1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 2, 2024

অশরীরী-কথা

 

ছবি : ইন্টারনেট

অশরীরী-কথা   

অভিষেক ঘোষ

(১)

ঠাকুর্দা মারা গিয়েছেন বছর আড়াই হল। কিন্তু এ'বারে গ্রামের বাড়িতে ফেরার পর থেকে প্রায়ই, তিনি তাঁর উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন। বাড়িটা বর্তমানে বন্ধই পড়ে থাকে, কলকাতাতেই সকলে থাকি এখন। লম্বা ছুটি না পেলে আসা হয় না এখানে। তাই ভারী স্যাঁতসেঁতে, নোনা-ধরা দেওয়াল, লাল মেঝেগুলো অনেকদিন মোছামুছি না করায় কেমন সাদাটে দাগ ধরে গেছে। বাড়ির চারপাশে জঙ্গল হয়েছিল। বাবা এবারে এসে পরিষ্কার করিয়েছে। বারান্দার জানালার গ্রিলের সাথে দড়ি বাঁধা দোলনাটা অকেজো হয়ে পড়েছিল বহুদিন। আমার ইচ্ছেতেই ওটাকেও সচল করা হয়েছে। আমরা এ'বারে ক'দিন থাকব। কিন্তু এই অশরীরী উপস্থিতির বিষয়টা আমায় বেশ চিন্তায় ফেলেছে। এক দিন বাথরুমে ঢুকতে যাচ্ছি, মনে হল যেন কেউ মগে করে জল ফেলছে, তার শব্দ শুনলাম। লাইট জ্বালিয়ে দেখছি কেউ নেই, বাথরুমের মেঝেও শুকনো! কিংবা বাজার থেকে ফিরে সিগারেট ধরিয়ে উঠোনে ঘুরছি, হঠাৎ কচুবনের ওদিক থেকে কথা ভেসে এল, "দাদুভাই ভালো আছো?" চমকে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পাই না!

এখন এই তিরিশ বছর বয়সে পৌঁছে, বাচ্চাদের মতো ভয় পেতে আর ভালো লাগে না। আর তাছাড়া ঠাকুর্দা আমায় খুবই ভালো বাসতেন, তাঁকে কেনই বা অযথা ভয় পাবো?

(২)

দু'দিন এভাবেই কাটল। বাবাকে বললাম, মাকেও বললাম। দু'জনেই তাই নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করল। তারপর বলল, ঠাকুর মশাইয়ের সঙ্গে কথা বলবে, যদি পুজো-টুজো কিছু করা যায়! বুঝলাম, ওদের দিয়ে কিছু হবে না, যা করার আমাকেই করতে হবে।

ঠাকুর্দা সেদিন কথা বলেছিলেন, কচুবনের ওপার থেকে। তাই সন্ধ্যায় সিগারেট ধরিয়ে পায়ে-পায়ে চুপি চুপি কচুবনে গিয়ে ঢুকলাম। কিন্তু বড্ড মশা, কে জানে ঠাকুর্দা ওইখানে থাকেন কী করে! কে যেন কোথায় রেডিও চালিয়েছে, এফ.এম.। পুকুরের ধারে বোসেদের বাড়িতেই হবে! একটা মাছি কিছুক্ষণ হল ভনভন করছে কানের কাছে। বিরক্ত লাগছিল, ভাবছি আর কতক্ষণ দাঁড়াব! ঠিক তখনই হালকা একটা বাতাস দিল আর সেই কন্ঠস্বর শোনা গেল, "এই অসময়ে কচুবনে কী করছ দাদুভাই?"

আমার একটুও ভয় করল না, বললাম, "কেমন আছো? সেদিন তো দুম করে না বলেই চলে গেলে! তুমি কি এখানেই থাকো আজকাল?"

"বালাই ষাট্! এই কচুবনে থাকব কেন? আমি থাকি আমার ঘরেই। বায়ুতে মিশে থাকি, কোনো জিনিস ছুঁতে তো আর পারি না! আমার আর থাকা!"

'ভাবে দু-দশটা অকাজের ব্যক্তিগত বার্তালাপের পরে আসল কথায় এলাম। বললাম, "তোমার তো শ্রাদ্ধ-শান্তি ইত্যাদি সবই ঠিকঠাক হয়েছিল! তাহলে সোজা স্বর্গে গেলে না কেন?"

"স্বর্গ আবার কোথায়? ওসব আদৌ সত্য নয়। ওইসব গুল গল্পে তুমিও বিশ্বাস করো নাকি! মরেছি কিন্তু পুরোপুরি মুক্তিও পাচ্ছি না। কারণ নিরানব্বইয়ে চলে যেতে হল! একশো হল না! এই একটা দুঃখ আমায় শান্তিতে মরতেও দিল না!"

"কী আশ্চর্য! এই তাহলে তোমার বেঁচে থাকার রহস্য!"

"বেঁচে! বলো, মরে থাকার রহস্য। মরেই আছি, সেই অবস্থা থেকে বেরোতেই পারছি না। আর মুক্তি না পেলে, আবার নতুন করে বাঁচার বন্দোবস্ত হবে কী করে?"

"আচ্ছা, তোমায় দেখতে পাচ্ছি না কেন বলো তো?"

"দেখবে? এই দেখো..." - বলতে বলতেই দেখি একটা মাছি এসে আমার নাকের ডগায় বসল। জ্বলন্ত সিগারেটের মৃদু আলোয় তাকে দেখা গেল বলে বুঝলাম।

"তুমি শেষ পর্যন্ত মাছি হয়ে গেলে ঠাকুর্দা!" - আমি আর্তনাদ করে উঠলাম।

"ওরে ছাগল! আমি এখন বায়ুভূত। আমি চাইলে যেকোনো সদ্যমৃতের শরীরে ঢুকে পড়ে তাতে প্রাণ-সঞ্চার করতে পারি। তাই আমাকে কোনো মতেই মাছি বলা যায় না। আমি চাইলেই এই তুচ্ছ মাছিদেহ ত্যাগ করতে পারি।"

"তা তুমি কি কোনো মানুষের দেহ পেলে না?"

মাছিটা একেবারে শান্ত হয়ে বসেছিল আমার বাম কনুইয়ে, এটা মাছির পক্ষে অস্বাভাবিক! তবে ওকে তো ঠিক মাছি বলা চলে না, কারণ ওকে তো এখন ভূতে পেয়েছে। ঠাকুর্দা বললেন, "এই কচুবনে দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ বকবক করবে! চলো আমার ঘরে যাই।

বেরোলাম কচুবন থেকে। বাবা গিয়েছে বন্ধুর বাড়ি। মা রান্নাঘরে। বাড়ি মোটামুটি নিস্তব্ধ। মৃদু ঝিঁঝিঁর ডাকটা শুধু বহুদিন পর, থেকে থেকে শুনতে পাচ্ছি। মাছিকে বললাম, "ঠাকুর্দা তোমার ঘর যে বহুদিন হল বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে!"

"আমার তো আর তাতে কোনো অসুবিধে নেই। মাছি হয়েছি কী আর সাধে! টুক করে যে কোনো জায়গায় ঢুকে পড়া যায়। তবে মাছির দৃষ্টিটা বড্ড বিতিকিচ্ছিরি। চশমাটাও কতদিন পড়া হয় নি! লাঠিটাও ধুলো খাচ্ছে! তাই মাঝে মাঝে বড্ড মানুষ হতে ইচ্ছে করে!"

(৩)

মাকে লুকিয়েই ঠাকুর্দার ঘরের তালাটা খুললাম। তালাটা বেশ ভারী। তাতে আবার একটা কেন্নো বাইছিল। সেটাকে একটা টোকা দিয়ে ফেলে তালাটা খুলতে হল। তাতে দেখি ঠাকুর্দা খুশির গলায় বলে উঠলেন, "বেশ হয়েছে।"

আমি প্রশ্ন করলাম, "কী হল?"

"আরে তুমি চিনবে না। ওই কেন্নোটার ভিতরে লবঙ্গ ঢুকে বসে আছে। আগে একটা ব্যাঙের ভিতর ঢুকে বসেছিল। তার আগে কিছুদিন ছিল একটা গরু। আসলে ও অন্য এলাকার লোক ইয়ে মেয়েছেলে, মানে এখানে ও একরকম প্রবাসী বলা চলে।"

"ভূতেদেরও আবার এসব আছে নাকি!"

"কী নেই, তাই জিজ্ঞেস করো। ভূত-জন্ম ভারী জটিল হে দাদুভাই! এই যে লবঙ্গ, ও আগে ছিল বামুনের মেয়ে আর বউ। বাজ পড়ে মারা গেছে। কিন্তু ডাকসাইটে সুন্দরী বলে ভারী নাম ছিল একসময়, তাই মরার পর ওদের এলাকার সব ভূতগুলো জ্বালাতন করতে শুরু করল। এ বলে, বিয়ে কর, ও বলে বিয়ে কর। লবঙ্গ তাই এলাকা ছাড়ল।"

"তা এখন তোমার সঙ্গে আবার কোনো..."! - কিন্তু কিন্তু করে বলেই ফেললাম।

"আরে না না... ওর এখানে অন্য ভূত-সঙ্গী জুটে গেছে। কিন্তু মুশকিল হল, আমার ঘরের দেওয়ালে প্রায়ই ঘুরোঘুরি করে। বিরক্ত লাগে তাই।"

ঘরের দরজাটা খুলতেই বিশ্রী ক্যাঁচ করে শব্দ হল। ঠাকুর্দা সজাগ হয়ে বললেন, "আহা! এত শব্দ কোরো না... তোমার মা এসে পড়বেন। কেউ না এলে, তোমায় তিরিশ সেকেন্ডের জন্য ভূত-রূপে দেখা দিতে পারি।"

"তাহলে কি তুমি মাছি-শরীর ত্যাগ করবে?"

"একেবারের জন্য না। জাস্ট ত্রিশ সেকেন্ডের জন্য। যদি এক মিনিটও পোকা-মাকড়ের শরীর থেকে বেরিয়ে, বাইরে থাকি, আর ওই শরীরে ঢোকার উপায় নেই।"

"কেন, তাহলে কী হয়?"

"আহা! সব কী আর বলে বোঝানো যায়! এ তো আর মানুষের দেহ নয়... মৃত মানুষের শরীরের বেলা ঢোকা-বেরোনোর নিয়ম হল এক ঘন্টা। এর বেশি আর জানি না... এতটুকু ঠেকে শিখেছি।"

"ন্যাকা..." - কে যেন বলে উঠল পাশ থেকে ধারালো মেয়েলি গলায়। চমকে তাকিয়ে দেখি, লবঙ্গদেবী তাঁর কেন্নো-শরীরে আমার আস্তিনে বাইছেন। ব্রাহ্মণ ছিলেন, তাই আবার টোকা দিয়ে ফেলতে মন চাইল না।

অন্য একটা গলা ভেসে এল, দেখি একটা বোলতা। বোলতা কানের পাশ দিয়ে উড়ে যেতে যেতে বলল, "ত্রিশ সেকেন্ডের এক সেকেন্ড দেরি হলেই কিন্তু আমি এই বোলতা-শরীর ত্যাগ করে, মাছি-দেহে ঢুকে যাবো।"

"দেখেছ দাদুভাই, ভূতলোকে কীরকম প্রতিযোগিতা! এতটুকু দেহত্যাগ করেও শান্তি নেই!"

এত কিছুর মধ্যে আমি হাসতেও ভুলে গেছিলাম। এই কথায় একটু হাসি পেল! ঠাকুর্দা এই সুযোগে টুক করে দেহত্যাগ করে, ভূত-দেহ ধারণ করলেন। দেখেই চিনলাম, সেই সাদা ফতুয়া আর পায়জামা, সেই রোগা শরীর, মুখটা বেশ শুকনো... অর্থাৎ আমার চেনা ঠাকুর্দাই। ওই পোশাকেই গত হয়েছিলেন কিনা! কেবল একটা ঝাপসা প্রতিচ্ছবির মতো দেখতে লাগছিল তাঁকে। ঠিক এই সময় একটা কাণ্ড হল। ঠাকুর্দার ঘরে শব্দ পেয়ে আচমকাই মা এসে হাজির। আমিও ঠিক খেয়াল করি নি। মা এসেই ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো হাতখানেক লম্বা, ময়লা-জমা আয়নাতে কী দেখে 'আঁক্' করে চেঁচিয়ে উঠল। ঠাকুর্দাও অমনি ভ্যানিস, মানে মাছি-দেহে অন্তর্হিত হলেন।

"আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, "তুমি?"

"মা আমাকে দেখে রাগের সুরে  বললেন, "তুই এখানে কী করছিস? আয়নায় কাকে যেন দেখলাম... ওরে বাবা রে! কী যে সব ঘটছে এখানে!"

আমি বললাম, "কী দেখলে বলো তো আয়নায়?"

"সত্যি বলতে, তোকেই দেখলাম। তবে এখনকার তোকে নয়। বিশ বছর আগের তোকে, এখনও ভাবতেই কেমন লাগছে! জানি না কী করে এমন দেখলাম!" - বলতে বলতেই মা বেরিয়ে গেল আর যেতে যেতে বলে গেল, "ওই ঘরে আর ঢুকিস না। তালাটা বন্ধ করে বেরিয়ে আয়। ঠাকুরমশাইকে কালকেই খবর দিতে হবে!"

"দেখলে, কী কেলেঙ্কারিটাই করলে! এই জন্য বলি, এত লোভ করতে নেই। আবার কাল ওই তপন ভট্চাজ্ এসে মন্তর পড়ে পড়ে কানের মাথা খাবে আর হোম-যগ্যি করে তাড়াবে আমাদের।" - লবঙ্গদেবী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।

"বোলতা-শরীর বলে উঠল আমারই উদ্দেশ্যে, "আরেকটু হলেই তোমার মা ভিরমি যেতেন। ছ্যা ছ্যা, তোমার ঠাকুর্দার মৃত বয়সে এক্কেরে ভীমরতি ধরেছে!"

একটা পিঁপড়ে ঘরের একমাত্র ধুলো-জমা ল্যাম্পটায় বসে বলল, "অতি লোভে, তাঁতি নষ্ট।"

"আহ্ তোমরা থামবে! মাছি-দেহ থেকে বিরক্ত ঠাকুর্দা তীব্র আপত্তি জানালেন। বললেন, "সর্বক্ষণ ক্যাটক্যাট করে কথা শোনানো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তোমাদের!" তারপর আমায় বললেন, "দেখো দাদুভাই, দেহ ধারণ আর ত্যাগ করার কতকগুলো নিয়ম আছে। এ তো আর রাজনীতির ময়দান নয় যে, বেহায়ার মতো যখন তখন দল বদল করব! যখনই আমি ভূত-দেহ ধারণ করে কোনো মানুষের সামনে আবির্ভূত হব, অমনি কিছু না কিছু অঘটন ঘটবে। এই যেমন এইমাত্র ঘটল... আমি যেই দেহ-ধারণ করলাম, তোমার বর্তমান ফ্রিকোয়েন্সি চেইঞ্জ হয়ে গেল! এবার আমি যদি, তোমার সামনে একটা মিনিটও পুরো দেহ ধরে থেকে যাই, অনর্থ ঘটবে। তুমি একেবারে কুড়ি-তিরিশ বছর আগের বয়সে ফিরে যেতে পারো! এছাড়া আর অন্য কী কী যে হতে পারে, আমার জানা নেই! ভাবতেও ভয় করে।"

এতক্ষণে আমার ত্রিশ বছরের বাস্তববাদী মনে ভয় ঢুকল। কপালে মৃদু ঘাম দেখা দিল। এতদিন জানতাম, মরে গেলে যত চাপ থেকে মুক্তি। এ তো দেখছি, ভূতেদেরও যা চাপ... বাপ রে বাপ!"

"সুতরাং ষাট সেকেন্ডের বেশি কোনো মতেই অশরীরী হয়ে থাকার নিয়ম নেই। তোমাদের ফ্রিকোয়েন্সিতে কোনো জিনিস ছোঁয়ারও নিয়ম নেই। এই লবঙ্গকেই দেখো না, ওর সাথে যা হয়েছিল, বলার নয়।" - এই বলে ঠাকুর্দা লবঙ্গদেবীর কাছে অর্থাৎ আমার আস্তিনে এসে বসলেন।

"কী হয়েছিল আপনার সাথে?" - লবঙ্গদেবীকে এই প্রশ্নটা না করে পারলাম না আমি।

লবঙ্গদেবী ভারী দুঃখিত স্বরে বললেন, "আর বোলো না! মৃত্যুর পর আমার বরের বেস্ট ফেরেন্ড মহা জ্বালাতন করছিল, সে সুইসাইড করেছিল কিনা। আমারই জন্য কিনা, কে জানে! তো একদিন, ওনাকে কথাটা জানিয়ে দেবো ভেবে, অশরীরী রূপ ধরেছিলাম। নিয়মটা জেনে গেছি ততদিনে। কিন্তু সময়ের হিসেব ছিল না। উনি তখন বাতের ব্যথায় অস্থির হয়ে ক্যাম্পখাটে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমার মাথাতেও নেই যে, ওঁর মৃত বন্ধুর নামে জীবিত ওঁকে নালিশ করাটাই অর্থহীন! তখন আমি ভ্রমর-জন্মে ছিলাম, রাগে-বিরক্তিতে ভ্রমর-দেহ ত্যাগ করে ছায়া-দেহ মানে অশরীরী হয়ে, ক্যাম্প-খাটে ঘুমন্ত ওঁর শরীর ছুঁয়ে ঘুম ভাঙাতে যাই। বারান্দায় একলা শুয়ে ছিলেন, আলো নেই, কারণ বাড়িতে কেউ নেই। খাটের পাশে শুধু একটা কেরোসিন লন্ঠন। তো ঘুম ভেঙে আমাকে দেখেই, আঁৎকে উঠে, শুয়ে-শুয়েই উনি ক্যাম্প-খাটে লন্ঠন উলটে ফেলে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিলেন।"

"বলেন কী?" - এতটুকু শুনে আমিও চমকে উঠলাম। কিন্তু কৌতূহল গেল না। জিজ্ঞেস করলাম, "তারপর কী হল!"

"অপঘাতে মৃত্যু যে... আমিও অশরীরী হয়ে গেলাম!" - বোলতা-শরীর থেকে জবাব ভেসে এল।

"তার মানে আপনিই লবঙ্গ-দিদার ইয়ে, মানে স্বামী?" - বিস্মিত আমার প্রশ্ন।

"হিসেব করলে তাই তো হয়..." - বোলতা-শরীরের গম্ভীর উত্তর।

ঠাকুর্দা এত অব্দি শুনেই, তাঁকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, "সুবলবাবু, এভাবে দাদুভাইকে সব বলে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। ভূতজন্মের এত বৃত্তান্ত মানবজন্মে জেনে ফেলাটা অত্যন্ত অন্যায্য।"

অমনি পিঁপড়ে বলে উঠল, "আই এগ্রি।"

তখনই আবার মায়ের গলা শোনা গেল, "কী রে! তুই এখনও ওই ঘরে! বললাম না, তালাটা দিয়ে বেরিয়ে আসতে।"

"যাই..." - বলে বেরিয়ে এলাম, ঠাকুর্দাকে ও আপাতত পরিচিত তাঁর ভূত-পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বললাম, "টাটা..."!

(8)

বাড়ির পিছনে মেলা গাছপালা। তারই ভিতর একটা লিচুগাছে বসে ছিল বড়ো সাইজের একটা গিরগিটি। তাগ করে, এক হাত লম্বা জিভখানা বের করে, কী একটা পোকা মুখে পুরে, গাল ফুলিয়ে চিবোতে চিবোতে আমাদের মন দিয়ে দেখছিল।

আমি ফিসফিস করে বললাম, "ঠাকুর্দা সাবধান, কোন্ দিন তোমাকেও না খেয়ে ফেলে!"

"কী যে বলো দাদুভাই! উনি হিমালয় ফেরৎ সাধু ভোলা-মহারাজ! ক্যানিব্যাল তো নয় রে বাবা!"

"আহা তুমি তো মানুষও নয়, গিরগিটিও নয় এখন। তাহলে আর খেতে বাঁধা কোথায়!"

কিন্তু গিরগিটি দেহে বসবাসকারী ভোলা-মহারাজ অপ্রসন্ন হলেন। বললেন, "ফিসফিস করে কথা বলাটা আমি পছন্দ করি না। কী চাও হে পরিমল?"

পরিমল অর্থাৎ ঠাকুর্দা বললেন, "মহারাজ, আমার কি মুক্তি হবে না?"

"হঠাৎ এ কথা? এতদিন তো এমন কথা বলতে শুনি নি!"

"আসলে মহারাজ, হয়েছে কী, আমার মানব-জন্মের আত্মীয়-পরিজনেরা আর আমার সঙ্গ চাইছে না! নিরানব্বইয়ের শোক ভুলে, তাই আমি মুক্তি পেতে চাই।"

"তোমার আসল উদ্দেশ্য তো অন্য..." - এ'টুকু শুনেই মাছি ভনভন করে উড়তে শুরু করল, যেন বড্ড অস্থির বোধ করছে। ভোলা মহারাজ বলে চললেন, "তুমি চেয়েছিল, গ্রামে কেউ টুক করে মরুক আর তুমিও সুট করে তার দেহে ঢুকে পড়ে সেঞ্চুরিটা করে দাও। কিন্তু দু-আড়াই বছর মাছি-জন্ম কাটিয়েও সুবিধা করতে পারলে না। কারণ প্রথমত এদিকটায় কেউ মরেই নি। আর দ্বিতীয়ত তুমি বড্ড ঘরকুনো, তোমার ওই মানবজন্মের ঘরের গণ্ডি ছেড়ে বেরোতেই পারলে না। গত ভোটের সময় এত লোক মরল দেশে, একটু খোঁজ-খবর রাখলে অনায়াসে একটা যুৎসই শরীরে ঢুকে আরো একটা বছর অনায়াসে একটা পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে পারতে। তোমার সেঞ্চুরিও হত আর পুণ্যও। কিন্তু তোমার তো ঘরেই শিকড় বেরিয়েছে।"

"মহারাজ, বিশ্বাস করুন ওই শিকড় আমি ছিঁড়ে ফেলতে চাইছি। সারাক্ষণ ভিতরে লড়াই চলছে... মাছি চাইছে ড্রেনে বসতে, আমি চাইছি বিছানায় বসতে, এভাবে কি একদেহে একসাথে ঘর করা যায়, বলুন!"

"আর লাবণ্য কী বলে?"

"ছিঃ ছিঃ ও-কথা বলে লজ্জা দেবেন না!" - বলেই মাছি একবার আমার দিকে ঘুরে, আমার প্রতিক্রিয়াটা দেখে নিল।

ভোলা মহারাজ কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর চিন্তামগ্ন সুরে বললেন, "আরেকটা উপায় আছে..."

"কী উপায়... হুজুর?"

"কখনও জ্যান্ত মানুষের শরীরে ঢুকেছ?"

"বলেন কী? সে যে কঠোরভাবে মানা!"

"মানা করা হয় তার কারণ আছে। আইডেন্টিটি ক্রাইসিস হয়ে যাবে না? কিন্তু এই কেস্ ভিন্ন। দেখো, যদি তুমি নিরানব্বই ছুঁই-ছুঁই কারো দেহে ঢোকার চান্স পাও, ঢুকবে? অসুবিধা নেই কারণ, হাতে লোকও আছে আর তিনিও এখন কোমায়। মানে অচেতন, একটা বছর কষ্ট করে হসপিটালের বেডে শুয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে না? সেঞ্চুরি হলেই আমরা হাততালি দেবো আর তোমার মুক্তি।"

"তিনি কোথায় আজ্ঞে?"

"বেলভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি আছেন। বিরাট বড়োলোক ওরা, তোমার যত্নের কোনো ত্রুটি হবে না।"

"তা মহারাজ এর বিনিময়ে আমি কী করতে পারি? এতো বড়ো উপকারটা করলেন আপনি।"

"বেশি কিছু নয়... অনেকদিন নেশা করি নি, তুমি তো জানো, অল্পবয়সী মানুষ ছুঁলে আমার হেব্বি নেশা হয়। আমি একটু অশরীরী হয়ে, একটা তরতাজা শরীর ছুঁয়েই আবার গিরগিটি দেহে প্রবেশ করব। তোমরা শুধু আমার গিরগিটি শরীরটা ওই সময় পাহারা দেবে। কি, পারবে না?"

ঠাকুর্দা ঈষৎ চিন্তিত গলায় বললেন, "মহারাজ বেশি লোভ করবেন না কিন্তু। আপনার বয়স হয়েছে তো, তাই বলছি।"

"আরে না না... কত তপস্যা করলাম, এইটুকু সংযম নেই ভেবেছ আমার! উফ্ নেশাটার কথা ভাবতেই আমার গিরগিটি-দেহে পুলক জাগছে!"

(৫)

তো সেই ব্যবস্থাই হল। একটা শুভ দিন দেখে, ঠাকুর্দা এবং তাঁর দলবল মিলিতভাবে, ভোলা-মহারাজের আত্মাহীন স্থূল শরীরটাকে পাহারা দিল। আর ভোলা মহারাজ সেই সুযোগে গিরগিটি-দেহ ত্যাগ করে, মাত্র দু-মিনিটের জন্য অশরীরী হয়ে বাগদি পাড়ার পুকুরঘাটে সন্ধ্যার সময় এক বউমানুষকে ছুঁয়ে দিলেন। তারপর সে এক কাণ্ড! মুহূর্তের মধ্যে সেই বউটির পনেরো বছর বয়স কমে গেল আর সে সোজা সেই আধো আলো আধো অন্ধকারে, "ধেৎ রোজ রোজ বাসন মাজতে ভাল্লাগে না..." বলে, সোজা পুকুড়পাড়ে একটা কুলগাছে উঠে, কুল খেতে খেতে পা দোলাতে লাগল। সেই দেখে নাকি ভোলা-মহারাজের প্রেতাত্মার কী হাসি! তিনি তখন পুলকে নাচছেন, সেই সঙ্গে রাজকীয় খিক্-খিক্ আর থামেই না। ওদিকে একগাদা অতৃপ্ত আত্মা পুকুরধারে ঘোরাফেরা করে, আরেকটু হলেই গিরগিটি-শরীর দখল হয়ে যাচ্ছিল আর কী! তাই সকলের কাকুতি-মিনতিতে তিনি আবার গিরগিটি-দেহে প্রবিষ্ট হলেন আর মেয়েটিও পুনরায় পুর্বাবস্থায় ফিরৎ গেল।

এত সব অবশ্য আমি স্বচক্ষে দেখি নি, তবে স্বকর্ণে শুনেছি। ঠাকুর্দার মাছি-মুখে শোনা সেই শেষ ক'টা কথা। তারপর আর কী! ঠাকুর্দার তো একটা হিল্লে হয়ে গেল! তিনি গত দু'দিন হল ওই বেলভিউতে অ্যাডমিট হয়ে গেছেন, আই-মিন আরেকজন নিরানব্বুই ছুঁই-ছুঁই বৃদ্ধের জীর্ণ শরীরে। আশাকরি, এইবার আর তাঁর সেঞ্চুরি মিস হবে না। সব কথা পূর্বাপর জেনে বাড়িতেও বেশ খুশির হাওয়া।

...(সমাপ্ত)...

2 comments:

  1. কনক মণ্ডলOctober 3, 2024 at 9:39 PM

    চমৎকার গল্প... "উফ্ নেশাটার কথা ভাবতেই আমার গিরগিটি-দেহে পুলক জাগছে!" 😆

    ReplyDelete
  2. Khub valo laglo...

    ReplyDelete