1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 2, 2024

পঞ্চাননের ঘুম হয়না

 

ছবি : ইন্টারনেট

পঞ্চাননের ঘুম হয়না

দীপক কুমার মজুমদার

পঞ্চানন বাবুর আজকাল রাত্রে ভাল ঘুম হচ্ছেনা। সারারাত এপাশ ওপাশ করে ভোরের দিকে চোখ দুটো একটু লেগে আসে ঐ ঘন্টাখানেক মতো। আর ঠিক তখনই গিন্নীর খোঁচা 'কি গো তোমার ঐ নাকের কনসার্ট একটু বন্ধ করবে!' ঘুমের রেশটা যাতে না কেটে যায় তাই প্রথমটায় পাত্তা না দিয়ে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকি। নাকের কনসার্ট বন্ধ না হলেও সুরটা একটু চেঞ্জ হলো, তবে মনে হচ্ছে ঐ ভৈরবী রাগের মধ্যেই আছে। আবার একটা খোঁচা, মনে হলো এবারেরটা অপেক্ষাকৃত তীব্র 'তুমি থামাবে তোমার রাগরাগিনী, কি অত্যাচার '। অনেক কষ্ট করে আসা ভোরবেলার এই ঘুমের গুষ্টির তুষ্টি করে দিল ' তোমার কি কোন আক্কেল নেই। আমার নাক যদি একটু ডেকেই থাকে তো তোমার কোন সে ট্যাঁকের খরচা হচ্ছে। নিজে তো জলহস্তির মত ভঁস ভঁস করে ঘুমোচ্ছো, আর আমার যে সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারিনা সে কষ্ট বুঝবে।' 

'দরকার নেই বুঝে, কে বলেছিল নাম রাখতে পঞ্চানন! পাঁচ পাঁচটা চোখ কি আর এক সাথে বন্ধ করা যায়!'

'এই ভোরবেলায় মস্করা করার সময় হলো তোমার।'

একটু সামলে নিয়ে গিন্নীর জবাব এলো 'মস্করা আবার কি, মনে এলো তাই বললাম।‘

রোজ রোজ  এইরকম পালাগান কার ভালো লাগে, চুপ করে গেলাম -সারাটি দিন পরে আছে।

পাশের বাড়ির মিত্তির মশাইএর এসব বালাই নেই। কোনদিন ঘুম নিয়ে কোনও অভিযোগ শুনিনি। কি সুখী মানুষ, সোফায় টিভি দেখার ফাঁকে, সিনেমা হলে, তাসের আড্ডায়, অনুষ্ঠান বাড়িতে একটু নিরীবিলি হলেই নির্দিধায় ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। মাঝে মাঝে ভাবি পরজন্মে আমি যেন মিত্তির বাবু হয়ে জন্মাই।

কাঁহাতক এই দূর্ভোগ রোজ রোজ সহ্য করা যায়। সাহস করে পাড়ার ঘোষ ডাক্তারের চেম্বারে হাজির হলাম। এটা ওটা চেক করে বললো সবইতো মোটামুটি আন্ডার কন্ট্রোল- প্রবলেমটা কি?

আজ্ঞে সেসব যতোই কন্ট্রোলে থাকুক , রাতের ঘুমটা একেবারে ডিকন্ট্রোল মানে অনিদ্রা। আজ বেশ কিছুদিন হলো রাত্রে ঘুম হয়না, সারারাত এপাশ ওপাশ ঐ ভোরের দিকে ঘন্টাখানেক একটু চোখ লেগে আসে  তাও…বলেই নিজেকেই কন্ট্রোল করলাম।

ডাক্তার কি বুঝলো জানিনা, ঘাড় ঘোঁজ করে প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বললো ‘একটা ঘুমের ওষুধ লিখে দিলাম দরকার হলে মাঝেমধ্যে আধখানা করে খাবেন। SOS. শোবার দশ মিনিট আগে খেয়ে নেবেন, দেখবেন যেন নেশা না হয়ে যায়।

খুব খুশি হয়ে কড়কড়ে তিনটে একশো টাকার নোট টেবিলে রেখে গদগদ চিত্তে বেড়িয়ে এলাম যেন আর আমায় পায় কে। এবার থেকে মনের সুখে যতক্ষণ খুশি ঘুমোবো, দরকার পড়লে ইচ্ছেমতো নাক ডাকবো।

বাড়ি ফিরে দেখি গিন্নী মনমরা হয়ে বসে আছে। জিজ্ঞেস করি ‘কি ব্যাপার?’

