ছবি : ইন্টারনেট |
শিবাঙ্গণ
সকালে ঘুম ভেঙে উঠে রাজামশাই একবার রাজপ্রাসাদের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ান, সেই ছোট্ট বেলা থেকে, এরকমটাই অভ্যাস। সামনের দিগন্ত বিস্তৃত ঘন সবুজ বন দেখলে নাকি চোখের দৃষ্টি ভালো হয়, ওনার ঠাকুমা বলতেন। কিন্তু এখন তো আর ওনার সেই ছোটবেলা নেই, বয়স প্রায় তিন কুড়ি পার। কিন্তু ঠাকুমার কথা মতো অভ্যাসটা রয়ে গেছে। আর সত্যি বলতে কি, আর সেই বনভূমিও নেই। বড়ো গাছ বলতে টিকে ছিল সবেধন নীলমণি, একটা পাকুড়, বাকি সব আগেই সাবাড়, কিন্তু তাও ওখান দিয়ে রাস্তা নিয়ে যেতে হবে বলে সেটাও কাটা হবে ঠিক হয়, আর সেই কাজের দস্তাবেজে সই করা থেকেই রাজামশাই এর মুখখানা বেশ গোমড়া, আর আজ সকাল থেকে তো কথাই বলছেন না, যেনো রাত থেকে কোনো একটা চিন্তা ওনার মাথায় কিছু একটা গাঢ় দুশ্চিন্তার কালো মেঘের সঞ্চার করছে, তারই ফল এই গোমড়া মুখ আর খিটখিটে স্বভাব। মুখে এক চিলতে হাসি নেই, মনে যেন সুখের বড়ো অভাব। তা এই সব নিয়েই ধানাই পানাই করতে করতে সকাল নয়টা বাজতে চলল, মন্ত্রী আমাত্যরা সবাই রাজদরবারে এসে গেছেন, এবার যে রাজকার্য শুরু না করলেই নয়। মিছিমিছি বেলা যে বয়ে যায়।
তাই সাহস করে মন্ত্রী মশাই এগিয়ে আসেন, রাজামশাইয়ের কাছে, আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করেই বসেন, "বলছি কি জাঁহাপনা, সুপ্রভাত, কিছু কি সমস্যা এসে হাজির হয়েছে?"
রাজামশাই: সমস্যা, মানে মস্ত সমস্যা, সবাই তো সেই সমস্যার ভিতরেই রয়েছে।
মন্ত্রীমশাই: হুজুর, কোন সবাই, আর সবাই মানে?
আর যারা রয়েছে, তারা কি সেটা জানে?
রাজামশাই: এতো মস্ত গেরো, বাকিদের কথা যদি নাও ধরি, তুমি তো দেশের মহামন্ত্রী, তুমি কি জানো?
নিয়ে কত্ত মস্ত মস্ত ডিগ্রি।
আর যারা গরীব মানুষ, দিন মজুর, নেই যেখানে অনেক অনেক শিক্ষা, তারা যে জানবে না, তাতে তাদের আর দোষ কি?
মন্ত্রীমশাই: হুজুর, একটু যদি বিস্তারিত বলেন।
কোনো শত্রু আক্রমণ, মহামারী, আর্থিক দুরবস্থা, এরকমই কি কিছু?
মাথায় ঠিক আসছে না যে, মন্ত্রী বললেন মুখ করে কাঁচুমাচু।
রাজামশাই: সেসব নয়, মন্ত্রী সেসব নয়, ভাবো অনেক গভীরে,
আমাদের এই পৃথিবীটা...... এই তো মোদের লালন পালন করে।
কিন্তু আমরা....... শুধু লোভ, ক্ষোভ, আর হিংসা ছাড়া, আর কি তাকে দি?
সব প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে, আর কি বাকি কিছু রেখেছি?
মন্ত্রীমশাই মাথা নাড়েন, কথাটা সত্যি, প্রাকৃতিক সম্পদ প্রায় যে নিঃশেষ,
ভবিষ্যতের চলবে কি করে, যেটুকু আছে বাচা কুচা অবশেষ?
রাজামশাই: সেতো ঠিকই মন্ত্রী, সেটাই তো ভেবে চিন্তা হচ্ছে ঢের।
মন্ত্রী মশাই: কেনো রাজামশাই, এতে চিন্তা কিসের?
রাজামশাই: রাজপুত্র তো ছোটো, ওর জন্য কি যে রেখে যাবো, সেটাই ........
মন্ত্রীমশাই: কেনো? সোনা দানা, মণিমানিক্য, রাজকোষ তো প্রায় উপচাই.....
তারসাথে এই দেশ মস্ত,
এপাশে যখন সূয্যি ওঠে, ওপাশে যায়নি তখনও অস্ত।
রাজামশাই: আর বিশুদ্ধ বাতাস, কাঁচের মত ঝকঝকে জল, যা খেলে জুড়াবে প্রাণ মন?
ঊর্বরা মাটি, উৎকৃষ্ট বনজ সম্পদ, থাকবে কিছু, যাতে থাকবে না কীটনাশক মণ মণ।
মন্ত্রীমশাই: একথাটা ঠিক, তবে....
রাজামশাই: কি তবে, এতগুলো মানুষ, শুধু মিটিং করে, মিছিল করে, কিন্তু এর সমাধান করবে কবে?
ভাবো মন্ত্রী, মেরুতে বরফ গলছে, বাড়ছে বিশ্ব উষ্ণায়ন,
তাতে কারো টনক নড়েছে, শুধু চলছে গাছ কেটে নগর সম্প্রসারণ।
কি বল হে, বাকিরা সব,
কি হে, পূর্ত মন্ত্রী, কেটেছ এ বছর কটা গাছ যেন?
পূর্তমন্ত্রী: আজ্ঞে হুজুর, এভাবে লজ্জা দিচ্ছেন কেনো?
সবার সামনে..... খারাপ লাগে না এভাবে বললে........?
বিদুষক : যাববাবা, দোষ করবে, অথচ গোঁসা হবে, মুখে বললে?
রাজামশাই: জানো মন্ত্রী, এই গাছই একমাত্র উপায়, আমাদের এই ভীষণ পরিস্থিতির একমাত্র ত্রাতা।
আর তাকেই আমরা কেটে ছেঁটে, করেছি একেবারে যা তা।
পূর্তমন্ত্রী: হুজুর, জানি, হয়েছে মস্ত ভুল, কিন্তু, উপায়......
আমি যে নিরুপায়।
রাজামশাই: হমম, তারই তো ফল ভুগছি এখন,
বাতাসে বাড়ছে ক্ষতিকারক দূষিত গ্যাস মণ মণ।
একটা তবু যেমন তেমন, তবু বাতাসে আর এক ব্যাটাও বাড়াচ্ছে উষ্ণায়ন। তাই নয় কি?
মন্ত্রীমশাই: কার্বন-ডাই-অক্সাইড, আর কি?
রাজামশাই: আর একটা তার দোসর ও আছে, যখন কার্বন পুরোটা না পোড়ে।
গাছে লাগলেই, পাতা কুঁকড়ে, অসময়ে যাবে ঝরে।
ওইটা আবার বেজায় বিষাক্ত, বলছে নাকি মরবে লোকে নাক দিয়ে ঢুকলেই।
মন্ত্রীমশাই: হ্যাঁ হুজুর, কার্বন মনোক্সাইড, পাজির পাঝারা, আর আপনি ধরেছেন, ঠিকটাই।
বিদুষক: জ্ঞানপাপী, সবজান্তা বিদ্যেধরি,
মন্ত্রীমশাই চোখ পাকান, বিদুষকের দিকে তুই চুপ করবি, নাহলে দেখ তোর কি করি?
ধমক খেয়ে বিদুষক চুপ করে গেলেও, চুপ করেন না, রাজামশাই, মন্ত্রী এ তোমার অন্যায় ভারী, চোখ রাঙিয়ে ওকে যদিবা চুপ করাও,
ভাবো তো, কি উত্তর দেবে, যখন আজকের কচিকাঁচার দল হবে আমাদের ওপর চড়াও।
মন্ত্রীমশাই জানেন, তিনি ও নিরুপায়, ভ্রান্ত আর অবৈজ্ঞানিক শিল্পকরণ, গিলে ফেলেছে পরিবেশের নির্মলতা।
চিমনির ধোঁয়া, গাড়ির ধোঁয়া, চারদিকে দূষণের ব্যাপকতা।
অপরিমিত আর অপরিশোধিত বর্জ্যজল আজ ভরেছে নদী নালা।
মাটির তলায় জল তলানিতে, গ্রীষ্মে ভিজবে না তৃষ্ণার্তের গলা।
কিন্তু, প্রশ্ন একটাই, তবে উপায় কি বা, কেউ কি তার খোঁজ জানে?
বাস্তবায়িত হয়নি কিছুই, যা উপায়, সবই রয়েছে মনে মনে।
রাজামশাই: কি মন্ত্রী , কি ভাবছো এতো? একদম চুপ মেরে গেলে যেন?
আরে বাবা দোষের ভাগীদার আমরা সবাই, তুমি একা মন খারাপ করো কেনো?
মন্ত্রীমশাই: না হুজুর, মন খারাপ নয়, ভাবছি কি আর করা যায়।
কলকারখানা, গাড়িঘোড়া সব বন্ধ করে দিলে, সেটা কি হবে এর উপযুক্ত উপায়?
রাজামশাই: ক্ষেপেছ নাকি? তাই হয় নাকি?
এতো মানুষের রুজিরুটি, যারা সবে কাজে ঢুকেছে, তাদের এখনও গোটা জীবন বাকি।
মন্ত্রীমশাই: তবে পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদের ভারসাম্য, তার কি হবে?
রাজামশাই: ভাবো মন্ত্রী, ভাবো, এখনই একটা মধ্যপন্থা ভাবতে হবে।
মন্ত্রীমশাই:হুজুর আমরা যদি কথা বলি এমন একজনের সাথে,
যার মাথায় বিদ্যাবুদ্ধি ঘড়া ঘড়া ভরা আছে।
সাথে আছে, অসীম শক্তি, হাতে শতেক হাতির বল।
যার দাপটে, বাঘ আর গরু, একঘাটে খায় জল।
রাজামশাই: কি বলছ, মন্ত্রী, এমন কি কেউ আছে?
কোথায় থাকেন, কোন দেশেতে, এখুনি যাই চলো তার কাছে।
উপায় যদি তিনি বাতলে দেন, তবে প্রণমি শত শত।
অর্ধেক রাজ্য তাঁকেই দেব, আর মনিমানিক্য চাইবেন যত।
মন্ত্রীমশাই: হেসে ফেলেন রাজামশাই এর কথায়, মহারাজ, তার নেই কোনো কিছুরই অভাব।
তবে কেউ চাইলে সাহায্য, ফেরান না তিনি, সেটাই তাঁর স্বভাব।
আস্ত রাজ্যপাটের মহারাজ তিনি, সকলে মান্যগণ্য করে।
দাঁড়ান একটু ভেবে দেখি, আমি আপনাকে জানাচ্ছি দুপুরের পরে।
*********
দেখতে দেখতে দুপুর হলো, কাটা পরা পাকুড় গাছটার দিকে তাকিয়ে বিমর্ষ রাজামশাই মুখখানা ভার করে তখনও বসে,
মন্ত্রীমশাইকে দেখে বললেন একটু কাষ্ঠ হেসে,
মন্ত্রী, তোমায় সবই তো বললাম, এখন ভেবেছো কিছু, কি যে করি?
পৃথিবীটা আমার বাঁচুক, এটাই চাই, তাতে আমি যদি মরি,......মরি।
মন্ত্রীমশাই: হ্যাঁ, মহারাজ, এ কথা ঠিক, বিপদ তো মস্ত,
দূষণ রাক্ষস এসেছে, আমাদের পৃথিবীটাকে গিলতে আস্ত।
আর বড়ো বড়ো সব রাষ্ট্র নেতা এক্কেবারে এক একটা পাগল.....
রাজামশাই: শুধু পাগল নয়, বুদ্ধিতেও এক একটা রামছাগল।
কত দেশের মানুষ পায় না খেতে,দারিদ্রতার ভারে জর্জরিত,
রোগ ভোগে লোক মরছে রোজ কতো শত শত।
অন্যদেশের থেকে ভিক্ষা করে খায়।
তবু দেখো, লোভের পাহাড়, শুধু যুদ্ধ করতে চায়।
বুঝিনা, নিজের দেশ না সামলে, এসব বুদ্ধি কোথায় পায়?
মন্ত্রীমশাই: জানেনই রাজামশাই, সবার ভাবনা আর কাজে বিস্তর অমিল,
আর অনেকে উপায় ভাববে কি, প্রতিপদে পদে গড়মিল।
কিন্তু সেসব আছে, থাকবে, আলোচনা ভুরি ভুরি।
আগে তো আমাদের বাঁচতে হবে, সেথায় নেই অন্য জারিজুরি।
রাজামশাই: সেতো ঠিকই মন্ত্রী, তাই তো ডাকলাম তোমায়,
বুদ্ধি তোমার বেজায় জানি, বাতলাও দেখি একটা জব্বর উপায়।
মন্ত্রীমশাই: আমার মতে....
রাজামশাই: কি...... তোমার মতে?
মন্ত্রীমশাই: এ ব্যাপারে আমাদের, করতে সাহায্য.....
তবে জানি না, তাঁর কাছে হাত পাতা, কতটা ন্যায্য?
রাজামশাই: কে সেই লোক, নামটা বল, আমি নিজে যাবো তাঁর কাছে.......বেঁচে থাকলে তবে তো ন্যায্য-অন্যায্য, এখন কি আর সে সব ভাববার যো আছে?
তুমি নামটা বলো, আর ঠিকানাটা....যদি জানা থাকে.... কোন অলিতে কোন গলিতে, কোথায় সে লোক থাকে?
মন্ত্রীমশাই: চলুন তবে রাজামশাই, একসাথে যাই তবে,
দেশের বিপদ, তিনিই ভরসা.....
রাজামশাই: কিন্তু, তুমি কার কথা যে বলছো, করোতো বাপু একটুখানি খোলসা।
মন্ত্রীমশাই: তিনিও এক রাজামশাই, আজব দেশের অধিপতি।
শেওড়াবনের দক্ষিণ-পশ্চিমকোণে তাঁর বিশাল রাজ্যপাতি।
এমনি কাউকে দেন না দেখা, তবে যদি মন থেকে ডাকা হয়।
ভালোবেসে, শ্রদ্ধা করে, আর না পেয়ে ভয়।
তবেই তিনি সামনে আসেন, যারা সরল মনে চায়,
এই রকমের ঝামেলা থেকে, একমাত্র তিনিই দেখাতে পারেন উপায়।
রাজামশাই: তরাক করে লাফিয়ে ওঠেন, তুমি বলেছ ভুতের রাজার কথা.....
ইশ, কেনো যে মাথায় এলো না, ওনার গুনোগাথা।
একদম ঠিক, উনিই পারেন, করতে মোদের ত্রান।
নইলে বেঘোরে মরব মোরা, উনিই পরিত্রাণ।
চলো চলো, তবে যাই, শেওড়াবনের দিকে, হাতে পায়ে ধরে ওনাকে শুধাই, আর চাই সাহায্য।
মন্ত্রীমশাই: চলুন তবে, এখুনি, করতে সে শুভকার্য।
রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে রাজামশাই এর মন্ত্রীমশাই হাঁটা দেন, শেওড়াবনের দিকে, তার ঠিক দক্ষিণ পশ্চিম কোণে এক মস্ত নিম গাছ, কোনোকালে পরা বাজে, একদম ন্যাড়াবোঁচা। সেটাই ভুতের রাজামশাই এর রাজপ্রাসাদ। আসে পাশের বাঁশের ঝার, শেওড়া গাছ আর সজনে গাছে থাকেন ওনার সব মন্ত্রী আমলারা। সামনে এক চিলতে জমি, লোকে বলে ওখানে নাকি আগে মড়া পোড়ানো হতো। সেখানেই প্রতি অমাবস্যায় বসে রাজামশাইয়ের রাজদরবার। মানুষ রাজামশাই আর মন্ত্রীমশাই সেখানে পৌঁছে, নতজানু হয়ে বসেন, ভয়ে গা ছম ছম করছে, কিন্তু কি আর করবেন? ওনারা এসেছেন, সাহায্যের আশায়।
ডানদিকের নিম গাছ থেকে হুমদো, মগডালের মামদোকে জিজ্ঞেস করে, “ও মামদো দা, দেখেছো, মানুষ এসেছে গো।“
জিভ দিয়ে ওপরের ঠোঁটটা একবার চেটে নেয় মামদো, “দেখেছি, দেখেছি, আজ মনে হচ্ছে, বিকালের টিফিনটা জম্পেশ হবে।“
হুমদো: কিন্তু এরা এখানে এসেছেই বা কেনো, তার কিছু জানো?
মামদো: একটু দেখি কি হালচাল, মেছোকে বলেছি, কি চায় ওরা, সব খবর আনো।
হুমদো: তবে সেই কথাই থাক, একটু দেখো, তারপর না হয়, দুটোর ঘাড় মটকাই।
মামদো: আমারও তো সেটাই ইচ্ছা, দেখি সন্ধ্যেয় ওদের যদি খেতে পাই।
এদিকে রাজামশাই আর মন্ত্রীমশাই, ভুতের রাজার দরবারে এসে নিজেদের উষ্ণিশ খুলে রেখে পাশে, হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে, হাতজোড় করে ডাক দেন, রাজামশাই..... রা....রাজামশাই। বড়ো বিপদে পরে আমরা এসেছি, আপনার স্মরণে, যদি একবার আপনার দেখা পাই।
ভুতের রাজামশাই ধীরে ধীরে ওনাদের সামনে প্রকট হন, সেই মিশমিশে কালো গায়ের রং, একটু পাংশুটে, ঠিক যেনো অমাবস্যার ঘুটঘুটে কালো রাত, সেই কুতকুতে ছোটো ছোটো চোখ, হাতির মতো, যা থেকে নীল আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে, মাথায় সাদা ধবধবে টোপর, নাকের মাথায় লাল গোল বল। আর গায়ে লম্বা আলখাল্লা, তাতেও চিকমিক করে তারাবাতি জ্বলছে, ওনাকে দেখে অবাক বিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকেন রাজামশাই আর মন্ত্রীমশাই।
ভুতের রাজা: কি হয়েছে তোদের, দূষণের ভয়ে তোদের একি হাল? এই কে আছিস, আন দেখি, দুই গেলাস জল।
রাজামশাই: ভয় নয়, রাজামশাই, দুশ্চিন্তায় কাটছে দিন কাল।
ভুতের রাজা: শিল্পায়ন হলে, নগরায়ন হলে, দূষণ হবে, এতে এতো দুশ্চিন্তার কি আছে?
রাজামশাই: সেটা ঠিক, তবে প্রাকৃতিক সম্পদ সব যে প্রায় শেষ..... চলবে কদিন, কি করেই বা, অন্যের থেকে কিনে...... আমাদের কি আর সে সামর্থ্য আছে?
ভুতের রাজা: নেই যখন.... তবে দেশটাকে কি করে বাঁচাবি, কিছু ভেবেছিস?
রাজামশাই: তাই তো আমরা.... আপনার কাছে......
ভুতের রাজা: তোদের সমস্যা আমরা মেটাবো, তুই কি খেপেছিস?
রাজামশাই: রাজামশাই, আসলে.....
ভুতের রাজা: যা চ্চলে।
মন্ত্রীমশাই: রাজামশাই, যদি অভয় দেন, তবে করি একটা অনুনয়।
ভুতের রাজা: দিলাম, তবে একটাই, তার একটাও বেশি নয়।
মন্ত্রীমশাই: যে আজ্ঞে, তবে বলি কি....
ভুতের রাজা: ভনিতা নয়, সিধে সিধে বল, চাস কি?
মন্ত্রীমশাই: আপনি তো সদা “ভালোর” পক্ষে, যেথা মানবতার জয়গান..... পাছে....
ভুতের রাজা: সেতো বটেই, “ভালো” ছাড়া আর সব মিছে।
মন্ত্রীমশাই: তাই তো বলি, একবার দেখুন গিয়ে আমাদের দেশ, তারপর আপনার যা সিদ্ধান্ত.....
ভুতের রাজা: তোদের দেশ আমি ভালই চিনি, এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত।
রাজামশাই: তাই তো মোরা, আপনার কাছে.....একটু সাহায্যের আশায়....
ভুতের রাজা: দেখ, দূষণের ব্যবস্থা তো করতেই হবে, তোরা ফিরে যা তোদের বাসায়।
কিন্তু, মনে রাখিস, আমি তোদের উপায় বাতলে দেব,
কিন্তু, সেটা প্রয়োগ করতে হবে তোদেরকেই।
রাজামশাই: অনেক ধন্যবাদ, রাজামশাই। হলাম নিশ্চিন্ত।
ভুতের রাজা: ভোর হলে দেখবি জগৎ পাল্টে গেছে,
কিন্তু ওই এক দিন, যা পারবি শিখে নিস, হারিয়ে ফেলিস না পাছে।
চব্বিশ ঘন্টা পর সব আগের মত হয়ে যাবে।
এই চব্বিশ ঘন্টাই তোদের হাতে সময়, তারপর আর সময় পাবি না যে।
রাজামশাই আর মন্ত্রীমশাই ফিরে আসেন ওনার রাজপ্রাসাদে, এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে। ভুতের রাজামশাই কথা দিয়েছেন, সাহায্যের। তবে দুশ্চিন্তা কি একেবারে যায়....... প্রজাদের রক্ষা করা, সে যে বড়ো দায়।
ওদিকে ভুতের রাজামশাই তখন জোর তলব ডাকেন ওনার ভূতেদের নিয়ে। ওনার মূল উপদেষ্টা বেম্মদত্তি ততক্ষণে একটা পরিকল্পনা করেছেন। ওদিকে সন্ধ্যে নামছে ধীরে ধীরে, এটাই ভূতেদের কাজ করার উপযুক্ত সময়।
********
পরদিন সকাল হলো, পুব আকাশে আলোয় আলোময়। রাজামশাই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ছুটে আসেন বাইরের বারান্দায়, কিন্তু একি, এ কি করে হলো?
বাতাসে যত ধুলো ছিল, রাতারাতি কোথা গেলো?
আআআহ, বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নেন রাজামশাই, যেনো মন প্রাণ জুড়িয়ে যায় তাঁর, এ যে অবিশ্বাস্য, অভুতপূর্ব। তৎক্ষণাৎ ডেকে পাঠান মহামন্ত্রীকে। খবর পেয়েই ছুটে আসেন মন্ত্রীমশাই।
মন্ত্রীমশাই: ডেকেছেন, রাজন, সুপ্রভাত।
গেছিলাম একটু হাঁটতে সকালে, প্রহরী বললে, আপনি ডেকেছেন ততক্ষণাত।
রাজামশাই: আরে মন্ত্রী, দেখেছো কি হয়েছে? আকাশ বাতাস কি নির্মল, নেই কালো ধোঁয়া, কার্বনের কণা।
আমার তো ভীষণ আনন্দ হচ্ছে, যেনো রাতারাতি গুটিয়ে গিয়েছে দূষণের বিষাক্ত ফণা।
মন্ত্রীমশাই: হ্যাঁ মহারাজ, দেখেছি, দেখেছি হাঁটতে গিয়ে,
কি পরিষ্কার জল, একদম স্ফটিকের মতো, বইছে নদী দিয়ে।
রাজামশাই: বলো কি মন্ত্রী, তাই নাকি, সব কিছু ঝকঝকে,
কিন্তু রহস্যটা কি, জানো কিছু? এসব করল কে?
মন্ত্রীমশাই: হুজুর, এ অসাধ্য করতে সাধন, একজনই তো পারে।
সাহায্যের আশ্বাস তো উনি কালই দিয়ে ছিলেন, আপনারে।
রাজামশাই: সত্যিই তো, একাজ তিনি ছাড়া আর কারো সাধ্য নয়।
চলো মন্ত্রী, আজই গিয়ে তার সাথে কথা বলি, কৃতজ্ঞতা যে না জানলেই নয়।
মন্ত্রীমশাই: হ্যাঁ, সেতো যাবো নিশ্চয়ই, তবে তার আগে.....
রাজামশাই: কিছু সমস্যা, ঝেড়ে কাশো ভাই, আগে ভাগে।
মন্ত্রীমশাই: চলুন আগে ঘুরে ঘুরে কৌশল গুলো দেখি,
একটু বুঝি, একটু শিখি, যেটুকু পারি খাতায় লিখে রাখি।
শিক্ষার কোনো শেষ নেই তো, আমাদের ভালোই হবে,
নিজের মতো চলবে পরে, যখন যেমন লাগবে।
রাজামশাই: তবে, তাই ভালো মন্ত্রী, চলো তাই করি।
ঘুরে ঘুরে আগে শিখি চলো, ওনাদের কারিকুরি।
আমাদের সব থেকে বড়ো চিন্তা.... কোথায় যেন, কোথায় যেন?
বিদুষক: জ্বালানি হুজুর। কয়লা আর তেল, তলানিতে ঠেকেছে ভান্ডার, সাথে সেটাই পুড়ে এতো ধোঁয়া.......
রাজামশাই: আরে ঠিক বলেছো বিদুষক, আর এখানে দেখো, সব যেনো ছেলের হাতের মোয়া।
মন্ত্রীমশাই: চলুন রাজামশাই, তবে গিয়ে দেখি,
এতো মেশিন চলছে, কল চলছে, চলছে কারখানা।
জ্বালানি তবে কোথায় আছে, জলে চলছে নাকি?
রাজামশাই: তাই চলো তবে, আজও যদি না শিখতে পারি তবে আর শিখবো কবে?
বিদুষক: মহারাজ, ওই গুলো কি বলুন তো, দূরে ওই মাঠের পর,
নীল চাদরে যেনো ঢেকেছে দেখুন, মাঠের পর মাঠ, ঘরের পর ঘর।
রাজামশাই: তাই তো বটে, ওইগুলো কি?
চলো তো গিয়ে দেখি।
হটাত করে একটা ঠান্ডা শনশনে হাওয়া এসে ওনাদের সামনে থামে, চোখের পলক পরতে না পরতেই সেটা থেকে একজন মানুষের মতো দেখতে লোক বেরিয়ে আসে।
লোকটা: আপনারা কে, কোথায় যাবেন, কার কাছে?
রাজামশাই: না কারো কাছে নয়, দেখছিলাম একটু এদিক ওদিক ঘুরে,
ওই নীল নীল ওই গুলো কি গো, যেনো মাঠ টা নিয়েছে পুরো মুড়ে।
লোকটা: ওই গুলো হলো সোলার প্যানেল।
বিদুষক: আজব তো, আমরা কি শোলা চিনিনা নাকি?
অতো শক্ত শোলা হয়, আমাদের দিচ্ছে ফাঁকি?
রাজামশাই: চোখ কটমটান, চুপ কর বলছি।
লোকটার দিকে ফিরে বলেন, মানে, আমরা তো ঠিক জানিনা, তাই এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখছি।
তা এই সোলার প্যানেলে কি হয়, কোন কাজে এটা আসে?
মন্ত্রীমশাই: হ্যাঁ, সেটাই জিজ্ঞাসিব ভাবছিলাম, কুলাচ্ছিল না সাহসে।
লোকটা: এটা থেকে বিদ্যুৎ শক্তি তৈরি হয়, এর ভিতরে থাকে ফটো ভোল্টাইক সেল, যা সূর্যের আলোর সাহায্যে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন করে।
রাজামশাই: ও তারমানে আমরা যেমন করি কয়লা পুড়িয়ে,
জল ফুটিয়ে বাষ্প বানিয়ে, তাই দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে।
লোকটা: না, একেবারেই নয়, এই শক্তির কোনো শেষ নেই, এতে কোনো ধোঁয়া তৈরি হয় না, কোনো বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয় না। তাই তো দেখুন, আমাদের আকাশ বাতাস কত শুদ্ধ, কোথাও কোনো কালো ধোঁয়া দেখছেন?
রাজামশাই: বলেন কি, সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ তৈরি,
কয়লা নেই, তেল নেই......কিন্তু এতে বড়ো বড় গাড়ি, কলকারখানা চলবে?
লোকটা: নিশ্চয়ই চলবে, কেনো চলবে না? তবে আমরা এই বিদ্যুৎ দিয়ে গাড়ি চালাই না, এই সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে আমাদের দেশের স্কুল কলেজ অফিস কল কারখানা সব চালাই, তবে গাড়ি ঘোড়ার জন্য অন্য উপায় আছে।
বিদুষক: কি আর উপায়, সেই তো পেট্রোল আর ডিজেল, আর সেগুলো পুড়ে গাদা গাদা সালফার অক্সাইড। আমরা সেসব জানি।
লোকটা: নো স্যার, নো পলিউট্যান্ট সালফার নো নাইট্রোজেন, কোনোটার কোনো অক্সাইড নয়, একেবারে নির্ভেজাল বিশুদ্ধ নির্মল সবুজ জ্বালানি।
রাজামশাই: সবুজ জ্বালানি, মানে লাল নয়, নীল নয়,
আচ্ছা ওতে কি কোনো সবুজ রং মেশানো হয়?
সেই লোকটা: হো হো করে হেসে ওঠে, সবুজ জ্বালানি মানে সবুজ রঙের জ্বালানি নয়, আসলে গ্রিন ফুয়েল। মানে যেটা পোড়ানো হলে বাতাসের বা পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না।
রাজামশাই এর চোখ তখন ছানাবড়া, বলেন: বলেন কি মশাই, এরকম আবার জ্বালানি হয়?
বিদুষক: যা খুশি বলে গেলেই হলো? করে নয় কে হয়।
মন্ত্রীমশাই: একটু যদি বলেন বিস্তারিত,
বুঝতেই তো পারছেন, এই ব্যাপার গুলোয় আমরা নই যথেষ্ট অবগত।
লোকটা: চলুন তবে, আপনাদের নিয়ে গিয়েই দেখাই, কিভাবে আমরা জ্বালানি তৈরি করি। জ্বালানি মূলত তৈরি হয় উদ্ভিজ সম্পদ থেকে, আমরা বলি বায়োডিজেল। তবে আপনাদের মতো মাটির তলায় জমে থাকা তেল আমরা তুলি না।
রাজামশাই: এতে গাড়ি চলে, আর গাড়ির ধোঁয়া?
তারপর দাম, থাকবে কি সেসব মানুষের ধরা ছোঁয়া।
লোকটা: নো স্যার, এতে নো ধোঁয়া। সম্পূর্ণ দাহ্য এই জ্বালানিতে কোনো অবশিষ্ট কার্বন থাকে না। তাই ধুলোর প্রশ্ন নেই। আর দাম? আপনাদের মতো পেট্রোলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যায় না। এককথায় একদাম, আপনাদের দামের তিনভাগের একভাগ কি বড়োজোর অর্ধেক ধরুন।
রাজামশাই: দারুন।
একি শুনছি মন্ত্রী? এ যে অবিশ্বাস্য।
তোমারও দেখছি মনে ধরেছে বেশ, আইডিয়া অতি উৎকর্ষ।
মন্ত্রীমশাই: হেসে ফেলেন, সত্যি বলতে কি জাহাঁপনা ,
এই পদ্ধতির কোনো উপযুক্ত বাহবা, ঠিকঠাক মাথাতেই আসছে না।
দেশের সবথেকে বড়ো সমস্যা, জ্বালানিতে,
কয়লা, পেট্রোলিয়ামের সম্ভার এমনিতেই ঠেকেছে তলানিতে,
সেখানে এরকম যদি সমাধান হাতে পাই,
ভবিষ্যতের জন্য উত্তম ভরসা, তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
কিন্তু.......
বিদুষক : আবার কিসে কিন্তু......?
রাজামশাই: কিসে কিন্তু আছে কি আরো কোনো সন্দেহ?
মন্ত্রীমশাই: না না, হুজুর সন্দেহ নয়,
এতো নিজেই নিজের কাছে, আস্ত একটা বিস্বয়।
তবে এই সব টেকনোলজি, শিখতে, চালাতে, লোক তো লাগবে।
একদিনে তো হবে না, যে রাতারাতি মানুষের চেতনা জাগবে।
রাজামশাই: জানি মন্ত্রী, সময় লাগবে।
ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে বোধ জাগবে।
তবে সব কিছু শুরুর ও একটা শুরু থাকে,
আর সেটাই এখন করতে হবে মিলে তোমাকে আমাকে।
ঠিক কিনা?
বিদুষক : সাথে আমিও আছি হুজুর।
মন্ত্রীমশাই: তাতো ঠিকই, তবে আমরা তো বুড়ো......
রাজামশাই: উদ্যোগ হবে আমাদের, তবে এগিয়ে আসতে হবে আগামী প্রজন্মকে,
মানুষ নতুন করে চিনতে শুরু করবে আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীটাকে, ভালোবাসতে শুরু করবে আমাদের এই পৃথিবীটাকে, সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গাইবে বেঁচে থাকার গান। তবেই হবে আমাদের উদ্যোগের বাস্তবায়ন। তাই ভেবো না, আমাদের কাজ শেষ, আমাদের কাজ সবে শুরু, বুঝলে মন্ত্রী সবে শুরু।
মন্ত্রী মশাই: যে আজ্ঞে, আপনি গুরু।
সেইদিন থেকে দেশে চালু হলো এক নতুন ধারণা, শুধু নিজে বাঁচলেই হবে না, বাঁচাতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে। ভুতের রাজা মশাই পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, এবার চলতে শুরু করা সবুজের পথে।
আজ এই এতো বছর পর সেই রাজামশাই, মন্ত্রীমশাই কেউ নেই, কিন্তু মানুষের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বেড়েছে, মানুষ আজ চিরাচরিত শক্তি ভান্ডার ভুলে মন দিয়েছে অচিরাচরিত্ শক্তি ভাণ্ডারের দিকে, আর সবার অলক্ষ্যে থেকে রাজামশাই আর মন্ত্রীমশাই আশীর্বাদ করেন, ওনাদের শুরু করা কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যাই হোক, আজকের মানুষজন বোধহয় কেউ ওই রাজামশাইদের কথা জানেইনা, তাই আমি ভাবলাম, আমিই বলে যাই। বুঝলেন? যাক সবাই ভালো থাকবেন, আর একটা সবুজ পৃথিবীর জন্য সবাইকে আগাম অভিনন্দন জানিয়ে আমি আপাতত চললাম, ও এখনো বুঝতে পারেন নি, আমি কে বলছি। যদিও আমাদের রাজামশাই বলতে বারণ করেছিলেন, তাও বলে যাই, আমি মামদো, যাই হোক, এখনো তবে যাই, থুড়ি থুড়ি যাই বলতে নেই, আসি তাহলে। কেউ আবার ভুল করে দুগ্গা দুগ্গা বলে বসবেন না যেন, চললাম, গুড বাই, সবাই ভালো থাকবেন।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment