্ণতা অর্থাৎ উন্নত সভ্যতার বিকাশের যথেষ্ট অবকাশ থাকে। আমাদের পৃথিবীতে গত তিনশ কোটি বছর ধরে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে। প্রথমে এককোষী, তারপরে   দ্বিকোষী এবং সেখান থেকে বহুকোষী জীবের উদ্ভব ঘটেছে এবং ধারাবাহিক ক্রম বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের মতো বুদ্ধিমান জীবের আবির্ভাব ঘটেছে এবং তাদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়ে আরো উন্নততর, আরো আধুনিক হওয়ার প্রয়োজনীয় সমস্ত প্রাপ্তি ঘটেছে। এবং এই ভাবে সূর্য যেহেতু তার এই বর্তমান অবস্থায় আরো দীর্ঘ প্রায় পাঁচশ কোটি বছর নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে তাই এই পৃথিবীর প্রাণী সভ্যতাও নিজেদেরকে আরো অধিক উন্নিত করার জন্য অন্তত আরো প্রায় 100 কোটি বছর সময় পাবে,যদি না নিজেদের ভুলে প্রাকৃতিক সাম‍্যাবস্থা বজায় রাখতে অপারগ হয়। 

আমাদের মানুষের মধ্যেও ঠিক একই রকম পরিণতি দেখা যায় অর্থাৎ, আমাদের মধ্যে সাধারণত শতকরা প্রায় 85 ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে স্থূলো ব্যক্তিরা তাড়াতাড়ি বিভিন্ন প্রাণঘাতী অসুস্থতার শিকার হন এবং তাদের আয়ুষ্কাল তুলনামূলকভাবে কম। যেখানে রোগা মানুষেরা  সাধারণত বেশিদিন বাঁচেন অর্থাৎ দীর্ঘজীবী হন। আমাদের শরীরে প্রধানত দুই ধরনের বিপরীতধর্মী শক্তি একত্রে বিরাজ করে তাই প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই ভালো-মন্দ, পাপ পুণ্য, আধুনিকতা ও কুসংস্কার, হিংসা ও ভালোবাসা, আয় ও ব‍্যয়, সুস্থতা এবং অসুস্থতা প্রভৃতি দ্বৈত গুণ একত্রে অবস্থান করে ঠিক যেমন প্রতিটি মহাজাগতিক বস্তুর মধ্যেই একই মুহুর্তে দুটি বিপরীতমুখী শক্তি বা আকর্ষণ বল ক্রিয়া করে। বস্তুর মধ্যকার মহাকর্ষ বল তাদেরকে কাছে টানে আবার একটি বিপরীতমুখী অপকেন্দ্র বল তাদেরকে পরস্পরের আকর্ষণ কাটিয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু এই দুটি বলই  সমশক্তি সম্পন্ন ও বিপরীতমুখী হওয়ায় তারা পরস্পরের সাপেক্ষে একই অবস্থানে থাকে যতক্ষণ না তাদের নিজস্ব ভরের তারতম্য ঘটে কারণ প্রতিটি বস্তুরই একটা স্বাধীন অস্তিত্ব বা চিন্তা ধারা থাকে ফলে কেউ অন্যের বন্ধনে বা অধীনে আবদ্ধ থাকতে পছন্দ করে না। যে কোন প্রাণীর ক্ষেত্রেও বিশেষত মানুষের ক্ষেত্রে যারা সমাজবদ্ধ ভাবে বা একত্রে মিলেমিশে একটা গ্রুপ বা ক্লাস্টার হিসেবে বসবাস করে, সেখানে দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত মানসিকতা বা বিবেচনা সম্পন্ন মানুষ ছোট ছোট গ্রুপে, যেটাকে আমরা পরিবার বলি,  অবস্থান করে এবং প্রতিনিয়ত পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বা  বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় এবং সেখানে একাধারে ভালোবাসা বা আকর্ষণ এবং বিচ্ছেদ বা  বিকর্ষণের সহাবস্থান পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু তথাপি শতকরা 90 শতাংশ ক্ষেত্রেই তারা একত্রে একটি নির্দিষ্ট শৃঙ্খলায় আবদ্ধ হয়ে তাদের জীবন অতিবাহিত করে এবং তাদের দুজনের মধ্যে মূল যে বন্ধন শক্তি ক্রিয়া করে যেটাকে মহাকর্ষ বলের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, সেটি হচ্ছে তাদের সন্তান, কারণ সেখানে তাদের যৌথ অংশগ্রহণকারী ইচ্ছা শক্তির প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান। আবার প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে কিছু ঋণাত্মক শক্তি অবস্থান করে যারা এই দুটি মানুষের মনে হিংসা, বিদ্বেষ, ভুল-বোঝাবুঝির মতো পরিস্থিতির উদ্ভব করে এবং এদের মানসিকতায় দূরত্ব তৈরি করে যেটা পরস্পরকে মানসিকভাবে দূরে সরিয়ে দেয় এবং এটা খুব দ্রুত হারে সম্পন্ন হয়।ঠিক ডার্ক এনার্জি বা কৃষ্ণ শক্তির মত। যেটির জন্যই গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে সময়ের সাপেক্ষে তুলনামূলকভাবে দ্রুত তাদের মধ্যেকার দূরত্ব কে বাড়িয়ে তুলছে। যেটিকে মহাকাশবিজ্ঞানীরা মহাকর্ষ বলের বিপরীত শক্তি রূপে কল্পনা করছেন এবং গোটা বিশ্বের মতো মানুষের মধ্যেও এই বিপরীতমুখী শক্তির প্রাধান্য দেখা যায়। প্রতিটি দেশ বা গোষ্ঠীকে যদি আমরা এক একটা গ্যালাক্সি হিসাবে মনে করি তবে এই পরিস্থিতিটাকে বুঝতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। দুটি ভিন্ন ধর্মী ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পৃথিবীর মানব সভ্যতার ক্রম উন্নয়ন হওয়ার সাথে সাথে এই মতবিরোধ বা পারস্পরিক সমঝোতার মানসিকতা আরো বেশি নৈকট্য হারাচ্ছে বা তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বা বোঝাপড়ার অভাব দিনকে দিন আরও প্রকটতর হচ্ছে। 

মানুষের মতোই গোটা বিশ্বেও মাত্র একটি শক্তিই  বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রূপে বিদ্যমান এবং সেটি হচ্ছে  আকর্ষণ শক্তি। এবং আকর্ষণ বল থাকার অর্থই হল একটি বিপরীতমুখী সমপরিমাণের বল, অর্থাৎ বিকর্ষণ বলের উপস্থিতি। এই বিশ্বের মোট ভর ও শক্তি পরস্পরের পরিপূরক এবং এই দুটিকেই সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায়না। শুরুতে যা, শেষেও তাই। শুধু পারস্পরিক পরিবর্তন, অর্থাৎ ভর থেকে শক্তি এবং শক্তি থেকে ভরে রূপান্তর ঘটে মাত্র। বিশ্ব শুরুর সময় সেই চরম একক বিন্দুতে শুধুমাত্র শক্তির উপস্থিতি ছিল কোন ভরের অস্তিত্ব ছিল না। আবার মধ্যকার বিভিন্ন পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময় বাদে পুনরায় সমস্ত শক্তি আবার চরম একক বিন্দুতে পুঞ্জিভূত হবে এবং একটি নতুন বিশ্ব সৃষ্টির আবহ  বা পরিমণ্ডল তৈরি করবে। এই বিশ্ব সসীম। নির্দিষ্ট সময় অন্তর এর পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং আমাদের প্রাণী দের ক্ষেত্রেও পুনঃ জন্মের মাধ্যমে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শক্তিবিন্দুর পুণরাবির্ভাব ঘটে। পৃথিবীতে প্রান সৃষ্টির পেছনে দুটি বিপরীত ধর্মী শক্তি বিন্দুর পারস্পরিক একত্রীকরণ দ্বায়ী। অর্থাৎ দুটি বিপরীত গুণসম্পন্ন শক্তির পারস্পারিক আকর্ষণের তীব্রতা তাদেরকে ক্ষণিকের জন্য ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ দেয় একটা সুরঙ্গপথে এবং সেই অন্ধকার সুরঙ্গপথে পারস্পরিক বিপরীতমুখী দুটি তীব্র  ইচ্ছা শক্তির পারস্পরিক মিলন ঘটে এবং সৃষ্টির বীজ রোপিত ও বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় এবং যেই মুহূর্তে শক্তি বস্তুতে রূপান্তরিত হয় সেই মুহূর্তে পারস্পরিক তীব্র আকর্ষণ শক্তি পরস্পরকে একে অপরের দিকে আকৃষ্ট করে যেটা সেই নীহারিকায় হাইড্রোজেনের মেঘের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণে প্রথম প্রটোস্টারের উৎপত্তির ঘটনার মতো এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পরে, মানুষের ক্ষেত্রে যেটা প্রায় নয় মাস দশ দিন, প্রথম নক্ষত্র সৃষ্টি হয় এবং তার আয়ুষ্কাল বিভিন্ন পর্যায়ে বিস্তার লাভ করে তার আকার আকৃতি অনুযায়ী। যেটা নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে বস্তুকে নিজের শরীরে আত্তীকরণ এর মাধ্যমে। অর্থাৎ তার স্থায়িত্ব নির্ভর করে।

সবশেষে বলার  চেষ্টা করবো  একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়তো বা একেবারেই নতুন এবং স্বতন্ত্র বিষয় নিয়ে।সেইটি হচ্ছে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্যের, হতেই পারে, আসল ব্যাখ্যা। আমরা জানি যে; কোন বিস্ফোরণে শক্তির  সম্প্রসারণ কখনোই একমুখী হতে পারে না। আমাদের সাধারন বুদ্ধিতে যেকোনো বিস্ফোরণেই  শক্তি সবদিকে সমানভাবে বিস্তার লাভ করে। বন্দুকের গুলি যখন নির্গত হয় বন্দুকের নলের ভেতর থেকে, এখানে নলটিকে অন্ধকার সুরঙ্গ হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে, তখন গুলি যে দিকে নিক্ষিপ্ত হয় তার বিপরীত দিকে একটি সমপরিমাণ ধাক্কা অনুভূত হয়। একটি মহাকাশযান বা রকেট যখন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিক্ষিপ্ত হয় তখন তার বিপরীতে সমপরিমাণ শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটে। ফলে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী আমাদের এই মহাবিশ্ব যদি  বিস্ফোরণের মাধ্যমে ঘটে থাকে তাহলে সেটিও কখনোই একমুখী হতে পারে না। তারও একটা বিপরীত বহিঃপ্রকাশ অবস‍্যই থাকতে বাধ্য। এবং শুরুর সেই বিন্দুটি, অর্থাৎ চরম  একক  বিন্দু ,যেহেতু একটি বিন্দুতেই স্থির অর্থাৎ তার স্থানচ্যুতি ঘটছে না তাহলে দুটি সমশক্তি সম্পন্ন দলের ধারণা করা যেতেই পারে যারা একটি বিন্দুকে এক জায়গায় স্থির রেখে দড়ি টানাটানি প্রতিযোগিতায় ক্রমাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যাচ্ছে। অর্থাৎ দুটি সমান্তরাল বিশ্বের,কল্পনা নয় বাস্তবে ঘটার সম্ভবনাই জোরালো স্বীকৃতি পাচ্ছে বা পাওয়া উচিত। এটা সেই দেবতা ও অসুরদের অমৃত পাওয়ার উদ্দেশ্যে সমুদ্রমন্থনের গল্পটাকেই পুনরায় মনে করিয়ে দিচ্ছে। যেখানে নাগরাজ বাসুকিকে মন্থন রজ্জু করে, মন্দর নামের পর্বতকে মন্থন দন্ড করে দেবতা ও অসুররা মন্থন কার্য শুরু করেন। পুরাণের গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে 14 প্রকারের রত্ন ও ভেষজ  ছাড়াও তিন দেবী এই মন্থনের ফলে ক্ষীরসাগর থেকে উত্থিত হন।

আমরা জানি যে এই বিশ্বের প্রত্যেকটি কণা বা  শক্তির একটি সম গুণ  সম্মন্ন বিপরীত প্রকৃতির কণা বা  শক্তির উপস্থিতি বা অস্তিত্ব আছে কিংবা থাকা উচিত। পদার্থবিজ্ঞানে বিপরীতধর্মী প্রতিকণা এবং প্রতি পদার্থের ধারণায় বলা হয়েছে যে যেভাবে কণা দ্বারা পদার্থ গঠিত হয় সেই ভাবেই প্রতিকণা দ্বারা প্রতিপদার্থ গঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ একটি প্রতি প্রোটন ও একটি পজিট্রন বা প্রতি ইলেক্ট্রন দ্বারা একটি প্রতি হাইড্রোজেন পরমাণু গঠিত। সাধারণভাবে প্রতিপদার্থ কণাদের তাদের নেগেটিভ বেরিয়ন সংখ্যা বা লেপটন সংখ্যা দিয়ে ধারণা দেওয়া হয়। যেখানে সাধারন কণাগুলোর ব্যারিয়ন সংখ্যা পজেটিভ। এই মহাবিশ্বে এখনো পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে উঠে আসা তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে,  এখানে সাধারণ পদার্থ বেশি। যেখানে বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুসারে পদার্থ এবং প্রতিপদার্থ এর সংখ্যা সমান থাকা উচিত। এই অসামঞ্জস্যতা কে বেরিওজেনেসিস সমস্যা বলা হয়। পার্টিকেল এক্সেলেরেটর  এবং তেজস্ক্রিয় ভাঙ্গন  থেকে একক প্রতিকণা তৈরি করা সম্ভব। অতিসম্প্রতি অনেক চেষ্টায় বিজ্ঞানীরা অ‍্যান্টি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।

বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী আধান, ঘূর্ণন ও অন্যান্য কোয়ান্টাম সংখ্যা ব্যতীত কণা ও প্রতিকণার সকল ধর্মই এক। তারমানে একটি কণা ও তার প্রতিকণার  ভর  এবং আয়ুস্কাল একই। আবার কিছু কণা, যেমন ফোটন এবং মেসন- এরা নিজেরাই নিজেদের প্রতিকণা। নিউট্রিনোও এই গোষ্ঠীভুক্ত হতে পারে। মূলত, প্রতি প্রোটন, প্রতি নিউট্রন এবং প্রতি ইলেকট্রন সমূহকে নিয়ে প্রতিপদার্থ গঠিত হয়। প্রতিটি কণা ও প্রতিকণা পরস্পরের সংস্পর্শে আসলে একে অপরকে ধ্বংসের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়। এই শক্তি এতটাই বেশি যে  একটি মহাকাশযান মঙ্গলে নিয়ে যেতে মাত্র চার গ্রাম পজিট্রনই যথেষ্ট। এবং মৌলিক কণা কোয়ার্কেরও প্রতিকণা আছে। আবার গ্র‍্যাভিটনের, যেটি একটি ভর শূন্য বোসন কণা এবং মহাকর্ষ বলের বাহক, এরও প্রতিকণা আছে।সমান্তরাল বিশ্বের প্রতিটি প্রতিপদার্থ প্রতিকণা দ্বারা গঠিত।এখানে সময় বিপরীতে প্রবাহিত হয় অর্থাৎ মাঝের  চরম একক বিন্দুর  অবস্থানটিকে বর্তমান ধরলে, যদিও বাস্তবে বর্তমান বলে কোনো মুহূর্তের অস্তিত্ব সম্ভব নয় কারণ প্রতি মুহুর্তে সময় পরিবর্তিত হচ্ছে, আমরা অতীত ও ভবিষ্যৎ এই দুটি সমান্তরাল বিশ্বের মধ্যে সতত  বিচরণ করছি। অতীত মানে ফেলে আসা সময় এবং ভবিষ্যৎ মানে আগামীর সময়। এই বিশ্বের সৃষ্টির পরবর্তী কিছুটা সময় আমাদের জন্মের পরবর্তী বছর দেড় বা দুইয়ের  মতো  পুরোটাই শুন্য বা ফাঁকা। এই সময়কার কোন স্মৃতি আমরা রোমন্থন করতে পারি না। তার পরবর্তী দেড় দু বছরের স্মৃতি টাও কিছুটা আবছা। আমাদের কাছে সেই স্মৃতি গুলোই  স্পষ্ট যেগুলো তৈরি হয়েছে সেইসব কাজের মধ্য দিয়ে যেখানে আমরা নিজেদের বিচারবুদ্ধি বা ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগাই এবং যার থেকে আমরা কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করি। সেখানে চাপিয়ে দেওয়া  ইচ্ছা শক্তিও থাকতে পারে। অর্থাৎ ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে কিছু করিয়ে নেওয়া বা করতে বাধ্য করা। কারণ সেখানেও একটা মানসিক তরঙ্গের উৎপত্তি ঘটে। সেটা হতেই পারে ঋণাত্মক কিংবা ধনাত্মক। একদম ছোট বেলায় কোন শিশুই কোনো গঠনমূলক কাজ করে না। যা করে সবটাই এলোমেলো বা অপ্রয়োজনীয়। কিংবা খেলাচ্ছলে কোনরকম পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই। সেই কাজের সাথে অতীত বা ভবিষ্যতের  কোন যোগসুত্র থাকেনা। শুধুমাত্রই বর্তমানের উপস্থিতি থাকে। এবং যেহেতু বর্তমান,  সময়ের  একটা অস্থির মুহূর্ত, তাই সেটির কোন প্রভাব আমাদের মনের উপর পড়ে না এবং স্বাভাবিক ভাবেই স্মৃতি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায় না।

আমাদের এই জগত,  যারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী তাদের কাছে, ঈশ্বরের তৈরি। আবার যারা নাস্তিক তাদের কাছে বিজ্ঞান এর দ্বারাই এই বিশ্ব সৃষ্টি এবং পরিচালিত। এবং এই দুই বিশ্বাসের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে যুক্তি, বা  তর্ক -বিতর্ক চলবেই। সেটা চলুক,  কারণ কোন কিছুর ওপর বিশ্বাস থাকতেই হবে। না হলে তো নিজেকেই ঈশ্বর বা এই জগতের সর্বময় কর্তা বলে মনে হবে এবং আরো আরো কংস, কিংবা রাবন, কিংবা মহিষাসুরের জন্ম হবে। ঈশ্বর এবং বিজ্ঞানের মধ্যে মূল তফাত  একটাই, ঈশ্বর হচ্ছেন এমন একটা কল্পনা যাকে সর্বশক্তিমান ধরে নিয়ে নিজের সমস্ত ভালো মন্দের ভার বা গুরুদায়িত্ব তার ওপর সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে জীবনটাকে কাটিয়ে দেওয়া যায়। যেরকম ছোটবেলায় আমরা বাবা-মা’র ওপরে সবকিছু সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে দায়মুক্ত থাকি। আর বিজ্ঞান হচ্ছে সেই শক্তি, জ্ঞান বা কড়া শাসন- যার কাছে কোন আবদার চলবে না কারণ সে নিজের নিয়মে অবিচল। সেখানে ফুল, বেল পাতা, সন্দেশ, মন্ত্র পাঠের  কোন জায়গা নেই। ব্যস্ত রাস্তা পার হতে গেলে ট্রাফিক নিয়ম বা আইন মেনেই সেটা করতে হবে। চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের উপর নিজের ভালো-মন্দ সঁপে দিয়ে নয়।

যে কোন মহাজাগতিক বস্তু কৃষ্ণশক্তি, মহাকর্ষ ও সময় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আবার প্রতিটি বস্তু নিজস্ব গন্ডিতে ত্রিমাত্রিক ( দৈর্ঘ্য × প্রস্থ × উচ্চতা ),অর্থাৎ মহাবিশ্বে পাশাপাশি দুটি পরিমাপক স্কেল বর্তমান। একটি নিজস্ব এবং একটি আরোপিত। প্রথম পরিমাপের স্কেল নিয়ন্ত্রক স্কেল এবং ত্রিমাত্রিক। আকারে কনিকাল (cone shaped ) এবং উভয়মুখী (বিপরীতমুখী সমান্তরাল বিশ্ব ),ডমরু আকৃতির। এবং বাকিটা আকার এবং ভরের স্কেল, যেটা গোটা বিশ্বের বিস্তৃতির সাপেক্ষে চ্যাপ্টা। মেঝের ওপর অনেকগুলো বালুকণা কে উপবৃত্তাকারে বা বৃত্তাকারে ছড়িয়ে দিলে যেমন দেখতে হবে। কারণ সমগ্র বিশ্বের সাপেক্ষে যে কোন মহাজাগতিক বস্তুর আকার, আয়তন এবং ভর প্রায় শূন্য। সমগ্র হিমালয় পর্বতের মাঝে একটা ছোট্ট বালুকণার মতো। এবং দুটি সমান্তরাল মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ততক্ষণই থাকবে যতক্ষণ না সমস্ত বস্তু পুনরায় শক্তিতে ( কৃষ্ণ শক্তি )রূপান্তরিত হচ্ছে। এবং সেই অন্তিম মুহূর্তে দুই সমানন্তরাল মহাবিশ্বের বিপরীতমুখী বিপুল পরিমাণ শক্তির পারস্পারিক টানে তুলনামূলকভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে, যেহেতু তাকে বাধা দেওয়ার জন্য কোন মহাকর্ষ বল সেই মুহূর্তে থাকবে না, আবার চরম একক বিন্দুতে মিলিত হবে এবং পুনরায় মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে বিপরীতমুখী সমান্তরাল মহাবিশ্বের সূচনা হবে, আমাদের শরীরের মতো। কারণ আমাদের দেহের কাঠামো মাথা থেকে পা পর্যন্ত মাঝ বরাবর দ্বিপার্শ্বীয় ভাবে প্রতিসম। অর্থাৎ হুবহু একই আকার ও আকৃতি সম্পন্ন দুটি দেহাংশের মিলিত সহাবস্থান। আমরা যখন দৌড়াই ( চলমান সমান্তরাল মহাবিশ্ব ),তখন আমাদের শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ, প্রত‍্যঙ্গ ডাইনে এবং বামে সমানতালে বিপরীতমুখী স্পন্দিত হয়, পঞ্চ ইন্দ্রিয় গুলিকে সজাগ রেখে। আমাদের শরীরের ক্ষেত্রেও জন্ম থেকে মৃত্যু, প্রথমে ভর বৃদ্ধি, তারপরে মাঝের কিছুটা সময় ধরে ভরের সাম্যতা এবং তার পরে পুনরায় ভরের ক্ষয়। মানুষের গড় আয়ু যদি সত্তর বছর না হয়ে একশ সত্তর বছর হতো তবে আমাদের ক্ষয় প্রাপ্ত দেহও একটা বিন্দুতে গিয়েই শেষ হতো।।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment