ছবি : ইন্টারনেট |
দরজার পেছনে কে?
মিলি ঘোষ
সবেমাত্র কলেজের ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সারাদিন বাড়িতে বসে বসে বোর হয়ে যাচ্ছি, সময় যেন আর কিছুতেই কাটতে চাইছে না। এই সময় ক'দিনের জন্য যদি একটু কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারতাম মন্দ হতো না। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? অলস দুপুরে বিছানায় শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎই ফোনটা বেজে উঠল। সুদীপ ফোন করেছে। সুদীপ আমার ক্লাসমেট। বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সুন্দরবনের কাছে এক প্রত্যন্ত গ্রামে। কলকাতায় হস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সুদীপ বলল, "এই শোন, তোর আর সুমির তো গ্রাম দেখার খুব ইচ্ছে, এখন তো কলেজের চাপ নেই, ক'টা দিন আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে যা। আশা করি তোদের খারাপ লাগবে না।" আরে এতক্ষণ ধরে তো এই কথাই ভাবছিলাম। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। সুদীপকে বললাম, "হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাবো।'' সুদীপ বলল, ''ঠিক আছে, তাহলে কবে আসবি আমাকে জানিয়ে দিস, আমি স্টেশন থেকে তোদের নিয়ে আসবো। আচ্ছা, তবে এখন রাখি।'' সুদীপ ফোন কেটে দিল। আমি তখনই সুমিকে ফোন করে ব্যাপারটা বললাম, ওতো একবার শুনেই রাজি হয়ে গেল। দুজনে মিলে ঠিক করলাম আগামী শুক্রবারই আমরা বেরোবো। বিকেল বেলায় ঘুম থেকে উঠে কথাটা মাকে বললাম। প্রথমটাই রাজি না হলেও যখন শুনলো সুমিও আমার সঙ্গে যাবে, তখন আর মা বেশি আপত্তি করলো না। সুমি আমার ছোটবেলার বান্ধবী, ক্লাসমেটও বটে।
শুক্রবার সকালে ট্রেন ধরে আমরা দুজনে ক্যানিং স্টেশনে পৌছালাম। সুদীপকে ফোনে আগেই বলা ছিল, ও আমাদের স্টেশন থেকে রিসিভ করল। এরপর আমরা নদী পথ পেরিয়ে ওদের গ্রামে এসে পৌঁছলাম। গ্রামের দৃশ্য দেখে চোখ যেন জুড়িয়ে গেল। যেদিকেই তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। দূরে দেখা যাচ্ছে ধানক্ষেত, চাষিরা মাঠে চাষ করছে আপন মনে। এইসব দেখতে দেখতে আমরা সুদীপদের বাড়িতে এসে পৌঁছলাম। মাটির বাড়ি, উপরে টালির চাল। আমরা গিয়ে পৌঁছতেই কাকিমা মানে সুদীপের মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আমাদের দেখে উনি খুব খুশি। বললেন, "তোমাদের কথা সুদীপের মুখে অনেক শুনেছি। তোমরা এসেছ আমি খুব খুশি হয়েছি। তোমরা হাত মুখ ধুয়ে নাও আমি তোমাদের খাবারের ব্যবস্থা করছি।"
দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা তিন বন্ধু মিলে গ্রামে ঘুরতে বেরোচ্ছিলাম। কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি অল্পবিস্তর মেঘ জমেছে। কাকিমা আমাদের বেরোতে বারণ করলেন। কিন্তু আমরা তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো বলে তাঁকে আশ্বস্ত করলাম। কিন্তু আমাদের কপাল খারাপ। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সমস্ত আকাশটা ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেল, সেই সঙ্গে শুরু হলো তার গুরুগর্জন। অবস্থা বেগতিক দেখে আমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলাম। এসে দেখি কাকিমা আমাদের জন্য পেঁয়াজি ভাজার উপক্রম করছেন। আজ সন্ধ্যেবেলা চায়ের সাথে গরম গরম পেঁয়াজি আর মুড়ি।
সন্ধ্যেবেলা আমরা তিন বন্ধু মিলে চা, পেঁয়াজি আর মুড়ি নিয়ে সুদীপের দাদুর ঘরে তক্তপোষে বসে গল্প জুড়লাম। দাদুও আমাদের দলে এসে যোগ দিলেন। সুদীপ বললো, "জানিস, দাদু কিন্তু খুব ভালো গল্প বলতে পারে, বিশেষ করে ভূতের গল্প। সুমি বললো, "তাহলে তো সোনায় সোহাগা! এই ঝড় বৃষ্টির সন্ধ্যায় পেঁয়াজি মুড়ির সাথে ভূতের গল্প পুরো জমে ক্ষীর। আমাদের অনুরোধে দাদু গল্প বলা শুরু করলেন।
-শোন আজ তোদের আমি যে গল্পটা বলবো সেটা শুধু গল্প নয়, এক্কেবারে বাস্তব ঘটনা। আমাদের গল্প শোনার আগ্রহ যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল। দাদু শুরু করলেন, "সেবার আমার ফুলদিদির শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফুলদিদির শ্বশুরমশাই ছিলেন সেই গ্রামের জমিদার। তার দাপটে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত। যাই হোক, সেখানে আমার খাতির যত্নের কোন অভাব হলো না। সারাটা দিন বেশ আনন্দেই কেটে গেল। রাত্রিবেলা ফুলদিদির সাত বছরের ছোট্ট ছেলে পলু আমার সঙ্গে শোবে বলে বায়না ধরলো। অতিথিশালায় একটা বেশ বড় ঘরে আমাদের দুজনের শোবার বন্দোবস্ত হল। আমি পলুকে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার কাছে গল্প শুনতে শুনতে পলু কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে আমার সে খেয়াল নেই। আমারও চোখটা প্রায় লেগে আসছিল, হঠাৎই মনে হল পাশের ঘর থেকে কেমন যেন একটা শব্দ আসছে। প্রথমটায় অতো কান দিলাম না, কিন্তু ধীরে ধীরে সে শব্দ বেড়েই চলল। এবার আমি বিছানা থেকে নেমে পড়লাম। দরজা খুলে বাইরে এলাম। মনে হল দক্ষিণ দিকের বন্ধ ঘরটা থেকেই আওয়াজটা আসছে। এই গ্রামে তখন ও বিদ্যুতের আলো প্রবেশ করেনি। পূর্ণিমার চাঁদের আলো এই চারিদিকটা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল। আমি সেই বন্ধ ঘরটার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। আওয়াজটা ক্রমে বেড়েই চলেছে। দরজার সামনে গিয়ে দেখলাম দরজায় একটা পেল্লাই সাইজের তালা ঝুলছে। আমি দরজায় কান পাতলাম। মনে হল কেউ যেন ঘরের ভেতরে গোঙাচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই আমি একটু সাহসী তাই ভয় না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ''ভেতরে কে?'' কিন্তু কোন উত্তর এলো না। দরজা ধাক্কানোর শব্দটা এবার থেমে গেল কিন্তু গোঙানির শব্দটা এখনো শোনা যাচ্ছে। আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম, "ঘরের ভেতরে কে আছো?" কিন্তু এবারেও কোন সাড়া পেলাম না। হঠাৎ মনে হল গোঙানির শব্দটা যেন থেমে গেল। আমি এবার নিজের ঘরের দিকে ফিরতে উদ্যত হলাম। যেই না পিছন ফিরেছি আবারও দরজায় ধাক্কা পড়লো। আমি চমকে পিছন ফিরলাম। সেই সঙ্গে শুরু হল গোঙানির আওয়াজ, আগের থেকে আরো জোরে। এবারে আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। দৌড়ে ঘরে চলে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু সে রাতে আর দু-চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। মনে হাজারো প্রশ্নের দোলাচল, সত্যিই কি কেউ আছে ওই বন্ধ দরজার ভেতরে? যদি থাকিও তবে কে? আর কেনই বা তাকে তালা বন্ধ করে রাখা হয়েছে?
সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠেই প্রথমেই গেলাম ওই বন্ধ ঘরটার কাছে। দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম ভেতর থেকে কোন শব্দ আসে কিনা। হঠাৎ আমার কাঁধের ওপর কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করতেই চমকে তাকালাম। ফুলদিদি। দিদি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ''কিরে কি করছিস এখানে?'' আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। মুখে বললাম, ''কই, কিছু নাতো।'' ফুলদিদি বললো, ''নিচে চল, খেতে দেওয়া হচ্ছে।'' আমি ফুলদিদির সাথে নিচে চলে এলাম।
দুপুরের খাওয়া সেরে ফুলদিদির সাথে বসে গল্প করছি। মনে হলো কালকে রাতের ঘটনাটার কথা দিদিকে বলি। জিজ্ঞেস করলাম, ''আচ্ছা ফুলদি, দোতলার ওই দক্ষিণ ঘরটা তালা বন্ধ কেন?'' ফুলদিদি যেন একটু চমকে উঠলো কিন্তু মুখে বললো, "আসলে ওই ঘরে পুরনো আসবাবপত্র আছে। তাই তালা বন্ধ রয়েছে।" আমি আর কিছু বললাম না। কিন্তু আমার মধ্যে একটা চাপা কৌতূহল, কি আছে ওই বন্ধ দরজার ওপারে?
বিকেল বেলা সকলের চোখ এড়িয়ে ওই বন্ধ ঘরে সামনে আবার এসে দাঁড়ালাম। নাঃ, এখন আর কোনো শব্দ নেই। ''... এখানে একা একা দাঁড়িয়ে কি করছো দাদাভাই?'' রামু কাকা। এবাড়ির চাকর। বহু বছর ধরে রামু কাকা এ বাড়িতেই আছে। আমি রামু কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আচ্ছা রামু কাকা, এই ঘরের ভেতরে কী আছে?' রামু কাকা কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল। বললো, "ও কিছু না দাদাভাই, তুমি এখানে আর কখনো এসো না।" কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। আজ আমাকে জানতেই হবে কী আছে এই ঘরে। আমি রামু কাকার হাত চেপে ধরলাম। "বলোনা রামু কাকা, কী আছে এখানে? কেন তালা বন্ধ থাকে এই ঘর?" এইবার রামু কাকা বলতে শুরু করলো, ''এই ঘরে থাকতো ভুবন দাদাবাবু, আমাদের বড় দাদাবাবুর কলেজের এক বন্ধু। বাপ-মা ছিল না, তাই এ বাড়িতে থেকেই সে পড়াশোনা করতো। কলেজে যখন ছুটি পড়তো তখন সেও বড় দাদাবাবুর সাথে এই বাড়িতে চলে আসতো। কলেজ পাস করেও সে এ বাড়িতেই থাকতো। জমিদারমশাই ভুবন দাদাবাবুকে কোষাধ্যক্ষর কাজে নিযুক্ত করলেন, সেও সেই কাজ দায়িত্বের সাথে পালন করতো। কিন্তু হঠাৎ একদিন কোষাগারে হিসেবের গোলমাল হলো, আর সেই দায় গিয়ে পড়ল ওই ভুবন দাদাবাবুর ওপর। লজ্জায়, অপমানে ভুবন দাদাবাবু এই ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। সেদিন ছিল পূর্ণিমা। ঘটনার পর জমিদারমশাই এই ঘরটা তালা বন্ধ করে দেন। তারপর থেকে এই ঘরে আর কেউ ঢোকেনা। আমার মনে পড়ে গেল গতকালও ছিল পূর্ণিমা। হঠাৎ কী মনে করে আমি রামু কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম, ''তোমার মনে আছে রামু কাকা, যেদিন তোমাদের ভুবন দাদাবাবু আত্মহত্যা করেছিলেন সেদিন তারিখটা কত ছিল?''রামু কাকা একটু ভেবে নিয়ে বললো, "১৩ই ভাদ্র।" আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো। আজ তো ভাদ্র মাসের ১৪ তারিখ। তাহলে...? এই পর্যন্ত বলে দাদু থামলেন। ঘরের মধ্যে একটা চাপা নিস্তব্ধতা, কারো মুখে কথা নেই। "বাবু, ভাত বাড়ছি। তোরা হাত ধুয়ে বসে পড়।" কাকিমার ডাকে আমাদের ঘোর কাটলো। আমরা তাড়াতাড়ি উঠে হাত ধুয়ে খেতে বসলাম। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম না জানি কত যন্ত্রণা বুকে চেপে সেদিন শুধুমাত্র নিজের সম্মান বাঁচাতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল ভুবনবাবুকে। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দুফোঁটা জল।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment