

![]() |
তরুণ চক্রবর্তী সম্পাদক |

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও বাংলা
সাহিত্য: সহাবস্থান, সংঘাত ও
সম্ভাবনার সন্ধানে
একটি নতুন যুগের সূচনালগ্নে দাঁড়িয়ে বাংলা সাহিত্য এখন এক মৌলিক প্রশ্নের
মুখোমুখি। সাহিত্য কি মানুষের একান্ত অনুভবের ফল, নাকি প্রযুক্তির সহযোগে রচিত বোধের ভাষাও সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে? এই প্রশ্ন আরও জটিল হয়ে উঠেছে যখন আমাদের জীবনে কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তা (AI) নামক প্রযুক্তিটি
প্রবেশ করেছে এক শক্তিশালী সহচরের মতো। আর এই সংখ্যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ‘কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তা ও বাংলা সাহিত্য’ এই পরিবর্তনের আলোকে সাহিত্যের সম্ভাব্য পথরেখা
অনুসন্ধানেরই একটি প্রয়াস।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো। চর্যাপদ থেকে শুরু
করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুনীল-শক্তি, এমনকি সাম্প্রতিক প্রজন্মের লেখকরাও আমাদের সাহিত্যকে করে
তুলেছেন বহুধাবিচিত্র, বহুমাত্রিক ও
গভীরভাবে মানবিক। অথচ এই সাহিত্যজগতে আজ এক নতুন বাস্তবতা সাহিত্যিক হিসেবে
আত্মপ্রকাশ করছে এক যন্ত্র। যন্ত্র? না, তাকে পুরোপুরি যন্ত্র বলা চলে না। সে শিখতে পারে, বুঝতে পারে, নতুন করে সাজাতে পারে
শব্দের জাল সে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’।
বর্তমানে ChatGPT, Gemini,
Claude, Grok-এর মতো এআই মডেলগুলো গল্প লেখে, কবিতা বানায়, ছন্দ অনুসন্ধান করে,
এমনকি
শুদ্ধ বানান ও ব্যাকরণেও সাহায্য করে। এমনকি কেউ যদি বলে, “বৃষ্টিভেজা বিকেলের প্রেম নিয়ে একটি কবিতা লিখো” AI এক লহমায় লিখে ফেলতে পারে একাধিক স্তবক। বিষয়, উপমা, অলংকার সবই যেন
নিখুঁত! তাহলে কি কবির প্রয়োজন ফুরালো?
প্রশ্নটা গভীর। AI যে আজ ‘লেখক’ নয়, তাও নয়। সে এক ‘সহকারী লেখক’, কখনো ‘সম্পাদক’, কখনো বা ‘চিন্তার
কাঠামো’ গড়ে দেয়। কিন্তু সে কি অনুভব করে?
সে কি
প্রেমে পড়ে? সে কি বিকেলবেলার নরম আলোয়
হারিয়ে যায় শৈশবের স্মৃতিচারণায়? না, এখনও নয়।
এখানেই দাঁড়িয়ে বাংলা সাহিত্য তার মৌলিক প্রশ্ন করে: সাহিত্য কি কেবল ভাষার
নির্মাণ? যদি তাই হতো, তাহলে AI অনেকটাই জায়গা দখল
করে ফেলত। কিন্তু সাহিত্য তো কেবল ভাষা নয়;
এটি
ইতিহাস, সংস্কৃতি, অনুভূতি, শিকড়ের টান, প্রতিবাদের ভাষা,
নিঃসঙ্গতার
ছায়া, প্রেমের অন্বেষণ। AI এই অনুভবগুলোকে কেবল ভাষাগত অনুরূপতা দিয়ে রচনা করতে পারে, কিন্তু সে নিজে অনুভব করে না।
হ্যাঁ, লেখকের ভূমিকা আজ বদলাচ্ছে।
আগেকার দিনে লেখক শব্দ খুঁজে বেড়াতেন,
বানান
নিয়ে লড়তেন, পাণ্ডুলিপি টাইপ করাতে সময়
লাগত মাসের পর মাস। আজ AI লেখকের জন্য অনেক কাজ
সহজ করে দিয়েছে তথ্য সংগ্রহ, উপাদান বিশ্লেষণ, স্টাইল সাজানো সবই দ্রুত ও নির্ভুলভাবে সম্ভব হচ্ছে। তবে এর
পাশাপাশি একটা ভয়ও তৈরি হচ্ছে লেখকের চিন্তা কি ধীরে ধীরে প্রযুক্তির ছাঁচে পড়ে
যাচ্ছে?
তরুণ প্রজন্মের অনেকেই আজ সাহিত্য রচনায় AI-এর সাহায্য নিচ্ছেন, যা কখনো সৃজনশীল চর্চার উদ্দীপক, আবার কখনো শৈল্পিক অলসতার বাহক। এই জায়গায় আমাদের দায়িত্ব হলো, AI-কে সহচর হিসেবে দেখা, অধিপতি হিসেবে নয়।
বাংলা ভাষায় AI-এর চ্যালেঞ্জ
বাংলা একটি সমৃদ্ধ ভাষা হলেও AI মডেলগুলো এখনও বাংলায় শতভাগ দক্ষ হয়ে ওঠেনি। ভাষার ব্যাকরণ, প্রমিত ও কথ্য রূপের পার্থক্য, শব্দের বহুবিধ অর্থ, প্রান্তিক অঞ্চলের উপভাষা—এসব বোঝা এখনও AI-এর পক্ষে সহজ নয়। ফলে এখনই বাংলা সাহিত্য পুরোপুরি AI-নির্ভর হতে পারে না।
তবে এই জায়গাতেই রয়েছে বড় সম্ভাবনা। যদি আমরা চর্চার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় AI-এর ডাটাবেস সমৃদ্ধ করি, তবে একদিন হয়ত AI-ও বাংলার বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যকে আরও ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারবে।
·
আমরা যদি সঠিকভাবে পথ খুঁজি, তাহলে AI ও বাংলা সাহিত্য একে
অপরকে সমৃদ্ধ করতে পারে। AI হতে পারে—
·
বাংলা সাহিত্যের সংরক্ষণকর্তা
(ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরির মাধ্যমে)
·
তরুণদের সাহিত্যচর্চায় আগ্রহ
বাড়ানোর মাধ্যম
·
অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া
সাহিত্যিক কণ্ঠগুলোকে পুনরুজ্জীবনের হাতিয়ার
·
দৃষ্টিহীন বা শারীরিকভাবে
অক্ষম পাঠকদের জন্য ভাষ্য রূপান্তরকারী (text-to-speech)
· আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদক
তবে মনে রাখতে হবে, AI কোনোদিনই মানবিক
অভিজ্ঞতার বিকল্প নয়। সাহিত্য তার আত্মাকে হারাবে যদি কেবল মেশিন-নির্ভর হয়ে পড়ে।
আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রযুক্তিকে সাহিত্যের একটি উপকরণ বানানো, সেই প্রযুক্তির গোলাম হয়ে যাওয়া নয়।
এই সম্পাদকীয় সংখ্যার মাধ্যমে আমরা এক নতুন চিন্তার দুয়ার খুলতে চাই যেখানে
সাহিত্য আর প্রযুক্তি হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যাবে, সংঘাতে নয়, সহাবস্থানে। AI আমাদের সাহিত্যচর্চাকে সহজ করে দিতে পারে, কিন্তু হৃদয়ের গভীর থেকে লেখা কবিতা, অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক চরিত্র কিংবা ইতিহাসের আবর্তে জন্ম নেওয়া
আখ্যান এগুলো এখনও মানুষের একান্ত নির্মাণ।
এই যুগে লেখকের কলমে থাকবে প্রযুক্তির ছোঁয়া, আর প্রযুক্তির কোডে থাকবে মানুষের ছায়া। বাংলা সাহিত্যকে তাই এখন শিখতে হবে
প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কীভাবে আরও মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়, ভুলে না গিয়ে সাহিত্য আসলে কার জন্য, আর কাদের হৃদয় ছুঁয়েই তার বেঁচে থাকা।
