|
মালেগড় ভ্রমণ
বিপ্লব গোস্বামী
আমাদের করিমগঞ্জ জেলার ভিতরও যে ঐতিহাসিক স্থান আছে তা আমাদের অবহেলা আর অজ্ঞানতায় বিস্মৃতির আড়ালে চলে যায়।এরকমই এক বিস্মৃতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণ করতে গিয়েছিলাম লাতুর মালেগড়ে।যেখানে জড়িয়ে আছে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্ৰামের রক্তমাখা ইতিহাস।গুগল ম্যাপস সার্চ করে দেখলাম ঐতিহাসিক মালেগড় টিলাটি করিমগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরে অবস্থিত।কিন্তু আমি আধ ঘন্টার ভ্রমণ শেষে গিয়ে পৌঁছলাম ঐতিহাসিক মালেগড় টিলায়।করিমগঞ্জ আর নিলামবাজার দুই দিক দিয়েই যাওযা যায় লাতুর ঐতিহাসিক মালেগড় রণভূমিতে।আমি নিলামবাজার থেকে বারোপুঞ্জি হয়ে লাতুর সেই ঐতিহাসিক মালেগড় রণভূমি ভ্রমণে যাই।যেতে যেতে রাস্তার দুই পাশের সবুজ বনানী আর শ্যামলী শোভা আর গ্ৰাম বরাকের নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।লাতু বাজার পাড়ি দিয়ে একটু এগোলেই রাস্তার বাম পাশে পাওয়া যায় লাতু হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল।তারপর একটা বাঁঁক নিয়ে সামনে এগোলেই পাওয়া যায় ঐতিহাসিক মালেগড় টিলা।ডান দিক দিয়ে বয়ে চলেছে শান্ত লংগাই নদী।এই লংগাই নদী বাংলাদেশে গিয়ে নাম ধরেছে সোনাই ।
আমি নিলাম বাজার থেকে একটা অন্টো গাড়ি ভাড়া করে রওয়ানা দিলাম মালেগড়ের উদ্দেশ্যে।বারোপুঞ্জি হয়ে গ্ৰাম রবাকের নান্দনিক প্রকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে অবশেষে গিয়ে পৌঁছলাম সেই ঐতিহাসিক পবিত্র ভূমি মালেগড় টিলায়।এই টিলাতেই প্রথম স্বাধীনতা সংগ্ৰামের এক রক্তমাখা ইতিহাস রচিত হয়েছিল ১৮৫৭ সালে।এই পবিত্র ভূমিতেই রয়েছে বীর শহীদের সমাধি সৌধ।রাস্তার পাশে রয়েছে একটা ছোট বিশ্রামাগার।রাস্তা থেকে পাকা সিঁঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় টিলাতে।উপরে রয়েছে মেইল গেট।গেটের এক পাশে ফলকে লেখা আছে মালেগড়ের ইতিহাস।ভিতরে চার দেয়ালের ভিতরে রয়েছে বীর শহীদদের সমাধি সৌধ।পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে ধীর গতিতে নিঃশব্দে লংগাই নদী।লংগাই নদীর এপাড়ে রয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পাহারা চৌকি।বেশ শান্ত পরিবেশ এখানে।এখানে দাঁড়ালে বন্য পাখির কিচিরমিচির আর শ্যামলী প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে মন ভরে যায়।
প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের এক রক্তমাখা ইতিহাস রচিত হয়েছিল এই মালেগড় টিলায়।সালটা ছিল ১৮৫৭ ,তখন সারা দেশ জুড়ে শুরু হয়েছিল প্রথম স্বাধীনতা সংগ্ৰাম।জ্বলছিল মহা বিদ্রোহের আগুন।দেশীয় সিপাহিরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছিল এক মহা বিদ্রোহ।সেই বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল ব্যারাকপুরে।দেশীয় সিপাহী মঙ্গল পাণ্ডে সেই বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন।দেখতে দেখতে সেই বিদ্রোহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।সেই ঐতিহাসিক বিদ্রোহের বাদ যায়নি পূর্ব ভারতও।চট্টগ্ৰামে নিয়োজিত ৩৪ নং নেটিব ইংফেন্টির দেশীয় সিপাহীরাও ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।সেই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন সিপাহী রিজবোল্লা খাঁন।তাঁর নেতৃত্বে বিদ্রোহী সেনারা চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুট করে সেখান থেকে নগদ প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকা ,অস্ত্র-সস্ত্র ও গোলা-বারুদ নিয়ে মালেগড়ের পথ ধরে যাচ্ছিলেন।তাঁদের পরিকল্পনা ছিল মালেগড়ের পথ দিয়ে টিলা পাহাড় অতিক্রম করে মনিপুর প্রবেশ করা।তাঁদের এই পরিকল্পনার কথা দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকেরা সিলেট ডিবিশনের কামান্ডার মেজর বিং এর কাছে বলে দেয়। ১৮৫৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর, মালেগড়ের এই টিলাতে বিং বাহিনী ও বিদ্রোহী সেনা বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংর্ঘষ বাধে।সেই সংর্ঘষে ছাব্বিশ জন বিদ্রোহী সেনা ও মেজর বিং সহ পাঁচজন ইংরেজ সেনা নিহত হন। সেদিন দেশ মাতৃকার শৃঙ্খল মোচনে চব্বিশজন দেশীয় সৈনিক শহীদ হয়েছিলেন এই পবিত্র ভূমিতেই।নিহত ছাব্বিশ জন দেশীয় বীর সিপাহিকে এই টিলাতেই সমাধি করা হয়েছিল।এই টিলাতেই সেদিন রচিত হয়েছিল প্রথম স্বাধীনতা সংগ্ৰামের এক গৌরব গাঁথা ইতিহাস।
মালেগড় টিলাতে বীর শহীদদের সমাধি সৌধ ছাড়া দেখার মতো আর তেমন কিছুই নেই।সেজন্যই হয় তো বা মালেগড় পর্যটকদের কাছে তেমন আকর্ষণীয় স্থান নয়। কিন্তু মালেগড়ের গৌরব গাঁথা ইতিহাসের কথা আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই হবে।আমাদের ছেলে মেয়েদের জানাতে হবে যে আমাদের বরাক উপত্যকায়ও ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে।তাদেরকে জানতে হবে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্ৰামে আমাদের বরাক উপত্যকাও অংশগ্রহণ করেছিল।আর পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে হলে মালেগড়কে গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতেই হবে।গড়ে তুলতে হবে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে।এক্ষেত্রে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের যৌথ প্রয়াসের একান্ত প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment