|
পায়ে পা দিয়ে
দীপক কুমার মজুমদার
[কিছু মানুষ আছে যাদের স্বভাবই হলো সব কিছুতেই ক্ষুঁত ধরা আর পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করা। এইরকম এক মানুষের সামনে একজন সরল স্বভাবের মধ্যবয়সী মহিলা কি পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় সেইসব উত্তেজনায় ভরপুর কথপোকথন নিয়ে এই শ্রুতিনাটক ‘পায়ে পা দিয়ে’।
মালিনী।। মেশোমশাই, ভালো আছেন তো?
হেমেন।। তুমি কেহে বাপু আমাকে মেশোমশাই বানিয়ে ফেললে।
মালিনী।। বানিয়ে ফেলার কি আছে, কিছু একটা সম্বোধন করে তো ডাকতে হবে।
হেমেন।। তার মানে, আর কি কোন কিছু বলার ছিলনা!
মালিনী।। সেকি, বয়স্ক মানুষ…
হেমেন।। বয়স্ক মানুষ! আমি কি আমার এজ সার্টিফিকেট বুকে ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি- যা দেখে তুমি কনফার্ম হয়ে গেলে যে আমি বয়স্ক।
মালিনী।। না না তা কেন হবে। তাছাড়া দেখে তো অনেকটাই বোঝা যায়।
হেমেন।। অ, দেখেই বুঝে গেলে আমি মেশোমশাই।
মালিনী।। হ্যাঁ চোখে মুখে বয়স্ক ভাব।
হেমেন।। বলো আমার বয়স কত।
মালিনী।। কারও বয়স নিয়ে হিসেব করা কি ঠিক হবে?
হেমেন।। কোনও অসুবিধে নেই, আমিতো কোনও ত্বন্যি মহিলা নই যে চটাস করে মানে লেগে যাবে! হতেই পারে সবার চামরা টান টান নাও থাকতে পারে। আমি তো আর এ যুগের মেয়েদের মতো ফেসিয়াল টেসিয়াল করি না।
মালিনী।। তারপর চুলের রঙটাও বেশ খানিকটা সাদা, মানে ঐ রুপোলি।
হেমেন।। অ.. চুলের রঙ রুপোলি, এটা হলেই সে মেশোমশাই!
মালিনী।। আপনার কি ঐ মেশোমশাই কথাটাতেই আপত্তি?
হেমেন।। আপত্তি তো আমার সবটাতেই ।
মালিনী।। তাহলে কাকু! নাকি আপনাকে নাম ধরে ডাকাই উচিৎ ছিল? নামটাও তো ঠিক জানা নেই।
হেমেন।। তোমার আস্পর্ধা তো কম নয়, দু দিনের মেয়ে আমায় তুমি নাম ধরে ডাকবে! আমার নাম হেমেন, হেমেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায়। কই ডাকো দেখি নাম ধরে।
মালিনী।। আমি কি তাই বলেছি!
হেমেন।। আর কেমন করে বলে আমার তো জানা নেই।
মালিনী।। মোটেই তাই বলিনি, তবে একটা কিছু বলে তো ডাকার দরকার নাকি।
হেমেন।। কেন ডাকতে হবেই বা কেন। যাচ্ছিলাম একটা কাজে, অমনি মেশোমশাই করে পেছনে না ডাকলেই চলছিল না!
মালিনী।। আমি কিন্তু ঠিক পেছন থেকে…
হেমেন।। থামো তো তুমি, এতদিন পরে তোমার আর সামনে পেছনে দেখাতে এসো না, ওসব আমার ঢের দেখা আছে। দুদিনের মেয়ে আমায় পেছন দেখাচ্ছে।
মালিনী।। এ মা ছি ছি এ কি বলছেন আপনি। আমার সামনে পেছন…. লজ্জায় আমার ….
হেমেন।। অতই যদি লজ্জা তাহলে এভাবে ডেকে আদিক্ষেতা না দেখালেই পারতে।
মালিনী।। আমি তো আপনাকে ভালো আছেন কিনা জানতে চাইছিলাম।
হেমেন।। কেন আমার ভালো থাকায় না থাকায় তোমার কোন অসুবিধে আছে?
মালিনী।। না না অসুবিধে হতে যাবে কেন। শুধু জানতে চাইছিলাম।
হেমেন।। এতো কৌতুহল কিসের তোমার, চারিধারে কত কিই তো ঘটছে। তার কতটুকু তুমি জানো আর কটা লোককেই বা তুমি চেনো যে আমার সম্মন্ধে তোমায় সব জানতে হবে!
মালিনী।। ভুল করছেন, আমার কিন্তু কোনও বদ উদ্দেশ্য ছিল না।
হেমেন।। এই বয়সে আর উদ্দশ্য বিধেয় শেখাতে এসো না। আর উদ্দেশ্য যাই থাক আমার ভুল ধরার তুমি কেহে।
মালিনী।। ঠিক আছে আমারই ভুল। এখন থেকে আর কোনরকম খোঁজ নেব না।
হেমেন।। তা কেন নেবে! ওই এড়িয়ে চলা। এখনকার জেনারেশন…তুমি কি এই পাড়াতেই থাকো।
মালিনী।। হ্যাঁ।
হেমেন।। তবে, পাড়ারই একজন মানুষ বাঁচলো কি মরলো, কেমন আছে কোন কিছুরই খোঁজ নেবে না। সামাজিকতা বোঝো?
মালিনী।। বুঝি বই কি।
হেমেন।। তাহলে এত কিন্তু কিন্তু করছো কেনো। তুমি কি চাওনা আমি ভালো থাকি, সুস্থ থাকি।
মালিনী।। নিশ্চয় চাই। আপনার কি তাই মনে হয়।
হেমেন।। আমার কি মনে হয় সেটা বড়ো কথা নয়, তোমার কি মনে হয়! তোমার বক্তব্য একান্তই তোমার।
মালিনী।। ভালোই থাকবেন। এখন আপনার কোনও টেনশন নেই, আফিসের চাপ নেই, রিটায়ার্ড….
হেমেন।। রিটায়ার্ড! কি বলতে চাও তুমি, রিটায়ার্ড বলে কি আমার কোনও কাজ নেই। তোমাদের কি ধারণা একজন মানুষ তার সবরকম উৎসাহ নিয়ে পূর্ণ উদ্দ্যমে চাকরি জীবনে যাবতীয় কাজ করলো তারপর রিটায়ার্ড করে একদম শেষ হয়ে গেলো, ফুরিয়ে গেলো!
মালিনী।। তা আমি নিশ্চয় বলিনি।
হেমেন।। আলবাৎ বলেছো।
মালিনী।। না বলিনি। আপনি ভালো আছেন কি না সেটাই তো জানতে চাইছিলাম।
হেমেন।। তুমিই তো এইমাত্র বললে আমি রিটায়ার্ড করেছি।
মালিনী।। তো!সেটাতো আর দোষের নয়।
হেমেন।। বিদ্রুপ করছো! আলু পেঁয়াজ কত দাম জানো? পটল ঢেঁড়স কত দাম জানো? জবাকুসুম তেল লাইফবয় সাবান কত দাম জানো? ওষুধের দাম জানো? এফ ডি ইন্টারেস্ট রেট জানো?
মালিনী।। কি মুশকিল খামোখা এতগুলো প্রশ্ন করে চলেছেন কেন? একি ইন্টারভিউ বোর্ড!
হেমেন।। বুঝলেনা….
মালিনী।। না।
হেমেন।। এই দূর্মূল্যের বাজারে একজন রিটায়ার্ড লোক কি করে সংসার চালায় তুমি জানো? কোনো রকম ধারণা আছে। এতসবের পরেও তুমি বিদ্রুপ করছো, জানতে চাইছো ভালো আছেন?
মালিনী।। না ঐ এফ ডি ইন্টারেস্ট আর পেনশন টেনশন নিয়ে হয়তো….
হেমেন।। ভুল করছো, এ দেশে রিটায়ারমেন্টের পর কত পারসেন্ট লোক পেনশন পায় তুমি জানো?
মালিনী।। ঠিক জানিনা।
হেমেন।। তাহলে শোনো, আমাদের দেশে ১০% লোক রেগুলার পেনশন পায় আর ২৫% থেকে ৩০% লোক যৎসামান্য পেনশন পায়। বাকি বেশির ভাগ লোকেই যেটা পায় সেটা হলো টেনশন! যেটা তুমি একটু আগেই উল্লেখ করলে।
মালিনী।। এটা আপনি ঠিকই বলেছেন।
হেমেন।। এটা ঠিক বলেছি অর্থাৎ আমার আগের কথাগুলো ঠিক ছিলো না!
মালিনী।। না না আগের গুলোও ঠিক এটাও ঠিক। আপনিই ঠিক।
হেমেন।। আবার এড়িয়ে যাচ্ছো। একটা মানুষ কখনও সবটা ঠিক হতে পারে?
মালিনী।। পারে না বোধ হয়। কি জানি এই সময় কি বলা উচিৎ। তাহলে আমি যাই।
হেমেন।। যাই মানে! আমি তোমায় আটকে রেখেছি না তুমিই আমায়….
মালিনী।। হ্যাঁ হ্যাঁ আমিই আপনাকে ডেকে আপনার কুশল জানতে চেয়েছি । অপরাধ নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন মেশো… সরি হেম… সরি কি বলে ডাকবো?
হেমেন।। আবার সেই তাচ্ছিল্যের সুর। না পোষায় কথা বলবে না । কিন্তু এইরকম তাচ্ছিল্য আমার এক্কেবারে অপছন্দের।
মালিনী।। আপনার কোনটা পছন্দের আর কোনটা অপছন্দের তা বোঝা শিবের অসাধ্য। আপনি মশাই বলতে বাধ্য হচ্ছি পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে পারেন।
হেমেন।। পায়ে পা দিয়ে মানে, সারা শরীরটা থাকতে তোমার পায়ের দিকেই আমার নজর পড়বে! এতক্ষণে তোমার এই মনে হলো!
মালিনী।। নয় তো কি?
হেমেন।। তোমাদের মেয়েদের ঐ হলো দোষ কোনও কথাই সোজা ভাবে নিতে পারো না। সবসময় উল্টো মানে ….
মালিনী।। মোটেই না। বরং উল্টোটা আপনিই বলছ। কিছু পুরুষ মানুষের চরিত্রই হলো মেয়েদের খুঁত ধরা আর ....
হেমেন।। তুমি থামো তো। আমার চরিত্র নিয়ে কথা! তর্কবাগীশ কোথাকার।
মালিনী।। বেশ তো তাই। এবার থেকে দেখা হলে কিছু বলেও ডাকবো না, কেমন আছেন জানতেও চাইবো না। সোজা পাশ কাটিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে গট গট করে চলে যাবো ।আর লম্বা হিল তোলা জুতো পরে পা টাকে শাড়ী দিয়ে এমন ভাবে ঢেকে রাখবো যাতে আমার পা আপনি দেখতে না পান।
হেমেন।। হ্যাঁ হ্যাঁ তাই ক’রো! যতো রকম বেআক্কেলে মেয়ে…বলে কিনা পায়ে পা দিয়ে, বয়ে গেছে তোমার মতো মেয়ের পা দেখতে। সারা শরীর থাকতে শুধু পা.....?
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment