1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

চিকিৎসকের রোজনামচা ( পর্ব ২ ) : আপনজন

আপনজন

ডাঃ সৌভিক ব্যানার্জী

"আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে,

তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে।"

      রবি ঠাকুরের গানের সুরে গলা মিলিয়ে আজ সকাল থেকেই মনে মনে গুনগুনিয়ে উঠছি। এখন বসে আছি বোলপুর ট্যুরিস্ট লজের খাওয়ার ঘরে। গরম গরম ফুলকো লুচি আর আলুর তরকারি দিয়ে সকালের খাবার খেয়ে এখন গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে আছি। আমি তিনদিনের ছুটি কাটাতে বোলপুরে এসেছি। বোলপুর আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা, যে কারণে ছুটি কাটাতে মাঝেমধ্যেই আমি এখানে আসি। আসলে দুর্গাপূজার সময়ে আমার কাজের ছুটি আমি পাই না। কারণ টা খুব স্পষ্ট, আমি একজন পেশায় চিকিৎসক। পেশার তাগিদে আমায় সারাদিন অসংখ্য মানুষের ও তাদের জীবনের সাথে ওঠাবসা করতে হয়। তাদের জীবনের না পাওয়ার গল্প, সুখ দুঃখের গল্পের অংশীদার হতে হয়। কিন্তু কিছু কিছু গল্প মনে দাগ কেটে যায়, মাঝে মাঝে চমকেও উঠি। তাই ভাবলাম সেই গল্পগুলো আপনাদেরকেও শোনাই। তবে বলাই বাহুল্য গল্পকারের পরিচয় সঠিক হলেও গল্পের স্থান কাল পাত্র কিন্তু পরিবর্তিত থাকবে। সেটা কিন্তু আমার পেশাগত কারণেই কারণ ডাক্তারি পাশ করার সময় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম যে সকল রোগীদের পরিচয় গোপন রাখবো। তাই সুরার পাত্রে লিকার চা ঢেলে গল্প শোনানোর পালা শুরু করলাম। এটা আমার দ্বিতীয় গল্প। অমাবস্যার রাত্রির ওই ঘটনাটার পর আমি একবার হেমন্ত সুইটস এর পাশ দিয়ে এসেছিলাম কিন্তু জানিনা কেন আর মন্দিরবাড়ির দিকে যেতে পারিনি। হয়তো নিজের উপর খুব রাগ আর দু:খ মিলিয়ে একটা কিরকম অনুভূতি হয়েছিলো। আজ ষষ্ঠী, মায়ের বোধন। মা দুর্গার কাছে প্রতিবারের মতো আমার প্রার্থনা থাকে এটাই যে সবাইকে সুস্থ রাখো। কিন্তু এবার তার সাথে সাথে আমি এটাও চাইবো যে মানুষের মনকে কুসংস্কার মুক্ত করো।

      তিনদিন ছুটি কাটিয়ে বাড়ি ফিরলাম। আমার মা তার বন্ধুদের সাথে বাইরে ঘুরতে গেছে। কাজের লোকটাও আসবে না। তাই মিঠুন কে বললাম এই পূজার কটা দিন আমার সাথে থেকে যেতে, "তোর বঊদিও নেই রে, বাপের বাড়ি গেছে। একসাথেই খাওয়া দাওয়া করবো। আর তুইই বা কি করবি বাড়ি গিয়ে। তার থেকে আমার সাথে থেকে যা।" মিঠুন তো খুব খুশি। ষষ্ঠীর রাত্রে বাড়ি ঢুকতে অনেকটা দেরী হয়ে গেছিলো। তাই সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠতেই দূর থেকে শুনতে পেলাম ঢাকের আওয়াজ আর মাইকে পুরুতমশাইয়ের মন্ত্রের উচ্চারণ। মিঠুন দেখলাম অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। "স্যার চা খাবেন তো? বানিয়ে রেখেছি। আমি যাই চেম্বার টা খুলি। পরিষ্কার করতে হবে, তিনদিন খুলিনি। নোংরা হয়ে থাকবে। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। পেশেন্টরাও আসবে। ম্যানাজ করি। স্যার আমি বেরোলাম আপনি আসুন" এই বলে মিঠুন বেরিয়ে গেলো। আমি ফ্রেশ হয়ে চা খেতে বসলাম আমার বারান্দায়। আরামকেদারায় বসে মোবাইলে শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সেই চিরাচরিত অমর হয়ে থাকা মহিষাসুরমর্দিনী চালালাম। সত্যি এই জিনিস পুরানো হওয়ার নয়। চা যে কখন শেষ হয়ে গেলো খেয়াল নেই। মন যেন আর উঠতেই চাইছে না এতটাই বিভোর হয়ে গেছিলাম। হঠাৎ করে মোবাইল টা সশব্দে বেজে উঠল। ফোনের ওপাশ থেকে একটা ভারী পুরুষ কন্ঠস্বর, "ডাক্তারবাবু বলছেন?" আমি সম্মতি দেওয়ার পর উনি বললেন, "নমস্কার স্যার, আমি পাতিপুকুর থেকে বলছি। আমার একজন পেশেন্ট আছে, জ্বর এসেছে, আপনি একটু যদি দেখে যান বাড়ি এসে খুব ভালো হয়।" আমি বললাম "চেম্বারে নিয়ে আসুন না, খুব ভালো হয়। পূজার সময়ে হোমকলটা,,, আসলে বুঝতেই পারছেন। চেম্বারে নিয়ে আসুন।" ভদ্রলোক আচ্ছা বলে ফোনটা কেটে দিলেন আর আমিও আলস্যি ঝেড়ে চেম্বারে বেরোনোর জন্য তৈরি হতে গেলাম।

      সপ্তমীর দুপুরে আমি আর মিঠুন মাংস ভাত খেলাম, অবশ্যই শীতলা মাসির দোকান থেকে আনিয়ে "মাংসটা ভালোই রেঁধেছে মাসি কি বল মিঠুন।" বড় একটা মুরগীর ঠ্যাং চিবোতে চিবোতে মিঠুন উত্তর দিলো "একঘর"। খাওয়া দাওয়া সেরে উঠে দেখলাম দুপুর তিনটে গড়িয়ে যায়। "চল মিঠুন বেরোই।" ও কথা প্রসঙ্গে বলা হয়নি, আজ আমরা এখন 3D সিনেমা দেখতে যাবো। আমি আগে দেখেছি 3D সিনেমা কিন্তু মিঠুনের কাছে এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা, তাই স্বাভাবিকভাবেই ও খুব উত্তেজিত। খাওয়া সেরে চেম্বার থেকে বেরিয়েই দেখি একজন ভদ্রলোক বয়স ওই আনুমানিক ষাট থেকে পয়ষট্টি হবে, পরনে একটা সাদা পাজামা আর গায়ে একটা সিল্কের পাতলা ফিনফিনে পাঞ্জাবি যেটার বাঁ দিকের কাঁধের কাছে অল্প ছেঁড়া, বাইরে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বেদিটার উপরে বসে আছেন। আমাকে দেখেই হাত দুটো জড়ো করে এগিয়ে এলেন, "নমস্কার ডাক্তারবাবু, আমার নাম কেষ্ট দাস। আমি থাকি পাতিপুকুরে। আমিই আপনাকে সকালে ফোন করেছিলাম। আপনি কি মনে করতে পারছেন?" বুঝলাম, ইনিই আমাকে ফোন করেছিলেন হোমকলের জন্য। মিঠুন দেখলাম চেম্বার বন্ধ করে মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিনেমা দেখতে যাওয়ার অনিশ্চয়তাটা নিশ্চয়ই ওর মধ্যেও কাজ করছে। "আপনার তো পেশেন্ট নিয়ে আসার কথা ছিলো। আনলেন না?" আমার প্রশ্নের জবাবে ভদ্রলোক বললেন "আসলে ডাক্তারবাবু পূজার সময় তো, কোনো গাড়ি ঘোড়া পেলাম না, আপনি যদি একটু কষ্ট করে যান। আমি খুব উপকৃত হই। খুবই জ্বর আসছে। আপনি খাচ্ছিলেন বলে আপনাদেরকে আর বিরক্ত করিনি, বাইরেই বসেছিলাম। আপনি যদি একটা বার দেখে আসেন।" আমার সামনে করজোড়ে বয়ঃজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোককে ওই ভাবে মিনতি করতে দেখে আমার খুব মায়া হলো। । মানুষটা নিশ্চয়ই বিপদে পরেছেন নাহলে আমায় এভাবে অনুরোধ করতেন না, "মিঠুন তোকে হলে নামিয়ে দিয়ে আসছি। আমি এদিকটা সামলাই। আমি নাহয় একটু পর থেকে দেখবো। চল, তোর জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা থেকে তোকে বঞ্চিত করবো না। কেষ্টবাবু আপনি এগোন, আমি আসছি। পাতিপুকুরের কোথায় যাবো? ঠিকানা টা?" ভদ্রলোকের চোখেমুখে যে একটা খুশির ঝলক সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম, "আপনি মাছের বাজার টা চেনেন তো? ওখানে এসে আমায় একটা ফোন করবেন। আমি আপনাকে নিয়ে যাবো। আপনার ফোনে একটা মিস কল করে দিয়েছি। " আমি 'ঠিক আছে' বলে মিঠুন কে নিয়ে এগোতে যাবো হঠাৎ সেই সময় কেষ্টবাবু বলে উঠলেন "ও হ্যাঁ ডাক্তার বাবু, ধন্যবাদ। "

     পাতিপুকুরের মাছের বাজারে এসে ফোনটা বের করতে যাবো এমন সময় পেছন থেকে ডাক, "আসুন স্যার, এইদিকে", ওমা দেখি কেষ্টবাবু সেখানে আগের থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমায় দেখে সম্ভবত উনি এগিয়ে এসে আমায় ডেকে নিয়ে গেলেন। উনি সাইকেলে করে সামনে সামনে যাচ্ছেন আর তার পেছনে আমি স্কুটি নিয়ে চলতে লাগলাম। একটা চওড়া রাস্তার ধার ধরে আমরা এভাবে এগিয়ে গিয়ে একটা দুধের দোকানের পাশ দিয়ে বেঁকে গেলাম। সামনে একটা লোহার জংধরা আধখোলা গেট যার দুদিকের মাটিতে ঘাস আর মাঝখানটা লোক চলাচলের কারনে ঘাস উঠে গেছে। স্কুটিটা নিয়ে অতিকষ্টে এঁকেবেঁকে ঢুকলাম। ভিতরে পুরানো দিনের সার সার কোয়ার্টার যার দেওয়াল খসে গিয়ে সিমেন্ট বেরিয়ে গেছে, রংতো কিছু বোঝাই যায় না আর পাইপের গায়ে প্রচুর শ্যাওলা। কিছু কিছু জায়গায় পাইপের অংশ দিয়ে ফোটা ফোটা জল পড়ছে, "সবতো অনেক পুরানো দিনের বাড়ি নাকি কেষ্টদা, কিছু কিছু জায়গা দেখে তো মনে হচ্ছে এখুনি বুঝি ভেংগে না পড়ে যায়", কেষ্টবাবু মুখ ঘুড়িয়ে বললেন " হ্যাঁ স্যার অনেক পুরানো, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধুকছে, তবে ইয়ে স্যার আপনি কেষ্টদা বলাতে খুব খুশি হলাম, এই পূজার দিনে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরী হলো, নিন স্যার এসে গেছি। আপনি বাইকটা এখানে রেখে দিন। আসুন ভেতরে, একটা তলা কষ্ট করে একটু উঠতে হবে।" আমিও স্কুটিটা রেখে কেষ্টদার পেছনে পেছনে উঠে গেলাম উপরে। পুরাতন দিনের মোটা মোটা দেওয়াল, খিড়কি দেওয়া জানালা আর উপরে মাকড়সার জাল যেটা কিছু কিছু জায়গায় ঝুলের মতো ঝুলছে। "প্রতিমা, ডাক্তারবাবু এসেছেন, মামণি কে বলো উঠে বসতে, আসুন ডাক্তারবাবু", এই বলে কেষ্টদা আমার ব্যাগটা নিয়ে নিলেন। আমিও জুতো খুলে এগোতে যেতেই একজন ভদ্রমহিলা হাত জড়ো করে বললেন "আসুন ডাক্তারবাবু, এদিকে" বুঝলাম ইনার নামই প্রতিমা। আর আমার পেশেন্ট খাটের উপর বসে আছেন। পরনে একটা সাদা নাইটি, খুবই সাধারণ মানের জীবনযাপনের কারনে চুল উস্কোখুস্কো তবে গায়ের রঙ দুধের মতো ফরসা। ঠোঁটের নিচে খাবার লেগে আছে সাদা রঙের, মনে হয় সবেমাত্র খাওয়া শেষ হয়েছে তাই মুখটা মোছা হয়নি আর বয়স আনুমানিক ষাটের গোড়ায়। আমি এগিয়ে গেলাম উনার দিকে "নমস্কার আমি ডাঃ সৌভিক ব্যানার্জী, আপনার কি অসুবিধে বলুন, ধীরেসুস্থে বলুন আর প্রতিমাদি, উনার মুখটা মুছিয়ে দিন, খাবার লেগে আছে।" "দেখুন তো কবে মরব" এই বলে ভদ্রমহিলা আমার দিকে তার ডান হাতটা এগিয়ে দিলেন। আমি পালস দেখার জন্য সামনের দিকে ঝুঁকে বসলাম, "আপনি এরকম কথা কেন বলছেন, সামান্য জ্বর হয়েছে, আমি ওষুধ দিচ্ছি সেরে যাবেন। সর্দি কাশি জ্বর, তেমন গুরুতর কিছু নয়।" কেষ্টদা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, "ওর কথায় কিছু মনে করবেন না ডাক্তারবাবু, ও ওই রকম কথা প্রায়ই বলে থাকে। মামণি, উনি নিজের পূজার প্রোগ্রাম ছেড়ে এসেছেন তোমায় চিকিৎসা করবেন বলে। এরকম কথা বলতে আছে কি?" কেষ্টদার প্রশ্নের উত্তরে উনি মাথা নামিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, "তুমি কি আর বুঝবে আগুনের জ্বালা, বাদ দাও।" অকস্মাৎ এরকম কথায় আমি হতচকিত হয়ে কেষ্টদার দিকে তাকালাম। কেষ্টদা দেখলাম মাথা নামিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি অগত্যা পেশেন্ট দেখার কাজে মনোনিবেশ করলাম। প্রেসস্ক্রিপশন করার জন্য পেশেন্টের নাম টা জানার দরকার ছিলো। কেষ্টদা নেই তাই অগত্যা প্রতিমাদিকেই জিজ্ঞেস করলাম কারণ মামণি যে উনার নাম নয় সেটা আগেই বুঝে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করে ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, "ও আমার নাম জানেনা, আমিই বলছি। আমার নাম কৃষ্ণকলি দত্ত রায়।"

     পেশেন্ট দেখে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম। কেষ্টদা কোথায় গেলেন জানিনা। আমি সদর দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়েই দেখি কেষ্টদা ঠিক বাইরেই দাঁড়িয়ে আছেন। মুখ নিচের দিকে, চোখের দৃষ্টি অন্যমনষ্ক। আমায় দেখেই হালকা গলায় বলে উঠলেন, "হয়ে গেছে আপনার, কি বুঝলেন ডাক্তারবাবু?" "খুব সাধারণ ফ্লু, জ্বর টা তাড়াতাড়িই কমে যাবে তবে গা হাত পা ব্যাথা আর মাথার ভার টা আস্তে আস্তে কমবে। দিন পাঁচেকের ওষুধ দিয়েছি, তার মধ্যে ঠিক হয়ে যাবেন উনি", এইবলে আমিও অবচেতন কন্ঠে হঠাৎ বলে উঠলাম, " কি ব্যাপার আপনি আমায় কিছু মনে না করতে বলে নিজেই মান অভিমান করে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?" এই কথাটা বলার পরেই নিজের উপর ধিতকার দিয়ে উঠলাম এই ভেবে যে এই কথাটা বলা উচিৎ হলো না। আমি তো চিকিৎসক, চিকিৎসা করে পারিশ্রমিক নিয়ে চলে যাবো। আমার কারোর ব্যাক্তিগত ব্যাপারে কথা বলা উচিৎ নয়। আমি জানিও না এই কেষ্টদা, প্রতিমাদি এবং আমার পেশেন্ট, এদের মধ্যে সম্পর্ক কি? কিছু না জেনে কথাটা বলে খুব অন্যায় করে ফেলেছি। ভাবছি কেষ্টদা কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেন আর ঠিক তখনই "আপনি কি চা খেতে ভালোবাসেন ডাক্তারবাবু? তাহলে আসুন আপনাকে পল্টুর দোকানে স্পেশাল চা খাওয়াই", কেষ্টদার এই কথায় আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে অনুভূতি বোঝার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। কিন্তু এইটুকু বুঝলাম যে ভদ্রলোকের মনে কোথাও একটা চাপা কষ্ট আছে যেটা মুখের চোয়ালের দৃঢ়তা আর চোখের চাউনির ভাজে লুকানো থাকে। আমি আর একমুহূর্ত কথা না বাড়িয়ে কেষ্টদাকে অনুসরণ করলাম। পুরো রাস্তাটা কেষ্টদা আর একটাও কথা বললেন না। আমি ভাবছি যে লোকটা এত কথা বলছিলেন আসার সময় সেই লোকটা আমার পেশেন্টের একটা কথায় এত প্রতিক্রিয়া কেন দিচ্ছেন? আর কৃষ্ণকলি ম্যাডাম কেনই বা ওরকম কথা বললেন, সেটাও ধোঁয়া আমার কাছে। কোনো কিছুই বুঝতে না পেরে কেষ্টদার পিছনে চলতে লাগলাম। যদিও আমার এসবের ভিতর ঢোকাটা উচিৎ নয় কিন্তু কেষ্টদার চোখের অনুশোচনা আমায় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আজ পেশেন্ট দেখতে আসা কিন্তু কেষ্টদার একান্ত অনুরোধে আর এখন সিনেমা হল না গিয়ে চায়ের দোকান যাওয়া, সেটাও ওই লোকটার চোখের অনুভূতির তাড়নাতেই। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে লোহার গেটটা পেরিয়ে গেলাম। যাঃ, তাড়াহুড়োতে স্কুটার টা নিতে ভুলে গেছি। আবার এতটা পথ আসতে হবে যদিও খুব বেশি দূর নয়। কোয়ার্টারের পরিধির বাইরেই চায়ের দোকান। কেষ্টদা আমায় একটা বেঞ্চ দেখিয়ে বললেন, " ডাক্তারবাবু বসুন, আমি চা নিয়ে আসছি। বিস্কুট খাবেন তো?"

     এখন বেঞ্চে বসে আছি চায়ের কাপ হাতে। কেষ্টদা আমার জন্য বাদাম বিস্কুট এনে দিয়েছেন। "বলুন দাদা, আপনি কি কিছু বলবেন। আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আপনি কিছু একটা বলতে চান। আপনি নির্ভাবনায় বলে ফেলুন।" আমার কথা শুনে কেষ্টদা বাইরের একটা দোকানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, "ওই যে দোকানটা দেখছেন ডাক্তারবাবু, বাইরে কিছু ওভেন আর গ্যাস সিলিন্ডার পড়ে আছে, ওটা আমার দোকান। আসলে বাবার দোকান, আমি পৈতৃক সূত্রে পেয়েছি। বাবার সময়ে দোকানে চাল ছিলো না। আমি উপরটা ঢেলেছি, আয়তনেও একটু বাড়িয়েছি। হাতের কাজ বাবার থেকেই শেখা। কলির বাবা মানে আপনার পেশেন্টের বাবা আর আমার বাবা খুব ভালো বন্ধু ছিলো। তখন নক্সাল আন্দোলন চলছে। কলির বাবা ছিলেন ডাকসাইটে নেতা, এখানকার কাউন্সিলার। কলির বাবারা দুই ভাই, বড় ভাই কাউন্সিলার আর ছোট ভাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কলির মা ছোটবেলাতেই মারা যান, তখন বোধহয় কলির দুই কি তিন মাস বয়স হবে। কলির কাকিমা মানে ছোটো ভাইয়ের বঊ কলির ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। কাকিমা ছিলেন নিঃসন্তান, জরায়ুতে কি একটা সমস্যা ছিলো, আপনাদের ডাক্তারি ভাষা তো অত পরিষ্কার বুঝিনা তবে সমস্যা কিছু একটা ছিলো যেটা আমার বাবার মুখে শোনা" এই বলে কেষ্টদা পাঞ্জাবীর পকেট থেকে বিড়ি বের করে মুখে দিতেই আমি বলে উঠলাম, "কেষ্টদা বিড়িটা আমার সামনে যদি না খান,,, " সাথে সাথে কেষ্টদা জিভ কেটে নিজের ভুল হয়েছে স্বীকার করলেন। "ঠিক আছে, ঠিক আছে, আপনি এগিয়ে যান। কৃষ্ণকলি ম্যাডামের কাকিমার কাছে বেড়ে ওঠা টা না হয় বুঝলাম কিন্তু উনার বাবার সাথে আপনার বাবার বন্ধুত্বটা কি আগে থেকেই ছিলো নাকি পরে হলো,,," আমায় থামিয়ে দিয়ে কেষ্টদা বলে উঠলেন, "বলছি বলছি। তা তখন কলি মনে হয় ক্লাস সেভেনে পড়ে। কলির বাবা তখন পার্টির বড় নেতা। হঠাৎ খবর আসে শিয়ালদহ তে ছবিঘর সিনেমার ওখানে একটা আক্সিডেন্ট হয়েছে, একজন ভদ্রলোক গুরুতর ভাবে আহত, এন-আর-এসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আইডেনটিটি কার্ড থেকে জানা গেছে নাম নারায়ণ দত্ত রায়।" আমি বলে উঠলাম, "কলির বাবা?" কেষ্টদা মুচকি হেসে বললেন, "নাঃ, কলির কাকা। কলির বাবার নাম মহাদেব দত্ত রায়। নারায়ণকাকার ছিলো ও নেগেটিভ ব্লাডগ্রূপ। সে ব্লাড তো কোথাও পাওয়া যায় না। মহাদেবজ্যাঠা প্রচুর চেষ্টা করে এক বোতল জোগাড় করলেন কিন্তু লাগবে তিন বোতল রক্ত। প্রাণাধিক প্রিয় ভাই এর জীবন বাঁচানোর জন্য মহাদেবজ্যাঠা পাগলপারা হয়ে গেছিলেন। আমার বাবা সেই সময় এন-আর-এসে গেছিলেন আমায় নিয়ে কুকুর কামড়ের ইনজেকশন দেওয়াতে। জ্যাঠাকে দেখে বাবা এগিয়ে যান কি হয়েছে জানতে। বাবার সামনে মহাদেবজ্যাঠা হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেন এবং সবটা বলেন। বাবা শুনে বলেন আরে আমি থাকতে আপনি কেন কাঁদছেন। বাবার ছিলো ও নেগেটিভ ব্লাড। ব্যাস, আর পায় কে। আমার বাবা রক্তদান করেছিলেন। শুধু বলেছিলেন আমার ছেলেটাকে বাড়ি তে পৌছে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দিতে। আমার তো তখন বুঝলেন মশাই, পেটে ইঞ্জেকশন নিয়ে বিশাল ব্যাথা। জ্যাঠা আমার বাবা কে তখন বললেন, তোমার ছেলে আজ আমার বাড়িতেই থাকবে, খাবে। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকো। আর আজ তুমি আর আমি একসাথে খাবো। তুমি আমার ভাইকে জীবন দিয়েছো, এই ঋণ ভোলার নয়। তুমি জীবিকা কি করো আমি জানি, তাতে তুমি ইতঃস্তত বোধ কোরোনা। তোমার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক।" মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম এই গল্প, মাঝে বিঘ্ন ঘটালো মোবাইল। মিঠুনের ফোন, "স্যার আপনি কোথায়? কতক্ষণ ধরে পেশেন্ট দেখছেন? সিনেমার যে হাফটাইম হয়ে গেলো। কখন আসবেন?" আমি শুধু বললাম "আসবো।"

     আরও এককাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে এলেন কেষ্টদা, সাথে আবারও বাদাম বিস্কুট। বিস্কুটটা ডুবিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, "আচ্ছা আপনি বলছেন মহাদেববাবু কাউন্সিলার। কিন্তু উনি রক্ত যোগাড় করতে গিয়ে এত হিমসিম খেলেন কেন?" চায়ে চুমুক দিয়ে আস্তে আস্তে হেটে কেষ্টদা আমার পাশে এসে বসলেন, "যে সময়ের কথা বললাম তখনো জ্যাঠা কাউন্সিলার হননি। পার্টির বড় নেতা ছিলেন। কিন্তু মজার কথা কি জানেন আমার বাবা কোনোদিন কোনো সুবিধা নেননি জ্যাঠার কাছ থেকে। নিলে আজ আমার ওইটুকু পুচকে দোকান থাকতো না। ওদের মধ্যে একটা অদ্ভূত সম্পর্ক ছিলো। সেটা বন্ধুত্ব নাকি কৃতজ্ঞতা সূচক আমি জানিনা। জ্যাঠার আপনজন ছিলেন আমার বাবা।" সন্ধ্যে নেমে আসতেই চারিদিকে রাস্তার আলো জ্বলে উঠল। কেষ্টদা দূরে তাকিয়ে রইলেন। সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে আকাশে যেরকম লাল ছটা ছড়িয়ে পড়ে সেইরকম এই গল্পের ছটা আমার মনে ছড়াতে লাগলো। "বুঝলাম কেষ্টদা, এই সম্পর্কের খাতিরেই আপনি এদের দেখভাল করেন। খুব ভালো লাগলো দাদা, আজকালকার দিনে কেউ সম্পর্কের দাম দেয় না। আপনি সত্যিই,,, " আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই কেষ্টদা দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলেন, "নাঃ"। সন্ধ্যে এখন অনেকটাই গাঢ়, চারিদিকে ঝকঝকে আলো জ্বলে উঠেছে। সবাই ঠাকুর দেখতে বেড়িয়ে পড়েছে। সপ্তমীর রাত, আজ থেকে বাঙালীর পূজা পরিক্রমা শুরু। এইসব কিছুর মাঝে একটা ষাট পয়ষট্টি বছরের লোকের ফেলে আসা কাহিনী শুনে চলেছি যার মধ্যে অনেক টানাপোড়েন লুকিয়ে আছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। "বাবা হঠাৎ করেই মারা যান", কেষ্টদা কাহিনী বলতে শুরু করলেন, "তারপর থেকে এই দোকানটার ভার আমার উপরে পড়ল। আমার পড়াশোনা বেশি নয়। বাপের কাছে হাতের কাজ শিখে গিয়েছিলাম খুব তাড়াতাড়ি। বাবা বলতেন, তুই আমার থেকেও ভালো কাজ জানিস। হয়তো কিছু দেখেছিলেন, তাই বুঝেছিলেন। কলির বাবা আমার দোকানে রোজ রাত্রি বেলায় বাড়ি ফেরার পথে আসতেন। বাবার ছবির দিকে চেয়ে খানিকক্ষণ সময় বসে থাকতেন চুপ করে। তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে জ্যাঠা চলে যেতেন। রোজ একই ঘটনা। আমি বুঝতাম কিছু একটা কষ্ট হয় যেটা উনি ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন না। নিখাদ বন্ধুত্ব বলতে যা বোঝায় তারই উদাহরণ ছিলো ওই দুজন। কোনো চাওয়া পাওয়া ছিলোনা, স্বার্থ ছিলো না। তখন জ্যাঠা কাউন্সিলার হয়ে গেছেন, হতে শত ব্যস্ততা, শয়ে শয়ে লোক জ্যাঠার সাথে রাতদিন ওঠাবসা, তবুও দিনের শেষে জ্যাঠা আসতেন আমার দোকানে। মাটির ভাড়ে এক কাপ চা নিয়ে চুপ করে বসে থাকতেন। আমায় খুব ভালোবাসতেন। বাবা চলে যাওয়ার পর আমার খাওয়াদাওয়ার ঠিকানা ছিলো এই বাড়ি। আমায় রোজ রাত্রে এসে জিজ্ঞেস করতেন আমি খেয়েছি কিনা, কাজ কেমন চলছে, এইসব। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যেতেন।" কেষ্টদার কাছে কাহিনী শুনতে শুনতে কখন সময় পেরিয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। একটা অটো হঠাৎ খুব জোরে হর্ণ বাজিয়ে রাস্তা দিয়ে চলে গেলো। গল্পের মাঝে বিরতি ঘটিয়ে দিতেই পল্টুর কাছে আর এক কাপ চা খাওয়ার ফরমান জারি হয়ে গেলো কেষ্টদার।

      "জ্যাঠার হঠাৎ করেই ব্রেন স্ট্রোক হল কয়েক মাস পর। বাঁচানো গেলো না।", কেষ্টদার এই কথায় চা খাওয়া থামিয়ে আমি মুখ তুলে চাইলাম। আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা দেখে কেষ্টদা বললেন, " আপনজনের টান একেই বলে ডাক্তারবাবু বুঝলেন। কলি তো এদিকে পিতৃহারা, শোকটা খুব গভীরে লাগল। আমি তো যখন আসতাম খেতে এই বাড়িতে কলিকে দেখতাম চুপ করে মনমরা হয়ে বসে থাকতে। আমি কলির সাথে হাসাহাসি করার চেষ্টা করতাম। এই কোয়ার্টার এর ভেতরে টগর গাছ ছিলো অনেকগুলো। টগরফুল নিয়ে যেতাম কলির জন্য। টগরফুল খুব ভালোবাসতো কলি।" আমি কেষ্টদাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "টগরফুল কেন?" কেষ্টদা পাশে এসে বসল আমার, "সকালে চান করে বাবা মায়ের ছবিতে টগর ফুল দিয়ে কলির দিন শুরু হতো। কলির মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরেই মহাদেব জ্যাঠা মারা যান। নারায়ণ কাকা আর কাকিমা ছিলেন ভীষণ সজ্জন ব্যক্তি। কলির কোনো অভাব রাখতেন না। নিজের মেয়ের মতো দেখাশুনা করতেন। আর আমাকেও খুব খাতিরযত্ন করতেন। প্রতি বছর নববর্ষের সময় আর দুর্গাপূজার সময় জামাপ্যান্ট দিতেন। দোকানটাও তখন ভালোই চলছিল। সেদিন কাকিমার খুব জ্বর। যথারীতি আমি গেছিলাম দুপুরে দোকান বন্ধ করে। গিয়ে তো দেখি এই অবস্থা। আমি তো আমাদের তখন দেখতেন দূর্গা ডাক্তার, তাকে খবর দিয়ে এলাম। ঘরে নারায়ণকাকা বা কলি কেউই নেই। একজন স্কুলে আর একজন কলেজে, ফেরেন নি। দূর্গা ডাক্তার সব দেখে টেখে ওষুধ দিলেন। কাকিমা আঁচলের খুঁট থেকে টাকা দিলেন, ওষুধ এনে দিলাম। তারপর বুঝলেন মশাই অনেক বিকেল করে দুপুরের খাবার খেলাম সেদিন। কাকিমার সে কি বকা, আমার খাবার ঠান্ডা হয়ে গেছিলো বলে। বলে কিনা শুনুন, আমি দুপুরের খাবার খেয়ে কেন ডাক্তার ডাকতে যাইনি। বলেন তো এ কখনও হয়। তারপর কাকিমা বললেন, এক কাপ চা আর এক গ্লাস দুধ গরম করে দিতে। আসলে কাকু আর কলির ফেরার সময় হয়ে গেছিলো। বার্ণার জ্বালাতে গিয়ে দেখি জ্বলছে না। বার্ণারের যে নবটা থাকে নিচে কালো মতন, সেটা ঠিক করে ঘুরছেনা। জ্যাম হয়ে গেছে। কাকিমা কে বললাম বার্নারের সুইচটা খারাপ হয়ে গেছে। ঠিক করতে হবে। তা কাকিমা বললেন আমায় করে দিসখন পরে। সেদিনের চা টা বুঝলেন খুব প্রশংসা পেয়েছিল। কলিও খুব প্রশংসা করেছিল আমার। কাকিমাকে যত্নআত্তি করেছিলাম বলে। আমি তো ভীষণ খুশি জানেন ডাক্তারবাবু। আমার কলি আমার প্রশংসা করেছে, আমি যে কি খুশি।" কেষ্টদাকে তখনই থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "আমার কলি? মানে, কেষ্টদা?" কেষ্টদা চুপ, আমি চুপ, তাকিয়ে আছি কেষ্টদার দিকে। "কুকুরের কামড়ের ইঞ্জেকশন নিয়ে যেদিন প্রথম কলিদের বাড়ি গেছিলাম সেদিন কলি আমায় খাবার বেড়ে দিয়েছিল, আমার সাথে সারা দুপুর গল্প করেছিল। তার পর থেকে শুরু হয় আমাদের বন্ধুত্ব। কলিদের স্কুলে হাতের কাজের ক্লাস হতো। যেটা ভালো হত আমায় দিয়ে যেতো। টগর ফুল ভালো লাগত বলে আমি ওর জন্য টগর ফুলের গাছ বসাতাম। এই কোয়ার্টারের যত টগর গাছ আমার বসানো। কলির বাবা মারা যাওয়ার পর আমিই ওকে কত সান্ত্বনা দিয়েছি। সারা দিন কাজের শেষে রাত্রে গল্প করে যেতাম। ওর মেয়েলি খেলার সঙ্গী ছিলাম আমি।


এই খেলা বন্ধুত্বের গন্ডী পেরিয়ে ভালোলাগায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু আমি কোনোদিন আমার এই ভালোলাগা কলিকে বলিনি। আমি জানি এর কোনো পরিণতি নেই তাই আমি আমার অনুভূতিকে কখনো বন্ধুত্বের মধ্যে ঢোকাইনি। কলি শুধু আমার মনেই কলি, আমার অনুভূতিতে কলি, বাইরের জগতের সামনে এমনকি তার সামনেও আমি তাকে তার বাড়ির নাম মামণি বলেই ডাকি। এটাও আর একটা আপনজনের গল্প বুঝলেন ডাক্তারবাবু।

             "স্যার সিনেমা শেষ, কি করব?" মিঠুনের ফোনের জবাবে আমি বললাম, "ওই মলেই ঘোরাঘুরি কর, আমি যাচ্ছি একটু পর" ফিরে এলাম কেষ্টদার কাছে। কেষ্টদা বললেন "আপনি বেরোবেন? চলুন তাহলে?" "গল্পটা অসমাপ্ত থেকে গেলোনা কেষ্টদা? দুই বন্ধুর মাঝে আজ অভিমান ঢুকে গেলো কি করে? আজ কৃষ্ণকলি ম্যাডামের একটা কথায় আপনি দরজার বাইরে চলে গেলেন। এত বছরের সম্পর্ক একটা ঠুনকো কথায় অভিমান জমিয়ে ফেলল? আপনি যখন জানতেন যে এই ভালোলাগা বা ভালোবাসা যাই বলেন তার কোনো পরিণতি নেই সেখানে আপনাদের মাঝে অভিমান চলে এল কিকরে?" আমার প্রশ্নে কিছুটা পিছিয়ে এসে কেষ্টদা বললেন, "আপনি চলুন, স্কুটার নেবেন তো? যেতে যেতে সব বলছি।" কেষ্টদার সাথে ফিরতে লাগলাম সেই একই পথ ধরে খুবই মন্থর গতিতে। "আচ্ছা ডাক্তারবাবু, ধরুন আপনি একজনকে দেখে বললেন তোমার পায়ে ঘা হয়েছে, চিকিৎসা করিও। সেও আপনাকে হ্যাঁ করাবো বলে আশ্বাসবাণী দেয়। এরপর সেও আর আপনাকে কিছু বলে না আর আপনিও কাজের চাপে ভুলে গেলেন। একদিন জানতে পারলেন ওই ঘা ক্যান্সার হয়ে তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, আপনার কেমন লাগবে?" চলতে চলতে থেমে গেলাম আমি সটান কেষ্টদার দিকে তাকিয়ে। কেষ্টদাও আমার দিকে তাকিয়ে, তার চোখের কোলে আলতো জলের রেখা অন্ধকারেও সুস্পষ্ট। তার হাতের কাছে কোয়ার্টারের লোহার গেট, সেটা ধরে বললেন, "আমি যেদিন বার্নারের নবটা খারাপ পেয়েছিলাম সেদিনই যদি পাল্টে দিতাম তাহলে হয়তো আজ পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারতো, কাকিমাকে হারাতাম না। কাকিমা পুরো সংসারটাকে বেঁধে রেখেছিলেন। আমার দোষে আমি আমার কাকিমাকে হারিয়েছি। আমার দোষে একটা সংসার ভেসে গেছে, আমার দোষে কলি আজ মানসিক রোগের ওষুধ খায়। একশ শতাংশ বার্ণ ছিলো কাকিমার। হাসপাতালে পৌঁছানো মাত্র কাকিমা মারা যান। ডাক্তারেরা কিছু করার সুযোগ পায়নি। কাকিমার চলে যাওয়াতে কাকু খুব ভেঙ্গে পরেন। কলিকে বড় বড় সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হয়। এখনো কলি সেই ওষুধ খায়। কাকু চাকরি থাকতে থাকতেই মারা যান। এমনিতেই একটা এক্সিডেন্টের পর কাকু একটু থড়বড়ে হয়ে গেছিলেন। সেই থেকে কলিকে আমি দেখভাল করে চলেছি। পয়সার কোনো অভাব নেই ওর কিন্তু সেটা ছাড়া ওর সব কিছুরই অভাব। কলির বিয়ের সম্বন্ধ আমি কত করেছি কিন্তু সবই ও নাকচ করেছে। ওদের বাড়ির জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সবই আমি করি হাসিমুখে। কোনো কিছুর কোনো অভাব রাখিনি কিন্তু এসবের মাঝে আমাদের বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে গেছে জানেন তো। কলি আমায় মনে মনে নিশ্চয়ই অপরাধী মনে করে। আসলে কলি কেন আমি সত্যিই আমার কাছে অপরাধী। বহুবছর আয়নায় মুখ দেখলে ঘেন্না করতো। দোকান বন্ধ রেখে দিনের পর দিন মাছের বাজারে মাছ কাটতে যেতাম। গ্যাসের কাজ করতে পারতাম না। কিন্তু মাছের বাজারে মন টিকল না। আর পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ এই জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতেও পারতাম না। আমি ছাড়া এদের দেখভাল করার কেউ ছিলো না,,," একনিঃশ্বাসে বলে গেলেন কেষ্টদা।

      একটা মানুষের বিবেকের দংশন যে কি মারাত্মক সেটা সেদিন বুঝতে পারলাম। হাটতে হাটতে এগিয়ে গেলাম স্কুটারের দিকে। কেষ্টদা আমার পিছনে আসতে লাগলেন, "আজকালকার যুগেও গান্ধর্ব মতে বিয়ে হয় ডাক্তারবাবু। যেমন আমি কলিকে করেছি। কিন্তু বিয়ের মালাটা আমিই গেঁথেছি আর আমিই ছিঁড়েছি। কলির কাছে আমি একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যক্তি যে কারোর ভালো করতে জানেনা, যে কারোর কিছু হয়ে ওঠার যোগ্যতা রাখে না। কিন্তু এটা আমার অভিযোগ নয়, এটা আমার শাস্তি আমি মাথা পেতে নিয়েছি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের মতো। রাস্তার ধূলো রাস্তাতেই ভালো। মাছের কাজ ছেড়ে ফিরে এলাম আমার নিজের কাজে, গ্যাসের কাজে। কিন্তু আমি আর ওই বাড়িতে খেতে যেতে পারতাম না। কাকিমার মুখটা, কাকিমার কথাগুলো আমি ভুলতে পারিনি জানেন ডাক্তারবাবু। তারপর থেকে আমি আমার দোকানেই খাওয়া শোয়ার জায়গা করেছি। এই দোকানটাই আমার কাছে মন্দির মসজিদ চার্চ সব। সারাজীবন অবিবাহিত থেকে গেলাম একটা মেয়েকে ভালোবেসে। কলিও জানিনা কেন আর কোনোদিন বিয়ে করলো না। এই জীবনে অনেক কিছু পেলাম ডাক্তারবাবু। এই যে আপনি ধৈর্য্য ধরে এতক্ষন আমার গল্পটা শুনলেন, এটা কি আমার কম পাওনা বলুন। এই শরীরটা চিতায় পুড়ে যাবে একদিন কিন্তু গল্পটা রয়ে যাবে আপনাদের মাঝে। এই সেরেছে, দেখেছেন আপনার সাথে কথা বলতে বলতে আপনার দেওয়া ওষুধগুলো আনা হয়নি কলির জন্য। যাই আমি ডাক্তারবাবু, মেয়েটা জ্বরে কষ্ট পাচ্ছে।" কেষ্টদা হনহন করে হেটে এগিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার পর আমি স্কুটারটার চাবি ঢুকিয়ে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে এলাম। এই গল্পটার শেষ যে কি তা আমার জানা নেই, তবে এরকম ভালোবাসা সবার প্রাপ্য হয়না। এরকম আপনজন ভাগ্য করে মানুষ পায়। সুখে থাক কেষ্ট আর কলির মতো মানুষেরা, পূর্ণতা পাক তাদের ভালোবাসা, এর চেয়ে বেশি আর কিছু চাওয়ার নেই আমার। দূরে একটা পানের গুমটি থেকে রেডিওর গান টা ভেষে আসছে, সেটা শুনে থেমে গেলাম আমি,

"যে জন প্রেমের ভাব জানেনা

তার সঙ্গে নাই লেনা দেনা,

খাঁটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয়

নকল সোনা,

সে যন সোনা চেনেনা।।"

...(সমাপ্ত)...

চিকিৎসকের রোজনামচা (১) : অমানিশার অমানুষ

No comments:

Post a Comment