(ধারাবাহিক রহস্য কাহিনী )
ছবি : ইন্টারনেট তরুণ চক্রবর্তী |
পূর্ব কথন - ক্যাপ্টেন ভেড়িতে সম্প্রতি এক অজ্ঞাত পরিচয় মহিলা খুন হয় । অঞ্চলটা পরমা আইল্যান্ড থানার মধ্যে পরে । পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী মহিলাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে । থানার বড়বাবু দিবাকর , সেকেন্ড অফিসার নকুরকে দায়িত্ব দেয় ইনভেস্টিগেসানের জন্য । দিবাকর ও নকুর বড়বাবুর ঘরে জরুরী কথা বলছিল , এইসময় হঠাত ঘরে ঢোকে প্রাক্তন সিভিক ভলেন্টিয়ার সতু ওরফে সত্যবান চৌধুরী ।সতু দিবাকরকে জানায় ঘটনার সময় ও ওখানে ছিল। দিবাকর সতুর কাছে সব শুনে সতুকেই খুনী বলে সন্দেহ করে এবং সতুকে চাপে ফেলে দেয় ।
(শেষাংশ)
————-
(পাঁচ )
বাড়ি ফিরে ক্লান্ত সতু তার এক ঘরের কামরার ,ছোট্ট বিছানায় শরীর ছেড়ে দিল।শরীর ,মন কোনটাই আর পারছে না।একে কোন বাঁধা রোজগার নেই , তারপর বড়বাবুর এই হুমকি সতুকে পুরো বিধ্বস্ত করে দিয়েছে । সতু থাকে ব্যারাকের মতো একটা বস্তিতে । কমন বাথরুম । সতুর দেশ জঙ্গল মহলে । বাড়ির সবাই ওখানেই থাকে । ওই শুধু পেটের তাগিদে কোলকাতার এই বস্তিতে । ঘরে শুধু ছোট বিছানা । আর কিছু বই । সবই বাংলা গোয়েন্দা উপন্যাস । বিশেষ করে ব্যোমকেশ । সতুর প্রিয় গোয়েন্দা । গ্রাজুয়্যাট সতুর খুব ইচ্ছে ছিল বড় গোয়েন্দা হবে ।তার বদলে কিছুদিনের জন্য জুটেছিল সিভিক পুলিশের চাকরী । তাও এখন নেই । এরপর বড়বাবু যা বললো , গোয়েন্দা থেকে না অপরাধী বনে যায় ।
ক্লান্ত সতুর চোখের সামনে হটাত সেই লোকটার হাঁটার ভঙ্গিটা ভেসে উঠল । সতু স্পষ্ট মনে করতে পারলো , লোকটা বাঁ পাটা একটু টেনে টেনে হাঁটছিল । তার মানে বাঁ পায়ে জোর কম আছে । তার মানে …।
দিবাকরের মোবাইলের স্ক্রিনে সতুর নামটা ফুটে উঠল। যা সেভ করা আছে ‘ বাঞ্চোত সতু ‘ বলে । তার সাথে … হুর হুর দাবাং , দাবাং ……রিং টোন তো আছেই ।
— বল ।
— স্যার , একটা কথা জিগ্যেস করার ছিল । ক্রাইম সিন থেকে কোন ফুট প্রিন্ট নেওয়া হয়েছে ? সতু জিগ্যেস করে ।
— কি জানতে চাস বলত । আমি তো এখন পুরো ফরেনসিক রিপোর্ট নিয়ে বসে নেই । রামের বোতল নিয়ে বসে আছি । তুই বরঞ্চ তোর প্রশ্নগুলো একসাথে করে রাখ । আমি উত্তর গুলো বার করে রাখব । কালকে থানায় এসে আমার সাথে কথা বলে নিস । এখন আমাকে রাম খেতে দে ।
— ঠিক আছে স্যার । সতু লাইন কেটে দেয় ।
(ছয় )
পরমা আইল্যান্ড থানায়, বড়বাবুর ঘরে, দিবাকরের সামনে সতু বসেছিল । সকাল দশটা । থানার ব্যস্ততা সবে শুরু হয়েছে ।
— বল তোর কি কি তথ্য দরকার । ওখানে অনেক ফুটপ্রিন্ট পাওয়া গেছে । শুধু একজোড়া ফুটপ্রিন্ট দেখে মনে হচ্ছে লোকটার বা পায়ে জোর কম আছে । কিন্তু তোর হটাত এই প্রশ্ন মনে এলো কেন ? দিবাকর সতুর দিকে তাকায় ।
— আসলে স্যার লোকটা বাঁ পাটা একটু টেনে টেনে হাঁটছিল । তাই মনে হোল ।
— বাঃ ! তুই তো দেখছিস পুরো গোয়েন্দা হয়ে উঠছিস ।
সতু লজ্জা পায় ।
— তুই তো ওই অঞ্চলেই তোলাবাজি করিস । লোকটাকে একদম চিনতে পারিসনি ? সত্যি কথা বলতো ?
— না স্যার ।তখন মাথায় আসেনি , তবে এখন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে । সতু বলে ।
— সে কিরে ? কে ?
জবাবে সতু যার নাম করে , দিবাকরের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয় । দিবাকর উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে আসে । তারপর সতুর সাথে তলিয়ে যায় গভীর আলোচনায় ।
(সাত)
দিন সাতেক পরে ।
দিবাকর তার ঘরে সবাইকে ডেকেছে । জরুরী মীটিং । সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে দিবাকরের জন্য ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দিবাকর ঢুকল । সবাই অবাক হয়ে দেখল দিবাকরের সাথে সাথে ঢুকছে সতু ।
দিবাকর তার চেয়ারে বসার পরে সবাই নিজের নিজের জায়গায় বসে । দিবাকর সতুকে তার পাশের চেয়ারে বসায় । সবার ভ্রু একটু কুঁচকে ওঠে । বিশেষ করে নকুর আর সনাতনের ।
দিবাকর তার বক্তব্য শুরু করে ।
— আমরা সবাই জানি কিছুদিন আগে ক্যাপ্টেন ভেড়িতে একটা হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে । একজন মহিলাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে শ্বাসরুদ্ধ করে খুন করা হয় ।পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে মহিলা প্রেগন্যান্ট ছিল । কেসটা খুব জটিল । কারন ঘটনাস্থল সি .সি ক্যামেরার কভারেজে ছিলনা । ফলে অপরাধীর চেহারা সম্বন্ধে আমাদের কোন ধারনা ছিলনা । এসব ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শীদের একটা বিরাট ভূমিকা থাকে । এখানে সেরকম কেউ এগিয়ে আসেনি । একমাত্র সতু ছাড়া । কিন্তু সেও কুয়াশার মধ্যে , মাফলারে মুখ ঢাকা অপরাধীকে চিনতে পারেনি । এমন কি ভিক্টিমকে আইডেন্টিফাই করার জন্যও কেউ এগিয়ে আসেনি । তবু এতো অসুবিধার মধ্যেও , সতু, হাঁ সতুর সাহায্যে আমরা অপরাধীকে সনাক্ত করতে পেরেছি । শুধু গ্রেপ্তার করা বাকি ।
ঘরে পিন পরলেও শোনা যাবে এরকম নৈঃশব্দ্য ।
দিবাকর আবার শুরু করে ।
— সতু অপরাধীকে চিনতে না পারলেও তার হাঁটাটা খেয়াল করেছিল । একটু বাঁ পা টেনে হাঁটে । ঘটনাস্থলে সেরককম কয়েক জোড়া ফুট প্রিন্টও পাওয়া যায় । কিন্তু শুধু এটুকু সূত্র দিয়ে তো আর অপরাধী ধরা যায়না । আর অপরাধের জায়গায় কোন ফিঙ্গার প্রিন্টও পাওয়া যায়নি । তবে সতু আর আমার মাথায় একজনের কথা আসে যে আমাদের দুজনেরই পরিচিত । এমনকি আপনাদেরও ।
ঘরে যেন নি:শব্দ বজ্রপাত হোল ।
— আমরা তার মোবাইল নাম্বার জানতাম । ঘটনার দিনের কল ডিটেলস্ আর টাওয়ার লোকেশান জোগাড় করলাম । কিন্তু টাওয়ার লোকেশান ঘটনাস্থলের সাথে মিললো না। কিন্তু কল লিস্টে দেখা গেল ,একটা নাম্বারে অনেকবার কল গেছে আর এসেছে । আর ওই নাম্বারটার ওই দিন কিছু সময়ের জন্য লোকেশান ছিল , অপরাধ যেখানে ঘটেছে সেখানে । রাত নটার পর থেকে অবশ্য নাম্বারটা সুইচড্ অফ ছিল । তার মানে অপরাধী , খুনটা করে মোবাইলটা সুইচড অফ করে দেয় । আর সতুর কথা আর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী সময়টাও মিলে যায় । কিন্তু আমরা অবাক ও হতাশ হই যখন দেখি সন্দেহভাজন অপরাধী আর ভিক্টিমের ফোন নাম্বার একই ব্যক্তির নামে । ভিক্টিমকে সনাক্ত করার শেষ আশাও বরবাদ । যেহেতু সন্দেহ ভাজন লোকটি আমাদের পরিচিত , আমরা সরাসরি ওকে জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারছিলাম না । কিন্তু আমরা গোপনে খবর নিয়ে জেনেছিলাম , ব্যাক্তিটি মোবাইলটি ঘরে রেখে , ওই সময়ে বাইরে ছিল । নিজের অ্যালিবাই প্রমাণ করার জন্য ।
দিবাকর একটু থামল। সামনে রাখা গ্লাস থেকে একটু জল খেল । তারপর আবার শুরু করলো ।
— আমাদের কাছে তখন বড় হয়ে দাঁড়ালো সেই ব্যক্তির সাথে ভিক্টিমের সম্পর্ক প্রমাণ করা । তাহলে অন্তত আমরা যে ঠিকপথে এগোচ্ছি সেটা বোঝা যাবে । আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে , কিছুদিন আগে , সার্ভিস বুকে ব্লাড গ্রুপ লিখতে হবে বলে আপনাদের সবার কাছ থেকে ব্লাড নিয়েছিলাম ।সেই ব্লাড থেকে আমরা খুন হয়ে যাওয়া মহিলার ভ্রূণের ডি .এন. এ টেস্ট করাই । আমাদের সন্দেহভাজন ব্যাক্তির সাথে ম্যাচ করে যায় । আমরা নিশ্চিন্ত হই আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছি । কিন্তু আমাদের এখনো তিনটে বড় কাজ বাকি , আইনের কাছে অপরাধ প্রমাণ করে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য । এক, ভিক্টিমের আইডেন্টিফিকেশন ; দুই ,মোডাস অপারেন্ডি; তিন, অপরাধের মোটিভ । আর সত্যি কথা বলতে নকুর বা সনাতন নয় , এ ব্যাপারে আমাদের একমাত্র হেল্প করতে পারে জনার্দন । কিরে জনার্দন , তাইতো ?
জনার্দন তখন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে । হাত জোড় করে দিবাকরের উদ্দেশে বলতে শুরু করেছে …
— আমাকে ফাঁসিতে চড়ান বড়বাবু । আমি আর পারছিলাম না । রোসির পেটে বাচ্চাটা আসার পরেই ও চাপ দিতে শুরু করে বিয়ে করার জন্য । বলুন তো স্যার, দেশে আমার বালবাচ্চা আছে। ওরকম বললেই বাঁধা বাবু থেকে হাসব্যান্ড হওয়া যায় । তাই ওকে সরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলাম । ঘটনার দিন ফোন করে ওকে ক্যাপ্টেন ভেড়িতে ডেকে আনলাম । ঘুমের ওষুধ আগেই কিনে রেখেছিলাম । গল্প করতে করতে মাঝখানে উঠে গিয়ে চা- পানি আনতে গিয়ে চায়ের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম । রোসি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো । তারপর জায়গাটা একদম ফাঁকা হতেই , গ্লাভস পড়ে রোসির গলাটা টিপে ধরলাম । কিছুক্ষণের মধ্যেই নিস্তেজ হয়ে যায় । সংসার বাঁচানোর জন্য এছাড়া আমার কি করার ছিল বলুন স্যার ?
— সংসার কি বাঁচল ? দিবাকর জিগ্যস করে ।
জনার্দন মাথা নিচু করে ।
দিবাকর নকুরের দিকে ইশারা করে , নকুর , জনার্দনের হাতে হাতকড়ি পড়িয়ে নিয়ে যায় থানা হাজতের দিকে ।
(আট)
দিবাকরের ঘর এখন ফাঁকা । শুধু সাতু আর দিবাকর বসে আছে ।
— তুই তো কামাল করে দিলি । আমি ডি. সি ( ডি .ডি ) কে বলেছি তোকে গোয়েন্দা দপ্তরে একটা পাকা কাজ দেওয়ার জন্য । উনি সব শুনে খুব ইমপ্রেসড্ । মনে হয় কাজটা হয়ে যাবে । দিবাকর বলে ।
— তাহলে এখন আমি যাই ? সতু জিগ্যেস করে ।
— হ্যাঁ । সাবধানে যাস ।
সতু থানা থেকে বেড়িয়ে আসে । থুড়ি , সতু নয় , সত্যসন্ধানী সত্যবান চৌধুরী ।
(সমাপ্ত)
tchak1961@gmail.com
কলকাতা
শেষটা ভালোই হল। বইয়ের গোয়েন্দাকাহিনীর মত সাবপ্লট, টু্ইস্ট এসব এখানে নেই, তাই প্রত্যাশা পূরণ একটু কম হল। তবে বাস্তবে বোধহয় এমনই ঘটে।
ReplyDelete