‘কি বললো ডাক্তার, কেন যাবার সময় আমায় নিয়ে যেতে পারলেনা? এই বয়সে কেউ একা একা ডাক্তারের কাছে যায়! যদি কিছু হয়ে যেতো, কি বিপদে পরতাম বলো দেখি?’

বোঝো কান্ড, সুস্থ শরীরে ডাক্তারের কাছে গেলাম তাতে হওয়ার কি আছে বুঝিনা।

‘কি বললো ডাক্তার শুনি?’

‘সেরকম কিছু না, বেশ কিছুক্ষণ এটা সেটা জেনে অবশেষে ঘুমের ওষুধ লিখে দিল’।

‘কি বেআক্কেলে ডাক্তার গো, কিবলে তোমায় ঘুমের ওষুধ দিলো শুনি-ওযে বিষ। ঐ ঘুমের ওষুধ খেয়ে মানুষ মারা যায় তুমি জানো।‘

‘অবুঝের মত কথা বলোনা, কত লোক ঘুমের ওষুধ খায় তোমার কোনও ধারণা আছে? এত পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়েছে বিষ দেওয়ার জন্য! ভাগ্যে তোমায় নিয়ে যাইনি।’

‘গেলে তুমি এই বিপদে পড়তেনা, আমি কিছুতেই লিখতে দিতাম না।‘

অনেক রকম করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শেষে নিমরাজী করা গেল। ‘বুঝলাম কিন্তু খুব সাবধান, হিসেব করে খাবে। নইলে নিজেও বিপদে পড়বে আর আমাকেও বিপদে ফেলবে। ছেলে মেয়ে সবাই বাইরে কেউ দেখার নেই আমাদের।‘

‘ওহো তুমি তিলকে তাল করো না।‘

‘বেশ বেশ তাই। তবে তোমারতো আবার সবটাই বাঁধানো দাঁত, ওষুধ খেয়ে অঘোরে ঘুমোবে তাই দাঁতের পাটি খুলেই শোবে। যদি গলায় আটকে যায় জানতেই পারবেনা।‘

‘ঠিক আছে তাই হবে’ বলে শান্তিপর্ব সাঙ্গ হলো।

          এরপর থেকে এই এক নতুন ঝামেলার উদয় হয়েছে। একবার খোলোরে,সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার পড়োরে। নির্ঝন্ঝাট ঘুমের জন্য এটুকু করাই যায়। ঘুমোনোর আগে টেবিলে দাঁত দুপাটি খুলে রাখা অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে এটা ঠিক ঐ ঘুমের ওষুধটা তা সে আধখানাই হোক নির্বিঘ্নে ঘুম হচ্ছে। রাতে এপাশ ওপাশ করতে হচ্ছেনা। নিজের নাক ডাকছে কিনা বুঝতেও পারছিনা, আওয়াজতো কানে আসছেনা। আর পাশ থেকে গিন্নীর নাক ডাকার শব্দও আর পাচ্ছিনা। একদম এক ঢিলে তিন পাখি মারা। গিন্নীকেও আর পেছন থেকে খোঁচা মেরে বিরক্ত করতে হচ্ছেনা। যাক বাবা বেশ কদিনের টানা অশান্তির অবসান হওয়ায় আনন্দেই আছি, গিন্নীরও সেই তেজটা অনেক কমেছে মাঝেমধ্যে হাসিঠাট্টা খুনসুটি এসব চলছে- এই বয়সে যেমন হয় আর কি।

কিন্তু সুখ বোধহয় একভাবে বেশিদিন থাকেনা। মাঝেমধ্যেই রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে, খানিকক্ষণ ঘুমোনোর পর বাথরুম যেতে হচ্ছে। এসে আবার এপাশ ওপাশ। চোখ বন্ধ করেই রাখছি। হলে কি হবে পাশ থেকে জলহস্তীর ভোঁস ভোঁস আওয়াজ । কেমন নিষ্ঠুরের মতো আয়েস করে ঘুমোচ্ছে, দুনিয়া চুলোয় যাক ওনার কিছুতেই কিছু যায় আসেনা। এতেই রাগটা আরও বেড়ে যাচ্ছে আর ঘুমটা ততটাই পিছিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আধখানা ওষুধ হজম হয়ে যাচ্ছে তাই আর কাজ হচ্ছেনা। কোনরকমে আবার সেই ভোরের দিকে একটু চোখের পাতা লাগছে।

          বেশ ক’রাত এইভাবেই কাটছে । অবশেষে একটু সাহস করে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম। বিষতো বিষই সই। আমি নীলকণ্ঠ হবো…রাতের যন্ত্রনা বেশিদিন সইতে কার ভালো লাগে – গিন্নীকে না জানিয়েই ঘুমের ওষুধের ডোজটা বাড়িয়ে একটা গোটা করে দিলাম। ব্যাস কাজ শুরু- আবার সেই নিঃশব্দে ঘুম। এইজন্যই লোকে বলে এক পেগ এক পেগ করে বাড়তে বাড়তে মানুষ প্রথমে মদকে তারপর মদই মানুষকে খায়। সে যাকগে মরুকগে ওসব নীতিকথা ধরে থাকলে চলেনা। আমার ঘুমের দরকার আমি ঘুমোচ্ছি। ঘুম ভাঙ্গতে একটু বেলা হলেও মনটা বেশ ফুরফুরে থাকছে।

          একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই অভ্যেসমতো টেবিলে দাঁতদুটো লাগাতে গিয়ে হকচকিয়ে গেলাম- দাঁত নেই! দোষ দেওয়ার একমাত্র কান্ডারী গিন্নীকেই জিজ্ঞেস করি ‘কিগো দাঁতের পাটি দুটো কোথায় গেল’?

‘টেবিলেই তো রাখো, যাবে আর কোথায়! দেখো সেখানেই আছে।‘

‘থাকলে কি আর তোমার কাছে জানতে চাই, শুধু শুধুই মুখ খাওয়ার জন্য।

‘আমি মুখ করি, বলতে পারলে!’

‘সত্যি বলতে আবার পারা না পারার কি আছে, যা হচ্ছে তাই বললাম’।

‘কই চলতো, দেখি তোমার দাঁত।‘

অনেকক্ষণ এদিক ওদিক উলটে পালটে দেখে বলে ‘সত্যিইতো পাচ্ছিনা, উবে গেল নাকি?’

‘তবে আমি কি এমনি এমনিই বলছি, খামোখা আমার ওপর রাগ করছো। এই তোমার জন্যেই…না দাঁত খুলে শুই আর না হারায়।‘

আপাতত সামাল দেওয়ার জন্য শান্তনা দিয়ে বলে ‘ঠিক আছে ঠিক আছে, আরতো দাঁত মাজার ঝক্কি নেই এবার মুখটা ভালো করে ধুয়ে এসো। চা খেতে খেতে ভাবা যাবে।‘

চায়ে চুমুক দিয়েই বুঝলাম নকলই হোক আর আসলই হোক দাঁতের একটা আলাদা ব্যাপার আছে। চায়ের চুমুকের প্রথম হিট স্ট্রোকটা দাঁতগুলো অনেকটাই সামলে দিতো, এখন ডাইরেক্ট মাড়িতে গিয়ে হিট করছে। কিন্তু দাঁত দুপাটি গেল কোথায়?

‘ঠিক পাওয়া যাবে, একটু ধৈর্য্য ধরো।‘

কাতর কন্ঠে বললাম ‘আর ধৈর্য্য, আর বোধহয় মাংস খেতে পারবোনা। কি হবে গিন্নী?’

‘ঐ ছাইপাঁশ বিষ ঘুমের ওষুধই কাল হলো। তখনই মানা করেছিলাম , এত কেউ অঘোরে ঘুমোয়!’

ঘাড় কাত করে মুখ বুজে সহ্য করতেই হবে, তাওতো গিন্নী জানেইনা আমি আধখানার বদলে গোটা গোটা খাচ্ছি।

‘হ্যাঁগো চুরি হয়ে যায়নিতো, আমার কাল রাতে মনে হলো যেন কোনও আওয়াজ হচ্ছিল।‘

‘হ্যাঁগো তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে! সোনা দানা নয়, রেডিও টিভি নয়, এমনকি কাঁসার থালা বাসনও নয় যে চুরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ব্যবহার করা দুপাটি দাঁত, নতুন হলেও বুঝতুম, চোরে কিসের লোভে চুরি করবে শুনি?’

গিন্নীর সন্দেহ তাও যায়না ‘কি জানি আমার যেন কেমন মনে হচ্ছে এ চোরেরই কাজ।‘

‘হলেই বা ওতো আর পাওয়া যাবেনা, থানা পুলিশ করলেও না। কি হবে সারাজীবনের জন্য আমার খাওয়া দাওয়া ঘুঁচে গেল, গিন্নী আর কি মাংস খেতে পারবোনা।‘

গিন্নীরও আবার শান্তনা ‘পারবে পারবে দরকার হলে মিক্সিতে বেঁটে খাওয়াবো, অত হতাশ হয়োনা।‘

‘ধুর ওটাকে কি আর মাংস খাওয়া বলে!, দেখো যা হয় করো।‘

সারাটা দিন দুজনেরই মনমরা হয়েই কেটে গেল। হাসি ঠাট্টা নেই কেউ কারও সঙ্গে কোনও কথা নেই। শ্মসানের নিস্তব্ধতা। চোপসা গাল আর ফোকলা দাঁত নিয়ে লজ্জায় বাড়ির বাইরেও বেরতে পারছিনা। এরই মাঝে আর এক কেলো, কলিং বেলের আওয়াজ। যথারীতি গিন্নীর ডাক ‘দেখো কে বেল বাজাচ্ছে, দরজাটা খোলো।‘

‘আমি? ওরে বাবা না, ও তুমিই খোলো, বলে দাও শরীর খারাপ’ বলেই তাড়াতাড়ি চাদরমুড়ি দিয়ে খাটে শুয়ে পড়লাম।

আবার বেল বাজলো ‘আমি মিত্তির বাবু বলছি’।

গিন্নীই এগিয়ে দরজা খুলে দিল, ‘ও আপনি, কোন দরকার ছিল? কর্ত্তারতো শরীর ভালো নেই তাই শুয়ে আছে।‘

‘তাহলে থাক পরে আসবো।‘ বলেই উনি ফিরে গেলেন, কিন্তু এভাবে কজনকে ফেরানো যাবে।

 যাইহোক হাজার মনের দুঃখ থাকলেও দিনের অল্প কিছু খেলাম আবার রাত্রেও অল্প কিছু গিলে গিলে গলার্ধকরণ করলাম। আর তারপর সবকিছু ভুলে ঘুমিয়ে পড়ার জন্যে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লাম।

সকাল সকাল গিন্নীর সেই খোঁচানি, তবে এবার বিরক্তির ভাব নেই, খুব খুশি হয়ে একগাল হাসিমুখ নিয়ে বলে ‘আরে ওঠো ওঠো এই দেখো তোমার দাঁত।‘

‘কি বলছো দাঁত কোথায় পেলে?’

গদগদ হয়ে গিন্নী জবাব দেয় ‘চৌকটে জল দেওয়ার জন্য দড়জা খুলেই দেখছি কাগজে মোড়া কি যেন একটা জিনিষ। খুলেই দেখি তোমার সেই দুপাটি দাঁত। দেখো দেখো ঐ মোড়ানো কাগজটায় কি যেন লেখা।‘

গিন্নীর হাত থেকে লেখা কাগজটা কেড়ে নিয়ে বলি ‘ও বাবা এতো চিঠি!’ বলেই পড়তে শুরু করি…

‘মেশোমশাই, কদিন ধরেই লক্ষ রাখছিলাম আপনি শোওয়ার আগে দাঁতের পাটি দুটো খুলে রেখে শোন। এতদিন জানতাম বড়লোকের বাড়ির বয়স্করা সোনা দিয়ে দাঁত বাঁধায়। তাই লোভ সামলাতে না পেরে গতরাতে চুপিচুপি চুরি করেছিলাম। কিভাবে করলাম দয়া করে জানতে চাইবেন না। বাড়ি ফিরে পরীক্ষা করে দেখি সোনার ছিটেফোঁটাও নেই, এতো আস্ত প্লাস্টিকের ঢিপি। এ নিয়ে আমার কি হবে বরং আপনারই অসুবিধে হবে। তাই রাতে একফাঁকে ফেরত দিয়ে গেলাম। প্রনাম নেবেন।‘

দুজনে আর কোন কথা না বলে হাসতে হাসতে বলি ‘গিন্নী আজ একটু খাসীর মাংস নিয়ে আসি।‘

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment